পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই বিবাদমান দুই বা ততোধিক দল, গোষ্ঠী অথবা দেশের মধ্যে বিভিন্ন কারণ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ হয়েছে অথবা যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব যুদ্ধের পরিস্থিতির জন্য কখনো শুধু একটিমাত্র কারণ কাজ করেছে, আবার অনেক সময় একাধিক কার্যকরী কারণে কোনো দেশ, জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। অতীতের বিভিন্ন যুদ্ধাবস্থা বা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সাপেক্ষে ঠিক যেসব কারণে একটি যুদ্ধ হয়ে থাকে বা যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে থাকে সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন।
যুদ্ধ পরিস্থিতি বলতে আসলে কী বোঝায়?
সাধারণভাবে যুদ্ধের সংজ্ঞা হচ্ছে এক বা একাধিক বিশেষ সুবিধা বা উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একটি গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা দেশ অথবা একই মনোভাবাপন্ন একাধিক দেশ বল বা জোরপূর্বক অন্য কোনো দল, সম্প্রদায় বা দেশের উপরে সামরিক আগ্রাসন পরিচালনা করে তাকে যুদ্ধ বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বলা হয়। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়-
শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক দেশের মধ্যে নয়, বরং কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শুধুমাত্র একটি দেশের মধ্যেও যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। গৃহযুদ্ধ অথবা কোনো বৈপ্লবিক যুদ্ধ এই পরিস্থিতির উদাহরণ।
সামরিক যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য
যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হাজার হাজার বছর আগে থেকে মানুষ বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। সভ্যতার শুরুর দিকে যুদ্ধের পরিধি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও ‘শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতা’র সাথে সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ছুঁয়েছে। বর্তমান সময়ে কোনো যুদ্ধের পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ভয়াবহ, নৃশংস এবং প্রাণঘাতী।
সামরিক যুদ্ধ কেন হয়- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পৃথিবীর অনেক মেধাবী সমাজবিজ্ঞানী তাদের গবেষণা চালিয়েছেন। তাদের গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করলে সামরিক যুদ্ধের কারণ হিসেবে কয়েকটি প্রধান কারণই ঘুরেফিরে আমাদের সামনে আসে। একাধিক দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা দেশের মধ্যে একটি সামরিক যুদ্ধের পরিস্থিতির জন্য মূলত কয়েকটি প্রধান কারণকে চিহ্নিত করা যায়।
অর্থনৈতিক সুবিধা
‘অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়’ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হবার অন্যতম প্রধান একটি কারণ। যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য অন্য কোনো কারণ কাজ করুক কিংবা না করুক, অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি একটি সর্বজনবিদিত কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে অন্য কোনো কারণকে সামনে এনে প্রচার করা হলেও অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়টি সবসময়ই ‘উহ্য’ হিসেবে কাজ করে থাকে।
শিল্পায়ন-পূর্ব সময়ে দামী ধাতু (যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা) এবং নানা দরকারি গৃহপালিত পশুর জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিককালে তেল, খনিজ পদার্থসহ নানা মূল্যবান সম্পদ যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘অর্থনৈতিক লাভের বিষয়’ হিসেবে ধরা হয়। জনসংখ্যার বাড়তি চাপের বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে বর্তমান সময়ের সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন-
বর্তমান পৃথিবীতে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে হয়তো ভবিষ্যতে শুধুমাত্র মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের স্বার্থে অন্য একটি দেশের উপরে আগ্রাসন চালাতে হবে।
অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ে সৃষ্ট যুদ্ধের উদাহরণ হিসেবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যুদ্ধ এবং দ্য উইন্টার ওয়ারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই দুই যুদ্ধের পিছনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি কাজ করেছে।
ভৌগোলিক সুবিধা
একাধিক দেশের মধ্যে বিরোধ এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য ‘ভূমি’ একটি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। জনসংখ্যার আধিক্য, চাষাবাদের জন্য জমি ইত্যাদি বিষয় অতীতে দুই বা ততোধিক দেশকে যুদ্ধের বিষয়ে প্রলুব্ধ করেছে। ভৌগোলিক সমস্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের পাশাপাশি এক্ষেত্রে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রক্সি যুদ্ধ হচ্ছে একটি ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধাবস্থা, যেখানে বিবাদমান দুটি দেশ তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য অন্য আরেকটি নিরপেক্ষ দেশে পরস্পরের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য ‘যৌক্তিক এবং অর্থনৈতিক’ কিছু বিষয়ও কাজ করে থাকে।
