রোসেতো ভালফোর্তোরে, রোম থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে ইতালির ফগিয়া প্রদেশের একটি গ্রাম। মধ্যযুগীয় গ্রামগুলোর অনুকরণে একটি বিশাল বর্গাকার ক্ষেত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই জনপদটি। চারপাশে গায়ে গায়ে লাগোয়াভাবে সজ্জিত দোতলা বাড়ির মাঝ দিয়ে একটি সরু পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের গা বেয়ে। অন্য এক পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা যায় কুমারী মাতা মেরীর নামে একটি চার্চ।
রোসেতোবাসীর জীবন সহজ ছিলো না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোসেতোর অধিবাসীদের পেশা ছিল চুনাপাথরের খনিতে কাজ অথবা পাহাড়ের উপত্যকায় চাষাবাদ। সকাল ভোরে উঠে তারা পাহাড় বেয়ে প্রায় পাঁচ মাইল পাড়ি দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যেত। আবার এই বিশাল পথ ভেঙে রাতে ফিরে আসত পাহাড়ে। তাদের অধিকাংশই ছিল মূর্খ এবং হতদরিদ্র। অর্থনৈতিক উন্নতির কোনো স্বপ্ন দেখারও সাহস পেত না তারা।
এসময় এক নতুন জগতের হাতছানি আসে তাদের সামনে। তারা জানতে পারে সাগর পাড়ি দিয়ে অ্যামেরিকা গেলেই মিলবে সচ্ছল জীবনের স্বাদ। ১৮৮২ সালে সর্বপ্রথম ১১ জন রোসেতানদের একটি দল পাড়ি জমায় নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। তাদের ঠাই হয় পেনসেলভেনিয়া থেকে প্রায় ৯০ মাইল দূরবর্তী ব্যাঙ্গর নামক একটি শহরে। সেখানে একটি স্লেট খনিতে কাজ পায় তারা।
এর পরের বছর রোসেতো ছাড়ে ১৫ জনের একটি দল। তাদের মধ্যে কয়েকজন এসে আবার হাজির হয় ব্যাঙ্গরে, আগের সাথীদের সাথে যোগ দেয় স্লেট-খনিতে। তাদের কাছ থেকে এই নতুন জগতের আশার বাণী পৌঁছে যায় রোসেতোতে। রোসেতো খালি করে দলে দলে পেনসেলভেনিয়া পাড়ি জমাতে শুরু করে তারা। জানা যায় শুধুমাত্র ১৮৯৪ সালেই প্রায় বারশ’ রোসেতান নাগরিক অ্যামেরিকার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিল।
রোসেতানরা ব্যাঙ্গরের পাহাড়ি এলাকায় জমি কিনতে শুরু করে। সেই জমিতে গড়ে তোলে চারপাশে গায়ে গায়ে লাগোয়াভাবে সজ্জিত দোতলা বাড়ি, ঠিক যেমনটি ছিল রোসেতোতে। একটি চার্চ তৈরি করে এবং তার নাম দেয় কুমারী মাতা মেরীর নামে। ইতালির বিখ্যাত নেতা গ্যারিবাল্ডির নামে তারা তাদের প্রধান সড়কটির নাম রাখে ‘গ্যারিবাল্ডি অ্যাভিনিউ’। প্রথম দিকে তারা এ শহরটিকে ‘লিটল ইতালি’ বলে ডাকতো। কিন্তু খুব দ্রুতই নাম বদলে সবচেয়ে উপযুক্ত নামে পরিচিত হয় শহরটি-‘রোসেতো’।
১৮৯৬ সালে রোসেতোর চার্চের দায়িত্ব নেন ‘প্যাসকেল ডি নিস্কো’ নামের একজন তরুণ ধর্মযাজক। ডি নিস্কো রোসেতানদের মাঝে ধর্মীয় ভাবধারা প্রচার এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন করেন। রোসেতানদের তিনি নানান ফসলের বীজ সরবরাহ করে চাষাবাদে উৎসাহিত করেন।
ধীরে ধীরে শহরটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন সমিতি, সংগঠন গঠিত হয়; গড়ে উঠতে শুরু করে স্কুল, পার্ক, সম্মেলন হল। ছোট ছোট দোকান, বেকারি, রেস্টুরেন্টে জমে উঠে রোসেতো। তৈরি হয় কয়েকটি পোশাক কারখানাও।
