বিখ্যাত নারী শাসকদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে উল্লেখ করতে হবে ইংল্যান্ডের সাবেক রানী প্রথম এলিজাবেথের নাম। ষোড়শ শতাব্দীতে বিভক্ত, অনুন্নত এবং হিংসাত্মক মনোভাবপূর্ণ ইংরেজদের শাসন করা ছিলো খুবই কঠিন। অন্তত একজন নারীর জন্য তা ছিলো একপ্রকার অসম্ভব কাজ। সে সময় ইউরোপের গন্ডি পেরিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পৌঁছে গিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। যদিও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ততদিনে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। বরঞ্চ তারা সর্বদা ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতো। অথচ নিজের মেধা ও দূরদর্শীতার গুণে এলিজাবেথ প্রায় ৪৪ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শাসন করেন।
রানী প্রথম এলিজাবেথের দীর্ঘদিনের রাজত্ব নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময় একাধিক ইতিহাসবিদ ঐ সময়ের ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর সেসব নিয়ে রচিত হয়েছে অগণিত বই। তাদের মতে, রানীর একদল গুপ্তচর বাহিনী ছিলো যারা বেসরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তারা রানীর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন, বিনিময়ে নিতেন অর্থ। এতে করে তিনি তার রাজত্বকালে সবরকম ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন অ্যালফোর্ড প্রথম এলিজাবেথের সেই গুপ্তচর বাহিনী নিয়ে লেখালেখি করেছেন। যদিও তার উল্লেখিত বিষয়বস্তু ১৯২৫ সালে আমেরিকান ইতিহাসবিদ কনার্স রিডের লেখা জীবনির সাথে অনেকাংশে মিলে যায়।
অ্যালফোর্ড রানী এলিজাবেথের গুপ্তচর বাহিনীকে আধুনিক যুগের সিআইএ’র সঙ্গে তুলনা করেন। যদিও তিনি এলিজাবেথের গুপ্ত বাহিনী নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেননি, বরং তিনি সে সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। আর সেগুলোর বেশিরভাগই ছিলো এলিজাবেথের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বিষয়ক। তিনি তার শাসনামলে প্রতিবেশী দেশের শাসকদের পাশাপাশি নিজের রাজত্বের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা উচ্চপদস্থ লোকদের ষড়যন্ত্রেরও শিকার হন।
রানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এবং তার পতন প্রার্থনা করা লোকদের একাংশ ছিলো তারই রাজ্যে আশ্রয় পাওয়া ক্যাথলিক পুরোহিত। কিন্তু রানীর গুপ্তচর চক্রটি এতটাই সক্রিয় ছিলো যে কোথাও রানীর বিরুদ্ধে কোনো কিছু আলোচনা হলে সব খবরাখবর গুপ্তচর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা লোকেদের নিকট পৌঁছে যেত। সে সময় রানীর পতন প্রত্যাশা করা শত শত ক্যাথলিকের জেল, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। যদিও কেউ কখনও বুঝতো না এসব খবরাখবর কীভাবে গুপ্তচরদের নিকট পৌঁছায়।
এলিজাবেথের নেতৃত্বাধীন নির্দয় সেসকল গুপ্তচরদের উপর দ্বিগুণ গুপ্তচর নিয়োগ করে পুরো চক্রটিকে গোপন এবং নিরাপদ রাখতেন তিনি। কোনো গুপ্তচর মিথ্যা তথ্য দিয়ে কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে সফল হওয়ার সুযোগ পায়নি। বরং রানীর গৃহীত নতুন আইনে ষড়যন্ত্রকারীদের মতো ফাঁসির দন্ড পেতো বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচররা। আর এই সুদীর্ঘ এবং সুদক্ষ গুপ্তচর চক্রের কল্যাণে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সফলতার সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন এলিজাবেথ। আজ এলিজাবেথের সেই গুপ্তচর চক্রের কার্যক্রম এবং ষড়যন্ত্র মোকাবেলার কৌশল তুলে ধরা হলো।
স্পেনের হুমকি এবং মেরির ষড়যন্ত্র
ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড এবং স্পেনের মধ্যকার সামরিক ও বাণিজ্যিক বিরোধ চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। এলিজাবেথ যখন ক্ষমতায় আরোহন করেন তখন স্পেনের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপস। রানীকে দুর্বল ভেবে তিনিও ব্রিটেনে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি সামরিক বাহিনী দ্বারা আক্রমণের পাশাপাশি রাজপরিবারের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে উদ্যোগ নেন। আর এই গোটা নীলনকশা বাস্তবায়নে তাকে সাহায্য করেছিল ইংল্যান্ডে নির্বাসিত রোমান ক্যাথলিক পুরোহিতরা।
পরিকল্পনানুযায়ী তাদের অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া দেন স্কটল্যান্ডের রানী এবং এলিজাবেথের পর সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী মেরি। ক্যাথলিক ধর্মযাজকরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এলিজাবেথের পতন হলে মেরি হবেন নতুন রানী এবং তার সাহায্যে পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার করা সহজ হবে। যদিও এর আগে গুপ্তচরদের সহযোগিতায় মেরিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে এলিজাবেথের লিখিত আদেশে ১৫৮৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মেরির মৃত্যুর সংবাদে বিচলিত হন রাজা দ্বিতীয় ফিলিপস। ১৫৮৮ সনের মাঝামাঝি সময়ে ১৩০টি জাহাজ নিয়ে ইংল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা করে তার নৌবহর। ঐতিহাসিকদের মতে, ঐ নৌবহরে প্রায় ৪০টি যুদ্ধজাহাজ ছিলো এবং সেগুলো ১৮ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধাকে বহন করেছিল। তবে স্প্যানিশ এই অভিযান যে শুধুমাত্র ইংল্যান্ড অভিমুখী ছিলো তা কিন্তু না!
রাজা ফিলিপস চেয়েছেন স্পেন থেকে শুরু করে পর্তুগালের লিসবন অবধি উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে। আটলান্টিক মহাসাগরে স্প্যানিশদের এই অগ্রযাত্রা স্প্যানিশ আর্মাডা নামে পরিচিত। যদিও ইংল্যান্ডে যাত্রাকালেই এই অভিযান ভেস্তে যায়। সামুদ্রিক ঝড়ে নৌবহরের এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়, অন্যদিকে রোমান ক্যাথলিক পুরোহিতদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে প্রকৃতি সশস্ত্র যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাজপ্রাসাদে কয়েক বছরের চলমান ষড়যন্ত্র কীভাবে এলিজাবেথ টের পেয়েছিলেন?
ইতিহাসবিদদের মতে, রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের মধ্যে এমনও লোক ছিলেন যারা রানীর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন। যদিও তারা অন্যসব ক্যাথলিকদের নিকট খুবই শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বাসযোগ্য হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। দ্বিতীয় ফিলিপসের এই ষড়যন্ত্রের খবর এলিজাবেথ অবধি পৌঁছানোর জন্য যে গুপ্তচরবৃত্তি ঘটেছিল সেটিকে ১৯৫০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কমিউনিজমের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেন গবেষক পেট্রিক মার্টিন।
গুপ্তচরদের সক্রিয়তা
রানী এলিজাবেথ ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করলেও রাজপ্রসাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত লোকেদের নিজের আয়ত্তে আনতে কিছুটা সময় নেন। তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব স্যার উইলিয়াম সেসিল ছিলেন রানীর অন্যতম একজন উপদেষ্টা। যদিও পরোক্ষভাবে তিনি গুপ্তচর চক্রের একাংশের নেতৃত্ব দিতেন। মূলত উইলিয়াম সেসিলের নির্দেশেই গুপ্তচররা ১৫৭০ সালে ক্যাথলিক ব্যক্তি জন স্টোরিকে অপহরণ করে। তার অপরাধ স্প্যানিশদের হয়ে ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করা। আর এই ষড়যন্ত্র তিনি ইংল্যান্ডের বাইরে বসেই করেছিলেন। অপহরণের পর স্টোরিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইংল্যান্ডে আনার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও স্টোরি তখনও বোঝেননি তিনি উইলিয়াম সেসিলের লোকদের হাতে অবরুদ্ধ। তাকে সুকৌশলে কোনোপ্রকার ঝামেলা ছাড়াই অপহরণ করেছিল গুপ্তচররা।
