৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আগের দিন পাকিস্তানের করাচি বন্দরে পুনরায় মিসাইল হামলা করে ‘অপারেশন ট্রাইডেন্ট’ ও ‘অপারেশন পাইথন‘-এর বিজয়োল্লাসে মত্ত ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের জলসীমায় একটি সাবমেরিনের সাথে পাকিস্তান নেভি হেডকোয়ার্টারের রেডিও যোগাযোগের তথ্য শনাক্ত করে। সপ্তাহখানেক আগেই অপর সাবমেরিন গাজী ধ্বংস হলেও পাকিস্তানিদের হাতে তখনও দুটো অত্যাধুনিক ফরাসি সাবমেরিন ছিল। তাই দেরি না করে শিকার করতে নেমে পড়ে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু এবার শিকারি নিজেই শিকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘পিএনএস হাঙর’-এর পাল্টা আক্রমণে ডুবে যায় ভারতীয় ফ্রিগেট ‘আইএনএস খুকরি’। এটি ছিল কোরিয়া যুদ্ধের পর সাবমেরিনের হামলায় শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজ ডুবে যাওয়ার প্রথম ঘটনা, যেখানে ১৯৪ জন নাবিক প্রাণ হারান।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হাই কমান্ড ভারতের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। ৩ ডিসেম্বর করাচি বন্দরে মিসাইল হামলা, পরদিন দুর্ভাগ্যজনকভাবে গাজী সাবমেরিনের ডুবে যাওয়া, ভুলক্রমে নিজেদের যুদ্ধজাহাজে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের হামলা, ৮ ডিসেম্বর পুনরায় করাচি বন্দরে মিসাইল হামলার পর পাকিস্তান নৌবাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙে পড়ে।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বার মুক্তিবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে টিকতে পারছিল না তাদের সেনাবাহিনী। আকাশ যুদ্ধে সফলতা ও ব্যর্থতা দুটোই দেখেছে পাকিস্তান এয়ারফোর্স। এ সময় আবারও চিরশত্রু ভারতের উপর মরণ কামড় বসাতে কৌশলগত অস্ত্র সাবমেরিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান নৌবাহিনী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের জলসীমায় পাকিস্তানী সাবমেরিনের অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সতর্ক হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তাদের সাবমেরিন ভারতকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল।
এরই মধ্যে গুজরাটের দিউ দ্বীপের ৫৬ কি.মি, দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগরে থাকা একটি অজানা যুদ্ধজাহাজের সাথে করাচিতে পাকিস্তান নৌ সদর দফতরের রেডিও যোগাযোগ ইন্টারসেপ্ট করে ভারত। এভাবেই পাকিস্তানি সাবমেরিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে। কিন্তু একে খুঁজে বের করা আরো কঠিন কাজ। দিউ দ্বীপের অবস্থান ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখান থেকে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে রাডার নজরদারি করা সম্ভব ছিল। তবে তাদের ধারণা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও বেসামরিক কার্গো জাহাজে হামলা করে বন্দর অচল করে নেয়ার মিশন নিয়ে এখানে এসেছে পাকিস্তানি সাবমেরিন। তাই ভারতীয়রা যেকোনো মূল্যে শত্রুকে ঘায়েলের জন্য একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠল।
ঘটনার শুরু যেভাবে
মুম্বাই বন্দরকে হোম পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা ভারতীয় নৌবাহিনীর ১৪ তম ফ্রিগেট স্কোয়াড্রনকে এই সাবমেরিন মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। এই নৌবহরে রয়েছে ৫টি ব্রিটিশ ব্ল্যাকউড ক্লাস ফ্রিগেট। এই শ্রেণীর ৩টি যুদ্ধজাহাজ মিশনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল- আইএনএস খুকরি, আইএনএস কিরপান ও আইএনএস কুঠার।
