১৯৭০ এর দশকে মার্কিন প্রশাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়া ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ছিল রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দুর্নীতিগুলোর একটি। ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট অফিস ভবনে অবস্থিত ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিস থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহের সময় ধরা পড়ে পাঁচ জন। সেই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে বের হয়ে যায় এই কেলেঙ্কারির খবর। ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এই দুর্নীতির দায়ে।
যেখান থেকে শুরু সবকিছুর, ১৯৭২ সালে সেই পাঁচ জনের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটির পেছনের মূল নায়ক ছিলেন ফ্রাঙ্ক উইলস নামের এক সিকিউরিটি গার্ড। তার কৃতিত্বেই ওয়াটারগেট ভবন থেকে ধরা পড়েছিল তারা। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার খুঁটি নড়বড়ে করে দেয়া এই ঘটনা উদঘাটনের অন্যতম নায়ক হিসেবে কী পুরস্কার পেয়েছিলেন উইলস? কেমন কেটেছিল তার বাকি জীবন? আজকের লেখা সেই ট্রাজিক হিরোকে নিয়েই।
ফ্রাঙ্ক উইলসের জন্ম হয়েছিল জর্জিয়ার সাভানায়। শৈশবেই বিচ্ছেদ ঘটেছিল মা বাবার মধ্যে। মা ম্যার্গির কাছে বড় হন উইলস। হাই স্কুল থেকে ড্রপআউট হয়ে যান ইলেভেন গ্রেডে ওঠার পর। এরপর মিশিগানের ব্যাটল ক্রিক থেকে শেখেন ভারী যন্ত্রপাতি চালানোর কাজ। এখান থেকে ডিগ্রি অর্জন করার পর মিশিগানেই ফোর্ড কোম্পানিতে চাকরি পান তিনি। সেখানে যন্ত্রপাতির বিভিন্ন অংশ একসাথে করা অর্থ্যাৎ ‘এসেম্বল’ এর কাজ করতেন উইলস। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার হাঁপানির সমস্যা। অসুস্থতার কারণে এক সময় কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি।
এরপর উইলস চলে যান ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে কয়েকটা হোটেলে কাজ করেন। তারপর চাকরি নেন ওয়াটারগেট হোটেলে, নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে।
১৯৭২ সাল। উইলসের বয়স তখন ২৪। ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সের পাঁচটি ভবনের মধ্যে একটি হল ওয়াটারগেট অফিস ভবন। পটোম্যাক নদীর তীরের এই ভবনে প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ডের দায়িত্ব পালন করছেন উইলস। ভবনের ছয় তলায় তখন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির হেডকোয়ার্টার অবস্থিত ছিল। উইলসের চাকরি নেয়ার এক বছর হয়ে গেছে এর মধ্যে। এই সময়ের মধ্যে গোটা কমপ্লেক্সে একটা চুরির চেষ্টা ছাড়া আর কোনো দুর্ঘটনাই ঘটে নি। তাই তার উপর তেমন একটা কাজের চাপ ছিল না। ওয়াটারগেট ভবন এতই নিরাপদ ভাবা হত, সিকিউরিটি অফিসারেরা তখন ভারি কোনো অস্ত্রও বহন করতেন না।
