বস্ত্র পরিধানের শুরু যেখান থেকে

মানব সভ্যতার ইতিহাসে পোশাকের আবিষ্কার নিঃসন্দেহে এক অনন্য কৃতিত্ব। আদিম গুহাবাসী মানুষ যখন আসলে বুঝতে শিখলো নিজেদের লজ্জা নিবারণের প্রয়োজনীয়তা, আমরা ধরে নিতে পারি ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিলো সেই প্রয়োজনীয়তার বাস্তবায়ন। আজকের সভ্য মানুষ আর সেই আদিম মানুষের মধ্যে এই আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরী করেছে আধুনিক পোশাক। আমাদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার ২য় চাহিদাই বস্ত্র অর্থাৎ পোশাক। বুঝতেই পারছেন, পোশাক পরিচ্ছদ মানব সভ্যতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

যদি প্রশ্ন করা হয় যে ঠিক কবে থেকে মানুষ পোশাক পরিধান করা শুরু করলো বা কে আবিষ্কার করলো পরিধেয় পোশাক, তাহলে সেই প্রশ্নের উত্তর করা হয়ে পড়বে খুবই কষ্টসাধ্য এবং বিতর্কিত। আদিম মানুষেরা সাধারণত পরিবেশের প্রভাব, যেমন শীত বা উষ্ণতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য গাছের বাকল বা পশুর চর্ম পরিধান করতো। কিন্তু এসব পরিধেয় বস্তু খুব সহজে পঁচে যায়, যে কারণে আসলে এসব বস্তুর কোনো ফসিল বা কোনো নমুনা পাওয়া যায় না অদ্যাবধি। যার কারণে বলা মুশকিল যে কবে থেকে মানুষ পোশাক পরতে শুরু করলো। দুই-একটি নমুনা হিসেবে যেগুলো পাওয়া যায় সেটাও সঠিক কিনা সে সম্পর্কেও গবেষকরা সঠিক মতামত প্রদান করতে পারেন নি।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব পাওয়া যায় এ সম্বন্ধে। জেনেটিক স্কিন-কালারেশন গবেষণার উপর নির্ভর করে জানা যায় যে, প্রায় এক মিলিয়ন বছর পূর্বে মানুষ তার শরীরের অপ্রয়োজনীয় লোম হারাতে শুরু করে। আর সেসময় থেকেই মূলত শুরু হয় তাদের পোশাক পরিধান করার।

আদিম মানুষ সর্বপ্রথম পশুর চর্ম পরিধান করতে শেখে; Source: glamour.com

তো পশুর চর্ম পরিধানের জন্য প্রথমে সেটা আহরণ তো করতে হবে। প্রাথমিকভাবে পশুর শরীরের চর্ম ছাড়ানোর জন্য সে যুগের যে যন্ত্র প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা পাওয়া যায় কার্বন ডেটিং অনুযায়ী সেটির বয়স নির্ণয় করা হয় প্রায় ৭,৮০,০০০ বছর পূর্বে। কিন্তু পশুর চর্ম তখন মানুষের আশ্রয় তৈরীর জন্যেও ব্যবহার হত অর্থাৎ ছাউনি ধরনের কিছু। অন্যদিকে প্রথম সেলাই সুচের সন্ধান পাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় ৪০,০০০ হাজার বছর আগে, যা ব্যবহার করা হত জটিল ডিজাইনের কাপড় বুননের জন্য। কাজেই পোশাক যে তারও আগে থেকে মানুষ পরিধান করা শুরু করেছে সেটি অনুমান করে নেয়া যেতে পারে সহজে।

সূক্ষ্ণ হাড়ের নিডল বা সুচের কার্বন ডেটিংয়ে পাওয়া গিয়েছে যে, সেটি প্রায় ২০,০০০ বছর পূর্বের এবং ধারণা করা হয় যে, এই ধরনের নিডল খুব সম্ভবত পশুর চর্ম সেলাই এবং এমব্রয়ডারি করার জন্য ব্যবহৃত হতো। রাশিয়ার সাঙ্ঘির নামক অঞ্চলে এক কবরে এক বালক ও এক বালিকার মৃতদেহে হাতির দাঁতের পুতি এবং শিয়ালের দাঁত এরকম এমব্রয়ডারি করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো, যার সময়কাল বের করা হয় আনুমানিক ২৮,০০০ বছর আগে।

