প্রতিবাদ ও প্রেরণার সঙ্গীত ’উই শ্যাল ওভারকাম’- গানটি সৃষ্টির ইতিহাস

যেসব মহৎ সঙ্গীত সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে করেছে প্রতিবাদী, রক্তে জাগিয়েছে উদ্দীপনা, চেতনাতে জাগিয়েছে অনুরণন, কল্পনাকে করেছে জাগ্রত, তাদের মধ্যে অন্যতম হল ‘উই শ্যাল ওভারকাম’।

এই গানের মালিক সারা বিশ্বের নিগৃহীত মানুষ, সৎ ও প্রতিবাদী মানুষ, এই গানের মালিক সারা পৃথিবীর আশাবাদী মানুষ। এ গান মানবতার গান। জাতীয় সঙ্গীতের পরপরই এই গান প্রায় প্রতিটি জাতির মানুষকেই উদ্দীপ্ত করে তোলে। পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষাতেই গানটি অনুবাদ করা হয়েছে এবং গেয়েছেন সকল ভাষার মানুষ।

we-shall-overcome

কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আন্দোলনে বহুল ব্যবহৃত গান উই শ্যাল ওভারকাম; Image Courtesy: Everett Collection Inc / Alamy Stock Foto

We shall overcome
We shall overcome
We shall overcome some day.
Oh, deep in my heart
I do believe
We shall overcome some day

এই গানটি সৃষ্টির ইতিহাস কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর। প্রথমদিকে উই শ্যাল ওভারকাম গানটি শুরু হয়েছিল ধর্মীয় সঙ্গীত এবং সকলে মিলে গান করার ঐকতান হিসেবে। পরবর্তীকালে চারজন গীতিকার একে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার অর্জনের গণসঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

জানা যায়ে, সঙ্গীতের সুরটি সম্ভবত ১৯৭৪ সালে তৈরি। স্যাঙ্কটিসিমা বা ‘সিসিলিয়ান’ নাবিকরা একে প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করতেন। প্রার্থনা সঙ্গীত হলেও এই গানের গানের বেশ কিছু অংশ ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে আধুনিক। তখন এই গানের লাইন গুলো এরকম ছিল না, আর শুরুর লাইনটি ছিল এমন- I shall over come some day.

সে সময়কার সুরটিও ছিলো একেবারেই আলাদা। ১৯০০ সালে যাজক এ্যালবার্ট টিন্ডলে রচিত শকলাই গ্রন্থে এই গানের লিখিত রূপ পাওয়া যায়। ১৯৪৫ সালে গানটির মধ্যে কিছু নতুন সুর ও শব্দ যোগ হয়। গানের অবশিষ্ট কথা গুলো লিখেছেন অস্ট্রিন টুইগ আর নতুন সুর তৈরী করেন কেনেথ মরিস।

বহু গানের মতোই জনপ্রিয় ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটির শিকড় খ্রিস্টান ধর্মবাণীতে। সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ এর ‘পিপলস সংস বুলেটিন’পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গানটি। বলা হয়, ‘ইফ মাই জেসাস উইল্স’ নামক স্তুতিগানই ছিল গানটির মূল উৎস। কারো মতে, এই গানের গঠন রেভারেন্ড চার্লস টিন্ডলের ‘আই উইল ওভারকাম সামডে’ থেকেই অনুপ্রাণিত, যা মূলত ব্যক্তিগত মানসিক দৃঢ়তা, ধর্ম-সান্নিধ্য ও ঈশ্বরকে নিজ চিত্তে ধারণ করার কথাই বলে।

চার্লস টিন্ডলে

চার্লস টিন্ডলে; Image Courtesy:  Tindley Temple United Methodist Church Philadelphia, PA

শিকাগোর জনৈক সু-সমাচার গায়ক রবার্টা মার্টিন এই গানের আরো একটি অনুবাদ করেন। গানটির শেষ বারোটি মাত্রা বর্তমানে উই শ্যাল ওভারকাম সামডে গানের অংশ। টেনেসি রাজ্যরে মন্টিগল-এ ‘হাইল্যান্ডার ফোক স্কুল’ এর প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী, জিলফিয়া হর্টন এ গানটি প্রথম শুনেছিলেন ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে।

জানা যায়, দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্যের চার্লসটন শহরের শিল্প সংগঠন কংগ্রেসের খাদ্য ও তামাক বিভাগের কর্মচারীরা প্রতি ঘন্টায় ৪৫ সেন্ট মজুরির দাবিতে ধর্মঘট করছিলেন। জিলফিয়া আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশের জন্য ধর্মঘটরত কর্মচারীদের পিকেটিংয়ে অংশ নেন। তিনি এই গানটি তখন পিকেটারদের মুখ থেকে প্রথম শুনেন। তখন গানটির কথা ছিল: “We will overcome, and we will win our rights someday.”

