ম্যারাথনের জানা-অজানা

বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, মানুষের শরীর দৌড়ানোর জন্য উপযুক্ত নয়। সর্বোপরি, মানুষ দু’পেয়ে প্রাণী; চিতা, বনবিড়াল, হরিণ ছাড়াও প্রাণী জগতের অন্যান্য দ্রুতগতি সম্পন্ন জন্তুদের মতো চার পায়ে দৌড়ানোর সুবিধা মানুষের নেই। তাছাড়া, সময়ের সাথে সাথে মানবজাতি বেশ বিকশিত হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় অগ্রসরের পরিমাণ এত বেশি যে, দ্রুত হাঁটা-চলার পরিমাণ বেশ কম বললেই চলে। এছাড়াও, শিকারের অস্ত্রশস্ত্রের কল্যাণে মানুষ প্রয়োজনে খুব সহজেই দ্রুতগতি সম্পন্ন শিকারের পিছু নিতে পারে। লম্বা দূরত্বের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ট্রেন, অটোমোবাইল, এরোপ্লেন সহ নানা ধরনের যান-বাহনের সুবিধা তো আছেই। এমনকি, দুই ঘর দূরত্বের প্রতিবেশী, সহপাঠী, সহকর্মীরাও প্রয়োজনে একে অপরের কাছে না গিয়ে ফোন-কল, টেক্সট-মেসেজ, ই-মেইল সহ নানা সুবিধার মাধ্যমে কথাবার্তা সেরে নেয় খুব সহজেই।

তবে পৃথিবীর পুরো জনসংখ্যার একটি অংশ উপরোক্ত মতবাদকে ভুল প্রমাণ করে লম্বা দূরত্বের দৌড়ে নিজেদের সম্পৃক্ততাকে এতটাই উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, ৪২.২ কিলোমিটার টানা দৌড়ানোর মতো যন্ত্রণাদায়ক কাজটি তারা করে যাচ্ছে আনন্দে সাথে। কেউ কেউ আবার এই দূরত্ব টপকিয়ে নাম লেখাচ্ছে পঞ্চাশ কিলোমিটারের ঘরে, কেউ আবার একশত কিলোমিটার ছাড়িয়ে একশত মাইল, এমনকি আটচল্লিশ ঘণ্টা থেকে ছয়দিনের দৌড়ে অংশগ্রহণ করে পাড়ি দিচ্ছে শত শত মাইল। মানুষের মাঝে এই প্রাণোচ্ছল, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সহজেই ভেঙে না পড়া অংশটিই পৃথিবীব্যাপী ‘ম্যারাথনার’ হিসেবে এবং দূরপাল্লার দৌড়ের এই ইভেন্টটি ‘ম্যারাথন’ হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু কীভাবে এলো আজকের ম্যারাথন? ঘটনা, দুর্ঘটনা সহ ম্যারাথনের বিভিন্ন জানা-অজানা দিক নিয়েই আজকের লেখা।

ফেইডিপ্পিডেস এবং আজকের ম্যারাথন

ম্যারাথনের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের প্রথমেই যেতে হবে সেই প্রাচীন গ্রিসে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দাঙ্গায় সয়লাব এথেন্স শহরের অভিমুখে। পার্শ্ববর্তী পার্সিয়ানরা তখন নিজেদের শক্তিশালী সৈন্যদলকে লেলিয়ে এথেন্স দখলের চেষ্টায় প্রায় সফল হওয়ার পথে। সংখ্যালঘু এথেন্সবাসী, শক্তিশালী, ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পার্সিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল না। এমতাবস্থায় বাইরের সাহায্য না পেলেই নয়।  

সেই কালে যুদ্ধ চলাকালে গ্রিক সৈন্যরা পদাতিক দ্রুতগামী বার্তাবাহকদের উপর নির্ভর করতো। ঐ সমস্ত বার্তাবাহকেরা দুর্গম এলাকা, পাহাড়ি ভূখণ্ডগুলোতে বার্তা আদান-প্রদান করা সহ কূটনৈতিকের ভূমিকা পালনে দক্ষ ছিল। জেফ গ্যালোওয়ের মতে, তারা শুধু বার্তা আদান-প্রদানই করতো না, সাথে সাথে মূল পয়েন্টগুলোর উপর গুরুত্ব দিয়ে পুরো বার্তাটি প্রাপকের কাছে  ব্যাখ্যা করা, প্রত্যুত্তর দেওয়ার সময় প্রাপকের চেহারারা অভিব্যক্তি, কণ্ঠের আবেগের বর্ণনাও গ্রিক সেনাপ্রধানদের কাছে পৌঁছে দিতো।

