আমাদের সমাজের অত্যন্ত পরিচিত একজন ব্যক্তি হলেন সাদা রঙের এপ্রন গায়ে জড়ানো একজন ডাক্তার। রাত-দিন নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে মানবসেবা করে যাওয়া এ ডাক্তার সম্প্রদায় আসলেই মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা পাওয়ার দাবিদার। ওদিকে চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে নিজেদের জীবনকে রঙিন করে সাজানোর স্বপ্নে বিভোর একদল ছেলে-মেয়ে বের হয় ‘ব্যাচেলর’ নামে একটি ডিগ্রি নিয়ে। এই ডিগ্রি অর্জনের জন্য চারটি বছর ধরে তাকে যে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেটাও কোনো অংশে কম নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- ডাক্তারদের এপ্রন সাদা রঙের হলো কেন? কেন তা ‘বেনিআসহকলা’র অন্য কোনো রংকে বেছে নিলো না? আর চার বছরের পরিশ্রমের ফসল এই ডিগ্রিকে কেন ‘ব্যাচেলর’ নামই দিতে হবে? আর কোনো কি সুন্দর নাম ছিলো না? এই প্রশ্নগুলোর পেছনের চমৎকার ইতিহাস নিয়েই আজ গল্প করবো আমরা।
ডাক্তারদের এপ্রন সাদা রঙের হলো কেন?
এর পেছনে ডাক্তারদের নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বেশ চমৎকার এক ইতিহাস আছে। এজন্য আমাদের চোখ ফেরাতে হবে প্রায় শত বর্ষের আগেকার পৃথিবীর দিকে।
তখনকার সময়ের চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনকার ধারেকাছেও ছিলো না। ওষুধ প্রস্তুতির ব্যাপারটাকে অনেকেই তখন দেখতো কিছু হাতুড়ে ডাক্তার ও প্রতারকদের ব্যবসা হিসেবেই। এজন্য ডাক্তাররাও সাধারণ পোষাক পরেই চিকিৎসা সংক্রান্ত তাদের যাবতীয় কাজ সারতেন। মেডিকেল ডিগ্রি পেতে তখন সময় লাগতো মাত্র এক বছরের মতো। আর সেই এক বছরে তাদের সিলেবাসও মানসম্মত চিকিৎসা দেয়ার জন্য খুব একটা গোছানো ছিলো না।
তবে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে এসে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রম উন্নতি ডাক্তারদের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোকে শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয়া শুরু করে। আগেকার আমলের ওষুধপত্র, চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা হাস্যকর ও অবৈজ্ঞানিক ছিলো তা নিয়ে কিছু লেখা লিখেছিলাম। সেখান থেকে অনেকেরই সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পাবার কথা। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ডাক্তারদের চিরচেনা পরিবেশকে বদলাতে শুরু করে, তাদের যেন নিয়ে যেতে থাকে অন্যরকম এক সূর্যোদয়ের দিকে।
ডাক্তারদের কাজকর্মের সাথে যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংশ্লিষ্ট, তাদের সিদ্ধান্তগুলোও যে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় এটা বোঝাতেই তারা তখন বেছে নেন ল্যাবরেটরির কোটকে। এটা যেন ছিলো তাদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠারই এক পোশাকি রুপ। তখন ল্যাবরেটরি কোটগুলো মূলত ধূসর বর্ণের হলেও ডাক্তাররা এটাকে কিছুটা বদলে বেছে নেন সাদাকে। কারণ সাদা রঙ সর্বদাই পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। আবার এটা একদিকে যেমন জীবাণুমুক্ত একটি পরিবেশকে বোঝায়, তেমনি তা রোগীদের মনেও ছড়িয়ে দিতো প্রশান্তির ছোঁয়া। রোগীরা এটা ভেবে শান্তি পেতেন যে, তাদের চিকিৎসা এখন বিজ্ঞান্সম্মতভাবেই হচ্ছে যে বিজ্ঞানের জয়জয়কার এখন সবদিকে।
এভাবেই একসময় সাধারণ পোষাকধারী ডাক্তাররা তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য গায়ে তুলে নিয়েছিলেন সাদা এপ্রনকে, প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেদের কাজকর্মের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির সত্যতা।
ডিগ্রির নাম কেন হলো ‘ব্যাচেলর’?