রোসেতোর প্রতিবেশী ব্যাঙ্গর এবং অন্যান্য শহরে ইংরেজ, ওয়েলস এবং জার্মান থেকে আসা অভিবাসীদের বসবাস ছিল। এসব অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্মেলন ঘটলেও রোসেতো ছিল সম্পূর্ণরূপে ইতালির সেই রোসেতো অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্যই। রোসেতোর রাস্তায় হাঁটলে কেবল ইতালিয়ান ভাষাই শোনা যেত। শুধু ইতালিয়ান ভাষাই নয়, বরং রোসেতান আঞ্চলিক টানের ইতালিয়ান ভাষা। বলা যায় এটি ছিল তাদের নিজেদের ছোট্ট কিন্তু পরিপূর্ণ একটা পৃথিবী।
রোসেতো হয়তো গোচরের বাইরে একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হয়েই রয়ে যেত। যদি না স্টুয়ার্ট ওলফ এর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠতেন। স্টুয়ার্ট ওলফ ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমার শিক্ষক এবং একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক। ১৯৫০ সালের দিকে তিনি গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন পেনসেলভেনিয়ার একটি খামার বাড়িতে।
সেখানে একদিন এক স্থানীয় চিকিৎসকের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে এক বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারেন তিনি। স্থানীয় চিকিৎসক জানালেন তিনি এ অঞ্চলে চিকিৎসা করছেন প্রায় সতের বছর ধরে। কিন্তু এ সতের বছরে তিনি পার্শ্ববর্তী রোসেতো অঞ্চলের এমন কোন রোগীকে পাননি যার বয়স ৬৫ এর কম কিন্তু হৃদরোগে ভুগছে।
ওলফের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা হিসেবে এটি রীতিমতো চমকে উঠার মতো তথ্য। কেননা সেসময় হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কোলেস্টেরল হ্রাস করার ঔষধ তখনো আবিষ্কৃত হয়নি, সম্ভব হয়নি হৃদরোগের বিরুদ্ধে এত ব্যাপক পরিসরে পদক্ষেপ নেয়াও। ফলে ৬৫ এর কম বয়স্কদের ক্ষেত্রেও হৃদরোগ হয়ে উঠেছিলো মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি।
সেই সময়ে আপনি ডাক্তার হবেন, কিন্তু কোনো হৃদরোগের রোগী দেখবেন না, এটা স্রেফ অবিশ্বাস্য ঘটনাই বলা চলে। স্টুয়ার্ট ওলফ এ বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চাইলেন। ১৯৬১ সালে তিনি ওকলাহোমা থেকে তার কয়েকজন ছাত্র এবং সহকর্মীর সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে হাজির হলেন রোসেতোতে।
রোসেতোর মেয়র তাদের জন্য নিজের কাউন্সিল রুম ছেড়ে দেন এবং আশ্বাস দেন পূর্ণ সহযোগিতার। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে গবেষক দল ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা যত বছর আগে থেকে সম্ভব রোসেতোর অধিবাসীদের ডেথ সার্টিফিকেট যোগাড় করলেন। তাদের মেডিকেল হিস্টোরি, বংশানুক্রমিক ধারা পর্যবেক্ষণ করলেন।
এরপর রোসেতোর অধিবাসীদের আহবান জানালেন রক্ত ও ই.কে.জির মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ার পরীক্ষার জন্য। তাদের সুবিধার জন্য গ্রীষ্মের ছুটিতে একটি স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করতে দেয়া হয়েছিলো। সেখানে একমাস ধরে তারা রোসেতোর প্রায় সকল অধিবাসীদের পরীক্ষা করলেন।
