‘নরখাদক’ শব্দটি শুনলেই সবার কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে। মানুষ হয়ে গরু-ছাগল, হাস-মুরগির মতো প্রাণীর মাংস খাওয়া মানা যায়, কিন্তু তা-ই বলে মানুষের মাংস খাওয়া? সেটা কীভাবে সম্ভব?
বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ইতিহাসে এমন ঘটনা বহুবারই ঘটেছে, যখন ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ মানুষকে খুন করে খেয়ে নিয়েছে তার শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এমনকি কখনো কখনো আপন বাবা-মায়ের হাতেই নিহত হয়েছে স্নেহের সন্তান। পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে খুন করেছে, কবর থেকে লাশ পর্যন্ত তুলে খেয়েছে!
ইতিহাসের কিছু দুর্ভিক্ষ, যেগুলো মানুষকে নরখাদক বানিয়ে ছেড়েছিলো, সেসব নিয়ে আলোচনা করতেই আজকের এ লেখা।
১. চীনের দুর্ভিক্ষ
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১, এ তিন বছর ছিলো চীনের ইতিহাসে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময়। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মারা যাচ্ছিলো সেখানকার কোটি কোটি মানুষ। খরা, খারাপ আবহাওয়ার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন অদূরদর্শী নীতিকেও দায়ী করা হয় এর পেছনে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলো প্রায় দেড় কোটি মানুষ। তবে ইতিহাসবিদ ফ্রাঙ্ক ডিকোটারের মতে এ সংখ্যাটা সাড়ে চার কোটির কম হবে না।
জনগণের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘দুর্ভিক্ষ’ লিখতে মানা করা হয়েছিলো চিকিৎসকদের। য়ু দেহং নামে একজন তখনকার পরিস্থিতি স্মরণ করে বলেছেন, “আমি একটি গ্রামে গিয়ে ১০০ মৃতদেহ দেখতে পেলাম। এরপর আরেকটি গ্রামে গিয়েও ১০০টি মৃতদেহ দেখতে পেলাম। কেউই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছিলো না। লোকে বলছিলো, কুকুরেরা সেগুলো খাচ্ছে। আমি বললাম, এটা সত্য না। মানুষেরা অনেক আগেই কুকুরদের খেয়ে ফেলেছে!”
মারাত্মক ক্ষুধার জ্বালায় সমাজের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিলো। মানুষ তখন হন্য হয়ে মাংসের জন্য ঘুরে বেড়াতো, মানুষের মাংস। চীনের সেই মহা দুর্ভিক্ষের সময় নরমাংস ভক্ষণের বেশ কিছু রিপোর্টই পাওয়া যায়। কেউ কেউ ক্ষুধার জ্বালায় তাদের সন্তানদের খেতো। কেউ আবার আপন সন্তানকে হত্যা করতে না পেরে তাদেরকে বিনিময় করতো অন্য কারো সন্তানের সাথে। তারপর তারা খেতো অপরের সন্তানকে। নিজের সন্তানকে খেতে পারবে না বলেই এমন অদ্ভুত বিনিময় প্রথা!
২. রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ
১৯১৭ সালে বলশেভিক রেড আর্মি ও হোয়াইট আর্মির মাঝে যুদ্ধের মাঝ দিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় রাশিয়ায়। রাজনৈতিক সহিংসতা, নৃশংসতা, অর্থনৈতিক দৈন্যের প্রভাবে ধীরে ধীরে দেশের অনেক জায়গায় অসুখের প্রকোপ বাড়তে থাকে, দেখা দিতে থাকে চরম খাদ্য সঙ্কট। ১৯২২ সালের শেষের দিকে যখন এ দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটে, ততদিনে ভলগা ও উরাল নদীর কাছাকাছি অঞ্চলগুলোয় খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলো প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ।
শুধুমাত্র দু’মুঠো খাবারের জন্য তখন মানুষ যা করেছিলো তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। ঘাস, ময়লা-আবর্জনা, পোকামাকড়, কাদামাটি, কুকুর, বিড়াল, মৃত প্রাণীর শবদেহ, এমনকি মানুষের মাংসও খেয়েছে অনেকে। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের খেয়েছে, শিকার করেছে মানুষের মাংস! পুলিশের কাছে যখন এগুলোর রিপোর্ট যেত, তখন তারাও কোনো ব্যবস্থা নিত না। কারণ তখন মানুষের মাংস খাওয়াকে দেখা হচ্ছিলো বেঁচে থাকার একটি উপায় হিসেবেই। একবার এক মহিলাকে মানুষের সিদ্ধ মাংস সহ পাকড়াও করা হয়। পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করেন যে এটি তার মেয়ের মাংস!