এই নৌবহর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখ মুম্বাই বন্দর থেকে রওনা হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন ৪৫ বছর বয়সী অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র নাথ মাল্লা। তিনি ছিলেন আইএনএস খুকরির কমান্ডিং অফিসার। কিন্তু যাত্রার শুরুতেই ঘটল একটি দুর্ঘটনা। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ আইএনএস কুঠারের বয়লার রুমে দুর্ঘটনাবশত প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। এতে জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এর ইঞ্জিন অচল হয়ে যায়। ফলে কমান্ডার মাল্লা আইএনএস কিরপানকে দায়িত্ব দেন আইএনএস কুঠারকে ক্যাবল দিয়ে টেনে আবার মুম্বাই বন্দরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। এর ফলে সাবমেরিন শিকারের মিশনে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তি অনেকটাই কমে যায়।
একটি সাবমারিন হান্টার গ্রুপে কমপক্ষে তিনটি যুদ্ধজাহাজ থাকাই এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের মূল নিয়ম। সমুদ্রের নির্দিষ্ট এলাকায় তন্ন তন্ন করে খোঁজার গ্রিড সার্চ পদ্ধতিতে তিনটি যুদ্ধজাহাজ মিলে বেশ দ্রুত এবং ভালো ফলাফল এনে দিতে পারত। তাই মারাত্মক ঝুঁকি থাকলেও খুকরি ও কিরপানকেই শেষ পর্যন্ত মিশনে পাঠানো হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমান্ডের এরিয়া কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল কোহলি দুই ফ্রিগেটকে অপারেশনে সাহায্য করতে নতুন সংযোজিত দুটো এন্টি-সাবমেরিন হেলিকপ্টার SH-3H Sea King পাঠান। এ ধরনের হেলিকপ্টার আকাশে ভেসে SONAR প্রযুক্তিসম্পন্ন বয়া পানিতে ফেলে সাবমেরিন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। শত্রুর উপস্থিতি নিশ্চিত হলে এরা টর্পেডো বা ডেপথ চার্জ ফেলতে পারে। নির্দেশ মোতাবেক হেলিকপ্টার দুটো সার্চ এরিয়ার দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ মুম্বাই বন্দরের কাছাকাছি অঞ্চলে অনুসন্ধান করবে। ফ্রিগেট খুকরি এবং কিরপানের দায়িত্ব হলো উত্তরাঞ্চলে দিউ দ্বীপের কাছাকাছি ৮৮.৫ কিলোমিটার × ৮০.৫ কিলোমিটার ব্যাপী এক বিস্তীর্ণ এলাকাতে অনুসন্ধান করা।
দুই পক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা
ভারতীয় নেভির শত্রু ছিল পাকিস্তানের সাবমেরিন পিএনএস হাঙ্গর। ফ্রান্সের তৈরি এই ড্যাফনে ক্লাস সাবমেরিনটি প্রযুক্তির দিক দিয়ে সেই যুগের অন্যতম সেরা। এর ক্যাপ্টেন ছিলেন কমান্ডার আহমেদ তাসনিম যিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে আরেক পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস গাজীর ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে কৃতিত্ব দেখানোর ফলে পদক পান। পিএনএস হাঙ্গর পিএনএস গাজীর মতো লং রেঞ্জ মিশনের জন্য উপযুক্ত ছিল না বিধায় আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরেই এটি ঘুরে বেড়াত। গাজী যখন ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী আইএনএস ভিক্রান্তের উপর হামলা করতে বেড়িয়েছিল, তখন হাঙ্গর অন্যান্য ভারতীয় যুদ্ধজাহাজের গতিপথ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছিল।
৩ ডিসেম্বর ভারতীয় যুদ্ধজাহাজের বহর করাচির দিকে এগোচ্ছে এমন গোয়েন্দা সংবাদ হাঙ্গরের কাছ থেকে পায় পাকিস্তান। বাধ্য হয়ে পরদিন নতুন পরিকল্পনা অপারেশন ট্রাইডেন্ট বাস্তবায়ন করে ভারত। উক্ত সাবমেরিনে ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক SONAR ডিটেকশন সিস্টেম যার রেঞ্জ ছিল ২৫,০০০ গজ। অন্যদিকে আইএনএস খুকরি ছিল তার প্রতিপক্ষের তুলনায় কিছুটা পুরনো যুগের যুদ্ধজাহাজ। এতে ছিল টার্গেট সার্চের Type 174 সোনার, টার্গেট ক্লাসিফিকেশনের জন্য Type 162 এবং টার্গেটিং এর জন্য Type 170 সোনার সিস্টেম। এই ১৭০/১৭৪ সিরিজের সোনার রেঞ্জ মাত্র ১,৫০০ গজ। উল্লেখ্য, SONAR ডিটেকশন এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে শত্রু জাহাজের অবস্থান বের করা যায়।
