ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান হলেও এর সমাধানে আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। বরং দিনে দিনে বেড়েছে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত ভূমির পরিমাণ, বেড়েছে ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন, হয়েছেন বাস্তুহারা এবং তাদের কান্নায় ভারী হয়েছে জেরুজালেমের আকাশ। তবে এই সংঘাত সমাধানের চেষ্টা যে করা হয়নি তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘ, আরব রাষ্ট্রসমূহ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতের সমাধানের চেষ্টা করলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। সেই প্রচেষ্টার সর্বশেষ সংযোজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রণীত তথাকথিত Deal of the century.
১৮১ পৃষ্ঠার এই মার্কিন প্রস্তাবনায় ফিলিস্তিনি দাবিগুলোকে অগ্রাহ্য করে, একতরফাভাবে ইসরায়েলি স্বার্থ নিশ্চিত করা হয়েছে বিধায় বিশ্লেষকগণ এটিকে অবাস্তব এবং অন্তঃসারশূন্য বলে উল্লেখ করেন। তবে আজ পর্যন্ত এই সংঘাতের সমাধান কল্পে যতগুলো প্রস্তাবনা এসেছে তন্মধ্যে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবসম্মত ছিল আরব পিস ইনিশিয়েটিভ তথা আরব শান্তি উদ্যোগ।
শুরুর কথা
১৯৮১ সালে সৌদি আরবের তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স ফাহাদ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে একটি প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত আরব ভূমি থেকে পুরোপুরি চলে যাবে, বিনিময়ে আরব রাষ্ট্রসমূহ ইসরায়েলকে ‘রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি’ দেবে। এটি ছিল আরব শিবির থেকে উত্থাপিত সর্বপ্রথম কোনো প্রস্তাবনা। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক-ইরান যুদ্ধের (১৯৮০-৮৮) ডামাডোলে সেই প্রস্তাবনা হারিয়ে যায়।
সেই ঘটনার দুই দশক পর, ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক থমাস ফ্রিডম্যানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ (যিনি পরবর্তীতে সৌদি বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত হন) প্রায় অনুরূপ একটি প্রস্তাবনা প্রকাশ করেন। ক্রাউন প্রিন্স আব্দুল্লাহের সেই প্রস্তাব ২০০২ সালের ২৭-২৮ মার্চে লেবাননের বৈরুতে অনুষ্ঠিত আরব লীগের সম্মেলনে সামান্য পরিবর্তনসহ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে প্রস্তাব করা হয়। এটিই ইতিহাসে সৌদি পিস ইনিশিয়েটিভ বা আরব পিস ইনিশিয়েটিভ (Arab Peace Initiative- API) নামে পরিচিত।
কী ছিল এতে?
১. ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে দখলকৃত পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান মালভূমি এবং দক্ষিণ লেবানন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করবে।
২. ৪ জুন ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান সীমানাকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করে গাজা এবং পশ্চিম তীরকে নিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম।
৩. জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রেজোলিউশন ১৯৪ অনুসারে ফিলিস্তিনি শরণার্থী সমস্যার সমাধান করা হবে।
রেজোলিউশন ১৯৪ ফিলিস্তিনি শরণার্থীদেরকে নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার দেয়। ইসরায়েল উপরোক্ত এই শর্তসমূহ মেনে নেওয়ার বিনিময়ে আরব রাষ্ট্রসমূহ ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করবে, আরব লীগের সকল সদস্য-দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করবে, আরব-ইসরায়েল সংঘাত সমাপ্ত হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এই অঞ্চলের সকল রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। ১৯৮১ সালের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ‘রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি’ দানের পরিবর্তে এবারের প্রস্তাবনায় ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন’ (Normal Relations) টার্ম ব্যবহার করা হয়।
এই শান্তি উদ্যোগের মূল প্রস্তাবটি করা হয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ২৪২ এবং ৩৩৮ এর ভিত্তিতে যেখানে আরব ভূমি থেকে ইসরায়েল নিজেকে প্রত্যাহারের বিনিময়ে ‘প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর’ সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সমর্থন
