ধনী হতে কে না চায় বলুন? সম্পদ মানুষের কাছে পরম আরাধ্য। বলা চলে অনেকটা মোহের মতো। আমরা নিজেরা যেমন সম্পদশালী হতে ভালবাসি তেমনি শুনতেও ভালবাসি সম্পদশালীদের গল্প। তাই তো আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের আগ্রহের বিষয় হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীরা।
একবিংশ শতকে বসে সম্পদকে আমরা টাকা, ডলার বা যেকোন কাগজের নোট দিয়ে মাপতে পারি। কিন্তু সভ্যতার মোটামুটি সাড়ে পনের আনা সময় জুড়ে সম্পদের মূল্যমান নির্ধারক ছিল স্বর্ণ বা রৌপ্য। আমরা সবাই জানি আজকের দিনের ১০০ টাকা আর পঞ্চাশ বছর আগের ১০০ টাকার মূল্যমান মোটেও এক নয়। তাই প্রতিযুগের সেরা ধনীদের এই তালিকাটি করতে গিয়ে সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে সোনার বিপরীতে। যেহেতু যে কোনো দুইটি শতাব্দির সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির মানদণ্ড ভিন্ন তাই সর্বকালের সেরা ধনীদের তালিকা তৈরি করার সময় একই শতাব্দীর একাধিক ধনী মানুষকে বিবেচনা না করে বরং আলাদা আলাদা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের বিবেচনা করা হয়েছে, যাতে করে বোঝা যায় গত এক হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ ছিলেন কারা। আসুন তাহলে জেনে নিই কারাই বা ছিলেন সেই আমিরদের আমির, ওমরাহদের ওমরাহ।
একাদশ শতক- উইলিয়াম দ্যা কংকারার
একাদশ শতকের সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ ছিলেন ইংল্যান্ড জয়ী প্রথম নরম্যান রাজা উইলিয়াম। তার উপাধি দ্যা কংকারার বা বিজয়ী। ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে জন্ম নেওয়া উইলিয়াম ইংল্যান্ড জয় করে কয়েক’শ বছরের অ্যাংলো-স্যাক্সন শাসনের অবসান ঘটান। উইলিয়ামের ইংল্যান্ড বিজয় ইতিহাসে সূচনা করেছিল নতুন অধ্যায়ের। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব যাই হোক না কেন অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে তিনিই ছিলেন সেই যুগে সবার সবচেয়ে এগিয়ে। তাই একাদশ শতকে সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ হিসাবে ধারণা করা হয় তাকেই। যেহেতু রাজাই হলেন রাজ্যের মালিক, সেই হিসাবে রাজ্যের যাবতীয় সম্পদ বিবেচনায় তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৩০ বিলিওন ডলার যা বিলগেটসের সম্পদের প্রায় ৩ গুণ!
দ্বাদশ শতক- চেঙ্গিস খান
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন মানব সভ্যতার ইতিহাসে চেঙ্গিস খানের ভূমিকা সুদূর প্রসারী। এতটাই সুদূর প্রসারী যে কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে বর্তমান পৃথিবীতে জীবিত পুরুষদের ২% নাকি কোন না কোন দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর। যদিও ছোট পরিসরে চালানো এসব গবেষণা মূলত পরিসংখ্যানিক তবুও মানব ইতিহাসে চেঙ্গিসের প্রভাব বুঝিয়ে দিতে যথেষ্ট। প্রায় এক কোটি বর্গকিমি আয়তনের বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক চেঙ্গিসকে নির্দ্বিধায় দ্বাদশ শতকের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান মানুষ বলা যায়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা ভাল চেঙ্গিসের বড় বড় বিজয়গুলো যেমন, খোয়ারেজেম এবং মাঞ্চুরিয়া বিজয় সংঘটিত হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে। তবুও চেঙ্গিস খান ত্রয়োদশ শতকে নয় দ্বাদশ শতকের ইতিহাসেই জায়গা করে নিয়েছে কারণ তার প্রতিপত্তি শুধু ত্রয়োদশ শতকে বলার চেয়ে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতক মিলিয়ে বলাই বোধ হয় বেশি যৌক্তিক।
ত্রয়োদশ শতক- ফিলিপ্পো ডি অ্যামেডিও ডি পেরুজ্জি
ফ্লোরেন্সের এই ধনাঢ্য বনিককে বলা হয় ত্রয়োদশ শতকের সবচেয়ে ধনী মানুষ। এখনকার হিসাবে যার সম্পদের পরিমাণ ছিল মোটামুটি ২০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। সে সময় ফ্লোরেন্স ও ভেনিসের বনিকরা এক চেটিয়াভাবে আমদানি রপ্তানির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন সারা ইউরোপে। কারণ ইউরোপ থেকে ভারতে সরাসরি আসার পথ তখনো অজানা। তাই ইউরোপে বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল ফ্লোরেন্স ও ভেনিস বন্দর। ফিলিপ্পোর পরিবার প্রায় দেড়শ বছর অবধি রক্ষা করে গিয়েছিল পারিবারিক ঐতিহ্য। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শতবর্ষ ব্যাপি যুদ্ধের খরচ চালাতে তাদের কাছে থেকেই টাকা ধার নিয়েছিলেন ইংরেজ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড
চতুর্দশ শতক- মানসা মুসা
এবার যার নাম বলতে যাচ্ছি তিনি শুধু চতুর্দশ শতকেই নয়, অনেক মতে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী। তার নাম মানসা মুসা। মানসা তার উপাধি। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে তাঁর জন্ম। মালির সুলতানকে বলা হত মানসা। মূলত স্বর্ণের অগাধ রিজার্ভ ছিল তাঁর সম্পদের মূল উৎস। চেঙ্গিস খান ইতিহাসে যেমন কুখ্যাত হয়ে আছে তার প্রবল পরাক্রম অপব্যবহার করে ধ্বংস লীলা চালানোর জন্য ঠিক তার উল্টো ছিলেন মুসা। বদান্যতার জন্য বিখ্যাত এই মহান মানুষটি একবার পবিত্র হজ্ব পালন করতে গিয়ে রাস্তায় গরিব মানুষের মাঝে এত বেশি পরিমাণ সোনা বিলিয়েছিলেন যে, মিশরে অতিরিক্ত স্বর্ণের জোগানের দরুন মূল্যস্ফীতি ঘটেছিল। পরে উপায়ন্ত না দেখে অনেক স্বর্ণ বাজার থেকে অপসারণ করা হয়।
পঞ্চদশ শতক-জ্যাকব ফ্যাগার
জ্যাকব ফ্যাগারের জন্ম হয়েছিল জার্মানিতে, বিখ্যাত ফ্যাগার পরিবারে। হলি রোমান এম্পায়ারের সম্রাট নির্বাচনের সময় তারই ধারের টাকায় নির্বাচিত হন সম্রাট পঞ্চম চার্লস। রাষ্ট্র তার কাছে এত বেশি ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল যে, ফ্যাগারকে টাকশালের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল ধার শোধ করতে না পেরে। তাই বলা হয়ে থাকে ফ্যাগার টাকা বানাতে পারতেন। এখনকার হিসাবে এই ধনকুবেরের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৭৫ বিলিয়ন ডলার!
