১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে একভাগে ইহুদীদের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ হয়। সে সময় সমগ্র ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ, যাদের অধিকাংশই এর পূর্ববর্তী কয়েক দশকে ইউরোপ থেকে অভিভাসী হিসেবে এসে আশ্রয় নেওয়া জনগোষ্ঠী। ইহুদীদের নিয়ন্ত্রিত ভূমির পরিমাণও ছিল খুবই কম, মোট ভূমির মাত্র ৭ শতাংশ। কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইহুদীদেরকে বরাদ্দ দেওয়া হয় শতকরা ৫৫ ভাগ ভূমি, যার অধিকাংশই ছিল সমুদ্র উপকূল জুড়ে এবং চাষাবাদের উপযোগী উর্বর এলাকাগুলোতে।
হাজার হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনে বসবাস করে আসা স্থানীয় আরবদের পক্ষে নিজেদের দেশকে ভাগ করে ইহুদীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। জাতিসংঘের প্রস্তাবে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু স্থানীয় আরবরা পরদিন থেকেই ইহুদী বসতিগুলোর উপর আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয় আরব-ইসরায়েল গৃহযুদ্ধ, যা চলে পরবর্তী সাড়ে পাঁচ মাস পর্যন্ত, ইসরায়েলের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
ফিলিস্তিনের ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতা ডেভিড বেন গুরিয়নের অবশ্য আগে থেকেই এই গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল। তিনি ভালো করেই জানতেন, আরবরা কখনোই তাদেরকে মেনে নিবে না। তিনি এটাও জানতেন, ব্রিটিশরা যদিও নীতিগতভাবে তাদের পক্ষে ছিল, কিন্তু ফিলিস্তিন ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তারাও ইহুদীদেরকে এককভাবে সাহায্য করবে না। সে সময় সিআইএসহ বিশ্বের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুমান ছিল, আরবদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে নতুন সৃষ্ট ইহুদী রাষ্ট্রটি টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও বেন গুরিয়নের আত্মবিশ্বাস ছিল, হাগানাসহ ইহুদীদের বিদ্যমান প্রতিরক্ষাবাহিনীগুলোর এই অসম যুদ্ধে জয়লাভ করার সামর্থ্য আছে।
সংখ্যার দিক থেকে ইহুদীরা ছিল আরবদের চেয়ে অনেক কম। প্রাথমিক দিকে তাদের অস্ত্রশস্ত্রও খুব বেশি ছিল না। যা ছিল, তা-ও ব্রিটিশদের অভিযানে বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হতো। বেন গুরিয়ন জানতেন, যুদ্ধের নীতি-নৈতিকতা মেনে চললে তাদের পক্ষে আরবদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। আরবদের উপর তাদেরকে আঘাত করতে হবে এমনভাবে, যাতে অল্পতেই তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা যায়। ফলে গৃহযুদ্ধ শুরুর একমাসের মাথয়াই ইহুদীদের প্রতিরক্ষাবাহিনী হাগানার প্রধান হিসেবে তিনি অনুমোদন করেন অপারেশন জারজির (অপারেশন স্টার্লিং) নামের এক বিশেষ অভিযানের, যার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের আন্দোলনের নেতাদেরকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নির্মূল করা।
অপারেশন স্টার্লিংয়ের আগেও হাগানা একাধিক আরব নেতাকে হত্যা করেছিল। কিন্তু এটি ছিল সমগ্র ফিলিস্তিন জুড়ে আরব নেতাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রথম আনুষ্ঠানিক এবং সুপরিকল্পিত অভিযান। অপারেশন স্টার্লিংয়ের মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি। আরব রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদেরকে অপহরণ অথবা হত্যা করা, রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ করা এবং আরবদের অর্থনৈতিক ও উৎপাদনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আক্রমণ করা। অর্থাৎ আরবদের আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার মতো নেতা ও তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলাই ছিল এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য।
