ট্রেঞ্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের যুদ্ধ স্থির যুদ্ধে পরিণত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরতে থাকে, কিন্তু কোনো পক্ষই এগোতে পারে না। এর মধ্যে দুই পক্ষের প্রশিক্ষিত বাহিনী হয় মৃত, না হয় আহত। ফলে যুদ্ধে নাম লেখাতে শুরু করে অপ্রশিক্ষিত, অনেক ক্ষেত্রে স্কুলপড়ুয়া কিশোরেরা। যুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখার আগেই দলে দলে মারা পড়তে থাকে তারা। অবাক করা বিষয় হলো: এই ভয়াবহ যুদ্ধে কেন তারা নাম লেখায়। অথবা, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন আদেশ আসে, ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে, তখন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কেন তারা আদেশ পালন করে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, অনেকক্ষেত্রেই তারা জানে না যুদ্ধক্ষেত্রে আসলে কী হচ্ছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা কৌশলে গোপন রাখা হতো বেসামরিক মানুষদের কাছে। সেই সাথে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যদি যুদ্ধে না যায়, তাহলে সেটাকে সমাজে কাপুরুষতা ধরে নেয়া হতো সেসময়। আবার, একবার যুদ্ধের ময়দানে যোগ দিলে, সেখানে আদেশ পালন না করা মানে মৃত্যুদণ্ড। তবে শুধু মৃত্যুদণ্ডের ভয় নয়, সৈন্যরা জানে, একজন তার অবস্থান পরিত্যাগ করলে তার চারপাশের সহযোদ্ধারা বিপদে পড়বে। দেশের জন্য নয়, সহযোদ্ধাদের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে অনেকে নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।
পশ্চিমের যুদ্ধ স্থির যুদ্ধে পরিণত হলেও পূর্বে আরও কিছু পরিবর্তন চলতে থাকে। ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্ক (অটোম্যান সাম্রাজ্য) যুদ্ধে প্রবেশ করে। এই সময় রাশিয়া ছিল তুরস্কের চিরশত্রু। সেই সাথে তুরস্কের কাছে জার্মানিকে এই যুদ্ধের সম্ভাব্য বিজেতা মনে হয়। ফলে তারা জার্মানির সাথে জোট গঠন করে। উল্লেখ্য, ১৯১২ এবং ১৯১৩ সালে বলকান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অটোমানদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে আসে। অটোমানদের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা না ছিল না জার্মানির। কিন্তু অটোমানরা তাদের পক্ষে থাকায় অন্যভাবে কিছু সুবিধা ভোগ করে জার্মানি। অটোমানরা ওই সময় বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। ফলে ব্রিটিশদের মন দিতে হয় তাদের মধ্যপ্রাচ্যের উপনিবেশ প্রতিরক্ষার দিকে। উল্লেখ্য, সেই সময় খিলাফত বিদ্যমান থাকায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অটোম্যান সুলতান ছিলেন সমগ্র মুসলিম বিশ্বের নেতা। আর ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া সব দেশেই আছে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী। ফলে ওসব দেশের শাসকরা মুসলিম বিদ্রোহ হতে পারে বলে ভয় পেয়ে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত বড়সড় কোনো মুসলিম বিদ্রোহ হয়নি ওসব দেশে।
১৯১৪ সালের শেষের দিকে যুদ্ধে আরেক নতুন মাত্রা যোগ হয়: ইউরোপের শীতকাল। ট্রেঞ্চের ভয়ংকর শীতে জমে অনেক সৈন্য মারা যেতে থাকে। ক্রমশ প্রতীয়মান হতে থাকে যে— এই যুদ্ধে আক্রমণের চেয়ে প্রতিরোধ করা সহজ। সংখ্যায় বা প্রযুক্তিতে কম হলেও শুধুমাত্র ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মেশিনগান আর রাইফেল দিয়ে অনেক বড় আক্রমণকে প্রতিহত করা সম্ভব। লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে চলতে থাকা এই যুদ্ধে যেমন বেরিয়ে আসে সভ্যতার কুৎসিততম দিক, তেমনি অজস্র উদাহরণ স্থাপিত হয় মানবতার। উল্লেখযোগ্য— ১৯১৪ সালের ক্রিসমাসের ঘটনা। ওই রাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই থেমে যায় বন্দুক আর কামানের গর্জন। দুই পক্ষের ট্রেঞ্চে জ্বলতে থাকে ক্রিসমাসের মোমবাতি। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ একসাথে গলা মিলিয়ে গাওয়া শুরু করে ক্রিসমাসের গান। সাহস করে একজন একজন করে ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। প্রথম সামনা-সামনি দেখার সুযোগ হয় শত্রুপক্ষের মানুষদের। ভাষা আলাদা হলেও ভাব বিনিময়ে খুব একটা সমস্যা হয় না। আদানপ্রদান হয় চকলেট আর সিগারেট। কথিত আছে, জার্মান আর ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে ফুটবল ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয় ঐদিন।
ক্রিসমাসের এই ঘটনা দুই পক্ষের নেতারা ভালভাবে নেননি। তারা নিশ্চিত করেন যেন ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা আর না ঘটে। যুদ্ধ ক্রমাগত আরও নিষ্ঠুর হতে থাকে। স্থিরাবস্থা ভাঙার জন্য দু’পক্ষই নতুন নতুন পন্থা খুঁজতে থাকে। ভেঙে পড়তে থাকে যুদ্ধের বিভিন্ন বিধিনিষেধ (Laws of War)। ১৯১৫ সালের মে মাসে জার্মান জেপলিন বিমান লন্ডনে বোমা হামলা চালায়। ইতিহাসে প্রথম শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, নিজ গৃহেও মানুষ অনিরাপদ বোধ করতে থাকে। জার্মানি এ সময় বুঝতে পারে যে যুদ্ধ লম্বা সময় ধরে চললে ব্রিটেন বা ফ্রান্স এগিয়ে যাবে; কারণ, তাদের লোকবলের অভাব হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কলোনি থেকে তারা আনতে পারবে অজস্র সৈন্য, যে সুযোগ নেই জার্মানির। ফলে মরিয়া হয়ে নতুন নতুন ভয়ংকর অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে তারা। ১৯১৫ সালের আগস্ট মাসে ইপ্রাতে প্রথম বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করা হয় শত্রুর বিরুদ্ধে। বাতাস যখন অনুকূলে তখন প্রায় ৬ম০০০ বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাসের সিলিন্ডার খুলে দেয় জার্মান বাহিনী। অপরপ্রান্তে থাকা ফ্রেঞ্চ এবং কানাডিয়ান বাহিনী প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি— কী হতে চলেছে।
তারা অবাক হয়ে দেখতে থাকে বাতাসে ভেসে আসতে থাকা হলুদাভ এই গ্যাসকে। অবশেষে এই গ্যাস তাদের ট্রেঞ্চে পৌঁছায় এবং মুহূর্তেই তাদের ফুসফুস ঝাঁজরা হতে থাকে বিষাক্ত গ্যাসে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা পড়তে থাকে সৈন্যরা। সহযোদ্ধাদের করুণ পরিণতি দেখে অনেকেই পালাতে শুরু করে। প্রায় ৬ মাইল লম্বা গ্যাপ তৈরি হয়। জার্মান বাহিনীও আশা করেনি গ্যাস এত কার্যকর হতে পারে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আক্রমণ করার জন্য তারাও প্রস্তুত ছিল না। অচিরেই সৈন্যদের হাতে হাতে পৌঁছে যায় গ্যাস মাস্ক, কার্যকারিতা কমে যায় বিষাক্ত গ্যাসের।
যুদ্ধের এই পর্যায়ে জার্মানি তাদের আরেক ভয়ঙ্কর অস্ত্র, সাবমেরিন ব্যবহার শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ। আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, কোনো বেসামরিক জাহাজকে আক্রমণের আগে তাদের সতর্ক করতে হবে। কিন্তু সতর্ক করতে হলে সাবমেরিনকে পানির উপরে আসতে হবে, যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আন্তর্জাতিক নীতি লঙ্ঘন করেই আক্রমণ চালাতে থাকে জার্মান সাবমেরিন। ফলে বিশ্ব দরবারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অগত্যা জার্মানি বেসামরিক জাহাজ আক্রমণ বন্ধ রাখে।