ফলাফল দেখে ওলফের বিস্ময় আর ধরে না। রোসেতোতে ৫৫ এর কম বয়সী কেউ কখনো হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়নি, এমনকি কারো মধ্যে হৃদরোগের কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। আর ৬৫ এর বেশী বয়েসিদের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর হারও যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক হারের প্রায় অর্ধেক। আর অন্যান্য রোগের কারণে মৃত্যুর হারও প্রায় শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ কম।
ওলফ এবার এর কারণ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিলেন। ওকলাহোমা থেকে তার বন্ধু সমাজবিজ্ঞানী জন ব্রুনকে নিয়ে আসেন রোসেতোতে। এছাড়াও সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য আনা হয় সমাজবিজ্ঞান ও মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট ছাত্র ছাত্রীদের। তারা রোসেতোর প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে যান। কথা বলেন রোসেতোর প্রায় সকল প্রাপ্তবয়স্ক অধিবাসীর সাথে।
ব্রুন পরবর্তীতে বিস্ময়ের সাথে সেসময়গুলোর স্মৃতিচারণ করে বলেন “রোসেতোতে একদম হতদরিদ্র কাউকে খুঁজে পাইনি আমরা। সেখানে কোনো আত্মহত্যা বা মাদকাসক্তির প্রবণতা ছিল না, অপরাধমূলক কাজের সংখ্যাও ছিল নগণ্য। হৃদরোগ পরীক্ষার পর আমরা তাদের পেপটিক আলসার আছে কিনা যাচাই করেছিলাম। রোসেতো তা থেকেও মুক্ত ছিল। বলা যায় তারা স্রেফ বৃদ্ধ হলেই মারা যেত।”
ওলফ প্রথমে ভেবেছিলেন, রোসেতানদের এ সুস্বাস্থ্যের পেছনে হয়তো তাদের পুরনো দিন থেকে চলে আসা বিশেষ কোনো খাদ্যাভ্যাস এর প্রভাব রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে তিনি দেখতে পেলেন রোসেতানদের খাদ্যাভ্যাস তুলনামূলক ক্ষতিকরই বলা যায়। স্বাস্থ্যকর অলিভ ওয়েল এর বদলে তারা এক ধরনের চর্বি দিয়ে রান্না করত। বড়দিনের জন্য জমিয়ে রাখা মিষ্টি জাতীয় খাদ্যগুলো তারা সারা বছর ভরে খেত। বিশেষজ্ঞরা তাদের খাদ্যাভ্যাস বিশ্লেষণ করে দেখলেন তাদের ক্যালরির শতকরা ৪১ ভাগই আসে চর্বি জাতীয় খাদ্য থেকে।
এছাড়াও বেশীরভাগ রোসেতানই অতিরিক্ত মাত্রায় ধূমপান করত। আর তাদের অনেকেই ভুগছিল স্থূলতার সমস্যায়। আর এমনও না যে, তারা ভোরে উঠে যোগ ব্যায়াম করতো বা নিয়ম করে কয়েক মাইল দৌঁড়াত। ওলফ এবার ভাবলেন, যদি এই খাদ্যাভ্যাস বা ব্যায়াম এ রহস্যের উত্তর না হয়, তবে কি রোসেতানরা বংশগত কারণেই স্বাস্থ্যবান? রোসেতানরা ইতালির একই অঞ্চল থেকে আসা এবং মোটামুটি আত্মীয় সম্পর্কিত ছিলেন।
ওলফ তাই ভাবলেন হয়তো তাদের জিনেই লুকিয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তর। তারা হয়তো কোনো শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক ধারণ করে চলছে। এটি যাচাই করার জন্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী, ইতালির রোসেতো থেকে আসা ব্যক্তিদের খোঁজ নিলেন। তিনি দেখতে চাইলেন তারাও কি এমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী? কিন্তু ফলাফল নেতিবাচক।