মানুষজন কবর খুঁড়ে লাশ খাওয়া পর্যন্ত শুরু করতে চেয়েছিলো। তাদেরকে ঠেকাতে কবরস্থানের চারদিকে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কালো বাজারে গোপনে বিক্রি হতো মানবদেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। জেলের বন্দীদের মাঝেও নরমাংস ভোজের বাতিক দেখা দিয়েছিলো।
৩. জেমসটাউনের দুর্ভিক্ষ
আমেরিকায় ইংরেজরা প্রথম স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিলো জেমসটাউনে। ১৬০৭ সালের মে মাসে ভার্জিনিয়া কোম্পানি অফ লন্ডনের হাত ধরে এর যাত্রা শুরু হয়। এর বাসিন্দা ছিলো আনুমানিক ৫০০ জন। জেমসটাউনের বাসিন্দারা খাদ্যের জন্য স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের সাথে বিভিন্ন বাণিজ্য করতো। কিন্তু বেশ কিছু সংঘর্ষের পর সেই বাণিজ্য চালিয়ে নেয়া আর সম্ভব হয় নি।
১৬০৯ সালের কথা। জেমসটাউনের বাসিন্দাদের জন্য ‘Sea Venture’ নামের এক জাহাজ খাদ্যের চালান নিয়ে রওয়ানা দেয় ইংল্যান্ড থেকে। কিন্তু পথিমধ্যে বারমুডার কাছে নষ্ট হয়ে যায় জাহাজটি। এতে জেমসটাউনের বাসিন্দাদের জন্য সামনের শীতের হিসেবে খাদ্যের মজুত ছিলো।
একসময় শীতকাল শুরু হলো, কিন্তু ঘরে নেই কোনো খাবার। মারাত্মক খাদ্যাভাবে পড়লো সেখানকার মানুষেরা। শত শত মানুষ মারা যেতে থাকলো। ১৬১০ সালে যখন এ দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটে, তখন ৫০০ থেকে মাত্র ৬০ জন মানুষ বেঁচে ছিলো। আধুনিককালে সেখানকার নানা ধ্বংসাবশেষ পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বেঁচে থাকতে জেমসটাউনের অধিবাসীরাও নরখাদকে পরিণত হয়েছিলো।
মাটি খুঁড়ে একটি লাশ পাওয়া যায় যার হাড়ে আঘাতের চিহ্ন থেকে বোঝা যায় তাকে মাংসের জন্যই জবাই করা হয়েছিলো। একজন নারীর খুলি পাওয়া যায় যার কপাল, মাথার পেছনের অংশ ও ডানদিকে কেউ বেশ জোরে আঘাত করেছিলো। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সম্ভবত মগজ বের করার জন্যই এমনটা করা হয়েছিলো। তবে সেখানে মানুষের মাংস খাওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ হওয়ার ব্যাপারটি শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলা যাচ্ছে না এখনো।
৪. মধ্যযুগের দুর্ভিক্ষ
মধ্যযুগে ইউরোপে দুর্ভিক্ষ ছিলো বেশ সাধারণ একটি ঘটনা। খারাপ ফলন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ব্ল্যাক প্লেগের মতো অসুখ এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতো। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে শুধুমাত্র ব্রিটেনই পঁচানব্বইবার দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে। ১৩৪৮-১৩৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে ব্রিটেনের মানুষের গড় আয়ু ছিলো মাত্র সতের বছরের কাছাকাছি।
১৩১০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী দু’দশকে উত্তর ইউরোপে আবহাওয়ার মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। ফলে ১৩১৫ সালের দিকে খাবারদাবারের দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। এত দাম দিয়ে খাবার কিনতে না পারার ফলে ছড়াতে শুরু করে দুর্ভিক্ষ।
দুর্ভিক্ষের সময়ে সামাজিক কাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। অনেক বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানদের পরিত্যাগ করেছিলো। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বাবা-মায়েরা কখনো তাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, কখনো কখনো জেলের বন্দীরা তাদের সঙ্গীদের খেয়েছে, কখনো আবার কবর থেকে লাশ চুরি করতে গিয়েও ধরা পড়েছে লোকজন।
৫. জিয়াবিয়াঙ্গৌ লেবার ক্যাম্প
