হাজার বছর স্মরণীয় হয়ে থাকার কৌশল

বাংলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে যে, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। অর্থাৎ মানুষ তার কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- একজন মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে ঠিক কত বছর অন্য মানুষদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন? এর উত্তর জানার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু জনপ্রিয় মানুষের জীবনীর দিকে আলোকপাত করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন, ভিক্টোরিয়ান যুগে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে আলোচিত ক্রীড়াবিদ ছিলেন থমাস সেয়ার্স, যিনি নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন অশিক্ষিত রাজমিস্ত্রী হিসেবে। ঘটনাক্রমে তিনি মুষ্টিযোদ্ধা বনে যান।

সেয়ার্সের উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি। এবং ওজন কখনোই ১৫০ পাউন্ডের বেশি হয়নি। কিন্তু তিনি এই শারীরিক গঠন নিয়েই তার চেয়ে বড় দেহের প্রতিযোগীদের সাথে লড়াই করেছেন। সেয়ার্স তার ক্যারিয়ার মোট ১৬টি হেভিওয়েট ম্যাচ খেলেছেন, যার মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে হেরেছেন। আর ড্র করেছেন ৩টি ম্যাচে। বাকি সবক’টি ম্যাচে তিনি জয় পেয়েছেন। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম বেয়ার-নাকল হেভিওয়েট বক্সার।

থমাস সেয়ার্স; Image Source: BBC Hulton Picture Library 

১৮৬০ সালের ১৭ এপ্রিল সেয়ার্স তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন আমেরিকান বক্সার জন ক্যামেল হিনান। এই ম্যাচকে বিবেচনা করা হয় প্রথম ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ হিসেবে। সেয়ার্স ও ক্যামেলের এই ম্যাচ ঘিরে যুক্তরাজ্যে প্রচুর উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। হ্যাম্পশায়ারে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচের দর্শকদের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স, উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে এবং প্রধানমন্ত্রী লর্ড পালমার্সটন। এই ম্যাচের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং রানী ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত ম্যাচের ফলাফল জানানোর জন্য আদেশ দিয়েছিলেন।

নিজের চেয়ে ৭ বছরের বড় এবং ৪০ পাউন্ড ভারী দেহের ক্যামেলের সাথে টানা ৪২ রাউন্ড লড়াই করেন সেয়ার্স। দুই ঘণ্টার অধিক সময় দীর্ঘ ছিল ম্যাচটি। ম্যাচের শেষ দিকে সেয়ার্স তার ডান হাতে চোট পান। ক্যামেল তখন জয় দেখছিলেন। কিন্তু সেয়ার্স তার এক হাত দিয়েই লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষপর্যন্ত ম্যাচটি ড্র ঘোষণা করা হয়। এবং উভয় প্রতিযোগীকে চ্যাম্পিয়নশিপ বেল্ট প্রদান করা হয়। এই ম্যাচ খেলার পর সেয়ার্স রিং থেকে বিদায় নেন। দর্শকরা তাকে নিজেদের পকেট থেকে ৩ হাজার পাউন্ড প্রাইজমানি প্রদান করেন।

জন ক্যামেল হিনান বনাম থমাস সেয়ার্সের বিখ্যাত সেই ম্যাচ; Image Source: Alamy

এই ম্যাচের পাঁচ বছর পর ১৮৬৫ সালের ৮ নভেম্বর মাত্র ৩৯ বছরে সেয়ার্স মৃত্যুবরণ করেন। তার শোকযাত্রায় প্রায় এক লাখ লোক যোগ দিয়েছিলেন, যা প্রায় দুই মাইলের বেশি দীর্ঘ হয়েছিল। তাকে কবরস্থ করা দেখার জন্য অনেকে গাছে চড়ে বসেছিলেন। কিন্তু ১৫০ বছর পর সেয়ার্সের সেই খ্যাতি আর টিকে নেই। তার কীর্তিগুলোর উপরও ধুলো জমেছে। বক্সিংয়ের বাইরে অধিকাংশ মানুষই তাকে চেনেন না। এমনকি তার নিজ দেশ ইংল্যান্ডের অনেকেই তার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।