এ কারণে আইএনএস খুকরির অনেক আগেই পিএনএস হাঙ্গর খুকরির অবস্থান জেনে ফেলতে পারত। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো খুকরির এই কম শক্তির সোনার সিস্টেমও ছিল পরীক্ষামূলক পর্যায়ে! এটি জাহাজের পূর্ণগতিতে নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারত না! বাধ্য হয়ে জাহাজের গতি কমিয়ে দিতে হত যা সাবমেরিন হান্টিং মিশনের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। কেননা আচমকা সাবমেরিন কর্তৃক হামলার শিকার হলে জাহাজের উচ্চগতি তাকে বাঁচিয়ে দিতে পারত।
এই অসম শক্তির খুকরিকে আদৌ এই অপারেশনে পাঠানো উচিত ছিল কিনা সে নিয়ে আজও বিতর্ক হয়। সোনার সিস্টেমের শক্তির পার্থক্যই জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে দেয়। খুকরির দুর্বল সোনার সিস্টেম কিছুটা শক্তিশালী করার জন্য জাহাজের ইলেক্ট্রিক্যাল অফিসার লেফটেন্যান্ট জৈন একটি নতুন ডিভাইস উদ্ভাবন করেন যা সোনারের ক্ষমতা কিছুটা বাড়ায় বটে, কিন্তু তার বিনিময়ে জাহাজের গতি আরও কমিয়ে দিতে হয়। কমান্ডার মাল্লা ব্যক্তিগতভাবে এই গতি কমানোর ব্যাপার পছন্দ না করলেও কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে উক্ত ডিভাইস খুকরিতে লাগাতে বাধ্য হন। ফলে সোনার নিখুঁতভাবে ব্যাবহারের জন্য তার গতি কমানো ছাড়া আর উপায়ও ছিল না।
ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
ভারতীয়দের কাছে ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ঐ অঞ্চলে সাবমেরিনের উপস্থিতির খবর আসছিল। ৪ ডিসেম্বর পিএনএস গাজী ডুবে গেলেও অপর দুটো পাকিস্তানি সাবমেরিন যে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে ঘোরাফেরা করছে তার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সাবমেরিনের অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করার যাচ্ছিল না। অবশেষে ৮ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় নৌবাহিনী পিএনএস হাঙ্গরের সাথে পাকিস্তানের করাচি নৌ-সদর দফতরের রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে দিউ দ্বীপের ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে হাঙ্গরের অবস্থান শনাক্ত করতে সমর্থ হয়। শুরু হয় ভারতীয় ফ্রীগেট খুকরি ও কিরপান এবং সাবমেরিন হাঙ্গরের এক অসম ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। খুকরি ও কিরপান উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ছুটে যেতে থাকে পিএনএস হাঙ্গরের সর্বশেষ শনাক্ত করা অবস্থানের দিকে। তবে পিএনএস হাঙ্গরের অত্যাধুনিক লংরেঞ্জ সোনার খুকরি-কিরপানকে গুজরাটের কাঠিয়ার উপকূলে থাকতেই ৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে শনাক্ত করে ফেলে। সোনার সিগন্যালগুলো যুদ্ধজাহাজের নিশ্চিত হবার পরেই সাবমেরিন হাঙ্গর শুরু করে পাল্টা ধাওয়া।
কিরপান-খুকরির বেয়ারিং অনুযায়ী রওনা দেয় উত্তর-পূর্ব দিকে। হাঙ্গর খুকরি-কিরপানের কোর্স ও স্পিড বিশ্লেষণ করে প্রথম অনুমান করা অবস্থানে তাকে খুঁজে পেল না। এর ফলে পিএনএস হাঙ্গরের কমান্ডার তাসনিম কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও বেশি স্পিড পাবার জন্য সাবমেরিনকে পানির নীচ থেকে খানিকটা সারফেসে তুলে এনে স্নোরকেলিং করতে শুরু করলেন (স্নোরকেলিং বলতে সামান্য গভীরতায় সাবমেরিন চালানো বোঝায়, তবে স্নোরকেল বলতে পানির উপর থেকে বাতাস সঞ্চালনের পাইপকে বোঝায়)। একইসাথে পেরিস্কোপে (সাবমেরিনে সংযুক্ত বিশেষ ধরনের দূরবীন) চারপাশে নজর রাখতে শুরু করলেন।
