যুদ্ধ মানেই স্নায়বিক উত্তেজনার আগুনে পেট্রোল ঢেলে দেওয়া। এখানে প্রতি মুহূর্তেই চরম সতর্ক থাকতে হয়। এই বুঝি অতর্কিতে হামলা শুরু হলো বলে! জেনারেলরা নতুন ছক কষতে থাকেন প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার অভিপ্রায়ে। সৈনিকদের অলস বসে থাকার জো নেই, উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। আর সেটা যদি হয় বিশ্বযুদ্ধে তাহলে তো কথাই নেই! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এরকমই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
বলা হয়, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক সৈনিক তার দেশ ও মানুষকে রক্ষায় সর্বদা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকে। ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারে না, এমনকি মৃত্যুর সাথে লড়াই করতেও সে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও সে পিছপা হয় না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ান সৈনিকদের মধ্যেও এমনি সাহসী মনোভাব ও দেশপ্রেম দেখা যায়। শত কষ্ট এবং মৃত্যুকে উপেক্ষা করে রাশিয়ান সৈন্যরা জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ে গিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ৬ আগস্ট ১৯১৫ সালে, পোল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অসোভিয়েক দুর্গে জার্মান ও রাশিয়ান সৈন্যদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যেখানে জার্মানদের দ্বারা গ্যাস হামলার শিকার হয়েও কিছু রাশিয়ান সৈন্য মৃতপ্রায় অবস্থায় সাহসের সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের দেখে তখন মনে হচ্ছিল যে, লাশেরা আক্রমণ করছে। চোখে-মুখে ছিলো ক্রোধ ও প্রতিশোধের আগুন। তাদের সেই বীভৎস চেহারা দেখে অনেকটাই জম্বিদের মতো লাগছিলো, যার ফলে জার্মান সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে সেখান থেকে কোনো রকমে পালিয়ে যায়। রাশিয়ান সেনাদের এই সাহসী প্রতিরোধ আক্রমণই ইতিহাসে ‘অ্যাটাক অব দ্য ডেড মেন’ নামে পরিচিত।
জার্মান সেনাবাহিনী প্রায় বেশ কয়েকবার রাশিয়ানদের দখলকৃত অসোভিয়েক দুর্গ আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দুর্গের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ রাশিয়ান সেনা এবং উন্নত অস্ত্র ও কামানের কাছে তারা প্রতিবারই প্রতিহত হয়। কিন্তু জার্মান সেনাবাহিনীও থেমে থাকেনি। তারা একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় জার্মানরা আরেকটি আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকে। এই সময়ে তারা একটু ভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের কথা চিন্তা করে। তারা ক্লোরিন গ্যাসকে শত্রুর বিপক্ষে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। জার্মান জেনারেল পল ভন হিন্ডেনবার্গ ভালোভাবেই জানতেন, রুশদের কাছে পর্যাপ্ত উন্নত গ্যাস মাস্ক নেই, আর যেগুলো আছে সেটা দিয়ে ক্লোরিনের ভয়াবহতা আটকানো যাবে না, ফলে খুব সহজেই তারা দুর্গ দখলে আনতে পারবেন।
ক্লোরিন গ্যাস মানবদেহের জন্যে খুবই মারাত্মক। এটি মূলত চোখ, খাদ্যনালী, এবং ফুসফুসের মতো নরম টিস্যুগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর্দ্র ত্বকের সাথে মিশে গিয়ে এটি এসিডে পরিণত হয়ে কোষগুলোকে ক্ষয় করতে থাকে এবং ভেতর থেকে মাংসগুলো গলে খসে পড়তে থাকে।
বেশ কয়েকদিন অনুকূল আবহাওয়া ও বাতাসের গতির জন্যে অপেক্ষার পর ৬ আগস্ট ১৯১৫ সালে জার্মান বাহিনী অসোভিয়েক দুর্গে ক্লোরিন গ্যাস নিক্ষেপ করে। ধীরে ধীরে সেখান থেকে একটি সবুজাভ হলুদ মেঘের উৎপত্তি হয়, যেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গেল। গাছের পাতা হলুদ এবং সবুজ ঘাসগুলো কালো রঙে পরিবর্তিত হয়ে গেল। দুর্গের বাইরে যারা ছিল তারা অল্প সময়ের ভেতরেই মরতে শুরু করল, যেহেতু কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না থাকার কারণে গ্যাস তাদের শ্বসনতন্ত্রে ঢুকে ফুসফুস বিকল করে দিচ্ছিল। দ্রুতগতিতে দুর্গের ভেতরে গ্যাসের বিস্তার ঘটতে থাকে এবং মূহুর্তের মধ্যে পুরো দুর্গের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়।
