প্রাক ইসলামিক সময়ে ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপের মূল শক্তি দুটি, পশ্চিমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আর পূর্বে সাসানিদ, বা পার্সিয়ান সাম্রাজ্য। এখানে বলে রাখা উচিত, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আসলে আধুনিক ঐতিহাসিকদের দেয়া নাম।
সেই সময়ে কন্সট্যান্টিনোপোলে বসে শাসন করা সম্রাটেরা নিজেদের রোমান সম্রাট বলেই দাবি করতেন, আর সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা নিজেদের পরিচয় দিত রোমান হিসেবেই। তবে ল্যাটিন নয়, গ্রীক ভাষা তারা সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করত। পূর্ববর্তী ল্যাটিন ভাষাভাষী পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্য থেকে এই গ্রীক ভাষাভাষী খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যকে পৃথক করতে ঐতিহাসিকেরা বাইজান্টাইন নাম ব্যবহার করে থাকেন। সেই সময় আরবরাও একে বাইজান্টাইন বলত না। ইসলামিক যুগে এশিয়া মাইনর/ আনাতোলিয়া আরবদের, এবং পরবর্তীকালে তুর্কি আক্রমণকারীদের কাছেও পরিচিত ছিল রুম নামে। তুর্কিরা এই অঞ্চল অধিকার করলে তাদের রুমিয়ুন (Rumiyun) নামে অভিহিত করা হয়।
প্রারম্ভের কথা
কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক।
বানের জলের মতো এই এলাকায় ধেয়ে এলো দাহি (Dahae) নামে একটি জাতি। তাদের একটি উপদল, পার্নি (Parni) বর্তমান ইরানের উত্তরপূর্বে পাহাড়ি এলাকায় এসে আবাস করে। এখানে প্রাচীন আসাক (Asaak) শহরে তারা নিজেদের রাজধানী বানাল। এখানেই তাদের প্রথম রাজার অভিষেক হলো, রাজা আর্সাসেস (Arsaces)। পূর্বে সেলুসিডদের টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে ২৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা পার্থিয়া, এবং পরে হার্সেনিয়া প্রদেশ দখল করে নেয়। আর্সাসেস থেকে উৎপত্তি হয় আর্সাসিড রাজবংশের, যারা নানা এলাকা জয় করে পূর্ববর্তী সেলুসিডদের অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন পার্থিয়ান সাম্রাজ্য, যা টিকে ছিল ২২৪ খ্রিষ্টাব্দ অবধি।
আর্সাসিডদের হয়ে ইরানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করতেন স্থানীয় শাসকেরা, যাদের ফ্রাতারাকা (frataraka) বলা হত। এরা নিজেদের ছবি অঙ্কিত মুদ্রা প্রচলনের ক্ষমতা রাখতেন। এরাই একসময় পার্সিয়ার রাজবর্গ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তৃতীয় খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে ইশ্তাখর (Istakhr) নগরকে কেন্দ্র করে গোঝির নামে এমনই এক রাজা শাসন করছিলেন। ২০৫-০৬ খ্রিষ্টাব্দে শহরের অগ্নি মন্দির আনাহিদের প্রধান পুরোহিত পবগ তাকে উৎখাত করে রাজদণ্ড দখল করেন। তিনি ছিলেন ক্ষমতাবান সাসান পরিবারের প্রধান। নিজের ক্ষমতা ইশ্তাখরের বাইরেও বিস্তৃত করতে পবগ আগ্রহী ছিলেন, ফলশ্রুতিতে পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো। এরই মধ্যে পবগের বড় ছেলে শাপুর (Shabuhr) মারা গেলে উত্তরাধিকারী হলেন আরেক ছেলে আর্দাশির (Ardashir) । তিনি ২২৪ খ্রিষ্টাব্দে পার্থিয়ার সর্বশেষ সম্রাট চতুর্থ আর্টাবানাসকে (Artabanus IV/ আর্দাওয়ান নামেও পরিচিত) হরমজগানের প্রান্তরে যুদ্ধে হারিয়ে দেন।