ম্যারাথন রোড বরাবর অবস্থিত ফেইডিপ্পিডেসের ভাস্কর্য; Image Source: wikimedia commons

সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সাল। পার্সিয়ানদের সাথে গ্রিকদের যুদ্ধ চলাকালে ম্যারাথন শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত দুর্গ থেকে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য গ্রিসের দক্ষিণে অবস্থিত স্পার্টার দিকে বার্তাবাহক হিসেবে ফেইডিপ্পিডেস(Pheidippides)কে পাঠানো হয়। সে সময় স্পার্টা ডোরীয় গ্রিক সামরিক সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পুরো দেড় দিন টানা দৌড়ে ফেইডিপ্পিডেস স্পার্টায় পৌঁছলেও স্পার্টানদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে হতাশার সাথে ম্যারাথনে ফিরে আসেন। এসেই শুনতে পান, বিশাল পার্সিয়ান সৈন্যদলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ম্যারাথনের যোদ্ধারা বড় জয় নিশ্চিত করেছে। কিংবদন্তি অনুসারে, এ সংবাদ এথেন্সে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফেইডিপ্পিডেসকে আবার রাস্তায় নামতে হয়। তিনি প্রায় ২৬ মাইল পুরোদমে দৌড়ে শহরের কেন্দ্রে পৌঁছান এবং “নানিকাক্যাম্যান” বা “আমরা বিজয়ী হয়েছি” বলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

https://assets.roar.media/assets/BpFFTIPyHtICJvRl_Pheidippides-720x586.jpg
শিল্পীর তুলিতে ফেইডিপ্পিডেসের এথেন্স শহরের কেন্দ্রে এসে “নানিকাক্যাম্যান” বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য; Photo by Rischgitz/Getty Images 

১৮৯৬ সালে গ্রিসে অনুষ্ঠিত আধুনিক সময়ের প্রথম অলিম্পিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম অ্যাথলেটিক ইভেন্ট হিসেবে ম্যারাথনের যাত্রা শুরু হয়। অলিম্পিকের মূল পরিকল্পনাকারী ব্যারন পিয়েরে ডি কুবার্তো হলেও, বার্তাবাহক ফেইডিপ্পিডেসের স্মরণে অলিম্পিকের মূল ক্রীড়াগুলোর অংশ হিসেবে ম্যারাথন থেকে এথেন্স শহরের কেন্দ্রে দূরপাল্লার দৌড়ের রেসটি অলিম্পিকের সহ-সংগঠক মিশেল ব্রেআল যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। ম্যারাথন এবং এথেন্স, এই দুই শহরের কেন্দ্র থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব যদিও প্রায় ত্রিশ মাইল, ফেইডিপ্পিডেসের সেই কিংবদন্তিতুল্য ট্র্যাকটি ছিল একুশ থেকে ছাব্বিশ মাইলের মতো। সেই বিবেচনায় অলিম্পিকের কর্তৃপক্ষ প্রথম ম্যারাথনের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার ধার্য করেন, যা প্রায় ২৪.৮৫ মাইলের সমান।