মেক্সিকা-আমেরিকা যুদ্ধ এবং সার্বো-বুলগেরিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘ভূমিগত বিরোধ’ একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
ধর্ম
প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম মানুষের মধ্যে যুদ্ধ এবং বিবাদের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন বিবাদ অনেকটা ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’র মতো। যুগের পর যুগ ধরে এই সংক্রান্ত যেকোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। আবার যেকোনো সময় অবস্থার একটু হেরফের হলেই বিষয়টি দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যকার যুদ্ধের অন্যতম সক্রিয় একটি কারণ হতে পারে।
ধর্ম সংক্রান্ত যুদ্ধকে অনেকসময় জাতীয়তা রক্ষার যুদ্ধ, প্রতিশোধের যুদ্ধ অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয়স্থান রক্ষার যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। পৃথিবীর অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আবার একই ধর্মের বিভিন্ন গোত্র, সম্প্রদায় অথবা গোষ্ঠীর (যেমন প্রোটেস্ট্যান্ট-ক্যাথলিক অথবা শিয়া-সুন্নি) মধ্যে বিবাদ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুদ্ধেরও নজির পাওয়া যায়।
ধর্মকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া কয়েকটি বিখ্যাত যুদ্ধ হচ্ছে দ্য ক্রুসেডস (১০৯৫-১২৯১), থার্টি ইয়ার্স ওয়ার (১৬১৮-১৬৪৮), লেবানিজ গৃহযুদ্ধ (১৯৭৫-১৯৯০) ইত্যাদি।
দেশাত্মবোধ
দেশপ্রেম অথবা দেশাত্মবোধ যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ঠিক এই কারণে পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি বড় বড় যুদ্ধের নজির রয়েছে। দেশাত্মবোধের কারণে একদিকে যেমন কোনো বড় দেশের পক্ষ থেকে অন্য কোনো ছোট দেশের উপরে আগ্রাসন চালানোর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার পরম ব্রত নিয়ে সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নজিরও রয়েছে। এই ধরনের যুদ্ধের বিষয়ে ডক্টর রিচার্ড নেড বলেন-
‘জাতীয় নিরাপত্তারক্ষা’ বা ‘বস্তুগত কোনো লাভ’ যে নামেই দুটি বা ততোধিক দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হোক না কেন এক্ষেত্রে প্রবলভাবে কাজ করে একটি বিষয়। আর তা হচ্ছে- ‘জাতীয়তা’।
দেশাত্মবোধ বা জাতীয়তার উপরে ভিত্তি করে বর্তমান পৃথিবী চিচিমেকা যুদ্ধ (১৫৫০-১৫৯০) এবং সর্বোপরি ‘র’ (১৯১৪-১৯১৮) ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে।
প্রতিশোধস্পৃহা
প্রতিশোধ, প্রতিকার, প্রতিরোধ, ক্ষোভ অথবা সাধারণভাবে পাল্টা একটি ব্যবস্থা হিসেবে একটি দেশের পক্ষ থেকে অন্য দেশের উপরে যুদ্ধের আগ্রাসন চালানোর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এই ধরনের যুদ্ধকে ‘জাতীয়তারক্ষা’ এবং ‘গর্ব ও অহংকার’ রক্ষার নামেও প্রচার করা হয়। ইউরোপের অনেক যুদ্ধের প্রধান কারণ হিসেবে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে প্রতিশোধপরায়ণতার নজির পাওয়া যায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) এবং ওয়ার অব টেরর এই ধরনের যুদ্ধের উদাহরণ।
গৃহযুদ্ধ
সাধারণত একটি দেশে দুই বা ততোধিক দলের মধ্যে মতো অথবা আদর্শের অমিলের কারণে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দেশটি ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত কোনো দেশের পরিচালকগোষ্ঠী এবং সাধারণ জনগণ বা অন্য কোনো শক্তিশালী বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে একটি বিবাদমান এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি পরবর্তীতে অনেক সময় ‘সশস্ত্র সংগ্রামে’ পরিণত হয় এবং দেশটিতে সাধারণত ক্ষমতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধাবস্থার সমাপ্তি ঘটে।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫), রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ (১৯১৭-১৯২৩), স্পানিশ গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৯৩৯) এই ধরনের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের উদাহরণ।
বৈপ্লবিক যুদ্ধ
কোনো দেশের মূল ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে দেশটির ক্ষমতায় থাকা অন্য একটি দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদমান কোনো সমস্যার কারণে একটি ‘সশস্ত্র যুদ্ধ পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হলে তাকে বৈপ্লবিক যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। গৃহযুদ্ধের মতোই এই ধরনের যুদ্ধ কোনো দেশের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। বিখ্যাত আমেরিকা বিপ্লব (১৭৭৫-১৭৮৩) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) এই ধরনের যুদ্ধের উদাহরণ।
প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ
দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার ভিত্তিতে দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে কোনো সশস্ত্র যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখা দিলে তাকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে একটি বিষয় প্রবলভাবে কাজ করে- অন্য কোনো দেশের অবশ্যম্ভাবী আক্রমণের জন্য অপেক্ষা না করে তার আগেই দেশটিকে আক্রমণ করা। স্নায়ুযুদ্ধ (১৯৪৭-১৯৯১) এই ধরনের যুদ্ধের অন্যতম উদাহরণ।
Featured Image- nationalinterest.org