আর্দাশিরের হাত ধরে সূচনা হয় সাসানিদ সাম্রাজ্যের। তার উপাধি হল রাজাধিরাজ (šahanšah/“King of Kings”)। সামরিক অভিযান চালিয়ে তিনি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড অধিকার করেন, যা পরে পরিচিত হল ইরানশার (Iranshahr/Eranšahr) নামে। পুরোহিত টোজার সাথে মিলে তিনি রাষ্ট্রীয় আইনকানুন লিপিবদ্ধ করার কাজেও হাত দেন, যেখানে জরথ্রুস্ত্রবাদের অনেক মূলনীতি দৃশ্যমান হয়। তার সন্তান শাপুরের সময় কের্দিরের নেতৃত্বে পুরোহিতেরা জরথ্রুস্ত্রবাদের ধর্মগ্রন্থ আভেস্তার প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক ক্ষমতা আদায়ে কাজ শুরু করেন। এই সময় মেসোপটেমিয়া থেকে মানি নামে এক ধর্মপ্রচারকের উদ্ভব হয়, যার প্রচারিত ধর্ম মেনিকিজম নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে প্রথম শাপুরের মৃত্যুর পর রহস্যময় পরিস্থিতিতে মানির মৃত্যু হয়, সম্ভবত জরথ্রুস্ত্রবাদী পুরোহিতেরা তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে হত্যা করেছিল।
প্রথম শাপুর সম্ভবত অনুধাবন করেছিলেন বিরাট সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিতে হবে, জরথ্রুস্ত্রবাদকে তাই তিনি রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থা থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল নাগরিকেরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবার পরিচয় হবে ইরনাঘান (Eranagan /Iranians)। কিন্তু পুরোহিতেরা নিজেদের প্রভাব কমে যাবার ভয়ে শাপুরের মৃত্যুর সাথে সাথেই জরথ্রুস্ত্রবাদকে রাষ্ট্রের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। ধর্মীয় ব্যাপারে সম্রাটের হস্তক্ষেপ তারা বন্ধ করার চেষ্টা করেন, যদিও এই নিয়ে পরে বেশ কয়েকজন সম্রাটের সাথেই পুরোহিতদের মনোমালিন্য হয়। তথাপি জরথ্রুস্ত্রবাদ সরকারি ধর্মে পরিণত হয় এবং পুরোহিতেরা প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেন।
সাসানিয়ান ধর্ম
সরকারি ধর্ম ছিল জরথ্রুস্ত্রবাদ। শুভ আর অশুভের দ্বিত্ত্ববাদের উপর এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর ঈশ্বর আহুরা মাজদা/হরমুযদ, যিনি বিশুদ্ধতার প্রতীক। তার প্রতিদ্বন্দ্বী অশুভের সম্রাট আহরিমান। আগুনকে আহুরা মাজদার প্রতীক হিসেবে ধরে নেয়া হত। তাই অগ্নিপূজা তাদের ধর্মীয় আচারের অংশ ছিল। সেজন্য বহু মন্দির সাম্রাজ্যজুড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, আহরিমানের উপাসনা কেউ করত না। সবাই একমাত্র আহুরা মাজদার উদ্দেশ্যেই প্রার্থনা জানাত। ফলে একে একেশ্বরবাদী ধর্ম বলেও অনেকে মনে করেন।
সাসানিদ শাসনকালে ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মের অনেক মানুষ রাজ্যে বসবাস করত। তারা প্রথম প্রথম স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করার সুযোগ পেয়েছিল। তবে খ্রিষ্টানদের কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখা হত। বিশেষ করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য খ্রিষ্টান হওয়ায় একই ধর্মের অনুসারীদের নানাভাবে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। যদিও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টানদের সমাদর করা হত কারণ তারা বাইজান্টাইনরা খ্রিষ্টধর্মের যেই ধারার প্রচার করত তার বিরোধী। ৩৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রোম ও সাসানিদদের শান্তিচুক্তির পরে সাসানিদ রাজধানী টেসিফোনে করের বিনিময়ে খ্রিষ্টান পাদ্রি এবং ইহুদি র্যাবাইরা কাজ করতে পারত। প্রথম ইয়াজদেগার্দের সময় (৩৯৯-৪২০ সাল) খ্রিষ্টধর্ম সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। নেস্টোরিয়ানরা