রুশ বিপ্লবের আদ্যোপান্ত

বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে পৃথিবীর সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রুশ বিপ্লব; সাধারণ, মেহনতি মানুষের বিপ্লব। রাজতন্ত্র ভেঙে সমাজতন্ত্রের উদ্ভবকারী এক বিপ্লব। দলিত, শোষিত ও অবহেলিতের অধিকার আদায়ের বিপ্লব। এ বছর শতবর্ষপূর্তি হলো এ মহান বিপ্লবের। এক শতাব্দী পরেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমান মর্যাদা ও মাহাত্ম্যপূর্ণ এই বিপ্লব। চলুন জানা যাক শোষিত মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রুশ বিপ্লবের আদ্যোপান্ত

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক; Source: slideplayer.com

রুশ বিপ্লব মূলত দু’টি ধাপে সম্পন্ন হয়েছিল এবং এই বিদ্রোহী চেতনার গোড়াপত্তন হয়েছিল আরও আগে। উনিশ শতকে যখন পুরো ইউরোপে শিল্পায়নের হাওয়া বইছে, রাশিয়াতে তখনও চলছে সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্র। জার (Czar) শাসিত রাশিয়াতে অভিজাত ভূস্বামীদের জমিতে শ্রম দিতে হতো ভূমিহীন কৃষকদের (Surf)। এমন জমিদারী প্রথার সাথে আমরাও ব্রিটিশ আমল থেকে পরিচিত। কৃষকদের উপর ইচ্ছেমতো খাজনা আরোপ করে, অত্যাচার-জুলুম করে চাষাবাদে বাধ্য করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই, এ কারণে কৃষকরা চাষাবাদে কোনো আগ্রহ পেতো না। ফলে উৎপাদন হতো খুবই কম। এই ভূমিপ্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইউরোপজুড়ে ততদিনে অনেক আগেই উঠে গেছে। দেরিতে হলেও সেই অর্থনৈতিক বিপ্লবের বাতাস রাশিয়ার জনজীবনেও লাগলো। সমগ্র রাশিয়াজুড়ে নানা রকম গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠলো। কিছু খন্ড খন্ড ব্যর্থ বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটতে থাকলো। ব্যর্থ বলেই এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বেড়ে গেলো জারের অত্যাচার-নিপীড়ন। কিন্তু যত বজ্র আঁটুনি, ততই ফস্কা গেরো। ১৮৫৩-৫৬ সালে সংঘটিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ধনতান্ত্রিক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছে রাশিয়ার পরাজয় আরও বেশি করে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন জানান দিলো।

১৮৬১ সালে উচ্ছেদ হলো ভূমিদাস প্রথা। লক্ষ মজুরের হাড়-মাংসের উপর গড়ে উঠলো শিল্পকারখানা ও শিল্পাঞ্চল। শিল্পায়নের সাথে সাথে বিকাশ লাভ করলো পুঁজিবাদ। শিল্পনগরী সেইন্ট পিটার্সবার্গ ও মস্কোতে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জীবনযাত্রার মান গেল কমে। জন্ম নিলো সর্বহারা মজুর শ্রেণী। নামমাত্র মজুরীতে ১২-১৩ ঘন্টা করে খাটানো হতো শ্রমিকদের। স্বল্প মজুরীতে জীবনধারণের জন্য মালিকের দোকান থেকেই তাদের চড়ামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে হতো। অর্থাৎ ধনী আরও ধনী হতে লাগলো, আর দরিদ্ররা এক দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতে লাগলো। এক শোষণব্যবস্থা থেকে আরেক শোষণ প্রণালীতে উন্নীত হলো রুশ অর্থনীতি। খেয়ে পরে বাঁচার দাবিতে আবারও শুরু হলো প্রতিবাদ। ১৯০৫ সালে নিরস্ত্র বিদ্রোহী মজদুর জনতার এক মিছিলে জারের বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। হতাহত হয় অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়ে ১৯০৫ সালের প্রথম রুশ বিপ্লব।

সহজ নয় বিপ্লবের পথ; Source: derimot.no

বিপ্লব হলো অনেকটা নিউক্লিয় ফিশন বিক্রিয়ার মতো, একবার শুরু হলে থামানো মুশকিল। ১৯০৫ এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর জারের গদিতে বসলেন দ্বিতীয় নিকোলাস। তিনিও পিতার মতো স্বৈরাচার ও দমননীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তার স্বৈরাচার বিপ্লবের চুলায় তুষ ঢালতে থাকলো। এরই মধ্যে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সার্বিয়া ও তার মিত্রবাহিনী ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পক্ষ নিয়ে রাশিয়াও যুদ্ধে যোগ দিলো। দীর্ঘকালের রাজতন্ত্র ও নব্য পুঁজিবাদের চাপে নিষ্পেষিত রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধ লড়ার মতো অবস্থায় ছিল না। শিল্পোন্নত জার্মানীর আঘাতে যে ক্ষত রাশিয়ায় তৈরি হলো, তা পূর্বেকার যেকোনো যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ ছিল। জার নিকোলাস রাজধানী ছেড়ে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন। এদিকে তার অনুপস্থিতিতে তার স্বেচ্ছাচারী জারিনা (Czarina) আলেক্সান্দ্রা খামখেয়ালি শুরু করলেন। ইচ্ছেমত রাজ কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা শুরু করলেন তিনি। তারই প্রশ্রয়ে তার বিতর্কিত সচিব গ্রেগরি রাসপুতিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। রুশ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করলো রাসপুতিন। তার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে রুশ অভিজাতরা ১৯১৬ সালে তাকে হত্যা করে ফেললো। পুরো দেশের জনগণের জারের শাসনের উপর থেকে ভরসা উঠে গিয়েছিল। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলো গোটা দেশ। সেই সাথে এই ভগ্ন অর্থনীতির কবলে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ পেটের ক্ষুধায় পুনরায় বিপ্লবী হয়ে উঠলো। ৮ মার্চ ১৯১৭ (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭), পেট্রোগ্রাডের সুতার কলে নারী শ্রমিকরা রুটির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

