২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮। চিলির ছোট্ট এক দ্বীপে অপেক্ষা করছেন পাঁচ অভিযাত্রী। তারা এক রোমাঞ্চকর অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাঁচজনই সমুদ্রযাত্রায় বিশেষ অভিজ্ঞ। দলপতি নেড জিলেট (৪২) ছিলেন এক প্রাক্তন অলিম্পিক স্কিয়ার। তার রয়েছে সাত মহাদেশ পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা। তিনি একজন দক্ষ, বিশ্বমানের পর্বতারোহী, নাবিক, ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক এবং একজন সুলেখক। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তার সাহসী অভিযানের জন্য তিনি ছিলেন সুপরিচিত।
তার অপর তিন সহযোদ্ধার মধ্যে মার্ক এইখেনবার্গ (৩৫) ছিলেন একজন অভিযাত্রী, ক্রীড়াবিদ এবং দক্ষ নাবিক। জে মরিসন (৩৩) ছিলেন একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এবং ফ্রেড ট্রম্বলি (৩২) ছিলেন অন্যদের মতোই একজন দক্ষ অভিযাত্রী। পঞ্চমজন, বব রাইস, ছিলেন ম্যাসাচুসেটসের বেডফোর্ড শহরের আবহাওয়া দফতরের প্রধান আবহাওয়াবিদ।
এই সমুদ্রযাত্রায় তাদের একমাত্র বাহন লাল রঙের ২৮ ফুট দীর্ঘ এবং ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট নৌকা ‘সি টম্যাটো’। প্রশান্ত মহাসাগরের নানারকম প্রতিকূল অবস্থার কথা ভেবে সর্বাধুনিক যন্ত্র দিয়ে তৈরি হয়েছে সি টোম্যাটো। শক্তপোক্ত, মজবুত, তীব্র গতিতে যেতে পারবে না, কিন্তু প্রয়োজনে যেকোনো অবস্থায় জলে ভেসে থাকতে পারবে। শক্ত জাহাজী অ্যালুমিনিয়ামের কাঠামো, ন’টি জলমুক্ত অংশে ইঞ্জিনটি ভাগ করা। ঝড়বৃষ্টির ঝাপ্টা সহ্য করার ক্ষমতা, যথাসম্ভব যাত্রাপথের উপযুক্ত করেই এই নৌকোটি তৈরি করা হয়েছিল। এই নৌকোয় ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত বেডফোর্ড আবহাওয়া দপ্তর থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ করার ব্যবস্থা রাখা হয়।
প্রশান্ত মহাসাগর অত্যন্ত রহস্যময়। এই অঞ্চলের আবহাওয়া প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হয়। এই শান্ত, তো পর মুহূর্তেই সে ভয়ঙ্কর। তার ভয়াবহ উত্তাল ঢেউ যাত্রাপথকে সর্বদাই বিপদসঙ্কুল করে রাখে। তাই কখন কী হয় তা আগে থেকে বলা সম্ভব না। কিন্তু অভিযাত্রীদের সাহস, জেদ আর বুদ্ধি একসাথে মিলে সব অনিশ্চয়তাকে হটিয়ে দিয়েছে বারবার। এই পাঁচ অভিযাত্রী সেই দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার জন্য সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তাদের লক্ষ্য বরফমোড়া অ্যান্টার্কটিকার দ্বীপ কিং জর্জ আইল্যান্ড। দক্ষিণের ৬০ মাইল প্রশস্ত ড্রেক প্যাসেজের উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে তাদের। বহুদিনের বহু বিপদের অভিজ্ঞতা থেকে দলপতি নেড ভালোভাবেই জানতেন, তাদের এই ইচ্ছেপূরণ খুব সহজ নয়। কিন্তু সবরকম বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত থাকা দরকার।