আইএনএস খুকরি একটি নিয়মিত আয়তাকার পথ ধরে সাবমেরিনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হাঙ্গরের উন্নত সোনার সিস্টেমে ৯ ডিসেম্বরের সন্ধ্যার সময় খুকরির এই আয়তাকার প্যাটার্ন সার্চ ধরা পড়ে। ফলে সাবমেরিন কমান্ডার তাসনিম আইএনএস খুকরির ভবিষ্যত অবস্থান কী হতে পারে তার একটা ভাল ধারণা পেয়ে যান। কারণ নির্দিষ্ট কোর্স এবং স্পিড অনুযায়ী একটি জাহাজ কত সময় পর কোন জায়গায় থাকবে জাহাজের নেভিগেশন অফিসার সেটা চার্ট দেখে গাণিতিকভাবে নির্ণয় করতে পারেন। ফলে সন্ধ্যা সাতটার সময় সাবমেরিনটি ভারতীয় ফ্রীগেট দুটোর সম্ভাব্য গমন পথের উপর আক্রমণাত্মক পজিশন নেয়। এ সময় পিএনএস হাঙ্গর তার ডিজেল ইঞ্জিন বন্ধ করে ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু করে। ফলে ভারতীয় সোনার সিস্টেমের জন্য সাবমেরিন শনাক্ত করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
শিকারি যখন হামলার শিকার
সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় সাবমেরিন হাঙ্গর আক্রমণের প্রথম চেষ্টা চালায়। কমান্ডার তাসনিম পেরিস্কোপ তোলার মতো অগভীর পানিতে উঠে এসে খুকরিকে খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু অভিজ্ঞ কমান্ডার মহেন্দ্রনাথ মাল্লা তার জাহাজের সমস্ত আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন বিধায় পেরিস্কোপে কিছু দেখা গেল না। এ ধরনের কৌশলকে ‘টোটাল ব্ল্যাকআউট’ বলে। হাঙ্গরের সোনারে খুকরির অবস্থান ৯.৮ কিলোমিটার দূরে দেখাচ্ছিল। অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন তাসনিম পেরিস্কোপের ভরসায় আর না থেকে পানির নীচ থেকে সোনারের উপর নির্ভর করে আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই সাবমেরিনটি ৫৫ মিটার গভীরতায় ডাইভ দেয়। এটি সর্বোচ্চ ৩০০ মিটার গভীরে যেতে পারত। আইএনএস কিরপান ১৪ নট এবং আইএনএস খুকরি মাত্র ১০ নট গতিতে সরলরৈখিক একটি কোর্স ধরে চলছিল। প্রথমত, গতি ছিল খুবই কম; দ্বিতীয়ত, সোজা পথে চলা এন্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের বেসিক রুলসের পরিপন্থী। কেননা সাবমেরিনের হঠাৎ টর্পেডো আক্রমণ ঠেকাতে আঁকাবাঁকা পথে চলাই সাধারণ নিয়ম যা নৌবাহিনীর পরিভাষায় ‘জিগজ্যাগ ম্যানুভার’ নামে পরিচিত।
কিন্তু সেই দুর্বল সোনারের কারণেই খুকরিকে নিরাপত্তার এই সাধারণ নিয়ম অমান্য করতে হয়। রাত ৭টা ৫৭ মিনিটে হাঙ্গর ৪০ মিটার গভীরতা থেকে উত্তর দিকে থাকা আইএনএস কিরপানকে লক্ষ্য করে প্রথম টর্পেডো নিক্ষেপ করে, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পাকিস্তানি তথ্যসূত্রানুযায়ী এই টর্পেডোটি কিরপানকে আঘাত করলেও বিস্ফোরিত হয়নি। অন্যদিকে ভারতীয় সূত্রের দাবী অনুযায়ী টর্পেডোটি আইএনএস কিরপানের keel অর্থাৎ জাহাজের পেটের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সম্ভবত, কিরপানের গতি বেশি থাকায় কমান্ডার তাসনিম টর্পেডো ফায়ারের হিসাবে সামান্য ভুল করেছিলেন।
সাথে সাথেই পাল্টা আক্রমণ শুরু করে কিরপান। কয়েকটি এন্টি সাবমেরিন ডেপথ চার্জ ছোড়া হয় হাঙ্গরের সম্ভাব্য অবস্থান লক্ষ্য করে। মর্টার লঞ্চড এ ধরনের ডেপথ চার্জ মিসাইলের মতো খানিকটা দূরে উড়ে গিয়ে পানিতে পড়ার পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে। ফলে সাবমেরিনের উপর প্রযুক্ত পানির চাপের ব্যাপক হেরফের হয় এবং পানির চাপেই সাবমেরিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! পাল্টা আক্রমণ শুরু হতে পিএনএস হাঙ্গর কিরপানের মর্টার রেঞ্জের বাইরে যাওয়ার জন্য কিছুটা পিছু হটে যায়। এই অবস্থায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিরপানের Limbo mark 10 মর্টার লঞ্চার অকেজো হয়ে যায় যা ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!