এ তো গেল ১৫০ বছর আগের কথা। আজ থেকে ২০ কিংবা ৩০ বছর আগেও অনেক তারকা ছিলেন যাদের নিয়ে মানুষের উন্মাদনার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু আজ তাদের ক’জনকে মনে রেখেছে? বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমের বড় একটা অংশ দখল করে রাখেন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা। কিন্তু ক’জন প্রেসিডেন্ট চিরস্মরণীয় হতে পেরেছেন?

কেন কিছু মানুষ তাদের বিদায়ের পরপরই বিস্মৃত হয়ে যান? আবার আর্কিমিডিস কিংবা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটদের মতো কিছু মানুষ কীভাবে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মাঝে বেঁচে রয়েছেন? তাদের কীর্তিগুলোর কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে? আজকের এই লেখায় সেসব প্রশ্নের উত্তরই খোঁজ করা হবে। 

নিজের খ্যাতিকে যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া

প্রাচীন গ্রিসে চিরস্থায়ী খ্যাতি লাভের প্রচেষ্টা ধর্মীয় আরাধনার পর্যায়ে ছিল। সম্পদের চেয়ে তারা যশ লাভের প্রতি অধিক মনোযোগী ছিলেন। প্রাচীন গ্রিকরা আমৃত্যু খ্যাতির নেশায় মত্ত ছিলেন। এ বিষয়ে তারা কোনো রাখঢাকও রাখেননি। বরং তারা তাদের এই খ্যাতি লাভের পরিকল্পনা নিয়ে বিশদভাবেই অন্যদের সাথে আলোচনা করতেন।

গ্রিসে তখন ‘ক্লিওস’ নামে একটি শব্দের প্রচলন ছিল, যা বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায় ‘লোকে আপনার সম্পর্কে কী জানে?’ আর এই শব্দকে জনপ্রিয় করেছিলেন মহাকবি হোমার, যিনি নিজেও হাজার বছর ধরে মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে আছেন। হোমারের লেখা ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ থেকে ঐতিহাসিক ট্রয় নগরী সম্পর্কে জানা যায়। হোমারের বই থেকে গ্রিক বীর অ্যাকিলিস সম্পর্কে জানা যায়, যার বীরত্ব প্রাচীন গ্রিস থেকে আধুনিক বিশ্বের মানুষকেও নাড়া দেয়। অ্যাকিলিস সম্পর্কে জানার পর অনেক গ্রিক নিজেদের চিরস্মরণীয় করার জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন। এতে অনেকে প্রাণও হারিয়েছেন।

বিখ্যাত গ্রিক কবি হোমার; Image Source: Print Collector/Getty Images

গ্রিক সেনাপতিরা নিজেদের অমর করার জন্যও অনেক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। তবে ইতিহাসের অনেক বড় বড় যোদ্ধা ছোট কোনো অর্জনের মাধ্যমেও নিজেদের নামকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছেন। তবে সেটা সম্ভব হয়েছিল তাদের বুদ্ধির জোরে। বিশেষ করে যারা সাহিত্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিলেন তারাই আজকের দিনে অমরত্ব লাভ করেছেন। এদের মধ্যে মহাবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও রয়েছেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ থেকে ৩২৩ সাল পর্যন্ত মেসিডোনিয়া শাসন করেছেন। তিনি তার সাম্রাজ্যকে মূল ভূখণ্ড গ্রিস থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন।

জুলিয়াস সিজারের মতো আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও আত্মপ্রচারে ওস্তাদ ছিলেন। তিনি তার সব অভিযানেই সাথে করে একদল ইতিহাস-রচয়িতা নিয়ে যেতেন। তারা আলেকজান্ডারের অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখে রাখতেন যাতে ভবিষ্যতে মানুষ তার সম্পর্কে জানতে পারেন।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের প্রতিকৃতি; Image Source: Alamy 

