নোলার তৃতীয় যুদ্ধ (২১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
ক্যাম্পানিয়াতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে নোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল হ্যানিবালের কাছে। তার আরো একবার তিনি নোলা দখলের চেষ্টা করলেন। প্রতিপক্ষ সেই মার্সেলাস। নেপলসের আশেপাশে তাণ্ডব চালিয়ে হ্যানিবাল আবার নোলার থেকে একটু দূরে এসে ঘাঁটি গাড়লেন। মার্সেলাস সুয়েসালা থেকে রোমান সেনাদলকে নোলায় ডেকে নিলেন। তিনি গাইয়াস ক্লডিয়াস নিরো নামে এক অশ্বারোহী কমান্ডারকে কিছু সেনাসহ রাতের আঁধারে শহর থেকে বের করে দিলেন। তাদের কাজ ছিল ঘুরপথে কার্থেজিনিয়ান বাহিনীর পেছনে চলে যাওয়া। নিরোর উপর নির্দেশ ছিল তাদেরকে নীরবে অনুসরণ করা এবং যুদ্ধ শুরু হলে পেছন দিক থেকে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।
যেকোনো কারণেই হোক, নিরো এক সময় হ্যানিবালকে হারিয়ে ফেললেন। তাকে ছাড়াই মার্সেলাস হ্যানিবালকে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হন। লিভির মতে, রোমান ৪০০ হতাহতের বিপরীতে কার্থেজ হারিয়েছিল দুই হাজারের বেশি সেনা। পরদিন হ্যানিবাল ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যান, তিনি আর কখনো নোলা দখলের চেষ্টা করেননি।
ক্যাসিলিনাম পুনর্দখল (২১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
নোলাতে রোমান সেনাদলের একটি অংশ রেখে মার্সেলাস কন্সাল ফ্যাবিয়াসের সাথে এসে মিলিত হন। উদ্দেশ্য ছিল কার্থেজের কাছ থেকে ক্যাসিলিনাম পুনরুদ্ধার করা। শহরে তখন প্রায় ৩,০০০ কার্থেজিনিয়ান সেনার একটি গ্যারিসন ছিল। তারা শহর প্রতিরক্ষার চেষ্টা করে। অধিবাসীদের একাংশ ফ্যাবিয়াসের কাছে তাদের নিরাপদে চলে যেতে দেয়ার আবেদন করে। এজন্য শহরের দরজা খুলে দিলে মার্সেলাস সেখান দিয়ে আক্রমণ করেন। রোমান সেনাবাহিনী প্রচুর লোককে হত্যা করে এবং গ্যারিসনের সেনাদের অনেককে বন্দি করে রোমে পাঠিয়ে দেয়। ক্যাসিলিনাম হ্যানিবালের হাত থেকে ফস্কে গেল।
বেনেভেন্টামের প্রথম যুদ্ধ (২১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
হ্যানিবালের নির্দেশে কার্থেজিনিয়ান কমান্ডার হ্যানো ১৭,০০০ পদাতিক ও ১,৫০০ অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে তার সাথে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। স্যামনিয়ামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তার পথে পড়ত বেনেভেন্টাম। এখানে গ্র্যাকাসের নেতৃত্বে রোমান সেনাদল তার আগেই এসে আস্তানা গাড়ল।
গ্র্যাকাসের বাহিনীর এক বড় অংশই ছিল দাস স্বেচ্ছাসেবক। তাদের রোম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে দুই বছর পর দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়ার। এর মধ্যে এক বছর পার হয়ে গিয়েছিল। গ্র্যাকাস রোমান সিনেটের সাথে আলোচনা করে তাদের কথা দিলেন, তারা যদি হ্যানোর বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে তাহলে সবাইকে মুক্তি দিয়ে দেয়া হবে।
বেনেভেন্টামের বাইরে দুই বাহিনী লড়াই শুরু করল। প্রায় চার ঘণ্টা তীব্র লড়াইতেও কেউ কাউকে পিছু হটাতে পারছিল না। গ্র্যাকাস তার অশ্বারোহী বাহিনীকে চার্জ করার আদেশ দিলেন। বিপরীতে নুমিডিয়ান বাহিনী হঠকারীভাবে তাদের মোকাবেলা করল। যুদ্ধের এই পর্যায়ে দুই জেনারেল সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন। গ্র্যাকাসের উৎসাহে রোমানরা এত তীব্রভাবে কার্থেজিনিয়ানদের আক্রমণ করল যে, তাদের ব্যুহ ভেঙে পড়ল। মাত্র ২,০০০ এর মতো যোদ্ধা নিয়ে হ্যানো পালিয়ে যেতে পারলেন।
সিসিলির যুদ্ধ (২১৪-২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
লিওন্টিনা (২১৪): দ্বিতীয় হিয়েরোর মৃত্যুর পর সিরাকিউজ কার্থেজের পক্ষাবলম্বন করে। কার্থেজিনিয়ান দুই ভাই হিপোক্র্যাটিস ও এপিসাইডেস সিরাকিউজে এসে পৌঁছেন। তারা সিরাকিউজের নাবালক রাজা হায়ারোনিমাসের উপদেষ্টা পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