সাবমেরিন হাঙ্গর এবার তার মনোযোগ দেয় খুকরির দিকে। কারণ সে সময় ভারতীয় যুদ্ধজাহাজটি সাবমেরিনের ইঞ্জিনের শব্দ সোনারে শোনার আশায় খুব অল্প গতিতে চলছিল। এ সুযোগ নিয়ে পিএনএস হাঙ্গর খুকরির বেশ কাছে চলে আসে। কমান্ডার তাসনিম শত্রুর কোর্স ও স্পিড বুঝে ফায়ার করেন তার দ্বিতীয় টর্পেডো। এবার আর তিনি মিস করলেন না। টর্পেডোটি সরাসরি খুকরির পোর্টসাইডে জাহাজের মাঝখানে আঘাত করে। এতে জাহাজে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সাথে সাথেই বেশ কয়েকজন ক্রু মারা যায়, ক্ষতিগ্রস্থ হয় জাহাজের ফুয়েল ট্যাংক। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সেখানে দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণ ঘটে, যা জাহাজের মরণঘন্টা বাজিয়ে দেয়। কমান্ডার মাল্লা বুঝতে পারেন যে জাহাজ বাঁচানো আর সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে তিনি তার শেষ অর্ডার হিসেবে জাহাজ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। নাবিকরা লাইফ বোট নামাতে শুরু করে। অফিসাররা লাইফ জ্যাকেট বিতরণসহ জাহাজ ত্যাগের কাজ তদারকি শুরু করে।
কিরপানের পিছু হটা
আইএনএস খুকরিকে আক্রান্ত হতে দেখে আইএনএস কিরপান তাকে সাহায্য করার জন্য ফিরে এসেই সাবমেরিন হাঙ্গরের হাতে আবার আক্রান্ত হয়। হাঙ্গর তাকে লক্ষ্য করে তৃতীয় টর্পেডো নিক্ষেপ করে। কিন্তু কিরপান এবার সতর্ক থাকায় গতি বাড়িয়ে দিয়ে জিগজ্যাগ ম্যানুভার করে টর্পেডোকে ফাঁকি দেয়। তৃতীয় টর্পেডো হামলা নিয়েও দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তানীরা দাবী করে, এই টর্পেডো কিরপানকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। ভারতের দাবি ছিল এই যুদ্ধে কিরপানের কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং তৃতীয় টর্পেডোটি খুকরিকে উদ্দেশ্য করে ফায়ার করা হয়েছিল যেন তার ডুবে যাওয়া নিশ্চিত হয়। এর বিপরীতে বক্তব্য পাওয়া যায় কমান্ডার তাসনিমের আফটার অ্যাকশন রিপোর্টে। তিনি বলেছেন, খুকরিকে হামলা করার দুই মিনিটের মধ্যেই জাহাজটি ডুবে যায়। জাহাজটি অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণে এত বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে আবার টর্পেডো হামলা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। আবার কিরপানের ডেপথ চার্জ হামলার আশঙ্কায় খুকরির বেঁচে যাওয়া নাবিকদের উদ্ধারে এগিয়ে যাননি (শত্রু জাহাজের ডুবন্ত নাবিকদের উদ্ধার করা নৌযুদ্ধের প্রাচীন রীতি, যার নজির ইতিহাসে অনেক রয়েছে)। পাকিস্তানের সাবমেরিন হাঙ্গর এবার কিরপানের পাল্টা ডেপথ চার্জ হামলার আশঙ্কায় দ্রুত পালিয়ে যায়। অন্যদিকে আইএনএস কিরপানও ডুবতে থাকা খুকরির ক্রুদের উদ্ধার না করে শেষ পর্যন্ত সাবমেরিনের হামলার ভয়ে পালিয়ে যায়!