ওলফ এবার রোসেতো অঞ্চলটার দিকে মনোযোগী হলেন। তবে কি পূর্ব পেনসেলভেনিয়ার পাহাড়ের পাদদেশের এ অঞ্চলে বসবাসের মধ্যে রহস্য লুকিয়ে আছে? এটিই কি তাদের সুস্বাস্থ্যবান করে তুলেছে? রোসেতোর পাশেই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অন্য একটি শহর ব্যাঙ্গর, আর তার কয়েক মাইল দূরে নাজারিথ।
এ দুটি শহরেই প্রায় রোসেতোর সমান জনবসতি এবং রোসেতোর মতোই ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসীদের বাস ছিল সেখানে। ওলফ এ দুই শহরের মেডিকেল রেকর্ড যোগাড় করলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন নাজারিথ এবং ব্যাঙ্গরে ৬৫ এর ঊর্ধ্বে হৃদরোগে মৃত্যুর হার রোসেতোর থেকে প্রায় তিন গুন বেশী। আবার অন্ধকারে পড়লেন তারা।
খুব শীঘ্রই ওলফ এবং তার দল বুঝতে পারলেন, রোসেতোর রহস্যের উত্তর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম বা জিন কিংবা স্থানের মধ্যে নেই। এ রহস্যের উত্তর রোসেতো নিজেই। এখানে গড়ে উঠা তাদের এ সমাজটি। ওলফ এবং ব্রুন যখন রোসেতোর রাস্তায় হাঁটতে বেরোতেন, তারা দেখতেন রোসেতানরা একে অপরের খোঁজ খবর নিতে যাচ্ছে, দেখা করতে যাচ্ছে। রাস্তায় থেমে দাঁড়িয়ে তাদের আঞ্চলিক টানের ইতালিয়ান ভাষায় গল্প জুড়ে দিচ্ছে বা অন্যের জন্য রান্না চড়াচ্ছে নিজের আঙ্গিনায়।
ওলফ এবং ব্রুন উপলব্ধি করলেন যে বর্ধিত পরিবারের দৃঢ় বন্ধন কীভাবে রোসেতোর সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলছে। তারা লক্ষ্য করলেন রোসেতোর অধিকাংশ বাড়ীতেই তিন প্রজন্ম একই ছাদের নিচে বসবাস করছে এবং পরিবারের মুরুব্বিরা কতটা শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছেন। তারা মাতা মেরীর চার্চের জনসমাগমে গিয়ে উপলব্ধি করেছেন রোসেতানদের উপর চার্চের কি নিবিড় প্রভাব।
মাত্র দুই হাজার অধিবাসীর রোসেতোতে সামাজিক সংগঠন ছিল প্রায় বাইশটি। ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে আর্থিক সমতা আনয়নের ব্যবস্থা ছিল সেখানে। তাদের সামাজিক মূল্যবোধ সফলদের তাদের সাফল্য নিয়ে অহংকারী হতে দিতো না, বরং তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত ব্যর্থদের দিকে।
রোসেতানরা তাদের প্রাচীন ইতালিয়ান সংস্কৃতি বেশ ভালোভাবেই ধারণ করে রেখেছিল আধুনিক পেনসেলভেনিয়াতেও। এটি তাদেরকে একটি শক্তিশালী সংরক্ষণশীল সামাজিক কাঠামো গড়তে সাহায্য করেছে, যা তাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল আধুনিক যুগের তুমুল গতি আর অস্বাভাবিক চাপের হাত থেকে। রোসেতানদের সুস্বাস্থ্যের রহস্য ছিল এ ছোট্ট জগতটি যা তারা নিজেদের জন্য তৈরি করে নিয়েছিল।
আজ মেডিকেল সায়েন্সে রোসেতো ইফেক্ট একটি স্বীকৃত বিষয়। মেডিকেল সায়েন্স আজ বিশ্বাস করে দৃঢ় সামাজিক বন্ধন হৃদরোগের সম্ভাবনা কমায়, আমাদের ভালো রাখে। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে চলছি। হায় আধুনিকতা! আজ আমাদের বর্ধিত পরিবার ক্ষুদ্র হতে হতে অণু পরিবারে এসে পৌঁছেছে। বন্ধন তো দূরের কথা আজ আমরা এতই ব্যস্ত যে জানিইনা আমার পাশের ফ্ল্যাটে কে বা কারা থাকে।