প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিত্রশক্তির দুই প্রধান সদস্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপ থেকে দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এই বিশাল অঞ্চলে যুদ্ধ চালানোর মতো জনবল ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে ছিল না। এজন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাদের সুবিস্তীর্ণ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থেকে সৈন্য নিয়োগ শুরু করে।
ব্রিটেনের জনসংখ্যা ছিল ফ্রান্সের চেয়ে কম, ফলে স্বভাবতই ব্রিটেনকে তার উপনিবেশগুলো থেকে প্রচুর সৈন্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল। এসময় ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ উপনিবেশ ছিল ভারতবর্ষ। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের প্রাক্কালে ব্রিটেনের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ, আর ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ কোটি ২০ লক্ষ। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেন ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর সৈন্য সংগ্রহের সুযোগ পেয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১৫ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিয়ে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করে। এটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে গঠিত সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদল। ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটেনের পক্ষে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম থেকে শুরু করে পুর্ব আফ্রিকা, ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও চীনের মাটিতে যুদ্ধ করে। প্রায় ৯০,০০০ ভারতীয় সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় এবং ১১ জন ভারতীয় সৈন্য বীরত্বের জন্য ব্রিটেনের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ লাভ করে।
১৮৫৭–১৮৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে বাঙালিদেরকে সামরিক বাহিনী থেকে দূরে রাখার যে নীতি ব্রিটিশরা গ্রহণ করেছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা সেই নীতি পরিত্যাগ করে এবং বাঙালিদেরকে সশস্ত্রবাহিনীতে নিয়োগ করতে শুরু করে। এর ফলে গঠিত হয় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘৪৯তম বাঙ্গালি রেজিমেন্ট’, যেটি ‘বাঙালি পল্টন’ নামে সমধিক পরিচিত। বাঙালি সৈন্যরা ব্রিটেনের পক্ষে তদানীন্তন মেসোপোটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) রণাঙ্গনে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও এই পল্টনে যোগদান করেন, যদিও তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা তুলনামূলকভাবে বেশ প্রচার লাভ করেছে। কিন্তু এই যুদ্ধে কিছু বাঙালি সৈন্য যে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিল এবং কৃতিত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল, সেই তথ্যটি প্রায় সকলেরই অজানা।
ভারতবর্ষ (বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) প্রধানত ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু বর্তমান ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এগুলো ছিল ফ্রান্স ও পর্তুগালের উপনিবেশ। বর্তমান ভারতের পুডুচেরি (প্রাক্তন পন্ডিচেরী) কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চন্দননগর, সর্বমোট ৫০৮.০৩ কি.মি. ভূমি, ছিল ফরাসি–শাসিত ভারতের অংশ। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি Éstablissements français dans l’Inde বা ‘ভারতে ফরাসি বসতিসমূহ’ নামে পরিচিত ছিল। ভারত স্বাধীনতা লাভের পর ফ্রান্স ১৯৫০ সালের ২ মে চন্দননগর এবং ১৯৫৪ সালের ১ নভেম্বর পুডুচেরি ভারতের নিকট হস্তান্তর করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফ্রান্সও ব্রিটেনের মতো জনবলের ঘাটতির সম্মুখীন হয় এবং উপনিবেশগুলো থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে। উত্তর আফ্রিকা থেকে ইন্দোচীন পর্যন্ত ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৯১৫ সালের শেষদিকে ফ্রান্স তাদের এশীয় উপনিবেশগুলো থেকে সৈন্য সংগ্রহ আরম্ভ করে এবং ইন্দোচীন (বর্তমান ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস) থেকে প্রচুর সৈন্য ফরাসি সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদান করে। ভারতে অবস্থিত ক্ষুদ্র ফরাসি উপনিবেশগুলো থেকেও সৈন্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা গৃহীত হয়, যদিও এই ক্ষুদ্র উপনিবেশগুলোর জনসংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম।
এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ফরাসি–শাসিত ভারতের গভর্নর আলফ্রেদ মাতিনো আহবান জানিয়েছিলেন,
ভারত নানাভাবে ফ্রান্সের নিকট ঋণী। এখন এই দুর্যোগের সময়ে ফ্রান্সের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি ভারতীয়ের কর্তব্য… এই কঠিন সময়ে যারা ফ্রান্সের পাশে দাঁড়াবে ফ্রান্স তাদের কখনো ভুলবে না। ফ্রান্স তাদের সঙ্গে নিজ সন্তানের মতো আচরণ করবে। ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিন!