সে দিন ছিল জুনের ১৭ তারিখ। উইলস নিয়ম মাফিক টহল দিচ্ছেন ওয়াটারগেট অফিস ভবনে। ছয় তলায় সে দিনের প্রথম রাউন্ডের টহল দিতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন একটা দরজার লক ডাক্ট টেপ (এক ধরনের শক্তিশালী টেপ) দিয়ে আটকানো। টেপটা লাগানো আছে এমনভাবে যাতে দরজা বন্ধ করলেও লকটা আটকে না যায়। সেটা দেখে প্রথম বারেই তেমন কিছু ভাবলেন না উইলস।কেবল টেপটা খুলে দিলেন লক থেকে। এরপর আবার চলে গেলেন টহলে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর। পরবর্তী রাউন্ডে আবার সেখানে এলেন উইলস। সেই দরজার দিকে চোখ পড়তেই সতর্ক হয়ে গেলেন তিনি। কারণ লকটাতে আবার লাগানো হয়েছে ডাক্ট টেপ। বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে উইলস দৌড়ে গেলেন ভবনের লবিতে। সেখান থেকে ফোন করলেন সরাসরি পুলিশের কাছে। চলে এল পুলিশ। তথ্য পাচারের যন্ত্রপাতিসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হল ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিস থেকে।
এই ঘটনার পর ফ্রাঙ্ক উইলসের জীবনটাই বদলে যাবার কথা ছিল, কারণ এই গ্রেফতারের তাৎপর্য ছিল বিশাল। কিন্তু সেটা হয় নি। এর আগ পর্যন্ত উইলসের বেতন ছিল সপ্তাহে মাত্র আশি ডলার। এত বড় একটা কাজের পুরস্কার হিসেবে তার বেতন বাড়ানো হয়েছিল কত জানেন? মাত্র আড়াই ডলার! পত্রিকার একটা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, হয়, উইলস এ সময় পদোন্নতিও চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও জোটে নি তার ভাগ্যে।
এদিকে এত অল্প বেতনে জীবনযাপন খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল উইলসের জন্য। আরেকটু বেশি টাকার আশায় এ ঘটনার কিছুদিন পরই ওয়াটারগেটের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। আরেক জায়গায় চাকরি নেন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে। সেখানে কিছু বেশি বেতন পেলেও টানাটানিটা যাচ্ছিল না। কিছু দিন পর সে চাকরিও ছেড়ে দেন তিনি।
উইলসের জীবনের পরবর্তী বিশটা বছর কেটে গেছে বেঁচে থাকার সংগ্রামের চরম হতাশার দিকগুলো দেখতে দেখতে। একটা ভালো চাকরি নিয়ে কোথাও থিতু হতে পারেন নি। হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির জন্য গিয়েছিলেন, তারা তাকে নিতে রাজি হয় নি। উইলসকে চাকরি দিলে সরকারি ফান্ড থেকে অর্থপ্রাপ্তিতে সমস্যা হতে পারে এমন চিন্তা করে তাকে চাকরিটা দিতে চায় নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওয়াশিংটন থেকে আরও কয়েকটা শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন কাজের খোঁজে, কিন্তু বেকারত্বের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে কিছু দিন পরপরই। আর শারীরিক অসুস্থতা তো ছিলই সব সময়। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে একই পদে চাকরি নিয়েছিলেন একবার, সেখানেও টিকতে পারেন নি। কমেডি শিল্পী ডিক গ্রেগরির সাথে কিছু কাজ করেছিলেন, সেটাও বেশি দিন নয়।
কয়েক বছর এভাবে ঘোরাঘুরির পর উইলস তার মায়ের সাথে এসে থাকা শুরু করলেন সাউথ ক্যারোলাইনাতে। মায়ের বয়স হয়েছে তখন, স্ট্রোক করেছিলেন এর আগে। তিনি প্রতি মাসে বীমা কোম্পানির সোশ্যাল সিকিউরিটি চেক থেকে পেতেন সাড়ে চারশ ডলার। সেটা দিয়েই কোনোমতে দিন কাটতে লাগল মা-ছেলের। ১৯৭৯ সালে উইলস একবার দোকান থেকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত হন, জরিমানা করা হয় বিশ ডলার। চার বছর পর আবার তাকে গ্রেফতার করা হয় দোকান থেকে এক জোড়া জুতা চুরির দায়ে, এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। ১৯৯৩ সালে যখন উইলসের মা মারা গেলেন, তখন দারিদ্র্য তাকে এতটাই জর্জরিত করে ফেলেছিল, কবরস্থ করবার জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও ছিল না তার কাছে। তাই মেডিকেলের গবেষণার জন্য দান করে দেন মায়ের লাশ।