আর একটি গল্প থেকে জানা যায়, পিকেটিংরত দুইজন শ্রমিক জিলফিয়ার স্কুলের একটি শিক্ষা প্রকল্পে এসে তাকে ঐ গানটি গেয়ে শোনান। যে ঘটনাটিই সত্যি হোক না কেন, এই গানটি শুনে জিলফিয়া মুগ্ধ হন। তিনি পরবর্তীতে গানটির কথা ও সুরে সামান্য পরিবর্তন এনে একে একটি সমবেত সঙ্গীতে পরিণত করেন।

জিলফিয়া হর্টন

জিলফিয়া হর্টন; Image Source: wisconsinhistory.org

পরে তিনি এই গানটি বিখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী পিট সিগারকে শোনান। পিট সিগার উৎসাহ ভরে গানটি শোনেন এবং তা জিলফিয়া থেকে তখনি শিখে নেন। পরে সিগার নিজের রাজ্যের উত্তরাংশে এই গানটি গেয়ে শোনান এবং গানে আরো কিছু পঙক্তি যোগ করেন। ‘উই উইল ওয়াক হ্যান্ড ইন হ্যান্ড‘ এইসব পঙক্তিগুলোর একটি।

গানটিকে আরও জনপ্রিয় করেন গণসঙ্গীত গায়ক ফ্রাঙ্ক হ্যামিল্টন। যে সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র ‘শুধুমাত্র শেতাঙ্গদের জন্য’ চালিত রেস্তোরার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্যে এই গানটি শোনান শেতাঙ্গ গণসঙ্গীত গায়ক গ্য কারাভন।

গ্য কারাভন।

গ্য কারাভন; Image Source: faculty.trinity.edu

জো গ্লেজার এবং এল্ম সিটি ফোর দল এই গানটি প্রথম রেকর্ড করে ১৯৫০ সালে। গানটির রেকর্ড বের হয় শিল্প সংগঠন কংগ্রেসের শিক্ষা ও গবেষণা দফতর থেকে।

১৯৬০ সালে গানটি প্রকাশিত হওয়ার পর চারজন গীতিকারই গানটিকে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার অর্জন আন্দোলনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। ঠিক হয় রেকর্ড বিক্রির যাবতীয় লভ্যাংশ আন্দোলনে দান করা হবে। গানের সর্বাধিক জনপ্রিয় অনুবাদটির স্বত্ব রয়েছে হর্টন, হ্যামিল্টন, কারাভন এবং সিগারের নামে।

লোকসঙ্গীত শিল্পী পিট সিগার

লোকসঙ্গীত শিল্পী পিট সিগার; Image Courtesy: George Pickow/Michael Ochs Archives/Getty Images

উই শ্যাল ওভারকাম-কৃষ্ঞাঙ্গদের স্বাধীনতা আন্দোলনের গান। মানুষ এই গানটির শক্তিশালী, সম্মোহনী সুরকে তীব্র আবেগের সাথে গাইত। একজন গানটির নেতৃত্ব দিত, আর অন্যরা এক অন্যের হাত ধরে ক্রমান্বয়ে একবার এগোত, একবার পিছিয়ে যেত, গানের অনুচ্ছেদগুলোর পুনরাবৃত্তি করত।

ফ্রাঙ্ক হ্যামিল্টন

ফ্রাঙ্ক হ্যামিল্টন; Image Courtesy: Old Town School of Folk Music

কথায় কিছু পরিবর্তন এনে সিগার গানের নবকল্পিত রূপ দেন। তিনি তার নিজের দল ‘দ্য উইভারস’-এর পক্ষ থেকে সিভিল রাইটস আন্দোলনে বহু সভা, সমাবেশে, র‌্যালি, কনসার্ট হলে গেয়ে সমকালীন রাজনৈতিক বিশ্বাসে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করেন। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের দাবির পক্ষে, মানবাধিকারের প্রশ্নে এই গানে গলা মিলিয়েছেন অনেক পীড়িতরাই।