১৮৯৬ সালের ম্যারাথনের জন্য প্রস্তুতিকালে তিন অ্যাথলেট; Photo by Burton Holmes

নিজেদের দেশে নিজেদের আত্মত্যাগী পূর্বপুরুষের স্মরণে শুরু হওয়া ম্যারাথনের প্রথম আসরে নিজেদের অংশগ্রহণকারীদের প্রথম অবস্থান নিশ্চিত করার ব্যাপারে গ্রিকরা ছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারী দলটি বেশ যত্ন সহকারে বাছাই করা হয় মূল ইভেন্টের জন্য, নির্ধারিত ম্যারাথন থেকে এথেন্সের সেই ট্রেকে কয়েকটি ট্রায়াল রেসের মাধ্যমে। ১৮৯৬ সালের ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম ট্রায়াল রেসের দ্রুততম ফিনিশার ছিলেন চরিলাওস ভিসিলাকস(Charilaos Vasilakos)। তিনি ৩ ঘণ্টা ১৮ মিনিটে তার রেস শেষ করেন। কিন্তু ১৮৯৬ সালের ১০ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক ম্যারাথনের মূল ইভেন্টে মাত্র ২ ঘণ্টা ২৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে ফিনিশ-লাইন স্পর্শ করে ইতিহাস গড়েন স্পিরিডোন লৌইস(Spyridon Louis)। তিনি ট্রায়াল রেসের দ্বিতীয় দফায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, অলিম্পিকের মূল ইভেন্টের রেস চলাকালে লৌইস মাঝপথে পিকেরমি গ্রামে থেমে এক মগ ওয়াইন পান করতে করতে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনিই আজকের রেস জিততে যাচ্ছেন। মূল ইভেন্টে ভিসিলাকসের অবস্থান ছিল দ্বিতীয় এবং পঁচিশজন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে মাত্র নয়জন ফিনিশিং লাইনে পৌঁছতে পেরেছিলেন।

দূরত্ব নিয়ে যত দ্বন্দ্ব

১৮৯৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের পরপরই ম্যারাথনের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর নানা জায়গায় অনুষ্ঠিত হতে থাকে একের পর এক ইভেন্ট। প্রায় প্রত্যেকটি ইভেন্টই ছিল অলিম্পিকের নির্ধারিত দূরত্বের; তবে তখনো সেটি আদর্শ দূরত্ব হিসেবে নির্ধারিত হয়নি। কিছু কিছু ইভেন্টে দূরত্বের ভিন্নতা থাকতো। কিন্তু লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রথম অলিম্পিকের সময় ম্যারাথনের দূরত্বে বেশ বড় একটা পরিবর্তন আসে।

১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে রানী আলেকজান্দ্রার নির্দেশে ম্যারাথন রেস শুরু হয় ব্রিটিশ উইন্ডজর ক্যাসল থেকে এবং শেষ হয় অলিম্পিক স্টেডিয়াম খ্যাত হোয়াইট সিটি স্টেডিয়ামের রয়্যাল ভিউয়িং বক্সের সামনে এসে; যার দূরত্ব পুরো ২৬.১৯৫ মাইল। সে সময় থেকেই প্রথানুযায়ী, ম্যারাথনাররা শেষ এক মাইল দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সময় সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বলতো, “প্রভু রানীকে রক্ষা করুক”

১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত লন্ডন ম্যারাথনে প্রথম ফিনিশার হিসেবে ফিনিশ-লাইন স্পর্শ করছেন ইতালিয়ান ম্যারাথনার ডুরান্দো পিয়েট্রি। যদিও ভলান্টিয়ারদের সাহায্য নেওয়ায় তাকে পরবর্তীতে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়; Photo by PA/EMPICS   

গ্রিসে অনুষ্ঠিত ১৮৯৬ সালের ম্যারাথন সহ প্রথম সাতটি আধুনিক অলিম্পিকে ম্যারাথনের ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি দূরত্ব ছিল। লন্ডন অলিম্পিকের পর পুরো ১৩ বছর ধরে ম্যারাথনের দূরত্ব নিয়ে চলা তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে ১৯২১ সালের মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশন(IAAF) ম্যারাথনের আদর্শ দূরত্ব হিসেবে ২৬.১৯৫ মাইলকেই বেছে নেয়। 

বোস্টন ম্যারাথন এবং ম্যারাথনে নারীদের অংশগ্রহণ

আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরের রেশ কাটতে না কাটতেই বোস্টন অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের হাত ধরে ১৮৯৭ সালের ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ‘বোস্টন ম্যারাথন’। এযাবতকালের সবচাইতে পুরনো এবং জমজমাট ম্যারাথনের আসর হিসেবে পরিচিত ম্যারাথন ইভেন্টের প্রথম আসরে অংশগ্রহণকারী ছিল মাত্র ১৫ জন। অ্যাশল্যান্ডের ম্যাটকাফ মিল থেকে বোস্টনের আরভিংটন ওভাল পর্যন্ত মাত্র ২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ১০ সেকেন্ডে ২৪.৫ মাইল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বোস্টন ম্যারাথনের প্রথম আসরের প্রথম ফিনিশার হিসেবে ইতিহাস গড়েন নিউ ইয়র্কের জন জে. ম্যাকডারমট।

