বিহারের গেহলর গ্রামে বেশ মুখরোচক একটা সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। দশরথ মাঝি নাকি একাই হাতুড়ি, শাবল নিয়ে পাহাড় কাটা শুরু করে দিয়েছেন আর কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলছেন, “এই পাহাড় কাইটা রাস্তা বানায়াই ছাড়মু”। লোকজন দেখতে আসে, কেউ টিটকিরি দেয় “ও মাঝি! পাহাড় কাটা কতদূর?” কেউ আবার একটু করুণার দৃষ্টিতে তাকায়, আফসোসের স্বরে বলে, “আহারে বেচারা! বউটা মারা যাওয়ায় মাথাটাই গ্যাছে”।
কিন্তু কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দশরথের। একমনে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তার শাবল, হাতুড়ির আঘাত। শক্ত পাথর টলে না একচুলও, উল্টো হাতুড়ি ছিটকে এসে লাগে তার পায়ে। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেন দশরথ, রক্তে লাল হয়ে উঠে পাহাড়ের গা; কিন্তু তিনি বিচ্যুত হন না তার সংকল্প থেকে, সকল যন্ত্রণা উপেক্ষা করে আবার হাতে তুলে নেন হাতুড়ি; কেননা তার হৃদয়ে যে চলছে এর চেয়েও বেশী রক্তক্ষরণ, বুক জুড়ে জমে থাকা যন্ত্রণার তুলনায় এ শারীরিক আঘাত যে ভীষণ নগণ্য।এ পাহাড় তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তার স্ত্রী ফাল্গুনীকে। এ পাহাড়ের উপর প্রতিশোধ নেয়ার আগ পর্যন্ত তো থামবেন না তিনি।
ভারতের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত গেহলর গ্রামটিকে শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে মস্ত এক পাহাড়। পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে পার্শ্ববর্তী শহরে যেতে গ্রামবাসীকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পথ। এ পাহাড়কে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন সবাই। তিনশ ফিট উঁচু এ পাথুরে পাহাড় ছাড়াও গেহলরকে ঘিরে আছে আরো অনেক অভিশাপ। পাহাড়ের এপারে বেশীরভাগ অধিবাসীই ‘নীচুজাতের’। জাতভেদ প্রথার প্রকটতার কারণে তাই তারা বঞ্চিত তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ থেকেও। পাহাড়ের এপারে পানি, বিদ্যুৎ সুবিধা তো দূরের কথা, নেই কোনো স্কুল বা হাসপাতালও। সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটির দূরত্বই প্রায় সত্তর কিলোমিটার।
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এ গ্রামেই শুরু হয় দশরথ ফাল্গুনির ভালোবাসার গল্প। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। অধিকাংশ গ্রামবাসীর মতোই দশরথ কাজ করেন পাহাড়ের অপর পার্শ্বে। কাজ করতে করতে মাঝ দুপুরে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন কারো অপেক্ষায় চোখ মেলে দেন দূরের পথের দিকে। এ সময় মুখে হাসি মেখে, কাঁখে কলসি ভর্তি পানি আর খাবার নিয়ে হাজির হন ফাল্গুনি। দশরথের মরুভূমির ন্যায় জীবনে যেন পাহাড়ের বাঁক ধরে নেমে আসে এক টুকরো স্নিগ্ধ ছায়া।
সেদিনও ফাল্গুনির জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন দশরথ। কিন্তু ফাল্গুনির আসতে দেরী হওয়ায় উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে তার। পাহাড়ের যে পথ ধরে গ্রামবাসীরা এ মাঠে আসেন সেটি খুবই বিপদজনক। একবার পা হড়কে গেলে আর রক্ষা নেই। দুর্ঘটনার আশঙ্কা উঁকি দিতে শুরু করে দশরথের মনে। এ সময় দৌড়ে সেখানে এসে হাজির হয় গ্রামবাসীদের একজন। খবর দেয় সত্য হয়েছে দশরথের আশঙ্কাই। তার জন্য খাবার নিয়ে আসার সময় পাহাড়ে পা পিছলে ভীষণ রকম আহত হয়েছেন ফাল্গুনি। যত দ্রুত সম্ভব নিতে হবে ডাক্তারের কাছে। কিন্তু হাসপাতাল যে সত্তর কিলোমিটার দূর।
হাসপাতাল নেয়ার সময় পথেই মারা যান তিনি। এলোমেলো হয়ে যায় দশরথের নিত্যকার জীবন, হারিয়ে যায় তার জীবনের একমাত্র ভালবাসাটুকুও। পাহাড়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা, ক্ষোভে বিষিয়ে উঠে তার অন্তর। পালের শেষ ছাগলটিও বেচে দিয়ে কিনলেন হাতুড়ি আর শাবল । এ পাহাড় যেন আর কারো প্রাণ নিতে না পারে তাই সিদ্ধান্ত নিলেন একাই এ পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করবেন তিনি। এমন অসম্ভব কল্পনা কোনো পাগল ছাড়া কেউ করতে পারে না বলে হেসেই উড়িয়ে দেয় সবাই। কিন্তু দশরথ তার সঙ্কল্পে অটুট।
তার দিনমজুরির কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ রূপে মন দিলেন পাহাড় খোঁড়ার কাজে। খেয়ে না খেয়ে, রাত-দিন এক করে চলতে থাকে তার সংগ্রাম। এ সময় তিনি মাঝে মাঝে মানুষের বিভিন্ন জিনিস পাহাড় পার করে দিতেন। এ থেকে প্রাপ্ত সামান্য অর্থ দিয়েই কোনোমতে চলতো তার সন্তানদের ভরণ-পোষণ। আর চলতো দশরথের পাহাড়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এভাবে এক দিন, দু’দিন নয়, কেটে যায় বছরের পর বছর। এর মধ্যে একবার ভীষণ খরার কারণে গ্রামবাসীদের অনেকেই গেহলর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। তার বাবা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের সাথে শহরে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যাননি দশরথ মাঝি।