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়া পরিকল্পনাটির প্রতি মৌখিক সমর্থন ব্যক্ত করে। এছাড়া জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রতিষ্ঠান থেকেও এটিকে সমর্থন করা হয়। জাতিসংঘ তৎকালীন মহাসচিব বান কি-মুন বলেছিলেন, “শান্তি প্রক্রিয়ায় আরব পিস ইনিশিয়েটিভ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ… এটি এই বার্তা দেয় যে, আরবরা শান্তি অর্জনের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” ২০০৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বারাক ওবামা বলেছিলেন, “মুসলিম বিশ্বের সাথে শান্তি এনে দেবে এমন একটি চুক্তিকে অস্বীকার করা ইসরায়েলিদের জন্য পাগলামি হবে।”
২০০৬ সালে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত ওআইসির (Organisation of Isamic Cooperation-OIC) ৩৩তম সম্মেলনেও এই শান্তি উদ্যোগকে সমর্থন করা হয়েছিল।
বিস্মৃতি এবং পুনরুত্থান
প্রস্তাবনা উত্থাপনের পর এই অঞ্চলে সংগঠিত বেশ কিছু ঘটনাবলির কারণে রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়বস্তু হতে এটি হারিয়ে যেতে শুরু করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি চিহ্নিত করা যায় তা হল প্রস্তাবনা উত্থাপনের সময়কাল। এই শান্তি পরিকল্পনা এমন সময়ে প্রণয়ন করা হয়েছিল যখন ফিলিস্তিন জুড়ে পূর্ণোদ্যমে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জাগরণ) চলছিল।
উপরন্তু, লেবাননের বৈরুতে যেদিন এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব করা হয় তার আগের দিন ইসরায়েলের নেটনিয়া শহরের পার্ক হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে যার দায় স্বীকার করে হামাস। দিনটি ছিল ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী একটি পবিত্র দিন যেটি ইহুদিরা পাসওভার নামে পালন করে। এই উৎসবে ইহুদিরা বিশেষ খাবার-দাবারের আয়োজন করে থাকে।
সেদিন পার্ক হোটেলে পাসওভার উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবেই বোমা হামলাটি সংগঠিত হয়েছিল। এতে ২৮ জন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ১৫০ জন আহত হয়। এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে Operation Defensive Shield নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে, যে অভিযানে প্রায় ৫০০ ফিলিস্তিনি নাগরিক এবং ৩০ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়। ইসরায়েলি সরকার এই ইন্তিফাদা ঠেকাতে এবং হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দমন করতে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করার ফলে প্রস্তাবনা থেকে মনোযোগ সরে যায়।
উপরন্তু, ২০০৩ সালে বুশ প্রশাসন একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে, যে পরিকল্পনায় পরবর্তীতে রাশিয়া, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্ত হয়। তখন Middle East Quartet নামে পরিচিতি পাওয়া এই চার পক্ষ যৌথভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের চেষ্টা করে যা শান্তির জন্য রোডম্যাপ নামে পরিচিত। কিন্তু সে পরিকল্পনাটিও শুরুতেই ব্যর্থ হয় যায়। রোডম্যাপ পরিকল্পনা প্রবর্তনের ফলে রাজনৈতিক আলাপের বিষয়বস্তু থেকে আরব পিস ইনিশিয়েটিভ ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
পরবর্তীতে ২০০৪ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু, ২০০৫ সালে গাজা হতে ইহুদি বসতি উচ্ছেদ এবং ২০০৬ সালে ইসরায়েলের নির্বাচন এপিআই এর বিস্মৃতিতে ভূমিকা পালন করেছিল। তবে ২০০৬ সালে সংগঠিত হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তনকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন আসে। উপসাগরীয় অঞ্চল এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে ইসরায়েল মিশর, জর্ডান এবং সৌদি আরবের মতো মডারেট আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, যার অংশ হিসেবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ২০০৬ এর নভেম্বরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে একটি “উন্মুক্ত, বাস্তব, প্রকৃত এবং আন্তরিক সংলাপের” আয়োজন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “যে ঘটনাগুলো আগে ঘটেনি সেগুলো এখন ঘটছে এবং পরিণত হচ্ছে। এই সুযোগকে আমাদের বিজ্ঞতা এবং দায়িত্বের সাথে কাজে লাগানো প্রয়োজন।”
পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত ১৯তম আরব লীগের সম্মেলনে শান্তি উদ্যোগটি পুনঃপ্রস্তাব করা হলে এটি পুনরায় রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। আরব লীগের প্রতিনিধি হিসেবে শান্তি উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে রিয়াদ সম্মেলনে আরব লীগের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির অন্যতম দুই সদস্য, মিশর এবং জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় তারই অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই ইসরায়েল সফর করেন। তারা প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট এবং প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কিন্তু ২০০৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগের ফলে ওলমার্ট পদত্যাগ করলে সকল প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটে।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর ডানপন্থী লিকুদ পার্টির নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে সম্ভাবনার সকল দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ২০০৮ সালে মার্কিন ক্ষমতায় বারাক ওবামা অধিষ্ঠিত হলেও শান্তি উদ্যোগটির প্রতি তার পূর্বের আগ্রহ আর দেখা যায়নি।
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল এবং আরব উভয় শিবিরেই পরিকল্পনার পক্ষে বিপক্ষে দলাদলি ছিল। ইসরায়েল এই পরিকল্পনার প্রতি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। অনানুষ্ঠানিক কিছু প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেও সেগুলো ছিল দ্বিধাবিভক্ত। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন উদ্যোগটিকে আরব বিশ্বের একটি ‘ইতিবাচক পরিবর্তন’ বললেও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এবং ৬৭ সালের পূর্বের সীমানায় ফিরে যাওয়ার শর্তসমূহকে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে একে প্রত্যাখ্যান করেন। আরেকটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াতেও “এতে নতুন কিছু নেই” উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
তবে ইসরায়েলের বাম দলগুলো এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। বিরোধীদলীয় নেতা ইয়োসি সারিদ এই প্রস্তাবনার উপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকার আহ্বান জানান। কিন্তু লিকুদ পার্টিসহ অন্যান্য ডানপন্থী দলগুলি পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে।
২০০৭ সালে পুনঃপ্রস্তাবের পর ওলমার্ট সতর্কভাবে এটিকে স্বাগত জানান। ২০০৮ সালে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ পরিকল্পনাটিকে আরব নীতিতে ‘বিশাল পরিবর্তন’ উল্লেখ করে এর প্রশংসা করেছিলেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক বলেছিলেন যে, “এটি আলোচনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে”। কিন্তু ২০০৯ এ ক্ষমতায় আসা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ছিলেন এই শান্তি উদ্যোগের চূড়ান্ত বিরোধী। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এভিগদর লিবারম্যান একে ‘ইসরায়েলকে ধ্বংসের রেসিপি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তবে ইসরায়েলি নাগরিকদের একটি অংশ এই পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি ইসরায়েলের প্রাক্তন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ ইসরায়েলি সরকার এবং জনগনকে এই ‘ঐতিহাসিক সুযোগকে অগ্রাহ্য না করার’ অনুরোধ জানিয়েছিল। তারা আরব পিস ইনিশিয়েটিভকে জোরালোভাবে সমর্থন করে এর পক্ষে একটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে যার অংশ হিসেবে প্রাক্তন ৫০০ ইসরায়েলি কূটনৈতিক, গোয়েন্দা এবং সেনা কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
অপরদিকে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই আরব পরিকল্পনাকে জোরালোভাবে সমর্থন করে তিনটি ইসরায়েলি পত্রিকায় হিব্রু ভাষায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিল। কিন্তু হামাসের সশস্ত্র শাখা, ইসলামিক জিহাদ এবং আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডের মতো ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত এবং পরবর্তীতে মাহমুদ আব্বাস পরিকল্পনাটিকে সমর্থন করলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া সমর্থন করেননি। শেষপর্যন্ত পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়ে যায়। ব্যর্থ হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ নিহিত ছিল।
ব্যর্থ হল কেন?