আবার ফিরে যাওয়া যাক পূর্বে। তুরস্ক যুদ্ধে যোগদানের সাথে সাথে এমন এক কাজ করে, যা রাশিয়ার জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা ডারডানেল পাস (Dardanelles Strait) বন্ধ করে দায়। এই পাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এটা ব্ল্যাক সি-কে যোগ করেছে অন্যান্য মহাসাগরের সাথে। আর এই ব্ল্যাক সি-তে আছে রাশিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ডারডানেল পাস বন্ধ করে দেওয়ায় রাশিয়ার ওসব বন্দর অকেজো হয়ে পড়ে। রাশিয়াকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে ব্রিটেন। ব্রিটেনের আছে বেশ কিছু আধুনিক যুদ্ধজাহাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব যুদ্ধজাহাজ আচমকা আক্রমণ করবে ডারডানেল পাস দিয়ে। দুই পাড়ে থাকা দুর্গগুলোকে শেলিং করে গুঁড়িয়ে দেবে প্রথমে। ডারডানেল পাস পার করলে তারা পৌঁছে যাবে ইস্তাম্বুলের তীরে। পুরো শহরকে জিম্মি করে ফেলা হবে শুধু নৌবহর দিয়ে। ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় এই আক্রমণ। কিন্তু এই যুদ্ধের অন্যান্য অনেক পরিকল্পনার মতো এই পরিকল্পনাও অচিরেই ভেস্তে যেতে শুরু করে। বেশ কিছু জাহাজ পেতে রাখা মাইনের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়। ফলে এই নৌবহরকে কয়েকবার পিছু হঠতে হয়, আচমকা আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অটোম্যান বাহিনী মূল্যবান সময় পেয়ে যায় তাদের দুর্গগুলো শক্তিশালী করার জন্য।
নৌবাহিনী যখন পাস দখল করতে ব্যর্থ হয়, তখন পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। প্রায় ৮০,০০০ সৈন্যের এক পদাতিক বাহিনী জড়ো করা হয়, যাদের দায়িত্ব পড়ে পাসের দুই দিকের দুর্গগুলো দখল করা। এর মধ্যে ছিল প্রায় ২৫,০০০ সৈন্যের অস্ট্রেলিয়ান আর নিউজিল্যান্ড বাহিনী। ২৫শে এপ্রিল এই বিশাল বাহিনী গালিপলির তীরে অবতরণ শুরু করে। কিন্তু সেখানে টার্কিশ বাহিনী অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। অবতরণের সাথে সাথে টার্কিশ মেশিনগানের সামনে পড়ে তারা। অনেক ক্ষেত্রে এসব বীচের চারদিকে ছিল উঁচু টিলা— আদর্শ অবস্থান মেশিনগানের জন্য। সেই সাথে ছিল বিভিন্ন বীচে অবতরণ করা সৈন্যদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। অন্যদিকে টার্কিশ বাহিনী অসাধরণ বীরত্বের পরিচয় দেয় এই যুদ্ধে। তাদের নেতৃত্বে ছিল মোস্তফা কামাল (কামাল আতাতুর্ক), যিনি পরবর্তীতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হন।
একসময় এই গালিপলির তীর ওয়েস্ট ফ্রন্টের মতোই স্থির যুদ্ধে পরিণত হয়। হাজার হাজার সৈন্য মরতে থাকে, আর নতুন সৈন্য আসতে থাকে, কিন্তু কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করতে বার্থ হয় ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ-অস্ট্রেলিয়ান বাহিনী। প্রায় আট মাস অর্থহীন যুদ্ধশেষে গালিপলির তীর ত্যাগ করে যৌথবাহিনী। দুই পক্ষের প্রায় ১,৩০,০০০ সৈন্য নিহত হয় আট মাসের এই যুদ্ধে। ২৫শে এপ্রিল গালিপলিতে অবতরণের দিন সরকারি ছুটি উদযাপন করা হয় অস্ট্রেলিয়াতে।
১৯১৫ সালে ঘটা আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো আর্মেনিয়ান গণহত্যা। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ শুধুমাত্র স্থলপথে সীমাবদ্ধ ছিল। আচমকা কিছু সাবমেরিন আক্রমণ ছাড়া নৌপথ ছিল শান্ত। দুই পক্ষেরই ছিল অত্যন্ত মূল্যবান ও ভয়ঙ্কর যুদ্ধজাহাজ ড্রেডনোট (Dreadnaught), যা কেউই হারাতে চায়নি। নৌপথে প্রথম এবং একমাত্র বড় মাপের যুদ্ধ হয় ৩১ মে ১৯১৬ সালে, যেটা জুটল্যান্ডের যুদ্ধ নামে পরিচিত। জার্মান নৌবাহিনী অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় তারা জানত ব্রিটিশরা পূর্ণশক্তি দিয়ে আক্রমণ করলে জার্মান নৌবাহিনীর পতন ঘটবে। তাই তারা কিছু ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের উপর অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা করে। কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের এই পরিকল্পনা জেনে যায় এবং যেখানে অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা করেছিল জার্মান বাহিনী, সেখানে পূর্ণশক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়। দুই পক্ষই অপরপক্ষকে টোপ দিয়ে আচমকা আক্রমণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কারো পরিকল্পনাই সফল হয়নি। জার্মানরা যখন বুঝতে পারে পুরো ব্রিটিশ বাহিনী তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন তারা পালাতে শুরু করে। পালানোর আগে তারা যথেষ্টই ক্ষতি সাধন করে ব্রিটিশ বাহিনীর। ১৪টি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ আর ১১টি জার্মান যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়। প্রায় ১০ হাজার সৈন্য হতাহত হয়।