এ বছর অনুষ্ঠিত ১২২ তম বোস্টন ম্যারাথন; Photo by Boston Marathon

মাত্র পনেরোজন ম্যারাথনার নিয়ে শুরু হওয়া বোস্টন ম্যারাথনের শতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া ইভেন্টে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৩৬,৭৪৮ জন। যার মধ্যে ৩৫,৮৬৮ জনই ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করা সহ ৩৮,৭০৮ মানুষের সমাগম গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া বোস্টন ম্যারাথনের পুরো ২৬.১৯৫ মাইল গতিপথ ধরে সম্মিলিত দর্শকের সংখ্যা ৫ লক্ষেরও উপরে। বছর বছর এর পরিমাণ বেড়েই চলছে।

প্রত্যেক বছর দাতব্য সংস্থাগুলোর জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ফান্ড উত্তোলন, ১৯৭৫ সালে বোস্টন ম্যারাথনে হুইলচেয়ার শাখার সংযোগ সহ বোস্টন ম্যারাথনেই সর্বপ্রথম নারী অংশগ্রহণকারীর আগমন ঘটে। ১৯৬৬ সালের পূর্বে পৃথিবীব্যাপী অনুষ্ঠিত সবগুলো ম্যারাথন ইভেন্টই পুরুষদের জন্য ছিল। কিন্তু ১৯৬৬ সালের আসরে প্রথম নারী হিসেবে রবার্তা ববি গিব (Roberta Bobbi Gibb) ম্যারাথনে অংশ গ্রহণ করেন এবং প্রথম নারী ম্যারাথন ফিনিশার হিসেবে ইতিহাস পাতায় নাম লেখান। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কোনো অফিসিয়াল বিব-নাম্বার ছাড়াই তিনি রেস চালিয়ে যান।

রবার্তা ববি গিব। পুরুষদের ম্যারাথনে নারী হিসেবে তার অংশগ্রহণ পত্র-পত্রিকায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; Photo by Scott Draper

অপরদিকে, ক্যাথরিন সুইৎজার প্রথম অফিসিয়ালি নথিভুক্ত নারী ম্যারাথনার হিসেবে ১৯৬৭ সালের ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করেন। যদিও, তিনি বিব-নাম্বার সংগ্রহ করেছিলেন একজন পুরুষের পরিচয় দিয়ে, কিন্তু রেসের সময় তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হোন। সে সময় ভলান্টিয়ারদের দ্বারা জোরপূর্বক রেসের গতিপথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাকে। তবে ক্যাথরিনের বন্ধু থমাস মিলার সাথে থাকায় সে যাত্রায় তিনি রেস চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান এবং দ্বিতীয় নারী ফিনিশার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন।

ভলান্টিয়ার দ্বারা ক্যাথরিন সুইৎজারকে অপসারণের চেষ্টা করা হলে তার বন্ধু থমাস মিলার সেটি প্রতিরোধের চেষ্টা করেন; Image Source: Boston Globe

পরবর্তীতে, দ্য অ্যামেচার অ্যাথলেটিক্স ইউনিয়ন ১৯৭১ সালে নারী অংশগ্রহণকারীদের ম্যারাথনে দৌড়ানোর সুযোগ দেয়। ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ অফিসিয়ালি নথিভুক্ত হয়ে ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করার প্রথম বছরে নারী অংশগ্রহণকারী সংখ্যা ছিল আটজন এবং এই আটজনই পুরো রেস শেষ করেন। প্রথম অফিসিয়াল নারী চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ট্রফি ছিনিয়ে নেন নিনা কুস্কসিক।