এছাড়া গ্রিক এই বীর পরিকল্পিতভাবে নিজের একটিমাত্র আবক্ষ মূর্তি তৈরি করেছিলেন, যাতে সবাই তাকে খুব সহজে চিনতে পারেন। তিনি তার এই আবক্ষ মূর্তি বিভিন্ন মুদ্রার সাথে জুড়ে দিয়েছেন। বর্তমান সময়েও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে অনেক তারকা ব্যক্তিত্ব নিজেদের ছবি দিয়ে স্মারক তৈরি করেন। তবে বর্তমান সময়ে এই পদ্ধতিতে স্মরণীয় হয়ে থাকা বেশ দুষ্কর।

সঠিক ক্যারিয়ার নির্বাচন

যারা ক্ষমতাধর কোনো পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং নিজেও ক্ষমতাধর ছিলেন তারা মানুষের মাঝে আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে আছেন এমন উদাহরণ খুবই কম। তবে যারা নিজেদের চিন্তাচেতনার মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে দেওয়া কথা ভেবেছেন তারা অনেকাংশে সফল হয়েছেন। বিশেষ করে যারা দার্শনিক ছিলেন। প্রাচীনকালে অবশ্য দার্শনিকরা সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। আবার তাদের চিন্তাভাবনা যদি ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার বাইরে যেতো তাহলে তাদের সন্দেহ করা হত এবং তাদের অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল; Image Source: New York Times

কিন্তু সময়ের সাথে দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনার গুরুত্ব মানুষ বুঝতে পেরেছেন। তারা সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে বদলে দিয়েছেন। যার ফলে তারা মানুষের মাঝে অমর হয়ে আছেন। তবে বর্তমান যুগের দার্শনিকদের চেয়ে পূর্বের দার্শনিকদের বিখ্যাত হওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল সেসময়ের অধিকাংশ মানুষের অজ্ঞতা ও অশিক্ষা। তারা যা আবিষ্কার করেছেন তা-ই ছিল প্রথম। মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে হলে মৌলিক আবিষ্কারের কোনো বিকল্প নেই। তাই বলে যে আধুনিককালের দার্শনিকদের সেই সুযোগ নেই তা বলা যায় না।

উদাহরণ হিসেবে ২০১৩ সালের এক ঘটনা তুলে ধরা যায়। একদল বিজ্ঞানী ‘বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পণ্ডিত’ এর খোঁজে নামেন। তারা ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে দেখেন কোন দার্শনিকের নাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে এবং বিভিন্ন জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করতে কার তত্ত্ব ব্যবহার হচ্ছে। বিজয়ী কে ছিলেন জানেন? কার্ল মার্কস। তবে কার্ল মার্কসের মতো দার্শনিকদের পাশাপাশি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, আইজ্যাক নিউটন, গ্যালিলিও, ডারউইন এবং আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীদের নামও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। এর অর্থ হলো বিখ্যাত হতে হলে ল্যাবেও সময় দিতে হবে। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে।

শত বছর পর লিওনেল মেসিকে কি মনে রাখবে কেউ? © Tim Clayton

কিন্তু বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান রাজ করলেও, বর্তমান বিজ্ঞানীরা কি হাজার বছর স্মরণীয় হতে পারবেন? প্রতি বছর যারা নোবেল পুরস্কার জিতছেন তাদের নাম অধিকাংশ মানুষই জানেন না। এর বড় কারণ তারা যা আবিষ্কার করছেন অথবা এমন কিছু তত্ত্ব দিচ্ছেন যার অধিকাংশ মানুষের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথবা তারা বুঝতে পারছেন না। বিজ্ঞানী হিসেবে স্টিভেন হকিংয়ের জীবনী মানুষের কাছে খুবই চমকপ্রদ, কিন্তু তিনি কি তার আবিষ্কার দিয়ে মানুষের মাঝে নিউটন কিংবা আইনস্টাইনের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারবেন? উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা রইলো।

বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সংখ্যা এত বেশি যে বিশেষভাবে কাউকে স্মরণ রাখা খুবই মুশকিল। এছাড়া মৌলিক কোনো তত্ত্বের আবিষ্কার এখন হচ্ছে না বললেই চলে। তাই বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ আর নিউটন কিংবা আইনস্টাইনদের মতো খ্যাতি যে পাবেন না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে স্মরণীয় হতে চাইলে ক্যারিয়ার হিসেবে খেলাধুলা কিংবা গানকে বাছাই করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ এই দুটি পেশার বিখ্যাত ব্যক্তিরা কোনো একটি বিশেষ প্রজন্মের মধ্যেই জনপ্রিয়। তারা যখন নিজের পেশা থেকে অবসর নেন তখন মানুষ তাদের খুব সহজেই ভুলে যান।

কাল মার্কসের মূর্তি; Image Source: Alamy

মানুষের মনে স্থায়ী আসন তৈরি করার জন্য রাজনীতি খুবই ভালো পেশা। তবে তার জন্য কখনোই অন্যকে অনুসরণ করা যাবে না। নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতারা মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরি করেছেন। তবে রাজনীতি করতে হবে মানুষের ভালোর জন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বে শান্তির জন্য যেসব নেতা কাজ করেছেন তারা স্মরণীয় হয়ে আছেন।

এছাড়া আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকার ভালো একটি পন্থা হলো সাহিত্য রচনা করা। ভালো কোনো বইয়ের মৃত্যু নেই। তা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। তাই বিখ্যাত হতে চাইলে সাহিত্য রচনা করতে পারেন। তবে প্রত্যেকের উচিৎ তার মন যা বলে সেই অনুযায়ী ক্যারিয়ার নির্বাচন করা। বিখ্যাত হতে হবে এমন চিন্তাভাবনা নিয়ে নিজের সাথে বেমানান কোনো পেশা নির্ধারণ করলে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।

রাজপরিবারের সদস্য না হওয়া

সরলভাবে ভাবলে মনে হতে পারে রাজপরিবারের সদস্য হওয়া মানেই অমরত্ব লাভের সুযোগ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজপরিবারের সদস্য হলেই মানুষ তাকে মনে রাখবে তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষত রাজপরিবারে ক্ষমতার লড়াই অনেক বেশি। প্রাসাদ রাজনীতিতে সফল হয়ে সিংহাসনের মালিক হতে হবে। এরপর রাজা অথবা রানী হিসেবে সাফল্যও পেতে হবে। তবেই মানুষের মাঝে হাজার বছর স্মরণীয় হয়ে থাকার একটা সম্ভাবনা থাকে।

কিন্তু রাজপরিবারের সবাই কি সিংহাসন লাভ করতে পারে? আবার রাজা হলেই মানুষ তাকে মনে রাখবে এরও নিশ্চয়তা নেই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কতজন রাজা অথবা অটোমান সাম্রাজ্যের কতজন সুলতানকে মানুষ মনে রেখেছে? হাতে গোনা অল্প কয়েকজন। তাই রাজপরিবারের সদস্য হয়ে যে ভোগবিলাস করতে পারবেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। হাজার বছর মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।

স্মৃতিচিহ্ন কিংবা উত্তরসূরি রেখে যাওয়া

স্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য বাস্তব কোনো উত্তরাধিকার অথবা প্রচুর সংখ্যক বংশধর রেখে যাওয়া সবচেয়ে কার্যকরী। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খান সবচেয়ে বেশি উত্তরসূরি রেখে গেছেন। এবং সারাবিশ্বে তার সাম্রাজ্যই সর্বোচ্চ সময় ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিল। এখনো বিশ্বে গড়ে ২০০ জনের মধ্যে একজন চেঙ্গিস খানের বংশধর। চেঙ্গিস খানকে নিয়ে একবিংশ শতকেও কেমন আলোচনা হয় সে সম্পর্কে আশা করি আপনারা অনেকেই ওয়াকিবহাল।