প্রস্তর যুগে গুহামানবেরা যে শুধু পশুর চর্ম পরিধান করতো সেটাই কিন্তু না। ১৯৯০ সালে চেক রিপাবলিকের পাভলোভ ও ডলনি ভেস্টোনিস-এর প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা থেকে কাদামাটির উপর ঝুড়ি ও টেক্সটাইল পণ্যের, অর্থাৎ বস্ত্রের ছাপ আবিষ্কার করা হয়। অর্থাৎ গবেষকগণ ধারণা করেন যে সেই সময়ও বয়ন শিল্প ও বয়নকৃত কাপড় পাওয়া যেত। কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে এর সময়কাল বের করা হয় আজ থেকে প্রায় ২৫,০০০ বছর আগে। কিন্তু গবেষকরা সঠিকভাবে এই মত দিতে পারেন নি যে এই বয়নকৃত কাপড় তখন পরিধানের জন্য ব্যবহার হতো কিনা। বরং এর বয়ন কৌশল দেখে মনে হয় যে, এগুলো কোনো এক জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের প্রকাশ করে। পরবর্তীতে জর্জিয়ার জুজুয়ানা গুহা থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩০,০০০ বছর পূর্বের প্রাকৃতিক ফাইবারের তৈরী সুতা পাওয়া গিয়েছিলো যেগুলো ছিলো গোলাপী, কালো আর তুর্কি নীল রঙে ডাই করা। অর্থাৎ ডাই করার পদ্ধতি যে তারও আগে আবিষ্কৃত হয়েছিলো সে কথা ধরে নেয়া যায় সহজে। কিন্তু ৩০,০০০ বছর পূর্বের সময়কে আমরা খুব যে প্রাচীন বলতে পারি এমন নয়। কাজেই প্রশ্ন থেকে যাবে যে এরও আগে মানুষ বা মানুষের পূর্বপুরুষগণ কী পরিধান করতো।

গুহাবাসী নিয়ান্ডারথাল মানবেরা প্রায় ১,০০,০০০ বছর আগে চামড়া ট্যানিন করতো; Photograph: Nikola Solic/Reuters

এই ইতিহাসের পেছনে যেসব গবেষক ছুটে চলেছেন তারা মাঝে মাঝেই এই প্রশ্ন করে থাকেন যে নিন্ডারথাল মানবেরা কী উপায়ে নিজেদের দেহকে পরিবেশের প্রভাব থেকে রক্ষা করতো। নিন্ডারথালস মানবদের ধরা হয়ে থাকে বর্তমান মানবের পূর্বপ্রজাতি। যদিও Homo Sapiens এর আগে Homo গণের প্রায় তিন প্রজাতির মানবের সন্ধান পাওয়া যায়।। এদের বসবাস ছিলো ইউরোপ অঞ্চলে এবং সেই সময়টা ছিলো পুরোপুরি এক বরফের দুনিয়া। কাজেই নিন্ডারথাল মানবেরা নিজেদের সুরক্ষিত করতে কি করতো তা প্রশ্নই বটে। গবেষণায় দেখা যায় যে এসব মানবেরা শীতের হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে খুব সম্ভবত পাশমিনা (বা বলা যায় ছাগল বা ভেড়ার শরীর থেকে পাওয়া পশম) ব্যবহার করতো। শীত তখন এতটাই প্রচন্ড ছিলো যে শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ, বিশেষ করে হাত ও পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না।