প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১৪ সালে সার আর্নেস্ট শ্যাকেলটনের জাহাজ অ্যান্টার্কটিকা পৌঁছার পর বরফে আটকে পড়ে। ‘এনডিয়রেন্স’’ ওয়েডেল সমুদ্রে হিমবাহের সাথে ধাক্কায় ডুবে গিয়েছিল সেই জাহাজ। তিনি পাঁচজন সঙ্গীকে নিয়ে সাড়ে ২২ ফুটের এক লাইফবোটে চেপে ৮০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এলিফ্যান্ট দ্বীপ থেকে দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে পৌঁছেছিলেন। জাহাজ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও শ্যাকেলটনের নেতৃত্ব আর ক্রুদের সাহায্যে সবাই নিরাপদে অ্যান্টার্কটিকা থেকে ফিরে আসেন।
এই অসীম সাহসী নাবিকের রোমহর্ষক অভিযান নেডকে ছোট থেকেই অনুপ্রাণিত করতো। তাদের এই লড়াই যে বেঁচে থাকার লড়াই- এ কথাটি সকলে বুঝে নিয়েছিলেন।
সব ধরনের ব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও বব রাইস তৃপ্ত ছিলেন না। ভূগোলের হিসাব অনুযায়ী, মোটামুটি ৪০ থেকে ৬০ ডিগ্রি দক্ষিণ পর্যন্ত পশ্চিমা বায়ুর স্বেচ্ছাচারিতার জগৎ। এই বায়ুর প্রভাবে সমুদ্রের ঢেউও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই বায়ু একদিকে তাদের নৌকোকে যেমন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগোতে সাহায্য করবে, তেমনই পথে বহু বিপদে পড়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। উপকূল সংলগ্ন প্রথম কয়েক মাইল চিলির মাছ ধরার জাহাজ ডন-আলবার্তো তাদের আগলে নিয়ে চললো, কারণ ওখানে সমুদ্র খুব অশান্ত থাকে। বব আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, হয়তো পুরো পথই চিলির নৌবাহিনীর সাহায্য নিতে হবে।
প্রথম পরীক্ষা এলো একেবারেই আচমকা। ভোর তখনও হয়নি। নেড ককপিট পর্যবেক্ষণ করছিলেন। হঠাৎ এক পাহাড়প্রমাণ ঢেউ এসে প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়লো নৌকার গায়ে। টালমাটাল নৌকো থেকে ডিগবাজি খেয়ে নেড ছিটকে গেলেন খোলা সমুদ্রে, হাত কোনোমতে নৌকোর গায়ে আটকানো, ফেনায় চারদিক সাদা। এমন সময় ফ্রেডের উপস্থিত বুদ্ধির কারণে রক্ষা পান নেড। ফ্রেডের সবল ডান হাত এক প্রবল ঝটকায় নেডকে টেনে নিয়ে এলো নৌকোর ওপর।
এরপর একটানা এগিয়ে চলা। টানা ৩৬ ঘন্টা একটানা নৌকা বেয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে কেপ হর্নের বিপজ্জনক চোরা পাথরের কবল থেকে মুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত খোলা সমুদ্রে এসে পড়লো ‘সি টম্যাটো’। চারজন পালা করে ছয় ঘন্টা করে নৌকা বাইতো। ধীরে সুস্থে গড়ে ২.২ নট গতিতে যাত্রা, অর্থাৎ ঘন্টায় ২.৫ মাইল বেগে সি টম্যাটোর এগিয়ে যাওয়ার পথে আবহাওয়া কখনও স্বাভাবিক, আবার কখনও বিরূপ।
আমাদের সাধারণের পক্ষে অভিযাত্রীদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা কল্পনা করা বেশ কঠিনই। প্রতিটি মুহূর্ত এখানে সজাগ- সতর্ক থাকতে হয়, ছয় ফুট বাই সাত ফুট কেবিনে চারজন, নিদেনপক্ষে তিনজন এদিক-ওদিক করে শুতে হয়, শুকনো কাপড় শুধু কল্পনায় থাকে, ঘুমোবার সময় তিন ফুট উঁচু প্যাড লাগানো ছাদে মুহুর্মুহু ধাক্কা খেতে হয়। শিখতে হয় অন্ধকারে দাঁড় বাওয়া, যেটা কখনো সম্ভব হবে নেড আগে ভাবেননি।