এদিকে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে দুই পক্ষই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে থাকে শত্রুর প্রতিরোধ ভাঙতে। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারদুনে (Verdun) জার্মানি তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ভয়ংকর এক আক্রমণ চালায়। প্রথমে বৃষ্টির মতো গোলা পড়তে থাকে ফ্রেঞ্চ বাহিনীর উপর। এই আক্রমণের প্রথম ৬ দিনে ২০ লাখ গোলা ছোড়া হয়। তবে যুদ্ধের এই পর্যায়ে ট্রেঞ্চের অনেক উন্নতি হয়েছে। গোলা হামলার সময় আশ্রয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে মাটির নিচে বাংকার। ফলে অনেক সৈন্য গোলার সরাসরি আঘাত থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু মুহুর্মুহু গোলা হামলার সময় এসব বাংকারে থাকার অভিজ্ঞতাও ছিল ভয়াবহ। ‘শেল শক’ (shell shock) শব্দের আবির্ভাব ঘটে সময়। বহু সৈন্য শেল শকে প্যারালাইসিসের শিকার হয়।
গোলা হামলা শেষে শুরু হয় পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ। শুরুর দিকে জার্মান বাহিনী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করতে পারলেও অচিরেই ফ্রেঞ্চ বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে পিছু হটায় জার্মান বাহিনীকে। প্রায় ৮ মাস ধরে চলতে থাকে এই গোলা হামলা, আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। এই ৮ মাসে দুই পক্ষের প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য হতাহত হয়, কিন্তু সীমান্ত সেই একই জায়গায় রয়ে যায়।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে জুন মাসে সোম-এ (Somme)। এবার আক্রমণ করে ব্রিটিশ বাহিনী। গোলা হামলা দিয়ে শুরু হয় আক্রমণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছোড়া হয় শ্রাপ্নেল শেল। এই শেল মানুষ মারার জন্য খুবই কার্যকর হলেও দুই পক্ষের মাঝে নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা কাঁটাতারের বেড়ার খুব একটা ক্ষতি করতে পারে না। সামান্য কিছু জায়াগায় যথেষ্ট ছিদ্র তৈরি হয় যেখান দিয়ে মানুষ প্রবেশ সম্ভব। ফলে গোলা হামলা শেষে যখন ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনী ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে আক্রমণ শুরু করে, তখন তাদের ঐসব ছিদ্রের কাছেই জড়ো হতে হয় নো ম্যান্স ল্যান্ড অতিক্রম করার জন্য। আর এক জায়গায় জড়ো হওয়া সৈন্য সবচেয়ে সহজ শিকার মেশিনগানের জন্য। একের পর এক আক্রমণের জোয়ার আসতে থাকে, আর ভেঙে যেতে থাকে নো ম্যান্স ল্যান্ডে এসে। ৫ মাসের এই যুদ্ধেরও একই পরিণতি হয়, সীমান্ত একই জায়গায় থেকে যায়, কিন্তু ১০ লক্ষ সৈন্য হতাহত হয়।
ভারদুন আর সোমের যুদ্ধে সীমান্তে কোনো পরিবর্তন না আসলেও দুই পক্ষই ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হয়। দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধের রসদ আর আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত করার জন্য লোকবলের অভাব তৈরি হতে থাকে, কারণ বেশিরভাগ জনবলই যুদ্ধক্ষেত্রে। ফলে নারীসমাজ কাজ শুরু করে কারখানাগুলোতে। যুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগতে থাকে। যুদ্ধ পরিচালনায় ভুল করা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা অদক্ষতা নয়, বরং অপরাধ বলা চলে। বিশেষ করে একেকটা ভুলের মাশুল যখন দেয়া লাগে লক্ষ লক্ষ জীবন দিয়ে।