গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আমেরিকার জন্য সময় অনেকটা প্রতিকূলে যাচ্ছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের লজ্জাজনক পরিস্থিতির পর চীনের উত্থানে আমেরিকান গোয়েন্দাদের তথ্য সংগ্রহে বিশেষ সুবিধা হচ্ছিল না। ততদিনে চীনও নিজেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে।
১৯৬৪ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় চীনও পারমাণবিক বোমার নাগাল পেয়ে যায়। এতে সবচেয়ে আতঙ্কিত হয় ভারত। যে সময়ে চীনের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র এলো, তার দুই বছর আগেই ঘটে যাওয়া ভারত-চীন যুদ্ধে পরাজয়ের দগদগে ক্ষত সেরে উঠেনি ভারতের। এমন একটা দুঃসময়ে ভারতের সীমান্ত-ঘেঁষা চীনের পারমাণবিক পরীক্ষা ভারতের জন্য যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ ছিল।
অপরদিকে চীনের উত্থান আমেরিকার জন্য ছিল নতুন হুমকি। যে সময়টায় চীন পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালাচ্ছে, তখন পুঁজিবাদের অভিভাবক হিসেবে আমেরিকার কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সমাজতন্ত্রের আঁতুড়ঘর সোভিয়েত রাশিয়া। সোভিয়েত রাশিয়ার হাত ধরে চীনের উত্থান ঘটছে বিশ্ব-রাজনীতিতে, এটা আমেরিকার পক্ষে হুমকি বৈকি।
ষাটের দশকের শুরুতেই আমেরিকা বিভিন্ন গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে জানতে পারে, চীন সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় পারমাণবিক বোমা বানানোর ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। সিআইএ’র একটি তার-বার্তায় জানা যায়, ১৯৫৯ সালের অক্টোবরেই চীন লোপ নরে (সীমান্তবর্তী বিরান এলাকা) নিউক্লিয়ার টেস্ট বেস স্থাপন করে। উদ্দেশ্য নিউক্লিয়ার ডিভাইসের পরীক্ষা চালানো। নজরদারি চালানোর জন্য চীনের উপর দিয়ে ইউ-টু বিমানের ফ্লাইট বেশ বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। তাই তারা চিন্তা করে, যদি হিমালয় পর্বতমালার কোনো একটার উপর নজরদারি চালানোর যন্ত্র স্থাপন করা যায়, তাহলে অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব। কোন পাহাড়ে যন্ত্র স্থাপিত হবে, তা নির্ভর করবে পাহাড়ের উচ্চতার উপর।
রাজনীতি ও ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে আমেরিকা ও ভারত দুই দেশের কাছেই চীনের এই পারমাণবিক পরীক্ষা নজরদারির মধ্যে আনার তাড়া ছিল। এ লক্ষ্যে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়। অনেক চিন্তাভাবনা, তর্ক-বিতর্কের পর সেই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন সিআইএ’কে গোপন মিশন চালানোর অনুমতি দেন। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থের দিকটি বড় করে দেখা হয়।
চীনের উপর নজরদারির আরেকটি উপায় ছিল। স্যাটেলাইট। এরকম যন্ত্র দিয়ে অনেক উপর থেকে নজরদারিতে আমেরিকা বেশ দক্ষ। কিন্তু স্নায়ু যুদ্ধের সে সময়ে আমেরিকার প্রায় সব উন্নত স্যাটেলাইটই সোভিয়েত রাশিয়ার উপর মোতায়েন করা ছিল। যেসব স্যাটেলাইট বাকি ছিল আমেরিকার হাতে, সেসব দিয়ে আদতে চীনের উপর পূর্ণ নজরদারি চালানো সম্ভব হতো না। তাই নজরদারি চালানোর মতো যন্ত্র পর্বতে স্থাপন করার পক্ষেই ছিল মার্কিন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা।
নন্দ দেবী পর্বতের চূড়াকে নির্ধারণ করা হয়। সেই পর্বত যেখান থেকে বিখ্যাত গঙ্গা নদীর উৎপত্তি ঘটেছে। স্থানীয়দের কাছে এ পাহাড় খুবই পবিত্র স্থান হিসেবে পরিগণিত। এই স্থানটির ভৌগলিক গুরুত্বও অনেক। নন্দ দেবী পাহাড়ের উত্তরে চীন, দক্ষিণে ভারত এবং পশ্চিমে পাকিস্তান। এখান থেকে চীনের পারমাণবিক মিসাইল পরীক্ষার ঘাঁটিও খুব বেশি দূরে নয়। এখান থেকে নজরদারি চালানোতে বেশি বেগ পেতে হবে না। চীনা গোয়েন্দারা এত দুর্গম অঞ্চল থেকে তাদের উপর কেউ নজরদারি চালাতে পারে– এটি মাথায়ও আনবে না। তাই সবদিক বিবেচনা করে নন্দ দেবী ছিল নজরদারি চালানোর ডিভাইস স্থাপনের একেবারে যুতসই জায়গা।