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির সেই গ্রেফতারের ঘটনার বিশেষ কোনো বর্ষপূর্তির আগে আগেই কেবল উইলসের কথা মনে পড়ত মিডিয়ার লোকজনের। এ নিয়ে রিপোর্ট করা বা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হলে তার বক্তব্য নেয়া- এমন কিছু একটা করেই শেষ। তারপর আবার অনেক দিনের জন্য সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হত তাকে। এক দিন উইলস বলেছিলেন, “সবাই বলে আমি নাকি একজন হিরো, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আমি পাই নি। যে কাজের জন্য আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সেটাই আমি করেছিলাম। কিন্তু আমি এখনও অনুভব করি, এর জন্য কেউ আমাকে কোনো রকম কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতে চাইল না। আমাকে চাকরিতে একটু পদোন্নতিও দেয়া হল না।”
এই কেলেঙ্কারির রহস্য উন্মোচন করা দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইনের ভূমিকা নিয়ে তৈরি করা ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস ম্যান’ সিনেমায় নিজের চরিত্রেই অভিনয় করেন উইলস। ১৯৭২ সালের ১৭ জুন তারিখে রাত ১টা ৪৭ মিনিটে তিনি ফোন করেছিলেন পুলিশকে, এই তথ্যটা লিখে রাখা হয়েছিল যে এন্ট্রি বইয়ের পাতায়, সেটা সংরক্ষিত আছে ন্যাশনাল আর্কাইভে।
উইলসের দিন কাটত বাগানের পরিচর্যা করে। নিয়মিত লাইব্রেরিতে পড়তে যেতেন তিনি। আর নিঃসঙ্গতার সঙ্গী ছিল কেবল তার বিড়ালগুলো। ব্রেইন টিউমার হয়েছিল তার। সেটা সারানোর মত আর্থিক সঙ্গতিও হয়ে ওঠে নি কখনোই। ২০০০ সালে, মাত্র ৫২ বছর বয়সে জর্জিয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান উইলস।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির দায়ে রিচার্ড নিক্সনকে হারাতে হয়েছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদ। আর সেই কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ল যার সাহসী দায়িত্বের কারণে, সেই লোকটির ভাগ্যে জুটেছিল কেবল ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির একটা স্বীকৃতিসূচক পুরস্কার। ঐ অতটুকুই। বাকিটা জীবন তার কেটেছে দারিদ্র্য কতটা ভয়ঙ্কর সেটা উপলব্ধি করতে করতেই।
১৯৯২ সালে, ওয়াটারগেটের ঘটনার বিশ বছর পূর্তিতে এক রিপোর্টার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “সেই ঘটনার দিন থেকে তখন পর্যন্ত জীবনটা যদি আবার কাটাতে দেয়া হয়, ঠিক একই কাজ কি আবার করতেন?” উত্তরে উইলিস বলেছিলেন, “প্রশ্নটা যেন এমন, আমি কৃষ্ণাঙ্গ না হয়ে বরং শ্বেতাঙ্গ হতে চাইতাম কিনা। আরে এমনটা হবে, সেটাই তো ছিল আমার ভাগ্যের লিখন।” পৃথিবীর মানুষ তাকে মূল্যয়ন করে নি, এমন একটা কাজের জন্য পান নি কোনো পুরস্কার। বরং জীবিকার সুযোগগুলো হারাতে হয়েছে এর কারণে। তবুও ফ্রাঙ্ক উইলস জানিয়ে দিলেন, আবার সুযোগ পেলে ঠিক আগের কাজটাই করতেন! একজন নিঃস্ব, রিক্ত, জীবনের সমস্ত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হওয়া মানুষের কী অসাধারণ উক্তি, সততার কী দারুণ দুঃসাহস!