প্রথমত, ইসরায়েলি সরকারপ্রধানদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান শিয়া প্রভাবের কারণে এহুদ ওলমার্টকে এপিআই গ্রহণ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সংকল্পবদ্ধ মনে হয়েছিল, কিন্তু নিজের রাজনৈতিক সক্ষমতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং জনসমর্থনের অভাবে তিনি সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। অপরদিকে শ্যারন এবং নেতানিয়াহু উভয়ের যথেষ্ট রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আদর্শিক কারণে আরব পিস ইনিশিয়েটিভকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা প্রকাশের সময়কাল। এটি ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সময়কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং পাসওভার হামলা ইসরায়েলকে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফলে পশ্চিম তীর এবং গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার অনেকটা অসম্ভব হয়ে যায়, যা কিনা এই প্রস্তাবনার প্রধান শর্ত ছিল।
তৃতীয়ত, মধ্যস্থতাকারী কোনো তৃতীয় পক্ষের অভাব। একই সঙ্গে ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মিত্র হওয়ায় নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব পিস ইনিশিয়েটিভের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম বছরে বুশ প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বন করেছিল। টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশ বরং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ইরাক আক্রমণ নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। যদিও প্রেসিডেন্ট বুশ আরব পিস ইনিশিয়েটিভকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং কখনো কখনো এর প্রশংসাও করেছিলেন, কিন্তু কখনই একে আরব-ইসরায়েল সংঘাতের সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেননি। মূলত ইসরায়েলের প্রতি আরব বিশ্বের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে মার্কিন প্রশাসন গুরুত্ব দেয়নি যা ডব্লিউ বুশ এবং কন্ডোলিৎজা রাইস উভয়েই তাদের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে, বারাক ওবামা প্রশাসনও মধ্যস্থতা করার সুযোগকে কাজে লাগায়নি। প্রস্তাবিত এই শান্তি পরিকল্পনায় ইসরায়েলের প্রধান মিত্র, মার্কিন প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত।
চতুর্থত, হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডের মতো ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা অন্যতম কারণ। সশস্ত্র এই সংগঠনগুলোর সমর্থন থাকলে আরব পিস ইনিশিয়েটিভ গ্রহণ করতে নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের উপর চাপ বাড়ত।
পঞ্চমত, আরব নেতৃবৃন্দ ইসরায়েলি নাগরিকদের নিকট পরিকল্পনাটি যথাযথভাবে প্রচার এবং এর পক্ষে জনমত গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রস্তাবনাটি হিব্রু ভাষায় প্রথম অনুবাদ করা হয় আনুষ্ঠানিক উত্থাপনের তিন বছর পর, ২০০৫ সালে। ২০১৩ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, হিব্রুভাষী ইসরায়েলিদের ৭৩.৫%ই আরব পিস ইনিশিয়েটিভের নামই শোনেননি অথবা শুনলেও এর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানেন না।
উপসংহার
১৯৬৭ সালে সুদানের খার্তুমে অনুষ্ঠিত আরব লীগের সম্মেলনে যেখানে আরব রাষ্ট্রসমূহ তিন ‘না’ কে ইসরায়েল বিষয়ে আরব নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল (Three No’s- No peace with Israel, No negotiations with Israel, No recognition of Israel তথা ইসরায়েলকে কোনো স্বীকৃতি নয়, ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সন্ধি নয়, ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো শান্তিও নয়), সেখানে আরব পিস ইনিশিয়েটিভ ছিল আরব নীতিতে সত্যিকার অর্থেই এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর মাধ্যমে আরব রাষ্ট্রগুলো কেবল তাদের প্রয়োজনই নয় বরং ইসরায়েলের প্রয়োজনও উপলব্ধি করে আরব-ইসরায়েল সংঘাত সমাধানের লক্ষ্যে একটি সম্মিলিত এবং সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
উপরন্তু, ৫৭ সদস্য বিশিষ্ট ওআইসি এটিকে সমর্থন করার ফলে ইসরায়েলের সামনে শুধু আরব বিশ্বের সঙ্গেই নয় বরং গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ বিভিন্ন সময় ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ এই প্রস্তাবনার বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করলেও, আজ পর্যন্ত ইসরায়েল এই প্রস্তাবনার প্রতি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি।
আরব শান্তি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যে দশকের পর দশক ধরে চলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার পরিসমাপ্তিসহ নিঃসন্দেহে বদলে যেত এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি, মিলিয়ন মিলিয়ন ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য লিখিত হত নতুন করে।