চেঙ্গিস খান; Image Source: Creative Common Licence  

এছাড়া আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার নিজের অসংখ্য মূর্তি এবং নিজের প্রতিকৃতি যুক্ত করে মুদ্রা তৈরি করেছেন। সম্রাট কিন শি হুয়াং এখনো নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন চীনের মহাপ্রাচীরের মাধ্যমে। তাজমহল যেমন মনে করিয়ে দিচ্ছে সম্রাট শাহজাহানের কথা। তাই মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাইলে তাদের জন্য কিছু করে যেতে হবে। মানুষের মাঝে নিজের কোনো স্মৃতিচিহ্ন রাখতে হবে।

নাটকীয়, বিখ্যাত অথবা হৃদয়বিদারক মৃত্যু

অল্প বয়সে হৃদয়বিদারক অথবা নাটকীয় কোনো মৃত্যু মানুষকে অনেক সময় খ্যাতি এনে দেয়। ক্লিওপেট্রা তার সৌন্দর্যের কারণে বিখ্যাত ছিলেন তা যেমন সত্য, তেমনই তার আত্মহত্যা যে তাকে আরো বেশি খ্যাতি এনে দিয়েছে তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। বিষাক্ত এক সাপের কামড়ে নিজের জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন ক্লিওপেট্রা। আজও তার রূপ আর বৈচিত্র্যময় জীবন সম্পর্কে জানার জন্য মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই।

কিন্তু বিখ্যাত হওয়ার জন্য আত্মহত্যা কখনোই কাম্য হতে পারে না। এর মাধ্যমে সবাই ক্লিওপেট্রা হবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে অল্প বয়সে হৃদয়বিদারক কোনো মৃত্যু মানুষকে বিখ্যাত বানাতে সাহায্য করে এটা সত্য। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অতিরিক্ত নেশার কারণে মারা গিয়েছিলেন মেরিলিন মনরো। কিন্তু আজও তার হাসিমাখা মুখ মানুষকে মুগ্ধ করে। মনরোর নাম শুনলেই তার বিখ্যাত ভঙ্গিমার ছবিগুলো মানুষের চোখে ভাসে। এক্ষেত্রে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নামও উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগ কেড়ে নেয় এই প্রতিভাবান কবির জীবন। অল্প বয়সে তার এই মৃত্যু মানুষের মাঝে তাকে আরো বেশি অমর করেছে।

খলনায়ক হওয়া

বিটলসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, কো-লিড ভোকালিস্ট, রিদম গিটারিস্ট এবং গীতিকার জন লেননকে হত্যা করার পর মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান বলেছিলেন,

বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়ার জন্য আমি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিকে হত্যা করেছি।

পৃথিবীর ইতিহাসে চ্যাপম্যানের মতো আরো খলনায়ক রয়েছেন যারা তাদের বর্বরোচিত কর্মের মাধ্যমেও মানুষের মাঝে বিখ্যাত হয়েছেন। এই তালিকায় জ্যাক দ্য রিপার, ক্যাপ্টেন ব্লাকবিয়ার্ড, এডলফ হিটলার, ইভান দ্য টেরিবল এবং মীর জাফরের মতো আরো অনেকেই রয়েছেন। মানুষ স্বভাবতই অত্যাচারী হতে চান। কিন্তু শিক্ষা ও বিবেক তাদের এই তাড়না থেকে বিরত রাখে। কিন্তু যারা বিবেকের ধার ধারেন না, তাদের অনেকে সীমাহীন হিংস্র হয়ে ওঠেন। কখনো এই হিংস্রতা তাদের খ্যাতিও এনে দেয়।