ড্রেক প্যাসেজ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝেমাঝেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ঢেউ প্রতিনিয়ত নৌকোর ওপর আছড়ে পড়তো। তার ধাক্কায় দাঁড় আর নাবিক দুদিকে ছিটকে যেতো। এই আশঙ্কায় আগে থেকে ভেবে দাঁড়গুলো বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করা ছিল। প্রত্যেকেরই এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘গ্রেট ড্রেক টম্যাটো পেস্ট’। যখন একদিকে জোরে বাতাস দিতো, তখন অন্যদিকে এক ফুট ছোট দাঁড় ব্যবহার করা হতো।
সি-টম্যাটো ক্রমাগত ডিগবাজি আর ওলটপালট খেয়ে অভিযাত্রীদের ধৈর্য আর সহ্যশক্তির পরীক্ষা নিতো। দাঁড় বাইতে বাইতে কখনো কখনো দেখা যেত মাথার ঠিক ওপরেই দশ ফুট পাখা নিয়ে অ্যালবাট্রস চক্কর মারছে, কখনোবা নৌকো ঘিরে মিঙ্ক তিমিরা ঘুরপাক খাচ্ছে।
এভাবে দিনের পর দিন কাটতে লাগলো, ২৪ ঘন্টা একটানা দাঁড় বাইতে-বাইতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন সবাই। নয়দিন একটানা দাঁড় বেয়ে যাওয়া আর ক্রমাগত লবণ জল লেগে ঘা হয়ে যাওয়ার ভয়ে শরীরে জিঙ্ক অক্সাইড মলম লাগানো থাকতো। দুষ্প্রাপ্য শান্ত সময়ে অনন্ত সমুদ্রে নিশ্চিন্তে গা ভাসিয়ে দেওয়া, এমন সুযোগ খুব কমই এসেছে। দ্বাদশতম দিনে অভিযাত্রী দল দেখতে পেল বরফের অসংখ্য ছোট ছোট চাঁই ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে। আর ধীরে ধীরে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো একখন্ড শুকনো স্থান। অবশেষে স্থলভাগের সন্ধান পাওয়া গেল।
দক্ষিণ শেটল্যান্ড আইল্যান্ড। এবার সাবধানে বরফ কাটিয়ে দ্বীপে পৌঁছানো। কিন্তু খানিক পরেই ৩০ নট বেগে বাতাস এসে তাদের দিকভ্রান্ত করে দিল, সেই রাতের প্রবল ঝড়ে সকলের দৃষ্টি সম্পূর্ণ ঝাপসা, দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে সবার শিরা টানটান। কিন্তু নেডের কথামতো, “যার ওপর কখনো নির্ভর করা যায় না, শুধুই আশা করা যায়,” সেই ভাগ্য তাদের সহায়। পরদিন সকালে সমুদ্র আবার শান্ত। সব মিলিয়ে ১৩ দিন ৫ ঘন্টা পরে অভিযাত্রীরা পৌঁছলেন ছোট দ্বীপ হারমনি কোভে। সেখানে একদিন অবস্থান করে অভিযাত্রী দল পৌঁছলেন ২৫ মাইল দূরে কিং জর্জ দ্বীপে।
অভিযাত্রী দলের প্রত্যেকের হার না মানা মানসিকতার কারণে ৫৭০ মাইল দাঁড় বেয়ে অশান্ত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা এক অসাধ্য সাধন করলেন। মেরু অঞ্চলে এত দীর্ঘ পথ নৌ যাত্রার অভিজ্ঞতা তাদের সকলের কাছেই ছিল প্রথম। তাই এই দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ জয় করার জন্য এই পাঁচ অভিযাত্রীর ছিল সাহস আর অদম্য মানসিকতা। আর এভাবেই তারা পাড়ি দিলেন এক দুর্গম পথ।
ফিচার ইমেজ- giornaledellavela.com