এর থেকেও অবাক করা বিষয় হচ্ছে প্রায় ১,০০,০০০ বছর আগেকার পাথরের তৈরী একপ্রকার যন্ত্র পাওয়া যায় যা নিয়ান্ডারথাল মানবেরা পশুর চর্ম ট্যানিন করতে অর্থাৎ কাঁচা চর্ম পাকানোর কাজে ব্যবহার করতো। এই যে ট্যানিন করার যন্ত্র, সে যন্ত্রের গায়ে একপ্রকার জৈব বস্তুর ছেড়া অংশ পাওয়া যায় যা ট্যানিন করতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থে ভেজানো ছিলো। অর্থাৎ আমরা যদি মনে মনে কল্পনা করতে পারি যে, কাপড়ের একটি ছেড়া অংশ ট্যানিন দ্রব্যে ডুবিয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে নিয়ান্ডারথাল মানবেরা চামড়ার উপর প্রলেপ দিচ্ছে যেন কাঁচা চামড়া তাদের ব্যবহার উপযোগী হয়, তাহলে সেটা খুব ভুল হবে না। মানে তখনও বয়নকৃত কাপড়ের অস্তিত্ব থাকতেও পারে। মতান্তরে ধারণা করা হয় যে, এটি ট্যানিন করা যন্ত্রটির হাতলে ব্যবহার করা হতো, যা ব্যবহারের সময় ট্যানিন দ্রবণ দ্বারা সিক্ত হয়।

যদিও চামড়া সেলাই করার জন্য নিয়ান্ডারথাল মানবদের সুচের প্রয়োজনীয়তা ছিলো না। কারণ তারা পাথর বা কাঠের সাহায্যে এই সেলাইয়ের কাজ করতে সক্ষম ছিলো।

অভিযোজিত এই প্রজাতির উঁকুন নিয়েই গবেষণা করা হয়; Source: seeker.com

বস্ত্রশিল্পের সন্ধানে যদি আমরা সময়ের আরো পেছনে যেতে চাই তাহলে এবার আমাদের কিছুটা নোংরা নমুনার দিকে চোখ বুলাতে হবে। সেটি হলো উঁকুন। মানুষের শরীরে লোমশ অংশগুলোতে মূলত উঁকুন থাকার সম্ভাবনা সর্বাধিক। মানবদেহের এই উঁকুন একসময় মানুষের পরিধেয় পোশাকে বসবাস করার জন্য নিজেদের অভিযোজিত করে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই গবেষণা পরিচালনা করেন। তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মানুষ পোশাক পরিধান শুরু করে আজ থেকে প্রায় ১,৭০,০০০ বছর পূর্বে। কিভাবে তারা এটি বললেন? মূলত ওসব উঁকুনের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই এসব তথ্য জানা যায়। অর্থাৎ, উঁকুনের অভিব্যক্তির পর্যালোচনা করেই এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়।

কিন্তু অন্যান্য গবেষকরা মনে করেন তারও আগে থেকেই মানুষ পোশাক পরিধানের সাথে পরিচিত হয়েছিলো। যদি বিবর্তনের ধারাবাহিকতা অর্থাৎ ডারউইনের তত্ত্ব সত্য বলে মনে করা হয়, তবে যদি আমরা আরো শত-সহস্র বছর পূর্বে ফিরে যাই, অর্থাৎ যখন মানুষেরই বেশ কয়েকটি প্রকরণ বা গোষ্ঠী ছিলো (এমনকি ৪০,০০০ বছর পূর্বেও তিন প্রকারের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়), সেই সময়ে নিয়ান্ডারথাল ও রহস্যজনক ড্যানিসোভানস মানুষেরা গুহাজীবন যাপন করতো। এই বিভিন্ন প্রকার মানুষের সংকরায়নের ফলে একই ধারায় মানুষের অভিব্যক্তির কথা বলেছেন গবেষকগণ। উকুনের তত্ত্বটি তখনকার সময় থেকেই শুরু হয়েছিলো বলেও তাদের ধারণা। তবে সেসব মানবেরা যে সবসময় পোশাক পরিধান করতো তেমনটাও বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই সম্বন্ধে খুব কম নমুনাই পাওয়া গিয়েছে।