বোস্টন ম্যারাথন বম্বিং

শত বছরের উপর চলে আসা জনপ্রিয় বোস্টন ম্যারাথনে ইতিহাস গড়া নানান ঘটনা ঘটলেও বোস্টন ম্যারাথন বম্বিং ছিল এমন একটি ট্র্যাজেডি, যা কখনো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল ১১৬তম আসরে ফিনিশ-লাইনের মাত্র ১৯০ মিটার দূরত্বে বাড়িতে তৈরি প্রেশার-কুকার বোম বিস্ফোরিত হয়ে তিনজন মারা যায়, আহত হয় কয়েক শত মানুষ এবং ষোলজনের মতো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায়। ঘটনায় দোষী হিসেবে পুলিশ জোখার সারনায়েভ এবং তামেরনাল সারনায়েভ নামের দুজন চেচেন বংশদ্ভূত ভাইকে চিহ্নিত করে। পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে বোমা হামলায় মূল পরিকল্পনাকারী তামেরনাল মারা গেলেও পুলিশের হাতে তার ভাই সারনায়েভ ধরা পড়ে এবং পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আলট্রা-ম্যারাথন ও অন্যান্য

দূরপাল্লার দৌড়ে আগ্রহ আছে, ম্যারাথন শব্দটার সাথে পরিচিত অধিকাংশ মানুষই হাফ, আলট্রা, আলট্রা-ট্রেইল, স্টেজ-ম্যারাথনের মতো শব্দগুলোর সাথে পরিচিত। কেউ কেউ আবার এগুলোর নাম শুনলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। কেননা, শব্দগুলো সাথে ২১.১ কিলোমিটার থেকে কয়েকশ কিলোমিটার টানা দৌড়ের সম্পর্ক রয়েছে, যা শুধু অনেকের জন্য দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। সে যা-ই হোক, কারো কারো কাছে ম্যারাথনের এই টার্মগুলো বেশ গোলমেলে হলেও নামগুলো থেকেই অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়।

হাফ-ম্যারাথন মূলত মূল ম্যারাথনের অর্ধেক দূরত্ব; অর্থাৎ, প্রায় ২১.১ কিলোমিটার বা ১৩.১ মাইলের রেস। সাধারণত, মূল ম্যারাথনের প্রস্তুতিলগ্নে অধিকাংশ ম্যারাথনারই এই দূরত্বের দৌড়ের মহড়া দিয়ে থাকেন। তাছাড়া, ফান্ড তোলা, স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এনডুরেন্স ইভেন্ট হিসেবে এটি বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে এনডুরেন্স ইভেন্টগুলো এখনো বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেনি, সেখানে এই দূরত্বের রেস বেশ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে বিডিরানার আয়োজিত ঢাকা হাফ-ম্যারাথনের সাথে সাথে থাউজেন্ড মাইল এক্সপিডিশন, দ্য বিগ বাংলা রান, কম্পাস সহ আরো কয়েকটি প্রফিট, নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন হাফ ম্যারাথন বন্দোবস্ত করে থাকে। চায়নার দ্য গ্রেট ওয়াল হাফ, লন্ডনের রয়াল পার্কস হাফ-ম্যারাথন, গ্রিসের এথেন্স হাফ-ম্যারাথন, সাউথ আফ্রিকার সাফারি হাফ-ম্যারাথন পৃথিবীব্যাপী বেশ জনপ্রিয়।

ঢাকা হাফ-ম্যারাথন’১৮ তে ফিনিশ-লাইন স্পর্শ করার পূর্ব মুহূর্তে; Photo by Dhaka half-marathon 

অপরদিকে আলট্রা-ম্যারাথন হচ্ছে প্রচলিত ম্যারাথন থেকে দূরত্ব বেশি, এমন যেকোনো ম্যারাথন। প্রচলিত আলট্রা-ম্যারাথনের ইভেন্টগুলো পঞ্চাশ কিলোমিটার থেকে শুরু করে একশত মাইল পর্যন্ত দূরত্বের হয়ে থাকে। এই দূরত্ব ছাড়িয়ে আরো পথ পাড়ি দেওয়ার রেকর্ডও অনেকগুলো। অন্যদিকে, দূরত্ব হিসেব না করে, সময়ের উপর নির্ভর করেও আলট্রা-ম্যারাথনের ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। ঐ ধরনের ইভেন্টগুলোই স্টেজ-ম্যারাথন হিসেবে খ্যাত। এগুলোকে শুধু দৌড়ের ক্যাটাগরিতে না ফেলে একপ্রকার অ্যাডভেঞ্চার হিসেবেই ভালো মানায়। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের ইভেন্টগুলো রোড-রেস থেকে ট্রেইল-রেসেই বেশি হয়ে থাকে; অর্থাৎ লম্বা দূরত্ব দৌড়ানোর সাথে সাথে ম্যারাথনারদের হাই-অল্টিটিউডে হাইকিংয়ের কাজও করা লাগে। এ ধরনের ম্যারাথনগুলোই মূলত ট্রেইল-ম্যারাথন হিসেবে পরিচিত।