২১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হায়ারোনিমাস আততায়ীর হাতে নিহত হন। এসময় সিরাকিউজের অধীন লিওন্টিনি শহরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে হিপোক্র্যাটিস ও এপিসাইডেস কিছু সেনা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং একে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। এখান থেকে তারা রোমের অধীনস্থ অঞ্চলে ছোট ছোট হামলা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে হিপোক্র্যাটিস রোমের একটি ঘাঁটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন, অনেক রোমান সেনা নিহত হয়।
মার্সেলাস সিরাকিউজের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করলে তারা তাকে অবহিত করে যে লিওন্টিনির উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তখন মার্সেলাস ঝটিকা আক্রমণ করে শহর দখল করে নেন। হিপোক্র্যাটিস ও এপিসাইডেস পালিয়ে সিরাকিউজে চলে যান।
সিরাকিউজ (২১৩-১২): মার্সেলাস আর ক্লডিয়াস পুলচার সিরাকিউজ অবরোধ করলেন। প্রথমে মার্সেলাস সরাসরি শহর আক্রমণের প্ল্যান করলেন। সেই অনুযায়ী সাগরপথে তিনি আর স্থলপথে পুলচার হামলা চালালেন। কিন্তু সিরাকিউজের ছিল অনন্য এক সম্পদ- বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস। তার উদ্ভাবিত ক্যাটাপুল্ট ও অন্যান্য যন্ত্রের বদৌলতে সিরাকিউজ রোমান আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিল। হতাশ মার্সেলাস এবার অবরোধের মাধ্যমে শহর দখলের পরিকল্পনা করলেন।
এদিকে কার্থেজিনিয়ান জেনারেল হিমিলকো ২০,০০০ পদাতিক ও ৩,০০০ অশ্বারোহী এবং সাথে ১২ টি হাতি নিয়ে সিসিলিতে অবতরণ করলেন। আশেপাশের বেশকিছু শহর তিনি দখল করে নিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অ্যাগ্রিগেন্টাম। মার্সেলাস নিজে অ্যাগ্রিগেন্টামের দিকে কিছু সেনা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে অ্যাগ্রিগেন্টাম পুনর্দখল সম্ভব নয় বুঝে আবার ফিরে আসতে লাগলেন।
এদিকে হিপোক্র্যাটিস চুপিসারে সিরাকিউজ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন হিমিলকো সাথে যোগ দেবেন বলে। কিন্তু মার্সেলাস তাকে রাস্তায় অসতর্ক অবস্থায় পেয়ে গেলেন। হিপোক্র্যাটিস পালিয়ে যেতে পারলেও তার বাহিনীর বেশিরভাগ সেনাই নিহত হলো।
হিপোক্র্যাটিস ও হিমিলকো যৌথভাবে সিরাকিউজের দিকে যাত্রা করলেন। এই সময় কার্থেজ থেকে ব্রমিলকার ৫৫টি জাহাজ নিয়ে সিরাকিউজের বন্দরে এসে ভিড়লেন। রোম থেকেও মার্সেলাসের কাছে আরো সেনা এসে পৌঁছল। এই পরিস্থিতিতে হিমিলকো সিরাকিউজে না গিয়ে সিসিলির অন্যান্য শহর দখল করার চেষ্টা শুরু করেন। ব্রমিলকারও পিছিয়ে যান। তারপরেও সিরাকিউজ টিকে ছিল।
২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মার্সেলাস সিরাকিউজ থেকে মেসিডোনিয়ায় প্রেরিত এক দূতকে আটক করেন। এপিসাইডেস তাকে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়ানোর প্রস্তাব দেন। নগরে রোমান প্রতিনিধিদল ও এপিসাইডেসের মধ্যে আলোচনা চলাকালে এক রোমান লক্ষ্য করেন, নগর রক্ষাকারী দেয়াল একাংশে একটু নিচু এবং সেখান দিয়ে মই বেয়ে দেয়ালে উঠে পড়া সম্ভব।
মার্সেলাস উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। সেই সুযোগ এলো যখন সিরাকিউজের অধিবাসীরা বার্ষিক এক উৎসবে মত্ত। উৎসবের ডামাডোলের মধ্যে রোমান বাহিনী প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সন্তর্পণে শহরে প্রবেশ করে। তারপরেও শহর দখল করতে মার্সেলাসের অনেক সময় লেগে যায়। এর মধ্যে ব্রমিলকার ফিরে এলেও মার্সেলাসের নৌবাহিনীর তারা খেয়ে পালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত সিরাকিউজ রোমানদের পদানত হয়।
বেনেভেন্টামের দ্বিতীয় যুদ্ধ (২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)