এই গবেষণার তাৎপর্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এই তথ্যের মাধ্যমে বলা হয় যে, আদিম মানুষেরা যখন আফ্রিকা থেকে অভিবাসিত হয়ে উত্তরে অপেক্ষাকৃত শীতল পরিবেশে প্রবেশ করে, তারও ৭০,০০০ বছর পূর্বে আবিষ্কৃত হয় পোশাক এবং ধারণা করা হয়, পোশাকও একটি কারণ, যার জন্য এই শীতল পরিবেশে আদিম মানুষের অভিবাসন সম্ভব হয়েছিলো।

তো এসব আবছা নমুনা আবছা তত্ত্বের ভীড়ে আসলে সঠিক করে বলা মুশকিল যে ঠিক কবে থেকে পোশাক পরিধানের সূত্রপাত। তবু মাঝে মাঝেই নানা জায়গায় নানা নমুনা আবিষ্কার হয় আর সেই সাথে পাল্টে যায় এর উৎপত্তির সময়কাল।

কিন্তু এভাবেই কোনো এক সূদুর অতীত থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই শিল্প পরবর্তীতে ছড়িয়ে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যেমন প্রাচীন সভ্যতাগুলোর দিকে তাকালে এর অনেক ভালো উদাহরণ মেলে। প্রাচীন মিশরের মানুষ খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫,৫০০ বছর পূর্বে আবিষ্কার করে লিনেন নামক তন্তুর। প্রায় ২,০০০ বছর পূর্বে তারা এই লিনেনের পরিবর্তে ঊলের ব্যবহার করা শুরু করে। আবার চীনে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৪,০০০ বছর পূর্বে আবিষ্কৃত হয় সিল্কের।এভাবেই একসময় আবিষ্কার হয় তাঁত যন্ত্রের, যার সাহায্যে বয়ন শিল্প হয়ে ওঠে আরো নান্দনিক আর সহজসাধ্য।

সবথেকে প্রাচীন যে বয়নশিল্পের নমুনা পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে একটি স্কার্টের ছেড়া অংশ, যা পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব আর্মেনিয়ার আরেনি-১ গুহা থেকে। যদিও এর সাহায্যে বলা যায় না যে এটি আদৌ তাঁতযন্ত্রে বোনা কিনা। কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে এর বয়স জানা যায় প্রায় ৫,৯০০ বছর পূর্বে। যেহেতু স্কার্টটির কেবল ভগ্নাংশই পাওয়া গেছে, কাজেই এটি অনুমান করা শক্ত যে পুরো স্কার্টটি দেখতে কেমন ছিলো বা কোনো নারী সেটা পরলে কেমন দেখা যেত।

৫,৯০০ বছরের পুরনো স্কার্টের ভগ্নাংশ; Source: toptenz.net

পরবর্তীতে প্রাচীন মিশরের এক সমাধিসৌধ (যা কায়রো থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত) থেকে আবিষ্কৃত হয় এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীন ও সম্পূর্ণ বস্ত্র এবং এটিই সবথেকে পুরাতন পরিধানযোগ্য বস্ত্রের নমুনা। এর বয়স নির্ণয় করা হয়ে প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্বে। বয়ন করা হয়েছিলো লিনেন তন্তুর সাহায্যে। পোশাকটি ‘তারখান’ নামে পরিচিত।

এখন পর্যন্ত পাওয়া সবথেকে প্রাচীন পরিধানযোগ্য পোশাকের নমুনা; Source: toptenz.net

আস্তে আস্তে শুরু হতে থাকে বস্ত্র বিপ্লবের সূচনা। এখন প্রতিটি মানুষেরই ফ্যাশন ও স্ট্যাটাসের সাথে পোশাক পরিচ্ছদের আছে এক অঙ্গাঅঙ্গি সম্পর্ক। কিন্তু কিভাবে এই এলো এই পোশাক শিল্প, কে বা কারা আবিষ্কার করলো এই পোশাক- এসবের সম্পূর্ণ সঠিক উত্তর না পাওয়া গেলেও বেশ কিছু জোরালো তত্ত্ব ও তথ্যের সাথে আমাদের পরিচয় তো অবশ্যই হয়েছে।

ফিচার ইমেজ: gizmodo.com

Related Articles

Exit mobile version