ষোড়শ শতক-সুলাইমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট
ষোড়শ শতকের ইতিহাস সুলাইমান আল কানুনিকে বাদ দিয়ে লিখা সম্ভব নয়। ইউরোপে এই ওটোম্যান খলিফা সুলাইমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট নামেই পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে “সুলতান সুলেমান” ড্রামা সিরিজের কল্যাণে তাঁর নাম জেনেছেন অনেকই। শাসক হিসাবে ন্যায়পরায়নতা, কিংবা সুলতান হিসাবে প্রতাপ কোন কিছুরই কমতি ছিলনা তাঁর। আর তাই তো ঘোর শত্রু ইউরোপেও তাঁকে ডাকা হয় দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট নামে। ভূমধ্যসাগর, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া মাইনর, ইউরোপের বলকান মিলিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পদের বিপুলত্ব সহজেই অনুমেয়। শাসক হিসাবে সম্পদকে অভিজাত শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত করে রাখা মোটেও পছন্দ করতেন না সুলাইমান আল কানুনি। তাই রাষ্ট্রীয় আইন করে নিশ্চিত করেছিলনে গরীবের ন্যায্য হিস্যা। উল্লেখ্য সুদীর্ঘ ৫০ বছর সাফল্যের সাথে রাজ্য পরিচলনা করেন সুলতান সুলাইমান।
সপ্তদশ শতক-সম্রাট আওরঙ্গজেব
সাধারণ মানুষের কাছে বাদশা আলমগীর নামেও তিনি পরিচিত। নিঃসন্দেহে পরাক্রমশালী মুঘল বংশের লাস্ট গ্রেট তিনিই। তাঁর আমলেই মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল সারা ভারতবর্ষে। তাঁর শক্ত হাতে পরিচালিত সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের শাসনকালে ভারতে পাত্তাই পায়নি ইউরোপীয় বেনিয়ারা। বলা হয়ে সপ্তদশ শতকে পৃথিবীর মোট জিডিপির ২৫% অবদানই ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের। ১৭০৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমেই ক্ষীয়মাণ হতে থাকে দিল্লীর মসনদের আলো। তাই প্রবল পরাক্রমশালী অথচ খুব সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই সম্রাট সবার উপরে রয়েছেন সপ্তদশ শতাব্দীর সম্পদশালী মানুষের তালিকায়।
অষ্টাদশ শতক-স্টিফেন জিরার্ড
ফরাসি বংশোদ্ভূত এই আমেরিকান ব্যবসায়ীকে ধরা হয় অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ। তাঁর সম্পদের পরিমাণ এখনকার হিসাবে প্রায় ১০৫ বিলিওনের মতো। মূলত শিপিং বিজনেসম্যান জিরার্ড বিবেচনা করা হয় মার্কিন ইতিহাসের সর্বকালের চতুর্থ সেরা ধনী এবং অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ ধনী হিসাবে।
উনবিংশ শতক- দ্যা রথশিল্ড ফ্যামিলি
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে রহস্যময় পরিবারগুলোর একটি হল দ্যা রথশিল্ড ফ্যামিলি। কত ঘটনা, বাস্তবতা, কল্পকথা ও কন্সপিরিসি থিওরি যে তাদের নিয়ে প্রচলিত আছে সেটার ইয়াত্তা নেই। কোনো ধরণের সন্দেহ ছাড়াই ইউরোপের এই ব্যাংকার পরিবারকে উনবিংশ শতাব্দীর সেরা ধনী বলা যায়। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি ছিল এই পরিবার। তাদের সম্মিলিত সম্পদ কত সেটা নিয়ে অনেক গুঞ্জন শোনা যায় তবে সেটা মোটেও এক ট্রিলিওনের নিচে নয়! শুধু সম্পদ বিবেচনায় নয় কলনিয়াল যুগে ইউরোপের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিস্ময়কর।
বিংশ শতক জন ডি রকফেলার
বিংশ শতকে জন ডি রকফেলার এক অতি পরিচিত নাম। তিনি তেলের ব্যবসা করেই কামিয়েছিলেন চোখ কপালে তোলা পরিমাণ সম্পদ যেটার বর্তমান মূল্য ৩৪০ বিলিয়ন। বলা হয় ১৯১১ সালে এন্টি ট্রাস্ট আইনে পড়ার আগে তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন গোটা পৃথিবীর ৯০% তেলের বাজার।
একবিংশ শতাব্দীতে মাত্র ১৬ বছর অতিবাহিত হলো। এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘটে গেছে অভূতপূর্ব রদবদল তাই এখনো বলা সম্ভব নয় কে হতে চলেছেন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী মানুষ। হয়ত সেটা হতে পারেন আপনিই!