পরিবেশগত কিছু সমস্যা ছিল। এ পর্বত ভারতের সবচেয়ে উঁচু পর্বতগুলোর মধ্যে একটি। এখানে তাপমাত্রা খুবই কম। আর তুষার-ঝড়ের ভয় তো আছেই৷ চূড়ায় উঠা বেশ কষ্টকরই বটে।
ভারতের তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’কে দায়িত্ব দেওয়া হয় মিশন বাস্তবায়নের জন্য। ভারতের চার জন ও আমেরিকার নয় জন– মোট তেরো জন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পর্বতারোহী নিয়ে নজরদারির ডিভাইস স্থাপনের জন্য টিম গঠন করা হয়। অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতের ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং কোহলিকে। ক্যাপ্টেন এমএস কোহলি বাদ দিয়ে বাকি সদস্যদের পরিচয় কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়।
দুই দেশের সদস্যদের নিয়ে গড়া এই টিমকে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকার আলাস্কায়। সেখানে বিশ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতার ম্যাককিনলি পাহাড়ে ‘গা গরম’ করার পর তাদেরকে চূড়ান্ত মিশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
নন্দ দেবীতে আরোহণ করা সহজ নয়। পৃথিবীর অন্যতম খাড়া পর্বতগুলোর মধ্যে একটি হওয়ায় এখানে অত্যন্ত অভিজ্ঞ পর্বতারোহীদেরও চূড়ায় আরোহণে ব্যর্থতার উদাহরণ আছে ভুরি ভুরি।
নজরদারি চালানোর যে ডিভাইস, সেটির মোট ভর ছিল ৫৬ কেজি। ৮-১০ ফুট উচ্চতার একটি এন্টেনাও ছিল এর সাথে। আরো ছিল দুটি ট্রান্সিভার সেট।
মূলত পুরো ডিভাইসটি আদতে একটি সেন্সর ছিল, যেগুলো পারমাণবিক মিসাইল পরীক্ষার পর ভেসে আসা ওয়েভগুলো ধরতে পারবে। আর সেন্সরটিতে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি সরবরাহের জন্য নিউক্লিয়ার জেনারেটর (SNAP) তৈরি করে রাখা হয়েছিল। জেনারেটরে প্লুটোনিয়াম-২৩৮ এর নিউক্লিয়ার ক্যাপসুল ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা ছিল। পারমাণবিক পরীক্ষার ফলে উদ্ভূত ‘রেডিও টেলিমেট্রি সিগন্যাল’ ধরার সক্ষমতা ছিল ডিভাইসটির। আমেরিকার ও ভারতের যৌথভাবে মূলত সেটিই দরকার ছিল।
১৯৬৫ সালের ১৮ই অক্টোবর মিশন শুরু হয়। কিন্তু অভিযাত্রী গোয়েন্দা দলের ভাগ্য খারাপ। প্রায় পনেরো শ’ ফুট বাকি থাকতেই ক্যাপ্টেন এমএস কোহলির টিম যেখানে ক্যাম্প করেছিল, সেখানে ভয়াবহ তুষাড়ঝড় শুরু হয় এবং অক্সিজেনের স্তর নিচে নেমে যায়। পর্বতারোহী টিমের পুরো পরিকল্পনা ধাক্কা খায় প্রকৃতির এহেন নির্মম আচরণে।
প্রতিটি মুহূর্তেই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে আসছিল। পর্বতারোহী টিমের ক্যাপ্টেন এমএস কোহলির সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল– হয় পুরো টিমের এখানে অবস্থান করা অব্যাহত রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে, নতুবা ফিরে যেতে হবে বেস-ক্যাম্পে। ক্যাপ্টেন এমএস কোহলি পুরো টিমকে নিয়ে বেস-ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ফিরে আসার সময় নিউক্লিয়ার জেনারেটর ও সেন্সর-সমেত পুরো ডিভাইসটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল ঝড়ো আবহাওয়া শেষ হওয়ার পর পুনরায় আরোহণের পর সেন্সর ও স্ন্যাপ জেনারেটর খুঁজে কাজ শুরু করবেন।
১৯৬৬ সালের বসন্তে পুনরায় মিশন শুরু করা হয়। এবার ঘটে যায় আরেক ঘটনা। টিম কোনোভাবেই সেই সেন্সর ও নিউক্লিয়ার জেনারেটর খুঁজে পাচ্ছিল না। বরফের স্তরের নিচে কোথায় সেই সেন্সর ও জেনারেটর আছে, তা শত চেষ্টার পরও পাওয়া যায়নি। সেই তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম-২৩৮ সমৃদ্ধ জেনারেটর ও সেন্সর খোঁজার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও অভিযান চালানো হয়েছে, কিন্তু কোনো কুল-কিনারা পাওয়া যায়নি।
পরে ১৯৬৮ সালে নন্দ দেবী পর্বতের পাশেই নন্দ কোট পর্বতে আবার মিশন পরিচালনা করা হয়েছিল আমেরিকা-ভারত যৌথ উদ্যোগে। কিন্তু এবার আর আগের মতো ভুল হয়নি। নজরদারির ডিভাইস বসানো হয়েছে, সিগন্যাল পাওয়া গেছে, আবার কাজ শেষে ডিভাইস সরিয়েও নেয়া হয়েছে।