অপারেশন স্টার্লিংয়ের তালিকায় ফিলিস্তিনের মোট ২৩ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম ছিল। এর মধ্যে সবার উপরের নামটি ছিল হাসান সালামা, যার সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচিত করেছি আমাদের পূর্ববর্তী একটি লেখায়। হাসান সালামা ছিলেন জেরুজালেমের মুফতি আমিন আল-হুসেইনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি ছিলেন ১৯৩৬ সালের আরব বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে তিনি মুফতির সাথে লেবানন, ইরাক, ইরান ও ইতালি হয়ে জার্মানীতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান-আরব যৌথ উদ্যোগে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ বিরোধী অপারেশন আটলাসে অংশগ্রহণ করেন।
অপারেশন আটলাস ছিল একটি ব্যর্থ অভিযান। এর পাঁচ সদস্যের চারজনই ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল, কেবলমাত্র হাসান সালামাই গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপন করে থাকতে পেরেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি আবারও ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় হন। এ সময় তিনি ফিলিস্তিনের হোলি ওয়ার আর্মি তথা জাইশ আল-জিহাদ ওয়াল মুকাদ্দাসের দক্ষিণাঞ্চলের কমাণ্ডার হিসেবে আবির্ভূত হন। জাতিসংঘে ইসরায়েলে স্বাধীনতার প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরদিনই, ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর, সালামার নেতৃত্বে তার বাহিনী ইহুদীদের উপর আক্রমণ করে। তারা পেতাহ তিকভা শহরের কাছে ইহুদী যাত্রীবাহী দুটি বাসে আক্রমণ করলে নিহত হয় আট ইহুদী।
পরদিন সকালে জাফ্ফা শহরের প্রধান চত্বরে দাঁড়িয়ে হাসান সালামা ঘোষণা দেন, ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিন থেকে উচ্ছেদ করা না হলে ফিলিস্তিন রক্তের নদীতে পরিণত হবে। পরবর্তী দিনগুলোতে তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ শতাধিক সদস্যের বাহিনী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে ইহুদীদের স্থাপনাগুলোর উপর একাধিক আক্রমণ করে। আরব বিশ্বে হাসান সালামা রীতিমতো নায়কে পরিণত হন। মিসরীয় সাময়িকী আল-মুসাওওয়ার তাদের ১৯৪৮ সালের ১২ জানুয়ারি সংখ্যায় সালামা এবং তার বাহিনীকে নিয়ে বিশাল একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘দ্য হিরো হাসান সালামা, কমাণ্ডার অফ দ্য সাদার্ন ফ্রন্ট’।
ইহুদীদের দৃষ্টিতে অবশ্য হাসান সালামা ছিলেন একজন সন্ত্রাসী, যিনি ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার নাম স্থান পায় অপারেশন স্টার্লিংয়ের গুপ্তহত্যার লক্ষ্যের তালিকার সবার উপরে। সালামাকে খুঁজে বের করার কাজে ফিলিস্তিনের ইহুদীরা তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গতানুগতিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় করে। ফিলিস্তিনি নেতাদের মধ্যকার কথপোকথন শোনার লক্ষ্যে তারা জাফ্ফার সাথে ফিলিস্তিনের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনকারী কেন্দ্রীয় টেলিফোন লাইনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা করে।