কিরপানের কমান্ডার সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিলেন। কেননা তার মর্টার অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় সাবমেরিন কর্তৃক হামলার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ডুবে যাওয়া খুকরির অসহায় নাবিকদের উদ্ধারে যোগ দেয়া। অথবা দ্রুত নিরাপদ এলাকায় চলে গিয়ে অকেজো মর্টার মেরামত করে বা অন্য যুদ্ধজাহাজের সাহায্য নিয়ে ফিরে আসা। কিন্তু ঐ মুহূর্তে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়ার জন্য কিরপানকে প্রায় থামিয়ে দিতে হতো। এক্ষেত্রে পাকিস্তানি সাবমেরিন খুব সহজেই টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দিতে পারতো কিরপানকে। সব মিলিয়ে ঐ মুহূর্তে তার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
একজন ক্যাপ্টেনের কর্তব্যনিষ্ঠা
আইএনএস খুকরি ডুবে যাওয়ার ভারতীয় বর্ণনায় এর ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র নাথ মাল্লার কর্তব্যনিষ্ঠার উদাহরণ পাওয়া যায়।
জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার পর হাতে সময় ছিল খুবই কম, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ডুবছে আইএনএস খুকরি। বেশিরভাগ নৌসেনা জাহাজের ডেকের নিচে আটকা পড়েছেন। ডুবে মরতে শুরু করেছেন অনেকে। তাদের বের হয়ে আসার জন্য মেইন হ্যাচ অবশিষ্ট আছে মাত্র দুটি। এ সময় ঠান্ডা মাথায় উদ্ধারকাজ পরিচালনা শুরু করেন আহত ক্যাপ্টেন মাল্লা।
টর্পেডো আঘাত করার পর বিস্ফোরণের ধাক্কায় তিনি তার আসন থেকে ছিটকে পড়ে আহত হন। তারপরও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোককে বাঁচানোর জন্য। ক্রুদের লাইফ জ্যাকেট বিতরণ, লাইফবোট নামানো, নিরাপদে জাহাজ থেকে বেরিয়ে আসার কাজ তিনি ও অন্যান্য অফিসারগণ তদারকি করলেন। ক্যাপ্টেন মাল্লার উদ্ধার কার্যক্রমের ফলে সেই রাতে ৬ জন অফিসার ও ৬১ জন নৌসেনা তাদের জীবন রক্ষায় সমর্থ হয়। বাকি ১৯৪ জন ডুবে মারা যায়।
ভারতীয় বর্ণনা থেকে জানা যায়, সমুদ্রের নাবিকদের প্রাচীন এক প্রথা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মাল্লা জাহাজ ত্যাগে অস্বীকার করেন! জানা যায়, প্রাচীন যুগের জাহাজের ক্যাপ্টেনরা নিজের জাহাজকে শত্রুর আক্রমণ বা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে না পারলে ইচ্ছাকৃতভাবে সেই জাহাজের সাথে ডুবে গিয়ে নিজের জাহাজের সাথে একই রকম ভাগ্য বরণ করতেন। কমান্ডার মহেন্দ্র নাথ মাল্লার এই অন্তিম যাত্রায় তাকে সঙ্গ দেন খুকরির এক্সিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার যোগিন্দর কিসেন সুরি।
অপারেশন ফ্যালকন
খুকরি ডুবে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর কিরপান আইএনএস কাঁচাল নামক উদ্ধারকারী জাহাজসহ ফিরে লাইফবোটে ভেসে থাকা মোট ৬ জন অফিসার ও ৬১ জন নাবিককে উদ্ধার করে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমান্ডের সকল যুদ্ধজাহাজ, মেরিটাইম পেট্রোল বিমান, এন্টি সাবমেরিন হেলিকপ্টারের সাহায্যে পরবর্তী ৪ দিন ধরে পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস হাঙ্গরকে ঘায়েল করতে অপারেশন ফ্যালকন পরিচালনা করে। সাবমেরিনটির করাচি ফিরে যাবার পথে নজরদারি করা হয়, সন্দেহজনক পজিশনে অসংখ্য ডেপথ চার্জ ফেলা হয়।