Source: twitter.com

মূলত খাদ্যের অভাবই ছিল এই বিপ্লবের মূল কারণ। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে এই বিপ্লব ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে পরিচিত। রুটির দোকানের সামনের ক্রেতাদের ভিড় থেকে হলো গোলযোগের সূত্রপাত। পৃথিবীজুড়ে সাধারণ মানুষের দাবির ভাষা এক, বিপ্লবের ভাষাও অভিন্ন। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘যুদ্ধ নিপাত যাক’ এই ছিল বিদ্রোহের শ্লোগান। ১১ মার্চ বিদ্রোহী জনতা ও সেনাবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানে কিছু জায়গায় সেনারা গুলি চালায়। এতে বেশ কিছু মানুষ নিহতও হন। কিন্তু তবু টলেননি বিপ্লবীরা। যেখানে দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকা দায়, সেখানে গুলির আঘাতে মরে যাওয়াও যেন অনেক সহজ। অবশেষে বিপ্লবীদের কাছে হার মানতে বাধ্য হন জার। ১২ মার্চ ডুমা বা জাতীয় পরিষদ একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে। এর কিছুদিন পরে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে যুগান্তরের রাজতন্ত্রের অবসান করেন জার নিকোলাস।

শোষণ যখন চরমে, প্রতিবাদ তখন রন্ধ্রে ; marxist.com

অস্থায়ী সরকার জনগণের বাক-স্বাধীনতা, আইনের সমান প্রয়োগ, মিছিল-মিটিং ও ধর্মঘট করার স্বাধীনতা প্রভৃতি অধিকার নিশ্চিত করে উগ্র বিদ্রোহ বন্ধ করার প্রয়াস চালালো। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে ক্ষান্ত দেয়ার কোনো পদক্ষেপ নতুন সরকার নিলো না। বরং যুদ্ধমন্ত্রী আলেক্সান্দার কেরেন্সকি জনমত উপেক্ষা করে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। ফলে খাদ্য সমস্যার কোনো সমাধানই হলো না। এই অবস্থায় বলশেভিক পার্টির নেতা ভ্লাদিমির লেনিন ডুমার অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটালেন। তারিখটি ছিল নভেম্বর ৭, ১৯১৭ (জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ২৫ অক্টোবর ১৯১৭; তাই এটি অক্টোবর বিপ্লব নামেও পরিচিত)। এবার বিপ্লবীরা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, রেলস্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলো দখলে নিয়ে নিলো। অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল রাশিয়ার ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত লোকজন দ্বারা। লেনিন তার পরিবর্তে সৈনিক, কৃষক ও শ্রমিকদের দ্বারা গঠিত সোভিয়েত সরকারের ঘোষণা দিলেন। শীঘ্রই লেনিনকে প্রধান করে নতুন সোভিয়েত সরকার শপথ নিলো। লেনিন হলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধিনায়ক।

রুশ বিপ্লবের অধিনায়ক লেনিন; Source: eloblog.pl

এভাবেই দু’টি ধাপে সম্পন্ন হয় রুশ বিপ্লব। প্রথম ধাপে হয় রাজতন্ত্রের পতন ও বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিতীয় ধাপে বিপ্লবীরা ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে একটি নতুন অর্থনৈতিক বন্টন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব করেন, একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে সংগ্রামের উদ্দেশ্য বা কৌশল সম্পর্কে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দিকে কার্ল মার্কসের ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ তত্ত্ব দ্বারা তরুণ সমাজ ও সচেতন জনগোষ্ঠী ভীষণ আলোড়িত হয়। বিপ্লব খুঁজে পায় দিক নির্দেশনা। মার্কস সমাজ ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, কোনো সমাজ ব্যবস্থাই স্থায়ী নয়। নির্দিষ্ট সময় পরে সব সমাজব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরের ফাঁকের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তার মতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই শোষণের অন্যতম কারণ। তিনি হিসাব-নিকাশ করে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন যে, পুঁজিবাদের শোষণের ফলেই উন্মেষ ঘটবে ‘প্রলেতারিয়েত’ বা রাজনীতি সচেতন শ্রমিক শ্রেণীর। পুঁজিবাদের অবসান হবে সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আগমনে। তাই হয়েছিল, যদিও সমাজতন্ত্র রাশিয়ায় স্থায়ী হতে পারেনি। বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী বিশ্বের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পারেন রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নও পরবর্তীতে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এই নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে, সর্বস্তরের মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্রই একমাত্র সফল রাষ্ট্রব্যবস্থা।

পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী ; socialist.ca

মহান রুশ বিপ্লবের একশত বছর পূর্ণ হলো এই নভেম্বরে। বিংশ শতাব্দী তো বটেই, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে তাৎপর্যবাহী এক ঘটনা এই বিপ্লব। শুধু রাশিয়ায় সীমাবদ্ধ না থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এর চেতনা। আজও বিশ্বজুড়ে মেহনতি মানুষের, শোষিত মানুষের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক এই রুশ বিপ্লব।

তথ্যসূত্র

১) বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর- তারেক শামসুর রেহমান (pub-2017; p-27-35)

ফিচার ইমেজ- wp.news365.mv

Related Articles

Exit mobile version