হাগানার গোয়েন্দা বিভাগের একটি ইউনিটের নাম ছিল শাই (Shai)। সে সময় শাই এর প্রধান ছিলেন ইসের হারেল (Isser Harel), পরবর্তীতে যিনি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত এবং মোসাদের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার নির্দেশে শাই-এর গোয়েন্দারা জাফ্ফার একটি কৃষি বিদ্যালয়ের পাশের জমিতে একটি অস্থায়ী ছাউনি নির্মাণ করে। ছাউনিটিকে তারা রূপ দেয় কৃষি যন্ত্রপাতি রাখার গুদাম ঘর হিসেবে, যেখানে তারা জমা করে জমির আগাছা পরিষ্কার করার কাঁচি, লন মোয়ারসহ নানাবিধ কৃষি যন্ত্রপাতি। কিন্তু এর ভেতরেই মাটির নিচের একটি প্রকোষ্ঠে তারা স্থাপন করে একটি আড়িপাতা যন্ত্র, যার অপর প্রান্ত সংযুক্ত ছিল পাশ দিয়ে যাওয়া জাফ্ফার কেন্দ্রীয় টেলিফোন লাইনের সাথে।
শাই-এর গোয়েন্দা তৎপরতা বেশ চমৎকার ফলাফল দেয়। ফিলিস্তিনিদের অজান্তেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আড়ি পেতে শুনে ফেলতে থাকে শাই-এর আরবি ভাষাভাষী ইহুদী গোয়েন্দারা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই টেলিফোন লাইনে তারা পেয়ে যায় স্বয়ং হাসান সালামাকেও। সালামার পরবর্তী অভিযানের জন্য জাফ্ফাতে আসার দিনক্ষণ এবং গতিপথও জেনে যায় তারা। হাগানার গোয়েন্দারা সিদ্ধান্ত নেয়, যে রাস্তা ধরে সালামার যাওয়ার কথা, সেখানে নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগেই তারা গাছের গুঁড়ি ফেলে তার গাড়ি আটকে দিয়ে এরপর তাকে হত্যা করবে।
হাগানার পরিকল্পনা অবশ্য সফল হয়নি। হাসান সালামাকে সেবার হত্যা করতে পারেনি তারা। শুধু সেবার না, এরপর একাধিকবার চেষ্টা করেও সালামাকে তারা হত্যা করতে পারেনি। ১৯৪৮ সালের ১৩ই মে ইসরায়েলের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে যখন গৃহযুদ্ধ পুরোপুরি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে রূপ নেয়, তখন সালামার নেতৃত্বে তার বাহিনী ইহুদীদের বিভিন্ন ঘাঁটির বিরুদ্ধে পুরোমাত্রায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়। জুন মাসের ২ তারিখে এরকম একটি যুদ্ধে ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুনের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ হন হাসান সালামা। তার হত্যাকারী ইরগুনের সদস্যরা সে সময় তার পরিচয় না জেনেই তাকে হত্যা করে।
অপারেশন স্টার্লিংয়ের অধিকাংশ হত্যা প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। হাসান সালামার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং মুফতি আমিন আল-হুসেইনির ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুল কাদের আল-হুসেইনির নামও ছিল এই তালিকার উপরের দিকে। কিন্তু তিনিও হাগানার একাধিক হত্যাপ্রচেষ্টাকে ধোঁকা দিয়ে শেষপর্যন্ত যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন। সে সময় গোয়েন্দা তথ্য ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ না থাকায় এবং গোয়েন্দাবাহিনীগুলো একেবারেই নবীন হওয়ায়ই ব্যর্থ হয়েছিল অপারেশন স্টার্লিং। কিন্তু ব্যর্থ হলেও এই অপারেশনের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটির গুপ্তহত্যার ইতিহাস, যাদের অপারেশনের পরিধি পরবর্তী দশকগুলোতে বিস্তার লাভ করেছিল বিশ্বব্যাপী।
তথ্যসূত্র: Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো
(১) সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি’র গুপ্তহত্যা (২) উগ্র জায়নবাদের উত্থান (৩) ইহুদীদের নৈশ প্রহরী হাশোমারের ইতিহাস (৪) আইডিএফের পূর্বসূরি হাগানার উত্থান (৫) নাৎসিদের উপর ইহুদী ব্রিগেডের প্রতিশোধ (৬) ফিলিস্তিন থেকে জার্মানদের উচ্ছেদ (৭) যে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের সৃষ্টি (৯) পালায়াম এবং ছদ্মবেশী আরব ইউনিটের নাশকতা
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons (জাইশ আল-জিহাদ ওয়াল মুকাদ্দাসের সদস্যরা)