‘ব্যাচেলর’ শব্দটি শুনলে আমাদের মানসপটে অবধারিতভাবেই চব্বিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবকের ছবি ভেসে ওঠে। হতে পারে সে চাকরির সন্ধানে জুতোর তলা ক্ষয় করছে নিজের বাবা-মা আর ছোট ভাই-বোনদের মুখে একটু অকৃত্রিম হাসি দেখার আশায়, হয়তো সে নিজেকে প্রস্তুত করছে বেলা বোসকে নিয়ে সুন্দর একটা ঘর সাজাবার স্বপ্নে কিংবা সে নিজেকে আরো যোগ্য করে গড়ে তুলছে ভবিষ্যতের জীবন সংগ্রামে দক্ষ যোদ্ধা হয়ে ওঠার দুর্দমনীয় বাসনায়।
তাহলে বারো বছরের স্কুল জীবন, দুই বছরের কলেজ জীবন আর চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে প্রাপ্ত ডিগ্রিটাকে কেন ‘ব্যাচেলর’ নাম দিতে হবে? ছাত্রজীবনে বিয়ে করা ছেলেটি যেমন পাস করে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাচ্ছে, তেমনই একই ডিগ্রি পাচ্ছে অবিবাহিত ছেলেটাও! এখন তাহলে এই ‘ব্যাচেলর’ ডিগ্রির পেছনের ইতিহাসই একটু জানা যাক, বোঝা যাক এর এমন বিচিত্র নামের পেছনের রহস্য।
মধ্যযুগীয় সময়কালের আগে ব্যাচেলর ডিগ্রি নামে কোনো ডিগ্রির অস্তিত্বই ছিলো না। কিন্তু এ দৃশ্যপট বদলে যায় মধ্যযুগে এসে। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা তিন থেকে চার বছর মেয়াদী লিবারেল আর্টসের বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হতো। সেখানে তারা পড়াশোনা করতো ট্রিভিয়াম (ব্যাকরণ, অলঙ্কার শাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যা) কিংবা কোয়াড্রিভিয়াম (অঙ্কশাস্ত্র, জ্যামিতি, সঙ্গীত ও জ্যোতির্বিদ্যা) নিয়ে। তিন বা চার বছর শেষে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তারা যে ডিগ্রি অর্জন করতো সেটাকে বলা হতো ‘ব্যাচেলর অফ আর্টস’। এই ব্যাচেলর শব্দটি এসেছিলো ল্যাটিন ‘baccalaureus’ থেকে যার অর্থ ‘তরুণ নাইট বা বীরযোদ্ধা’।
এবার তাহলে ব্যাচেলরের ল্যাটিন মূলের দিকেই একটু নজর দেয়া যাক। ব্যাচেলর শব্দটির সাথে বেশ ভালো যোগসূত্র রয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘baccalaria’র, যার অর্থ ‘ভূমির অংশ’। এককালে ‘baccalarius’ ও ‘baccalaria’ শব্দযুগল দ্বারা প্রধানত পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের বোঝানো হতো যারা কোনো জমিতে কাজ করে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে আরো অন্যান্য কাজেও জড়াতে থাকে। ফলস্বরুপ দক্ষতার ভিত্তিতে সমাজে বিভিন্ন রকমের কাজের উদ্ভব ঘটতে শুরু করে। একই সাথে অর্থের বিবর্তন ঘটে উপরের দুইটি শব্দের অর্থেরও।
তের শতকের দিকে এসে ব্যাচেলর শব্দটি ল্যাটিন ও ইংলিশ উভয় ক্ষেত্রেই ‘তরুণ নাইট’কে বোঝাতে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। তবে আগের মতো সেই ‘baccalarius’ বা ‘baccalaria’ না লিখে বরং ফরাসী বানান ‘bacheler’-কে বেছে নেয়া হয় তখন। আস্তে আস্তে দিন, মাস, বছর করে সময় পেরিয়ে যেতে থাকে।