গ্যাস আক্রমণ প্রতিরোধের জন্যে দুর্গটি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার অভাব ছিল। সৈন্যরা নিজেদের আত্মরক্ষার কোনো উপায়ই খুজে বের করতে পারছিল না, এমনকি তাদের যে গ্যাস মাস্ক ছিলো সেগুলোও কোনো কাজের ছিল না। ফলে সৈন্যরা মরতে শুরু করে এবং পুরো পরিস্থিতি একটি বীভৎস রূপ নেয়। ২২৬ তম পদাতিক সৈন্যবাহিনী বিভাগের ৩টি সেনাদল অপনোদিত হয় এবং ৪র্থ দল থেকে মাত্র ১০০ জনের মতো বেঁচে ছিল। কিন্তু তারা সকলেই ছিলো মৃতপ্রায়।
জার্মানরা নিশ্চিত ছিল যে, ক্লোরিন গ্যাসের ভয়াবহতার পর রাশিয়ান সৈন্যদের আর কেউই বেঁচে থাকতে পারবে না, প্রতিরোধ তো দূরের কথা। তাই তারা সুরক্ষিত গ্যাস মাস্ক পরে দুর্গের ভেতরে আক্রমণের জন্য এগোতে থাকে, যেটা পরবর্তীতে তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রাশিয়ানদের দ্বারা তৈরিকৃত প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেদ করে যখন শত্রুরা দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করছিল, তখন তারা সামনে এক ভয়াবহ চিত্রের সম্মুখীন হয়। তারা যতই ক্লোরিন গ্যাসের স্তর ভেদ করে ভেতরে যাচ্ছিল, সৈন্যদের মরদেহ পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। তারা যেন এক মৃত্যুপুরীতে পৌঁছে গেছে, কিন্তু একপর্যায়ে তাদের মনে হলো মৃত সৈন্যরা জীবিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে এবং তাদের আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে।
রাশিয়ান সৈন্যরা এত সহজে আত্মসমর্পণ করেনি! তাদের খুবই ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। সকলের মুখ রক্তমাখা ছেড়া কাপড়ে জড়ানো ছিলো, ফলে দেখতে অনেকটা মমির মতো লাগছিলো। অনেকে আবার রক্তবমি করছে এবং ত্বকের বিভিন্ন অংশ গলে খসে পড়ছে। সেই দৃশ্য ছিলো ভীষণ ভয়ংকর! কিছু সময়ের জন্য জার্মানরা ভেবেছিলো তাদের সামনে জম্বিরা দাঁড়িয়ে আছে। তারা পুরোই হতভম্ব হয়ে যায়। এ যেন রূপকথার ফিনিক্স পাখির গল্প!
সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ভ্লাদিমির কোটলিন্সকির নেতৃত্বে বেঁচে থাকা রাশিয়ান সৈন্যরা প্রতিরোধের জন্যে এগিয়ে আসে। যদিও তারা সংখ্যায় ছিল কম, কিন্তু তাদের মনোবল ছিলো অটুট, প্রচন্ড ক্রোধের সাথে তারা শত্রুকে পর্যুদস্ত করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে এবং জার্মানদের প্রায় সাত হাজার সৈন্যের উপর আক্রমণের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু জার্মান সৈন্য ‘ডেড ম্যান’দের উপর গুলি চালায়, কিন্তু রাশিয়ানরা এতটাই ক্ষোভ, সাহস ও উন্মত্ততার সাথে আক্রমণ করতে থাকে যে কিছুই তাদের দমাতে পারেনি। সেই ভয়াবহ রক্তাক্ত দৃশ্য, অর্দম্য পাল্টা আক্রমণ এবং রাশিয়ান সৈন্যদের লড়াইয়ের মনোবল দেখে জার্মানরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
জার্মান সৈন্যদল দ্রুতগতিতে দুর্গ থেকে পালাতে শুরু করে। তারা এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত ছিল যে তাদের রাইফেল এবং মেশিনগান সেখানেই ফেলে রেখে যায়। অনেকে আবার আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে পালানোর সময় নিজেদের দেয়া কাঁটাতারের বেড়ায় নিজেরাই আটকা পড়ে। আতঙ্কিত জার্মানরা কোনোমতে তাদের প্রাণ নিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে।
পরে সেদিন সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট কোটলিন্সকি এবং আরো অনেকে মারা যান, কিন্তু তাদের সেই সাহসী প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। অসোভিয়েক দুর্গ আরো বেশ কয়েকদিন রাশিয়ানদের দখলে ছিল, যেখানে রাশিয়ান সেনাদের লুকিয়ে রেখে রক্ষা করা হত এবং পরবর্তীতে শক্তিসঞ্চয় করে জার্মানদের উপর আঘাত হানা হত। তাছাড়াও এই ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৯২৫ সাল থেকে রাসায়নিক যুদ্ধকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
পরবর্তীতে এই ঘটনাকে স্মরণ করেই সুইডিশ মেটাল ব্যান্ড সাবাতোন এর ২০১৯ সালের ‘দ্য গ্রেট ওয়ার’ অ্যালবামে ‘অ্যাটাক অব দ্য ডেড ম্যান’ শিরোনামে একটি গান মুক্তি পায় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।