পাকিস্তানি বর্ণনামতে, মাত্র দুটো ডেপথ চার্জ হাঙরের আশেপাশে বিস্ফোরিত হয়েছিল। কমান্ডার তাসনিম ভারতীয় সোনারে ধরা পড়া এড়াতে অধিক গভীরতায় অল্প গতিতে সাবমেরিন চালিয়েছিলেন। তিনি এতটাই সতর্ক ছিলেন যে খুকরি ডুবিয়ে দেয়ার খবর করাচিতে নেভাল হেডকোয়ার্টারে চারদিন পরে রেডিওতে রিপোর্ট করেন। তার আশঙ্কা ছিল রেডিও সাইলেন্স ব্রেক করলেই ধরা পড়ে যাবেন। করাচি যাওয়ার পথে ভারতের নজরদারি আছে অনুমান করে পিএনএস হাঙ্গর চারদিন এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে, টানা এক সপ্তাহ পানির নিচে থাকে। স্নোরকেল (বাতাস সংগ্রহের পাইপ) ব্যবহার করে পানির নিচে থেকেই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ ও রিজার্ভ ব্যাটারির অতিরিক্ত ব্যবহার করে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছিল। এসব কারণে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়েও হাঙ্গরকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
ব্যাপারটি আসলে ভারতীয় নৌবাহিনীর দুর্বলতা না বলে সাবমেরিনের সক্ষমতা বলা উচিৎ। কেননা বিশাল সাগরের বুকে সাবমেরিন খোঁজা আর খড়ের গাঁদায় সুঁই খোঁজা একই কথা। সাবমেরিন ধরা পড়ার মতো সুযোগ তৈরি না করলে আপনি তাকে খুঁজেই পাবেন না। কমান্ডার আহমেদ তাসনিম আফটার অ্যাকশন রিপোর্টে লিখেছেন,
An extensive air search combined with surface ships made our life miserable but with the intelligent evasive action we managed to survive these attacks and arrived in Karachi safely after the ceasefire.
তিনি বীরের বেশে করাচি নৌঘাটিতে পৌঁছান ১৮ ডিসেম্বর। কিন্তু এত বড় সাফল্যের পর ঘাঁটিতে পাকিস্তানি নৌসেনাদের মন খারাপের কারণ তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। কারণ ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পরাজয় বরণ করে নিঃশর্তভাবে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর নিকট লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ করেছে সেটা তার জানা ছিল না। তবে পরবর্তীতে তাকে আইএনএস খুকরি ডোবানোর পুরষ্কার হিসেবে ‘সীতারা-এ-জুরাত’ পদক দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র নাথ মাল্লাকে মৃত্যু-পরবর্তী ‘মহাবীর চক্র’ পদকে ভূষিত করে ভারত। খুকরির মৃত নাবিকদের সম্মানে দিউ দ্বীপের একটি ছোট টিলার উপর নির্মাণ করা হয় একটি স্মারক মডেল।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের অপারেশন দ্বারকার মাধ্যমে যে নৌ-যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, খুকরি ডোবানোর মাধ্যমে সেটি শেষ হয়। এই সিরিজের আগের পর্বগুলো পড়লে আপনি বুঝবেন যে যুদ্ধে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির বিচারে অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে পাকিস্তানের, এবং বেশি সংখ্যক নৌসেনা মারা গেছে ভারতের। ১৯৭১ সালে ভারতের অপারেশন ট্রাইডেন্ট ও অপারেশন পাইথনের মিসাইল হামলায় অচল হয়ে গিয়েছিল করাচি বন্দর, যা তাদের জাতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুই অপারেশনের মাঝখানে ৯২ জন নাবিকসহ পাকিস্তানের সাবমেরিন পিএনএস গাজী ডুবে যায়। শেষদিকে ১৯৪ জন নাবিকসহ আইএনএস খুকরি ডুবিয়ে দেয় পাকিস্তান।
এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভারত-পাকিস্তান নৌ-যুদ্ধ। কার্গিল যুদ্ধসহ ভারত-পাকিস্তানের একাধিক সীমান্ত সংঘর্ষ হলেও নৌ-যুদ্ধ আর সংগঠিত হয়নি।
এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ
১) অপারেশন দ্বারকা
২) অপারেশন ট্রাইডেন্ট
৩) পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজী ধ্বংসের ঘটনা
৪) অপারেশন পাইথন