গির্জা তৈরির অনুমতিও পায়। ইহুদিরাও স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই তাদের ধর্মকর্ম করতে থাকে। কিন্তু প্রথম ইয়াজদেগার্দের মৃত্যুর পর জোরেশোরেই খ্রিষ্টানদের উপর অত্যাচার আরম্ভ হয়। জরথ্রুস্ত্রবাদ ব্যতিরেকে অন্য ধর্মাবলম্বীরা নানাভাবে নিষ্পেষিত হতে থাকে। ৪৫১ খ্রিস্টাব্দে ব্যাটল অফ আভারেইরে আর্মেনিয়ান খ্রিষ্টীয় সেনাদলের পরাজয়ের পর থেকে ভিন্ন ধর্মের মানুষের ব্যাপারে সাসানিদ উদারনীতি প্রায় সম্পূর্ণই পরিত্যক্ত হয়।
জরথ্রুস্ত্রবাদ পুনর্জন্মসহ প্রচলিত অনেক পৌত্তলিক ধারণাই প্রত্যাখ্যান করত। সমাজের সর্বস্তরে সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জরথ্রুস্ত্রবাদ তাগিদ দিত। তাদের পবিত্র গ্রন্থ আভেস্তা সম্ভবত লিখিত আকারে মানুষের রচিত প্রথম ধর্মগ্রন্থ। কেউ কেউ একথাও বলে থাকেন লিখিত আকারে আভেস্তা দেখেই ইহুদিরা পরে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়, যা থেকে উৎপত্তি হয় তোরাহ আর তালমুদে’র। আভেস্তার কিছু কিছু অংশের সাথে হিব্রু এবং খ্রিষ্টান বাইবেলের অনেক মিল পাওয়া যায়। এছাড়াও মেনিকিজম নামে যে ধর্মের প্রচলন ছিল এটি আসলে জরথ্রুস্ত্রবাদেরই কিছুটা পরিবর্তিত রূপ। মেনিকিজমকে অনেকটা মূল ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদ বা মিস্টিকাল ধারার সাথে তুলনা করা যায়।
রোমানদের সাথে লড়াই
আর্দাশিরের সময় থেকেই রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সাসানিদদের বিবাদ শুরু হয়। মূল কারণ ছিল মেসোপটেমিয়া আর সিরিয়া অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে। এই বিবাদ চলেছিল ইসলামের আবির্ভাব অবধি, যার শেষ হয় রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের হাতে সাসানিদদের পরাজয় এবং পরে মুসলমানদের হাতে এর পতনের মাধ্যমে।
রোমান সম্রাট সেভেরাসের শাসনামলে আর্দাশিরের সাথে বেশ কিছু সংঘর্ষ হলেও কোনো পক্ষই সুবিধা করে উঠতে পারেনি। কিন্তু ২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সেভেরাসের মৃত্যুর পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হলো। ছেলে প্রথম শাপুর মেসোপটেমিয়ার অনেক এলাকা দখল করেন। উপুর্যুপুরি অভিযান চালিয়ে তিনি রোমানদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। ২৬০ খ্রিষ্টাব্দের লড়াইতে রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ান শাপুরের হাতে বন্দি হন। সাসানিদ কারাগারেই তার মৃত্যু ঘটে বলে ধারণা করা হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে উদ্ধারকৃত পুরাকীর্তিতে দেখা গেছে শাপুরের সামনে ভ্যালেরিয়ান নতজানু হয়ে আছেন। দ্বিতীয় শাপুর বেশ কয়েকজন রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধে টিকে ছিলেন এবং রোমের থেকে বহু এলাকা তিনি ছিনিয়ে নেন। সম্রাট জোভিয়ান তার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন এবং মেসোপটেমিয়া এবং আর্মেনিয়ার দাবি ত্যাগ করেন। যদিও পরে রোমানরা এই চুক্তি আর মানেনি। তবে ৩৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ভ্যালেন্স এবং শাপুরের চুক্তি বেশ লম্বা সময় শান্তি বজায় রেখেছিল। এরপর প্রথম ইয়াজদেগার্দের সময় (৩৯৯-৪২০ সাল) দুই পক্ষের সম্পর্ক সম্ভবত সবথেকে ভাল অবস্থায় ছিল। এতটাই যে রোমের ভাবি সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াসের অভিভাবক হিসেবে সাসানিদ সম্রাট দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