ট্রেইল-আল্ট্রা ম্যারাথন: সাধারণ দৌড়, নাকি অ্যাডভেঞ্চার? Image Source: lifeofadventure.com

পুরুষদের মাঝে স্টেজ-ম্যারাথনের আটচল্লিশ ঘণ্টা ক্যাটাগরিতে ট্র্যাক এবং রোড ভেন্যুতে যথাক্রমে ৪৭৩.৪৯৫ কিলোমিটার এবং ৪৩৩.০৯৫ কিলোমিটার দৌড়ানোর বিশ্ব রেকর্ডটি গ্রিক দৌড়বিদ ইয়াননিস কোরাসের। অপরদিকে, মহিলা ক্যাটাগরিতে ট্র্যাক ভেন্যুতে জাপানি দৌড়বিদ সুমি ইনাজিকির রেকর্ড ৩৯৭.১০৩ কিলোমিটার এবং রোড ভেন্যুতে পোলিশ দৌড়বিদ প্যাটরিকা বেরেজনওসকার পুরো ৪০১ কিলোমিটার দৌড়ানোর রেকর্ডটি এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে।

ডেথ ভ্যালিতে ব্যাডওয়াটার আল্ট্রা-ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারীরা! প্রায় পঞ্চান্ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে ১৩৫ মাইলের পথ দৌড়ে পাড়ি দিতে হবে তাদের; Photo by Reuters

ডেথ ভ্যালিতে প্রায় পঞ্চান্ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে ১৩৫ মাইলের ‘ব্যাডওয়াটার আল্ট্রা-ম্যারাথন’, দক্ষিণ মেরুতে মাইনাস পঁচিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ‘অ্যান্টারটিক আইস ম্যারাথন’ সহ পৃথিবীব্যাপী ম্যারাথন, আল্ট্রা-ম্যারাথনের কাঠিন্যে এত ভিন্নতা রয়েছে যে, দুঃসাহসিক অভিযাত্রীদের মন-মানসিকতার মানুষেরাই এ ধরনের ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণের সাহস করে। কিন্তু চ্যালেঞ্জে ভরা এসব এনডুরেন্স ইভেন্টে মানুষ কেন অংশগ্রহণ করে? প্রতিটি স্বতন্ত্র দৌড়বিদের স্বতন্ত্র উত্তর থাকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে ঘুমহীন ৮০ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটে টানা ৫৬০ কিলোমিটার দৌড়ে আলোচিত হওয়া, একনাগাড়ে পঞ্চাশ দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করে বিশ্ব রেকর্ড করা, ‘আল্ট্রা-ম্যারাথন ম্যান’ খ্যাত বিখ্যাত দৌড়বিদ ডিন কারনাযেস বলেন,

 “আমি দৌড়াই, কেননা আমার পদচিহ্ন বিবর্ণ হতে হতে আমি হয়তো গুটিকয়েক মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যেতে পারবো, যারা সহজ পথ এড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেইল দিয়ে ছুটবে, পায়ের পর পা ফেলে আমার মতো একই গন্তব্যে পৌঁছবে। আমি দৌড়াই, কেননা এটি সব সময় আমায় ঠিক ঐখানটায় পৌঁছে দেয়, যেখানে আমি যেতে চাই। ”

আরো পড়ুন: ডিন কারনাযেস: অতিমানবীয় এক দৌড়বাজের গল্প

ফিচার ছবি: Los Angeles Times

Related Articles

Exit mobile version