চৌদ্দ শতকে এসে ব্যাচেলর শব্দটির অর্থে আরেকটু পরিবর্তন আসে। তখন কেবল নাইটদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে নি শব্দটি। বরঞ্চ কোনো সমবায় সংঘ কিংবা নাইটদলের অপেক্ষাকৃত নবীন সদস্যদের বোঝাতে ব্যাচেলর শব্দটি ব্যবহৃত হতো তখন। এর কাছাকাছি সময়েই ঘটে যায় আরেকটি মজার ব্যাপার। ‘bacheler’ এর কাছাকাছি বানানের ‘bachiler’ তখন প্রচলিত হতে শুরু করে যার অর্থ ছিলো ‘একজন শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থী’ কিংবা ‘প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা একজন শিক্ষার্থী’।
এই ‘bachiler’ এসে আগের হিসেবগুলো পাল্টে দিলো। আগে যেখানে ব্যাচেলরের অর্থ কেবল তরুণ নাইটের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, ‘bachiler’ সেটাকে বানিয়ে ছাড়লো ‘একজন তরুণ যে কিনা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নিজের জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটাতে শিক্ষানবীশ হিসেবে কোনো নাইট বা জ্ঞানী ব্যক্তির অধীনে কাজ করছে’।
এই ‘bachiler’-রা নবীন হওয়ার কারণে সবাই ধরেই নিতো যে, সেই বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতা খুব বেশি একটা না। কেবলই সে এই বিষয়ে ভিত গড়ে নেয়ার মতো কিছু শিখেছে, তবে সামনে তাকে শিখতে হবে আরো অনেক কিছুই! আচ্ছা, চার বছর শেষে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাওয়ার পরে আমাদের অধিকাংশেরই কি এই একই অনুভূতি কাজ করে না? আমরা তখন বুঝতে শিখি যে, চার বছরে মাত্র হামাগুড়ি থেকে একটু একটু করে হাঁটতে শিখেছি আমরা। তবে জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধি করতে হলে যেতে হবে বহুদূর!
এখন তাহলে প্রশ্ন আসবে, ব্যাচেলর ডিগ্রির সাথে যে তরুণ শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আছে তা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু অবিবাহিত পুরুষকে বোঝাতে তাহলে কেন এই একই শব্দ ব্যবহার করা হয়?
এখানেও কিন্তু সেই যুদ্ধবিদ্যার দিকেই যেতে হবে। তখনকার দিনে যাকে ব্যাচেলর উপাধি দেয়া হতো, সে থাকতো বয়সে তরুণ, জ্ঞানের দৌড়ও তার খুব বেশি থাকতো না। তরুণ এ ব্যাচেলরের তাই নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করতে হতো। এটা করতে গিয়ে সে যেমন অন্যকিছু নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনার সময় পেতো না, তেমনই উপযুক্ত চাকরির অভাবে তার হাতে অর্থকড়িও তেমন একটা থাকতো না। তাই বিয়ে করার চিন্তা তাকে তখনকার মতো স্থগিতই রাখতে হতো।
কী অদ্ভুত মিল! তাই না? কারণ পড়াশোনা শেষ করে ব্যাচেলর ডিগ্রিটা কপালে জুটলেও আমাদের থাকে না তেমন অভিজ্ঞতা। চাকরির বাজারে গিয়ে দেখা যায় তারা এত অভিজ্ঞ লোক খুঁজছে যে নিজেদের মান বাঁচানোই দায়। মাঝে মাঝে তো কেউ আক্ষেপ করে বলে, “যেমনে অভিজ্ঞতা চাইতেছে, তাতে তো মনে হয় দুনিয়ায় আইসাই চাকরিতে ঢোকা দরকার ছিলো!” সবাই তখন ব্যস্ত থাকে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার কাজেই। আবার যারা চাকরিতে ঢুকে যায়, তাদের বেতনও শুরুর দিকে নিজের পরিবার সামলে আবার বিয়ে করে নতুন সংসার চালানোর মতো হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অর্থাৎ সে হয়ে যায় ব্যাচেলর!
অবশেষে অনেক পথ পেরিয়ে আঠারো শতকে এসে বানানটি রুপ নেয় আমাদের আজকের পরিচিত ‘Bachelor’-এ।