প্রায় দশ বছর চলে যায়। দশরথের বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রমের ফলে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে দেখা দেয় চিড়। এ সময় তার গ্রামের কেউ কেউ এগিয়ে আসেন তাকে সাহায্য করতে। মাঝে মাঝে খাবার এবং যন্ত্র কিনে দিয়ে সহায়তা করতেন তারা। দশরথ পাহাড় কাটা শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালের দিকে। এর প্রায় বাইশ বছর পর ১৯৮২ সালে একদিন তিনি তার পথ থেকে সরান শেষ পাথরটি । পাহাড়ের বুক চিরে তখন তৈরি হয়েছে ৩৬০ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট চওড়া একটি পথ।
সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজের জন্য তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। রাজ কোষাগারের অঢেল অর্থ খরচ করে, প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক দিয়ে তৈরি হয়েছিল তার তাজমহল। পুরো পৃথিবী এখন এটিকে ভালবাসার প্রতীক হিসেবে চেনে। অন্যদিকে ফাল্গুনির প্রতি ভালবাসার জন্য গেহলরের সহায় সম্বলহীন দশরথ মাঝি বাইশ বছর ধরে একাই কেটে গেছেন পাথুরে পাহাড়। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তার ‘তাজমহল’; পরবর্তীতে যার নাম হয় ‘দশরথ মাঝি রোড’। এর ফলে আগে যেখানে পৌঁছানোর জন্য মানুষের পাড়ি দিতে হতো ৫৫ কিলোমিটার পথ, এখন সেই দূরত্ব নেমে এসেছে মাত্র ১৫ কিলোমিটারে। তবে এখানেই শেষ হয়নি দশরথ মাঝির সংগ্রাম।
এ রাস্তাকে মেইন রোডের সাথে সংযুক্ত করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে দিল্লী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দিল্লী যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি তার নেই। যে মানুষ বাইশ বছর ধরে পাহাড় ভাঙতে পারে তার কাছে এ আর এমন কি! তিনি পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দেন বিহার থেকে দিল্লী। পথে যেতে যেতে সকল ষ্টেশন মাস্টার এর কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন তিনি। কিন্তু দিল্লীতে গিয়ে দেখা করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রীর সাথে।
পরবর্তীতে তিনি বিহারের প্রাদেশিক সরকার প্রধানের সাথে দেখা করেন। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দশরথ মাঝিকে সেখানে বসিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন রাজ্যপ্রধান নিতেশ কুমার। প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে ৫ একর জমি দেয়া হয় তাকে। কিন্তু যার জীবনের এতটা বছর কেটে গেছে মানবতার কল্যাণে তিনি কি আর নিজের জন্য ভাবেন! সেই জমিটুকু তিনি দান করে দেন হাসপাতাল তৈরির জন্য। সেখানে এখন তার নামে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল। ২০০৬ সালে বিহার সরকার ভারতের সবচেয়ে সম্মানজনক পদকগুলোর একটি ‘পদ্মশ্রী পদকের’ জন্য প্রস্তাব করেন দশরথ মাঝির নাম।
দশরথ মাঝির জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। বলিউডের প্রখ্যাত বায়োপিক নির্মাতা ‘কেতন মেহতা’ দশরথ মাঝিকে নিয়ে তৈরি করেন ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’ সিনেমাটি। সেখানে দশরথ মাঝির চরিত্রে অভিনয় করেন গুণী অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, আর তার স্ত্রীর ফাল্গুনীর চরিত্রে অভিনয় করেন রাধিকা আপ্তে। নওয়াজউদ্দিন তার অসাধারণ অভিনয় গুণ দিয়ে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন দশরথ মাঝির প্রেম-ভালবাসা আর সংগ্রামের গল্প। তবে এ সিনেমার আসল নায়ক দশরথ মাঝিই।
দেশের হাজারো সমস্যা নিয়ে আমরা যারা নিরন্তর অভিযোগ করে যাই তাদের জন্য দশরথ মাঝি এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। গেহলর-এর মানুষ যখন পাহাড়কে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে, কেউ আবার সরকার এর আশায় হা হুতাশ করেই ক্ষান্ত দিয়েছে, তখন দশরথ মাঝি কারো প্রতি কোনো অভিযোগ করেননি। সরকারের আশায়ও বসে থাকেননি। নিজেই হাতে তুলে নিয়েছেন হাতুড়ি,শাবল। বছরের পর বছর কাজ করে গেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য।
দশরথ মাঝি বলেন,
আমি আমার কাজের মাধ্যমে সবাইকে একথা বিশ্বাস করাতে চেয়েছি যখন ঈশ্বর আপনার সাথে থাকবেন কেউ আপনাকে থামাতে পারবে না”। “আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার গ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাবো। আমি কোনো সরকারের কোনো শাস্তির পরোয়া করিনা। একই ভাবে কোনো পদক বা পুরষ্কারের জন্যও লালায়িত নই।
তিনি তার কথা রেখেছেন। ২০০৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গ্রামের উন্নয়নই ছিল দশরথ মাঝির ধ্যানজ্ঞান। সবশেষে প্রত্যাশা করি দশরথ মাঝির আত্মত্যাগী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের মাঝেও যেন শুধুমাত্র ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের’ দিকে আঙ্গুল তুলে না রেখে দেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে এগিয়ে আসি আমরা নিজেরাও।