বলাই বাহুল্য, মাতিনোর বক্তব্য তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসকদের মানসিকতারই প্রতিচ্ছবি।
বস্তুত এই যুদ্ধ ভারতবর্ষের অধিবাসীদের নিজেদের যুদ্ধ ছিল না। ইউরোপের মাটিতে চলমান যুদ্ধে ভারতীয়দের কোনো জাতীয় স্বার্থ ছিল না। এমনকি এই যুদ্ধে ভারতবর্ষকে জড়িত করার আগে ভারতীয়দের কোনো মতামত নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও ব্রিটিশ বা ফরাসিরা বোধ করেনি।
তবে তা সত্ত্বেও বাঙালি–অধ্যুষিত চন্দননগরে ৩০ জন ব্যক্তি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য এগিয়ে আসে। ১৯১৬ সালের বসন্তকালে এদের মধ্যে ২৬ জনকে সেনাবাহিনীতে নেয়ার উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদেরকে ফরাসি সেনাবাহিনীর ১১তম ঔপনিবেশিক পদাতিক রেজিমেন্টের ১৭তম কোম্পানিতে সংযুক্ত করা হয়। ১৯১৬ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি একটি বিদায় অনুষ্ঠানের পর তারা পুডুচেরি থেকে সমুদ্রপথে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
তাদের সম্পর্কে তাদের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট গিলেট প্রতিবেদনে জানান, “তারা (বাঙালি সৈন্যরা) সবাই স্বাস্থ্যবান। এবং পন্ডিচেরীতে পৌঁছার পর থেকে তাদের অসাধারণ কাজের জন্য তাদের প্রশংসা না করে পারা যায় না। তাদের সবাই ভালো তরুণ সৈনিক এবং তাদের ব্যাপারে আমার কখনোই কোনো অভিযোগ ছিল না। কোনোরকম বাড়াবাড়ি ছাড়াই বলা যায়, তারা ছিল আমার সৈন্যদলের চ্যাম্পিয়ন!”
দক্ষিণ ফ্রান্সের তোলোন বন্দরে পৌঁছানোর পর এই বাঙালি সৈন্যদেরকে একটি ৭৫ মি.মি. আর্টিলারি ব্যাটারিতে মোতায়েন করা হয়। ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে তাদেরকে ভার্দুন শহরে মোতায়েন করা হয়। ১৯১৬ সালে এই ভার্দুনে মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, যেটি ‘ভার্দুনের যুদ্ধ’ হিসেবে ইউরোপের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
ফরাসি সেনাবাহিনীর এই বাঙালি সৈন্যরা ১৯১৮ সালে দুটি বড় অভিযানে অংশ নেন। ১৯১৮ সালের ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরে সংঘটিত হয় সেন্ট–মিহিয়েলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত বাহিনীর নিকট জার্মানি পরাজিত হয়। যুদ্ধটিতে ৪,৫০০ ফরাসি ও মার্কিন সৈন্য নিহত এবং ২,৫০০ সৈন্য আহত হয়, অন্যদিকে, ২,০০০ জার্মান সৈন্য নিহত, ৫,৫০০ সৈন্য আহত এবং ১৫,০০০ সৈন্য বন্দি হয়। এই যুদ্ধে ফরাসি সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে চন্দননগরের বাঙালি সৈন্যরাও অংশ নিয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাদের কেউ প্রাণ হারায়নি।
১৯১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিয়ামের (বর্তমান থাইল্যান্ড) সম্মিলিত বাহিনী জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে মিউস–আর্গন আক্রমণাভিযান আরম্ভ করে। এই যুদ্ধেও চন্দননগরের বাঙালি সৈন্যরা অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে ২৬,২৭৭ জন মার্কিন সৈন্য নিহত ও ৯৫.৭৮৬ জন আহত হয়; প্রায় ৭০,০০০ ফরাসি সৈন্য হতাহত হয় এবং ১৯ জন থাই সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে, ২৮,০০০ জার্মান সৈন্য নিহত, ৪২,০০০ সৈন্য আহত এবং ৫৬,০০০ সৈন্য বন্দি হয়। বাঙালি সৈন্যদের জন্য সৌভাগ্যক্রমে, এই যুদ্ধেও তাদের কেউ নিহত হয়নি। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল, সে তুলনায় চন্দননগরের এই বাঙালি সৈন্যদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবানই বলা যায়। প্রায় তিন বছর ইউরোপের বিপজ্জনক এই রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেও এই ২৬ জন সৈনিকের কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারায়নি। কেবল একজন সৈনিক, মনোরঞ্জন দাস, ফ্রান্সে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
চন্দননগরের বাঙালি সৈন্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে ফ্রান্সের যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালন করেছিল। তাদের সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের প্রত্যেককে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিসূচক মেডাল প্রদান করা হয় এবং তাদের মধ্যে একজনকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য ‘Croix de Guerre’ (যুদ্ধের ক্রস) পদক প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতের ইতিহাসে এই সৈনিকদের একপ্রকার স্থান দেয়া হয়নি বললেই চলে। ২০১৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের একটি সেমিনারে ফ্রান্সের জন্য যুদ্ধ করা এই বাঙালি সৈন্যদের স্মরণ করা হয়।