পশ্চিমা বিশ্বে আমেরিকা মহাদেশকে একসময় ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ বলা হতো। এ মহাদেশের অস্তিত্ব জানার পর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী গোষ্ঠী আকণ্ঠ লোভের তাড়নায় ও ভাগ্য গড়ায় আশায় গণহারে পাড়ি জমাতে শুরু করে। সরল আদিবাসীদের কোণঠাসা করার পর ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসীরা মহাদেশের অধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তদুপরি সাগরের ওপারে উপনিবেশের প্রভু রাজন্যবর্গের শোষণ তো ছিলই। ১৭৭৬ সালে ঔপনিবেশিক শাসন অগ্রাহ্য করে স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা শুরু করার পর ইউরোপ থেকে আরো অধিক হারে অভিবাসী আগমন শুরু হয়। তাছাড়া আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে আসার স্রোত তো ছিলই। দাসপ্রথা মার্কিন ইতিহাসের কিছু কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্রাহাম লিংকন ক্ষমতাসীন হলে দাস প্রথা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে দাস নির্ভর অর্থনীতির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশগুলো সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা দেয়, যা গৃহযুদ্ধের সূচনা করে।
যুদ্ধবিক্ষুব্ধ অস্থিরতা, অভিবাসীর স্রোত, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে ভাগ্যবিধাতা নেতৃবৃন্দের বিভাজন বেশ শ্বাসরুদ্ধকর সময় ও পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো। ফলে বেশ কয়েকটি মারাত্বক রক্তক্ষয়ের ঘটনা সংঘটিত হয়। নিউ ইয়র্কে সংঘটিত ‘ড্রাফট রায়ট’ তন্মধ্যে একটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতার ইতিহাসে দেখা যায় যে, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড থেকে আগত জনস্রোতের সমন্বয়ে দেশটির জনবৈশিষ্ট্যের প্রাথমিক মূলধারা গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে জার্মান অভিবাসীরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ফলে এর সাংস্কৃতিক প্রভাবও অধিক। অন্যদিকে, ১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ডে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, যা ইতিহাসে ‘গ্রেট আইরিশ ফেমিন’ নামে আজও কুখ্যাত হয়ে আছে। এই আকালে প্রায় ২০ লক্ষ লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইরিশ অভিবাসীর স্রোত ধীরে ধীরে বেড়েই চলছিলো। এই জনস্রোত নিউইয়র্কের সামাজিক পরিবেশ বদলে দিতে থাকে।
স্বাধীনতার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বড় শহর হিসেবে নিউইয়র্কের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বেড়ে চলছিলো। ক্রমান্বয়ে একসময় তা দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানীর সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইউরোপ থেকে ভাগ্য বদলের আশায় আগত অভিবাসীদের এক বৃহৎ অংশের গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায় নিউইয়র্ক। দুর্ভিক্ষ ও চরম দারিদ্র্যের শিকার আইরিশরাও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। এজন্য সেসময় শহরটিতে শ্রমিক ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর একটি বড় অংশ ছিলো আইরিশ অথবা আইরিশ বংশোদ্ভূত। এর ফলে দেখা গেলো যে, জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা, মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ও নতুন ভূখন্ডে পুরনো জাতিবিদ্বেষের কারণে আইরিশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
এর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতবিরোধের সামাজিক প্রতিফলনেরও অনেক ব্যাপার ছিলো। স্বাধীনতা লাভের বেশ আগে থেকেই ইংল্যান্ড ও জার্মানি থেকে আগত অভিবাসীদের কারণে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের অনুসারীরা দেশটির জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। আইরিশ ও ইতালিয়ান অভিবাসীরা ক্যাথলিক মতের অনুসারী হওয়ায় ঐতিহাসিক কারণেই পরষ্পরবিরোধী ধর্মীয় বিশ্বাস সংঘর্ষের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত ইউরোপ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের পর বেশ র্যাডিকেল রূপ ধারণ করছিলো। কারণ, এর অনুসারীরা যে ধরনের ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ এর স্বপ্ন ইউরোপের বাইরে নতুন ভূখন্ডে দেখেছিলেন, আইরিশ ক্যাথলিকদের আগমনে তা কার্যত হুমকির মুখে পড়ছিলো!