মীর জাফর; Image Source: Twitter

কিন্তু বিখ্যাত হওয়ার জন্য এই কৌশল নিরতিশয় মন্দ এবং অবিশ্বাসযোগ্য। কেননা খলনায়ক হতে গিয়ে নিজেদের ইতিহাসের এমন আস্তাকুঁড়ে নিয়ে যাবেন যা তাদের পরবর্তী বংশধরদের মানসিক ও সামাজিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেমন- মীর জাফরের বংশধরদের এখনো মুর্শিদাবাদে পরিচয় গোপন করে বসবাস করতে হয়। কারণ মানুষ এখনো তাদের ঘৃণা করেন। অথচ পলাশীর যুদ্ধে তাদের কোনো দায় নেই।

 

অঢেল সম্পদের মালিক

অঢেল সম্পদ বলতে বিশ্বের শীর্ষ ধনী হওয়া। যেমন প্রাচীন খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০-৫৪৬ সাল পর্যন্ত প্রাচীন গ্রিসে লিডিয়ার রাজা ছিলেন ক্রিসাস (Croesus)। তার অজস্র সম্পদ ছিল। তার নামের অর্থই ধনকু্বের। ইতিহাসে তিনি এখনো স্মরণীয় হয়ে আছেন শুধুমাত্র তার সম্পদের কারণে। কিন্তু সম্পদ চিরস্থায়ী নয়। আবার ক্রিসাসের মতো বর্তমানে সম্পদশালী হওয়াও সম্ভব নয়। তাই ধনকুবের হলেও যে মানুষ মনে রাখবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

অমরত্ব পেতে হলে ভাগ্যেরও প্রয়োজন

খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ সালে তুতেনখামেন যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। সম্ভবত থেবেসে তখন ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল। মাত্র ১৯ বছর বয়সের মধ্যে ১০ বছর রাজত্বে ছিলেন তুতেনখামেন। কিন্তু এই ১০ বছরে তার অর্জন বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু মিসরের ফারাওদের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা তার। কিন্তু এর কারণ কী? এটাকে ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

তুতেনখামেনের কফিন; Image Source: Independent.co.uk 

কারণ ফারাওদের মমি তৈরির কাজ ছিল এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এমনকি রাজমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী এবং ভাস্করদের কয়েকযুগ লেগে যেত কোনো ফারাওয়ের কবর তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে। সেখানে তুতেনখামেন মারা যান মাত্র ১৯ বছর বয়সে। ফলে তার কবর তৈরির জন্য খুব বেশি সময় মিস্ত্রীদের হাতে ছিল না। তাই ধারণা করা হয়েছিল তার কবর হয়তো ফারাওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হবে এবং তা মাটির নিচে হারিয়ে গেছে।

কিন্তু ১৯২২ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার এবং তার পৃষ্ঠপোষক লর্ড কারনার্ভন ‘ভ্যালি অব কিংস’ থেকে তুতেনখামেনের মমি আবিষ্কার করেন তখন তা ছিল ধনসম্পদে ভরপুর। তারা পুরোপুরি অবাক হয়ে যান। তার পাশের অনেক মমি লুট হলেও তুতেনখামেনের কবর একেবারে অক্ষত ছিল। মূলত তার মমির আকার ও অবস্থানই চোরদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।

তুতেনখামেনের কফিনে লাগানো মুখোশ © Lennart Preiss

তবে তুতেনখামেনের অক্ষত মমিই তাকে বিখ্যাত করেছে। তার রেখে যাওয়া বিভিন্ন পুরাকীর্তি তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাকে নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে এবং ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে। সারাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মিসরের কথা উঠলেই সবার চোখেই পিরামিড আর তুতেনখামেনকে ভেসে উঠে। তবে তুতেনখামেন আজ যে খ্যাতি পেয়েছেন তার পুরোটাই ভাগ্যের জোরে। যদি তার মমি থেকে সবকিছু চুরি হয়ে যেতো তাহলে হয়তো তাকে নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ থাকতো না।

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This article is in Bangla language. It is about 'Who will be remembered in 1000 years? '. 

Necessary references have been hyperlinked. 

Featured Image Source: National Geographic

Related Articles

Exit mobile version