১৯৬৩ সালে পিট সিগার এবং একটিভিস্ট গ্রীনউড একসঙ্গে এক প্রতিবাদ সভায় গেয়ে উঠেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি

১৯৬৩ সালে পিট সিগার এবং একটিভিস্ট গ্রীনউড একসঙ্গে এক প্রতিবাদ সভায় গেয়ে উঠেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি; Image Courtesy: Adger Cowans/Getty Images

পরে সিগার ‘উই শ্যাল ওভারকাম ফান্ড’ গঠন করেন। এই ফাউন্ডেশন থেকে আফ্রো-আমেরিকানদের উন্নতির লক্ষ্যে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হত।

১৯৬৩ এর অগাস্টে ওয়াশিংটনে মার্টিন লুথার কিং এর পদযাত্রায় এই গান পৃথিবী জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তা সকলের হৃদয় ছুঁয়েছিল। শীতলযুদ্ধের সময় বহু কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলনে এই গান অনুরণিত হয়েছিল।

মার্টিন লুথার কিং

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র; myspace.com

এই গান সম্পর্কে জুনিয়র বলেছিলেন, এই গান স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্য এনে দিয়েছে। ১৯৬৫ সালে, আলাবামাতে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী শ্বেতাঙ্গিনী ভায়োলা লুৎসিকে খুন করা হয়। মরতে মরতে ভায়োলা গাইছিলেন, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’।

১৯৬৫ সালের ১ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের জেলখানায় ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জন হ্যারিসও এই গানটি গেয়েছিলেন। তারপর থেকে অনেকদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় এই গানটি গাইতে দেওয়া হয়নি।

জন হ্যারিস

জন হ্যারিস; Image Source: southafricaplus.co.za

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বা আয়ারল্যান্ডে মানবাধিকারের জন্যে, গাজায় ইসরায়েলের ঘেরাও প্রতিবাদে রজার ওয়াটর্স, বা নরওয়েতে জঙ্গিহানার পর ব্রুস স্প্রিংস্টিনের গলায় এ গান শোনা গিয়েছে।

গানটি বিশ্বের প্রায় সব ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কবি গিরিজা কুমার মাথুরের আক্ষরিক অনুবাদ ‘হাম হোঙ্গে কামিয়াব এক দিন’ আশির দশকে এক স্বদেশপ্রেমী সংগীত হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়।

বাংলায় এই গানের অনুবাদ করেন গণসঙ্গীতের কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তার অনুবাদ এবং ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে বাংলায় ‘আমরা করব জয়’ গানটি উচ্চারিত হয় সবার মুখে মুখে ।

গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস

গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস; Image Source: wikimedia.org

এই গান প্রথম বাংলায় গেয়েছেন কলকাতার ধর্মঘটের শ্রমিকরা, চিনা ভাষায় গেয়েছেন তিয়েনামেন স্কোয়ারের ছাত্ররা, ফরাসিতে গেয়েছেন পরমাণু যুদ্ধ বিরোধী নাগরিকরা। এসএফআই এর এন পি চন্দ্রশেখরন মালায়াম ভাষায় গানটি অনুবাদ করেন ‘নাম্মাল বিজয়াকুম’ নামে, যা সত্তরের দশকে লোকমুখে বেশ প্রচারিত হয়েছিল।

‘এক দিন সূর্যের ভোর’ নামক অন্য একটি অনুবাদ করেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যা রুমা গুহঠাকুরতার তত্ত্বাবধানে ক্যালকাটা ইউথ কয়ার রেকর্ড করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।

ভূপেন হাজারিকা; Image Source: sunsigns.org

এই মহৎ সঙ্গীতের মাধ্যমে সবাই তাদের প্রতিবাদেরর ভাষা ও প্রেরণার উৎস খুঁজে পেয়েছে, প্রকাশ ঘটিয়েছে তীব্র মানবিক চেতনার।

আমরা করব জয় , আমরা করব জয় ,
আমরা করব জয় নিশ্চয় |
আহা বুকের গভীর, আছে প্রত্যয়
আমরা করব জয় নিশ্চয় |আমরা করব জয় , আমরা করব জয় ,
আমরা করব জয় নিশ্চয় |

Related Articles

Exit mobile version