১৮২২ সাল অবধি বাণিজ্যিক মহানগর হিসেবে নিউইয়র্কের সাথে দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর ব্যবসায়িক সম্পর্ক দৃঢ় ছিলো। এর মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলো টেক্সটাইল কারখানার জন্য তুলা রপ্তানি। এই ব্যবসায়িক সম্পর্ক দেশটির রাজনীতিতে যে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে, তা গৃহযুদ্ধকালীন অবস্থা অনুধাবনের জন্য বেশ তাৎপর্যের দাবি রাখে। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে আব্রাহাম লিংকন ও রিপাবলিকান দলের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিলো দাস প্রথার নিরসন। আর এই প্রতিশ্রুতির ঘোর বিরোধিতা করেছিলো ডেমোক্রেটিক দল। দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলো এই ঘোষণায় তাদের সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন দেখতে পেলো।
আব্রাহাম লিংকন প্রসিডেন্ট হবার বেশ কিছুদিনের মধ্যেই ১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণের ৭টি অঙ্গরাজ্য সাউথ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতা ও ‘কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা’র ঘোষণা দেয়। এ বছরের এপ্রিল মাসে সাউথ ক্যারোলিনার ফোর্ট সামটারে বিচ্ছিন্নতাবাদী কনফেডারেট আর্মির সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিলো। তার অবশ্যম্ভাবী রাজনৈতিক প্রভাব থেকে নিউইয়র্কও বাদ থাকলো না।
১৯৬৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা নিরসনের জন্য আইন পাশ করেন। এর ফলে পরিস্থিতি আরো উত্তেজনাকর হয়ে উঠলো। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত আইরিশ অভিবাসীরা দাসপ্রথা নিরসনের ফল হিসেবে কর্মহীনতা, কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে প্রতিযোগিতা, অনাহারে মৃত্যু ও নানাবিধ অনিশ্চয়তার ভীতিতে আক্রান্ত হয়েছিলো। আর তা কাজে লাগিয়েছিলো দাসপ্রথার সমর্থক বর্ণবাদী রাজনীতিবিদরা।
নিউইয়র্ক শহরে ডেমোক্র্যাট দলের রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য ছিলো। এই প্রাধান্য কনফেডারেট সহানুভূতির ক্ষেত্র আরো সুগম করে দিয়েছিলো। তৎকালীন মেয়র ফার্নান্দো উড কনফেডারেটদের প্রতি সমর্থনের অংশ হিসেবে আলব্যানি ও ওয়াশিংটন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ঘোষণা দিয়ে বসেন। এর অনেক আগে থেকেই পত্রিকাগুলো দাসপ্রথা উচ্ছেদ ও মিশ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ নিয়ে উগ্র কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী বর্ণবাদী প্রচারণা চালাচ্ছিলো।
ডেমোক্রেট রাজনীতিবিদরা তাদের ভোটব্যাংক বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রভাব দূর অবধি প্রসারিত করার জন্য অভিবাসী আইরিশদেরদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন। এর ফলে আইরিশ জনগোষ্ঠী কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারের বিরুদ্ধে একজোট হয় এবং এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হয়, তন্মধ্যে ‘দ্য ডেড র্যাবিট’, ‘দ্য ফোর্টি থিভস’, ‘ও’কনেল গার্ডস’ ইত্যাদি বেশ সক্রিয় ছিলো।
১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘এনরোলমেন্ট অ্যাক্ট’ পাশ করে। এই আইনের অধীনে গৃহযুদ্ধকালে কনস্ক্রিপশন বা ড্রাফট প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেনাবাহিনী অথবা স্বেচ্ছাসেবক দলে বাধ্যতামূলক ভর্তির ব্যবস্থা রাখা হয়। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে আইরিশ ও অন্যান্য শ্বতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সমবেত ‘নো ড্রাফট’ চিৎকারের মাধ্যমে শুরু হয় ইতিহাসে কুখ্যাত সেই ‘ড্রাফট রায়ট’।
১৮৬৩ সালের ১১ জুলাই শান্তিপূর্ণভাবে ড্রাফট গ্রহণ শুরু হয়। ১৩ জুলাই সোমবার থেকে সক্রিয় সহিংসতা ও সংঘাতে পুরো শহর আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে সশস্ত্র দাঙ্গাকারীর একাধিক দল রিপাবলিকান মেয়রের বাসভবন, প্রোভোস্ট মার্শালের অফিস, নিউইয়র্ক টাইমসের অফিস, কৃষ্ণাঙ্গ অনাথ আশ্রম, বুল’স হেড হোটেলে হামলা চালায়। নিউ ইউর্ক অঙ্গরাজ্যের মিলিশিয়া গৃহযুদ্ধের কারণে অন্যত্র থাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশের উপর দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পড়ে।
কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঙ্গার ভয়াবহতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল ছিলো। পুলিশ প্রধান জন আলেক্সান্ডার কেনেডি নিজেই দাঙ্গাকারীদের হাতে গুরুতর আহত হন। দাঙ্গাকারীরা বিভিন্ন স্থানে টেলিগ্রাফের তার কেটে দিয়ে যোগাযোগে ব্যাপক গোলযোগ তৈরি করে। প্রায় ১২০ জনের অধিক কৃষ্ণাঙ্গ নরনারীকে প্রকাশ্য দিবালোকে অত্যাচার, বেধড়ক প্রহার শেষে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়।
পর দিন অর্থাৎ ১৪ জুলাই মঙ্গলবার দাঙ্গাকারীরা মূলত দাসপ্রথার বিরোধী নেতা ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের উপর আক্রমণ শুরু করে। এইদিন কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সহানুভূতিশীল পুরুষ ও নারীরা ব্যাপক হারে আক্রমণ ও হত্যাকান্ডের শিকার হন। নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট গভর্নর হোরেশিও স্যামোর কনস্ক্রিপশনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেন। সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জন এলিস উল প্রায় ৮৯৯ মেরিন সৈনিক সমবেত করেন। পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস আতঙ্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছিলো।
পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে প্রোভোস্ট মার্শাল বুধবার ১৫ জুলাই ড্রাফট গ্রহণ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন। এদিকে নিউইয়র্কে ব্যাপক হারে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট সমাবেত করা শুরু হয়। সংঘর্ষ কিছুটা স্তিমিত হয়েছিলো, তবে একেবারে শান্ত হতে সময় লাগছিলো। বৃহস্পতিবার ১৬ জুলাই বাল্টিমোর ও ফিলাডেলফিয়া থেকে উগ্র কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী ‘প্লাগ আগলি’স’ ও ‘ব্লাড টাবস’ সংগঠনের দাঙ্গাকারীদের আগমনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এসব সংগঠন সশস্ত্রভাবে শহরের বিভিন্ন স্থানে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করলে সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র পুলিশ বাধ্য হয়ে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এইদিন ১২ জন নিহত ও আরো অনেক আহত হবার কথা বলা হয়।
‘ড্রাফট রায়ট’ এ নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা। মার্কিন ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় ১২০ জন মানুষ নৃশংসভাবে নিহত হন। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো অধিক হওয়াই স্বাভাবিক। নিহতদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ নরনারী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সমব্যথী ও রিপাবলিক দল সমর্থনকারী মানুষজনও নিহতদের তালিকায় ছিলেন।
পুরো পাঁচদিনের জন্য নিউইয়র্ক শহরে শৃঙ্খলাহীন ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। প্রাথমিকভাবে দাঙ্গাকারীদের উপস্থিতির ব্যাপকতার কারণে আইন রক্ষা করার ক্ষেত্রে পুলিশের অপ্রতুলতা এর অসহায়ত্বের অন্যতম কারণ ছিলো। তদুপরি গৃহযুদ্ধের কারণে সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে থাকায় তাদের আগমনে বিলম্বও রক্তক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। মার্কিন ইতিহাসের একটি অন্যতম সংগ্রামের ইতিবৃত্ত হচ্ছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। আর গৃহযুদ্ধের সময়কার একটি কলঙ্কজনক প্রাণঘাতী অধ্যায় হচ্ছে কুখ্যাত ‘ড্রাফট রায়ট’।