২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাপুয়ান প্রতিনিধিরা হ্যানিবালের সাহায্য প্রার্থনা করে। কুইন্টাস ফ্ল্যাকাস ও অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াসের নেতৃত্বে রোমান বাহিনী তাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, যার ফলে কাপুয়ার খাদ্য সরবরাহ প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।
হ্যানিবাল তার কম্যান্ডার হ্যানোকে কাপুয়ানদের জন্য খাদ্য জোগাড়ের দায়িত্ব দিলেন। হ্যানো বেনেভেন্টামের কাছাকাছি শিবির করে খাবারের বন্দোবস্ত করলেন। এই খবর বেনেভেন্টাম থেকে ফ্ল্যাকাসের কাছে পৌঁছল। তিনি তার বাহিনী নিয়ে বেনেভেন্টামে এসে অবস্থান নিলেন।
রাতের আঁধারে ফ্ল্যাকাস কিছু সেনা নিয়ে হ্যানোর ক্যাম্প আক্রমণ করল। কার্থেজিনিয়ানদের ক্যাম্প ছিল উঁচু টিলার উপর, চারদিকের খাড়া পাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে রোমান সেনারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়। ফ্ল্যাকাস এক পর্যায়ে পিছিয়ে যাওয়ার আদেশ দেন। তার ইচ্ছা ছিল আগামী দিন বেনেভেন্টাম থেকে পূর্ণ বাহিনী নিয়ে হামলা চালান। কিন্তু বেশ কিছু সেনা এই আদেশ না মেনে আক্রমণ জারি রাখে এবং ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে পড়তে সমর্থ হয়। তাদের দেখে বাকি রোমান সেনারাও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ফ্ল্যাকাস তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং সেনাদেরকে হামলা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। শেষ পর্যন্ত রোমানরা হ্যানোর ক্যাম্প ছারখার করে দেয়।
কাপুয়া অবরোধ
কাপুয়ার গুরুত্ব হ্যানিবালের কাছে অনেক। কাজেই তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেলেন। অমীমাংসিত এক দিনের যুদ্ধ শেষে ফ্ল্যাকাস ও ক্লডিয়াস পরিকল্পনা করে দুজন দুদিকে যাত্রা করলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হ্যানিবালকে শহর থেকে বের করে আনা। হ্যানিবাল ক্লডিয়াসকে ধাওয়া করলেন। ছোটখাট কিছু সংঘর্ষে রোমান সেনাদেরকে পরাস্তও করলেন। কিন্তু তাকে ফাঁকি দিয়ে ক্লডিয়াস আর ফ্ল্যাকাস আবার শহর অবরোধ করে বসলেন।
এর মধ্যে আপুলিয়া থেকে সাহায্যের আবেদন এসে পৌঁছল। হ্যানিবাল পরলেন উভয় সংকটে। কোনদিকে যাবেন তিনি? শেষ পর্যন্ত আপুলিয়াতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, যেখানে ফ্ল্যাকাসের ভাই গেনিয়াস ফ্ল্যাকাস ব্যাপক হামলা চালাচ্ছিলেন।
হ্যানিবাল চলে যাবার পরেও কাপুয়া রোমের অবরোধ প্রতিরোধ করে টিকে ছিল। ছোট ছোট সংঘর্ষে কাপুয়ার অশ্বারোহী বাহিনী রোমান ঘোড়সওয়ারদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেখাচ্ছিল। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে ২১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানরা এক অভিনব কৌশল করল। তারা অশ্বারোহী সেনার পিছনে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত আরেকজন সেনাকে বসাল, যার কাজ ছিল নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে প্রতিপক্ষ অশ্বারোহীর দিকে বর্শা ছোড়া। এই কৌশলে রোমানরা কাপুয়ার অশ্বারোহী দলের বিপক্ষে অনেক বিজয় লাভ করে। কাপুয়ার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে দাঁড়াল।
এই পরিস্থিতিতে হ্যানিবাল ফিরে আসলেন। তার বাহিনী একদিক থেকে আর কাপুয়ানরা অন্যদিক থেকে রোমানদের আক্রমণ করল। ফ্ল্যাকাস ও ক্লডিয়াস সেনাদলকে দুই ভাগ করলেন, ফ্ল্যাকাস সম্মুখীন হলেন হ্যানিবালের আর ক্লডিয়াস কাপুয়ানদের।
ক্লডিয়াসের নেতৃত্বে রোমান বাহিনী কাপুয়ানদের পরাজিত করে এবং কার্থেজিনিয়ান সেনাদলের দিকে নজর দেয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের একপর্যায়ে হ্যানিবালের ব্যুহ ভেঙে পড়ে এবং তিনি পিছু হটে যেতে বাধ্য হন। হ্যানিবাল কাপুয়া ত্যাগ করলেন, শহর রোমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। এর অধিকাংশ বাসিন্দাকে হত্যা করা হলো, বাকিদের রোমানরা দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়।