এলিজাবেথের অন্য আরেকজন উপদেষ্টা ছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহাম। ইতিহাসবিদদের মতে, সেসিলের গুপ্তচর চক্রের থেকেও ওয়ালসিংহামের চক্রটি বেশি সক্রিয় ছিলো। বুদ্ধিমান, চতুর এবং ধৈর্যশীল ওয়ালসিংহাম তার চক্রটিকে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করে জাহাজের নাবিক এবং বণিকরা। তারা খুব সহজেই গোপন তথ্য পাচার করতেন। বিনিময়ে তাদের কোনো অর্থ দিতে হতো না, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সুবিধা পেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকতেন।
বণিকদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গুপ্তচররাও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতেন। আর এই ভ্রমণের দুটি উদ্দেশ্য ছিলো। প্রথমত, ভিনদেশী রাষ্ট্রদূতরা এলিজাবেথের মন্ত্রীসভা নিয়ে কেমন মন্তব্য করে তারা জানা এবং ঐ দেশগুলোর রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বইসমূহ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহামের কাছে প্রেরণ করা। পরবর্তীতে রানী এলিজাবেথ নিজে তার উপদেষ্টাদের থেকে প্রমাণসাপেক্ষ ভিনদেশীদের মতামত শুনতেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন। আর এই থেকে বোঝা যায়, রানী এলিজাবেথ কখনোই তার একজন উপদেষ্টার অনুগত গুপ্তচর চক্রের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। তিনি খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে গুপ্তচরদের উপরেও গুপ্তচরবৃত্তি করাতেন। আর এমনটা বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
বেবিংটন পটভূমি দমনের সুকৌশল
স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপসের প্ররোচনায় পড়ে স্কটল্যান্ডের রানী মেরি এলিজাবেথকে হত্যা করে ব্রিটিশ সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। রাণীর মামাতো বোন হওয়ার সুবাদে মেরি ছিলেন সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী। এদিকে মেরির পুরো ষড়যন্ত্রের খবর জানতেন ওয়ালসিংহামের অধীনস্থ গুপ্তচররা। যদিও তাদের হাতে তখন অবধি কোনোপ্রকার প্রমাণ এবং আলামত ছিলো না। আর এই কারণে ষড়যন্ত্রের শেষ অবধি অপেক্ষায় ছিলেন গুপ্তচররা।
মেরির ষড়যন্ত্র উন্মোচন করতে গুপ্তচররা গোপন অক্ষর এবং প্রতীক ব্যবহার করে। তারা নিজেদেরকে ষড়যন্ত্রের সমর্থনকারী হিসেবে ঘোষণা করে এবং মেরির বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা গোপন অক্ষর ব্যবহার করে চিঠি আদান প্রদানে মেরিকে প্ররোচিত করে এবং এমন প্রস্তাবে তিনি রাজিও হন। যদিও মেরি বুঝতে পারেননি গুপ্তচর চক্রটি তার সঙ্গে মিশে তথ্যপ্রমাণ লুটে নিয়েছিল। পরবর্তীতে রানী এলিজাবেথের বিরুদ্ধাচরণ করে মেরির লেখা একটি চিঠিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
প্রথম ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার পরে আরো একাধিক ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়েছিলেন এলিজাবেথ। কয়েকজন গুপ্তচর ক্যাথলিকদের নিকট গুপ্তচরবৃত্তির খবর পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করে। যদিও তারা তাদের নির্দেশদাতা ব্যতীত কাউকেই চিনতো না। ফলশ্রুতিতে অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে জানার সুযোগ পায়নি এলিজাবেথের বিরোধীরা। ১৫৯৩ এবং ‘৯৪ সনের মাঝামাঝি সময়ে রানীর ব্যক্তিগত চিকিৎসকও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। রদ্রিগো লোপেজ নামক ঐ চিকিৎসক গোপনে স্প্যানিশ আদালতে এবং ক্যাথলিক পুরোহিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। যদিও লোপেজকে অভিযুক্ত প্রমাণের বিশেষ কারণও ছিলো। এর আগে সমুদ্রপথে স্প্যানিশ আগ্রাসন ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিশোধ হিসেবে নতুন ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করেন রাজা ফিলিপস। রানীর চিকিৎসা করার খাতিরে প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ খবরগুলো সহজেই স্পেনে পৌঁছাতে পারতেন লোপেজ। এই অপরাধের কারণে তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় রানীর আরো কিছু সংখ্যক গুপ্তচর নিয়োজিত ছিলো। তারা ভিনদেশী ভ্রমণকারী কিংবা বার্তাবাহকদের উপর নজরদারিতে ব্যস্ত থাকতেন। এছাড়াও প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ যেকোনো অভ্যুত্থান মোকাবেলা করার জন্য রোমে একদল সশস্ত্র গুপ্তচর সবসময় প্রস্তুত ছিলো। যদিও তারা নিজেরাও জানতো না তারা রানীকে রক্ষার জন্যই বেতন ভোগ করছেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে তারা সবাই ছিলেন ক্যাথলিক পুরোহিত।
ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহামের মৃত্যুতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়
এলিজাবেথকে রক্ষায় পরিচালিত গুপ্তচর চক্র পরিচালনায় সবথেকে বেশি সফল হয়েছিলেন ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহাম। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন গুপ্তচরদের কাজকর্ম ঠিকভাবেই চলছিলো। কিন্তু ১৫৯০ সালে তার মৃত্যুর পর বিপাকে পড়েন রানী এলিজাবেথ। প্রয়াত ওয়ালসিংহামের নেতৃত্বাধীন চক্রটির নিয়ন্ত্রণ নিতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করেন অ্যাসেক্সের দ্বিতীয় আর্ল রবার্ট ডেভেরু এবং স্যার রবার্ট সেসিল। তাদের দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত আদালতে গড়ায়। দুজনে রানীর অনুগত হওয়া সত্ত্বেও চক্রটির নিয়ন্ত্রণ নিতে সমঝোতায় যেতে রাজি হননি। ফলশ্রুতিতে একক নেতৃত্বের অভাবে গুপ্তচররা সঠিক তথ্য আদানপ্রদানে ব্যর্থ হয়।
যদিও গবেষকরা মনে করেন, সেকালে উইলিয়াম সেসিল গুপ্তচরদের বৃহত্তর অংশটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে রবার্ট ডেভারুর সঙ্গে তার টানাপোড়ন সম্পর্কের কারণে গুপ্তচরদের মাঝেও বিভেদ তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে স্প্যানিশদের দুটি সমুদ্র অভিযানের খবরও তারা উপদেষ্টাদের নিকট পৌঁছাতে পারেননি। যদিও স্প্যানিশদের ঐ দুটি অভিযান পূর্বের ন্যায় ঝড়ের কবলে পড়ে ভেস্তে যায়।
ক্রিস্টোফার মার্লোর মৃত্যু রহস্য
প্রকৃত অর্থে গুপ্তচরবৃত্তি বলতে গোপনে নজরদারি এবং তথ্য পাচার করাকে বোঝায়। কিন্তু রানী এলিজাবেথের গুপ্তচররা নজরদারি ও তথ্য পাচার করার পাশাপাশি সন্দেহভাজন লোকেদের অপহরণও করতো। কখনও কখনও তাদের অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হলে মুক্তির বদলে খুন করতেও পিছপা হতো না গুপ্তচররা। এমনই ঘটনা ঘটে নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর সঙ্গে। গুপ্তচররা ভেবেছিল তিনি স্প্যানিশ আদালতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন। যদিও সঠিক তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে ব্যর্থ হয় গুপ্তচররা। পরবর্তীতে ১৫৯৩ সালে তাকে খুন করা হয়। ক্রিস্টোফার মার্লো হত্যা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে কেউই বেশিদূর এগুতে পারেননি। তাদের ধারণা ঐ সময় তাকে হত্যার পর তার সম্পর্কিত সকল তথ্যপ্রমাণ উধাও করে দেয় গুপ্তচররা।
সর্বোপরি সরকারি আইন দ্বারা আড়াল করা এমন একটি গুপ্তচর চক্রের মাধ্যমে একজন নারী শাসক ৪৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। যেখানে ছিলো না কোনো ব্যর্থতা কিংবা ভুল। এমনই এক কৌশলের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন যেখানে তাকে হটিয়ে কেউই ক্ষমতার মসনদে বসতে পারেনি। নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো নির্দোষ হয়েও যদি মৃত্যুবরণ করেন তবুও তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ নেই। হয়তো এমন আরও অনেকে ঐ সময় নির্দোষ থেকেও খুন হয়েছেন। কিন্তু শাসকদের ক্ষেত্রে এসব কার্যকলাপ শুধুমাত্র সফলতার পাতায় লিপিবদ্ধ হয়। আর এই সফলতা নিয়ে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ ৪৪ বছরের শাসনকালের ইতি টানেন প্রথম এলিজাবেথ। রাজপরিবারের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তিনি ঘুমের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে।