লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার নাম এখন সারা বিশ্বেই বেশ পরিচিত। কারণ এটা এখন দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের সংঘাতের সর্বশেষ ফ্লাশপয়েন্টে পরিণত হয়েছে। এই উপত্যকাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে।
কৌশলগত দিক দিয়ে ভারত এবং চীন উভয় দেশের কাছেই এই উপত্যকাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই উপত্যকাকে ঘিরে ইতিপূর্বে একাধিকবার সংঘাতে জড়িয়েছে দেশ দুটি। সম্প্রতি আবারও সংঘাতময় অবস্থা বিরাজ করছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৫ জুন সংঘাতে প্রায় ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার নজর এখন গালওয়ান উপত্যকার দিকেই।
কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এই উপত্যকার প্রকৃত ইতিহাস। প্রায় ১২৫ বছর আগে এই উপত্যকার নামকরণ করা হয়েছিল লাদাখেরই গোলাম রসূল গালওয়ান নামক এক কিংবদন্তী পর্বতারোহী ও অভিযাত্রীর নামানুসারে। আজকের লেখাটি সেই অজানা ইতিহাসই জানাবে।
সাধারণত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে যেকোনো ধরনের ভৌগোলিক নিদর্শন বা স্থান দেশি অভিযাত্রীদের নামে নাম রাখার ঘটনা ছিল খুবই বিরল। তা সে পর্বতশৃঙ্গই হোক বা উপত্যকা-গিরিখাত। এই সমস্ত ভৌগোলিক স্থান বা নিদর্শনের নামগুলো ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের নামেই করা হত।
লাদাখের ধূসর পাহাড় আর তুষারধবল শিখর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ও বিস্তীর্ণ পাথুরে এক ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে কুল কুল রব তুলে বয়ে চলেছে এক নদী। এ নদীর উৎস কারাকোরামের গিরিকন্দরে। আকসাই চীন ও পূর্ব লাদাখের মধ্য দিয়ে এ নদী প্রায় ৮০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে প্রবাহ গিয়ে মিশেছে শিয়কে। শিয়ক আবার ঐতিহাসিক প্রাচীন সিন্ধু নদীর একটা গুরুত্বপূর্ণ উপনদী।
‘গালওয়ান’ শব্দটি কাশ্মীরি, যার অর্থ ‘ডাকাত’। গোলাম রসূল গালওয়ানের দাদা কারা গালওয়ান ছিলেন উনবিংশ শতকে কাশ্মীরের এক বিখ্যাত লুটেরা, যিনি ধনীর সম্পদ লুট করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এজন্য তার খ্যাতি ছিল রবিনহুডের মতো। জনশ্রুতি আছে, তিনি একবার কাশ্মীরের রাজার শোবার ঘরে ঢুকে তার গলাতেও ছুরি ধরেন। কিন্তু রাজার সৈন্যদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে যান কারা গালওয়ান। রাজার গলায় ছুরি ধরার অপরাধে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর আত্মক্ষার্থে তার পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে যায় লাদাখে। কিন্তু ততদিনে তাদের নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে গালওয়ান বা ডাকাত শব্দটি।
১৮৭৮ সাল নাগাদ গোলাম রসূল গালওয়ানের জন্ম হয় লাদাখের রাজধানী লেহ-তে। বিধবা মা তাকে বড় করে তোলেন। কিন্তু সংসারে ছিল চরম অভাব-অনটন। মাত্র ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই সে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের সাথে নানা অভিযানে শামিল হতে শুরু করে। সারাদিন অভিযাত্রীদের সাথে পাহাড়-পর্বত ও বনজঙ্গলে ঘোরাঘুরি করত কিশোর গোলাম রসূল। অভিযাত্রাদেরকে পথপ্রদর্শন করত, যাত্রাপথের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোও তাকেই করতে হত। বিনিময়ে যা পেত তা দিয়েই কোনো রকম খেয়ে-পরে দিন চলে যাচ্ছিল।
গোলাম রসূলের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখন স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের দলে পোর্টার বা মালবাহক হিসেবে তার অভিযানের যাত্রা শুরু হয়। ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা তখন ঘন ঘন তিব্বত, কারাকোরাম, পামির মালভূমি বা মধ্য এশিয়ার দিকে অভিযান পরিচালনা করত। তখন কিশোর গোলাম রসূলও জুটে যেত তাদের সঙ্গে।
কিন্তু তার জীবনের এক আমূল পরিবর্তন আসে ১৮৯২ সালে। চার্লস মারের (সেভেন্থ আর্ল অব ডানমোর) সঙ্গে পামীর ও কাশগার পর্বত অভিমুখে এক অভিযানে বেরোনোর মাধ্যমে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ভ্রমণের একপর্যায়ে ঐ দলটি লাদাখের এক দুর্গম অঞ্চলে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী আর খাড়া গিরিখাতের মাঝখানে আটকে যায়। সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না। এমনকি বের হওয়ার জন্য কোনো রাস্তাও দেখা যাচ্ছিল না।
তখন গোলাম রসূলের বয়স মাত্র ১৪ বছর। যখন সব চেষ্টা করেও অভিযাত্রিক দলটি ব্যর্থ হলো, তখন গোলাম রসূল নিজেই বেরিয়ে পড়ে সেই জটিল গোলকধাঁধার মধ্য থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে। আশ্চর্যজনকভাবে খাদের ভেতর দিয়ে সে বেশ সহজ এক রাস্তা খুঁজে বের করে, যার কারণে এই অভিযান কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই শেষ হয়। বেঁচে যায় অনেকগুলো প্রাণ।
দলের নেতা চার্লস মারে কিশোর গোলাম রসূলের প্রতিভা দেখে অবাক হন। তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে, কল কল রব তুলে বয়ে চলা যে জলাধারের পাশ ঘেঁষে নতুন রাস্তাটির সন্ধান মেলে, তার নামকরণই করে ফেলেন গোলাম রসূল গালওয়ানের নামে, যা বর্তমানে গালওয়ান নদী নামে পরিচিত। আর এই নদী থেকে গালওয়ান উপত্যকার নামকরণ হয়েছে। সেই থেকে গোলাম রসূল হয়ে ওঠেন লাদাখের ইতিহাস। শুধু তা-ই নয়, হয়ে ওঠেন ভূগোলের অংশ। পাশাপাশি উপমহাদেশে তিনিই সম্ভবত প্রথম নেটিভ যিনি কি না ঔপনিবেশিক আমলে এই সম্মান অর্জন করেন।
যে গোলাম রসূল একসময় ছিল সামান্য মালবাহক ও টাট্টু ঘোড়া চালক, সেই গোলাম রসূল একদিন লেহ-তে নিযুক্ত ব্রিটিশ জয়েন্ট কমিশনারের ‘আকসকল’ বা প্রধান সহকারীর পদে উন্নীত হন। তবে অভিযানে বের হয়ে পড়াটা তার নেশায় পরিণত হয়ে যায়। দারিদ্র্য আর অর্থকষ্ট মিটে যাওয়ার পরও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কত অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন বা পথপ্রদর্শন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই গোলাম রসূল পাড়ি জমান পরপারে। জীবনের নানা অভিযানের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি লিখে ফেলেন একটি আত্মজীবনী, ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস’ বা ‘সাহেবদের ভৃত্য’। দারিদ্র্য আর অর্থকষ্টের মধ্যে বেড়ে ওঠা গোলাম রসূল খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না। এমনকি জানতেন না এক অক্ষর ইংরেজিও। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি কখনোই অর্জন করেননি। এরপরও কীভাবে তিনি ইংরেজিতে নিজের স্মৃতিকথা লিখলেন তারও এক মজার ইতিহাস রয়েছে।
গোলাম রসূল গালওয়ান লাদাখি, উর্দু আর তুর্কি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। এছাড়া তিব্বতি এবং কাশ্মীরি ভাষাতেও তার সামান্য জানাশোনা ছিল। কিন্তু ইংরেজিতে তিনি মোটেও কথা বলতে পারতেন না। এরপর এক অভিযানে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন মার্কিন অভিযাত্রী রবার্ট ব্যারাটের সঙ্গে। সেই অভিযান থেকেই তিনি শুরু করেন সিরিয়াস ইংরেজি চর্চা।
গোলাম রসূল যখন রবার্ট ব্যারেটের সঙ্গে অভিযানে বের হন তখন তিনি বড়জোর দশ-বারোটা ইংরেজি শব্দ জানতেন। কিন্তু ইংরেজিতে তার কথা বলা এবং লেখালেখি করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। এ কাজে রবার্ট ব্যারেট তাকে বেশ উৎস যোগান। তাকে সাহায্য করার জন্য রবার্ট ব্যারেট তার সাথে সব সময় কেটে কেটে, ধীরে ধীরে ইংরেজিতে কথা বলতেন, যাতে করে তিনি শব্দগুলো শিখে নিতে পারেন। তাকে পড়ার জন্য দিয়েছিলেন একটি কিং জেমসের বাইবেল এবং সপ্তদশ শতাব্দীর একটি ট্রাভেল ব্যাগ। রবার্ট ব্যারেটের স্ত্রী ক্যাথরিন দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে সম্পাদনা করেছেন গোলাম রসূল গালওয়ানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি।
গোলাম রসূল একটানা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নিজের ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতেই আত্মজীবনী নোট করেন। এরপর ডাকে করে পাঠিয়ে দিতেন আমেরিকায় ক্যাথরিনের কাছে। প্রথম প্রথম পান্ডুলিপিগুলো পুনরায় লেখার জন্য তার কাছে ফেরত পাঠানো লাগত, কারণ লেখাগুলো ছিল একেবারেই অস্পষ্ট ও অগোছালো। পরে অবশ্য ফেরত পাঠানোর তেমন দরকার হতো না। আত্মজীবনীতে তার নিজস্ব লেখার ভঙ্গিটাই বজায় রাখা হয়। অবশেষে ১৯২৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়, নাম ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস – আ বুক টু রিড অ্যালাউড’।
বর্তমানে দিল্লির বিখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিক টাইমসে সাংবাদিকতা করেন রসূল বাইলে। পারিবারিকভাবে গোলাম রসূল গালওয়ান হলেন রসূল বাইলের প্র-পিতামহ।
আজকের লাদাখ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে পর্যটন খাতের সুবাদে। অথচ, এমন একটা সময় ছিল যখন লাদাখে যুবকদের আহার সংগ্রহ করার জন্য পশ্চিমা যাত্রীদের সাথে বিপজ্জনক অভিযানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপার্জনের কোনো রাস্তা ছিল না। আর অভিযাত্রার পথে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো তাদেরই করতে হতো। গোলাম রসূল সেই ধারার সূচনা করে যান।
গালওয়ান উপত্যকার নামকরণের মধ্য দিয়ে গোলাম রসূলের স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে। রসূল বাইলে একদিন তার প্র-পিতামহের নামে লাদাখে নিজস্ব জমিতে একটি হোটেল চালু করার স্বপ্ন দেখেন। অবশ্য তার চাচা ইতিমধ্যেই লাদাখে চালু করে দিয়েছেন পর্যটকদের জন্য এক আধুনিক বিশ্রামাগার, যা ‘গালওয়ান গেস্ট হাউজ‘ নামে পরিচিত।