১৯৫৭-১৯৬১ সাল পর্যন্ত চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গানসু প্রদেশে ছিলো জিয়াবিয়াঙ্গৌ লেবার ক্যাম্পের অস্তিত্ব। মূলত রাজনৈতিক বন্দীদেরই স্থান হতো এখানে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ক্যাম্পটিতে থাকার ব্যবস্থা ছিলো মাত্র ৪০-৫০ জন্য বন্দীর জন্য, কিন্তু সেখানে রাখা হয়েছিলো আনুমানিক ৩,০০০ বন্দীকে! ১৯৬০ সালে সেই অঞ্চলে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মানুষ নিজেদেরই খাবার যোগাড় করতে পারে না, বন্দীদের দেখার সময় কোথায়? বন্দীরা তাই পড়ে রইলো অযত্নে, অবহেলায়। ক্ষুধার তাড়নায় তারা গাছের পাতা, বাকল, ইঁদুর, প্রাণীদের বর্জ্যপদার্থ, এমনকি শেষপর্যন্ত মানুষকেও খাওয়া শুরু করেছিলো।
১৯৬১ সালের দিকে ৩,০০০ বন্দীর মাঝে বেঁচে ছিলো মাত্র ৫০০ জন। তারাই মূলত নরখাদক হতে বাধ্য হয়েছিলো। বেঁচে থাকা মানুষগুলোর সাক্ষাৎকার নিতে ইয়াং জিয়ানহুই নামে এক লেখক গিয়েছিলেন সেখানে। তার লেখা বই থেকেই মূলত বন্দীদের দুর্দশার কথা জানা যায়।
৬. লেনিনগ্রাদ অবরোধ
১৯৪১ সালের জুন মাসের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের মধ্য দিয়ে নাৎসি বাহিনী অপারেশন বারবারোসার সূচনা ঘটায়। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিলো একে একে লেনিনগ্রাদ, দোনেৎস্ক বেসিন ও মস্কোর দখল নেয়া। ফিনিশ আর্মির সহযোগিতায় তারা লেনিনগ্রাদকে ঘিরে ফেলে। ৮৭২ দিন ধরে চলে সেই অবরোধ। লেনিনগ্রাদে যেন কোনোপ্রকার খাবারের সরবরাহ পৌঁছতে না পারে, সেজন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয় নাৎসি বাহিনী।
খাদ্য, পানীয়, কোনো রকম শক্তির উৎস ছাড়া খুব মানবেতর জীবনযাপন করতে শুরু করে লেনিনগ্রাদের জনগণ। অবরোধের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে পনের লক্ষ মানুষ মারা যায়। যুদ্ধের আগে লেনিনগ্রাদে প্রায় ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ বসবাস করতো। যুদ্ধ শেষে সেখানকার মাত্র সাত লক্ষ মানুষই বেঁচে ছিলো।
অবরোধ শুরু হবার কিছুদিন পরই লেনিনগ্রাদের খাবারের হোটেলগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হতে শুরু করে। বিভিন্ন অপরাধী সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করে যাদের মূল কাজই ছিলো খাবার চুরি করা। পেস্ট, চামড়া, পশম, লিপস্টিক, মশলা, ওষুধ- কী খায় নি তারা! বিভিন্ন জায়গায় মানুষ মানুষকে খাওয়ার মতো ঘটনা শোনা যেতে থাকে। পুলিশকে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হয়েছিলো শুধুমাত্র মানুষ মানুষকে খাওয়া ঠেকাতে। নাৎসি বাহিনীর বোমা হামলার ভয় যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো স্বদেশী জনগণের পেটে চালান হবার ভয়ও।
৭. আয়ারল্যান্ডের মহা দুর্ভিক্ষ
১৮৪৫ থেকে ১৮৫২, এ সাত বছর যেন আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। সে সময় দেশটির অধিবাসীরা এক মহা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। আলুর ব্লাইট রোগকেই মূলত এর জন্য দায়ী করা হয়। পাশাপাশি সরকারের নানা ভুল সিদ্ধান্ত এ দুর্ভিক্ষের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় অনেক ইতিহাসবিদ একে গণহত্যা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
দুর্ভিক্ষ কবলিত হয়ে সেখানকার প্রায় দশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের প্রফেসর করম্যাক ও’গ্রাডা সেই দুর্ভিক্ষের সময় নরমাংস ভক্ষণের সুদৃঢ় সম্ভাবনার ব্যাপারে জানান। অনেকগুলো রিপোর্টই তার কাছে এসেছিলো। এর মাঝে একটি ঘটনা ছিলো জন কনোলী নামে এক ব্যক্তিকে নিয়ে, যাকে তার মৃত ছেলের মাংস খেতে দেখা গিয়েছিলো। ১৮৪৯ সালের ২৩ মে এমনই আরেকটি ঘটনার ব্যাপারে জানা যায়। সাগরপাড়ে এক লোকের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে এক লোক সেই মৃতদেহ কেটে যকৃৎ ও হৃৎপিণ্ড বের করে খেয়েছিলো!