রোমের সাথে সংঘর্ষে আর্মেনিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করছিল। রোম আর্মেনিয়াকে দেখত সাসানিদ আর নিজস্ব ভূখণ্ডের মাঝে বাফার হিসেবে। বার বার যুদ্ধে আর্মেনিয়া বিভক্ত হয়ে যায় রোম আর সাসানিদদের মধ্যে। রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান সাসানিদ দ্বিতীয় ওয়াহরামের সাথে সন্ধিচুক্তি করে আপাতভাবে এই ভাগাভাগি পাকাপাকি করে নেন। পরবর্তীতে সাসানিদ সম্রাট নার্সেহ রোমানদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মেসোপটেমিয়ার অনেক অঞ্চল আর আর্মেনিয়ার দখল ছেড়ে দেন। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাব অবধি থেমে থেমে সংঘাত চলছিলই।
আর্মেনিয়া
সম্রাট দ্বিতীয় হরমুযদের (৩০২-৩০৯ খ্রিষ্টাব্দ) সময় আর্মেনিয়ার সাসানিদপন্থি রাজা চতুর্থ টির্দাতেস খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। আর্মেনিয়ার অধিবাসীরা প্রথমে ছিল পৌত্তলিক, পরে পার্সিয়ান ও সাসানিদদের প্রভাবে তারা জরথ্রুস্ত্রবাদে দীক্ষিত হয়। এদের অনেক গোত্রপতি বা নাক্সারাস (naxarars) রাজার ধর্ম পরিবর্তনকে ভাল চোখে দেখেনি। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম দ্রুতই প্রসার লাভ করে। এদিকে আর্মেনিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হরমুযদ নিজ কন্যাকে আর্মেনিয়ার রাজপুত্র মামিকোনিয়ানের হাতে তুলে দেন। হরমুযদের প্রভাবে অনেক নাক্সারাস টির্দাতেসকে সমর্থন শুরু করেন। ফলে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী এবং ভিন্নধর্মী আর্মেনিয়ানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়। অনেক লেখক পরবর্তীতে আর্মেনিয়ার ইতিহাস রচনার সময় পৌত্তলিক এবং জরথ্রুস্ত্রবাদি অধিবাসীদের মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন, তাদের দেখাতে চেয়েছেন অসভ্য, বর্বর হিসেবে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় পৌত্তলিক আর্মেনিয়ার নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল।
আর্মেনিয়া নিয়ে রোম আর সাসানিদ সংঘাতের এক পর্যায়ে সাসানিদ সম্রাট চতুর্থ ওয়ারহামের শাসনামলে তা পশ্চিম আর পূর্বাংশে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিম অঞ্চল চলে যায় রোমের হাতে আর পূর্বাঞ্চল সাসানিদ নিয়ন্ত্রণে। ৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় ইয়াজদেগার্দ জোরপূর্বক পুরো আর্মেনিয়ার উপর জরথ্রুস্ত্রবাদ চাপিয়ে দিতে চাইলে মামিকোনিয়ান পরিবারের উত্তরাধিকারী ভার্ডান খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ানদের নিয়ে ব্যাটল অফ অ্যাভারেইরে সাসানিদ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়। বীরত্বের সাথে লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত আর্মেনিয়ান সেনারা পরাস্ত হয়। আর্মেনিয়ার উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ।
আরবদের সাথে সংঘর্ষ
দ্বিতীয় হরমিযদের শিশুপুত্র দ্বিতীয় শাপুর রাজা হলে তার হয়ে পুরোহিতেরাই দেশ চালাতে থাকেন। এ সময় সাসানিদদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিমে পূর্ব আরব থেকে শত্রুরা অনুপ্রবেশ করে। শাপুর পূর্ণবয়সে উপনীত হয়ে আরবদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে চালানো শাপুরের প্রতিশোধমূলক অভিযান যথেষ্ট ভয়াবহ ছিল, তাই আরবদের কাছে তার নাম হয়ে যায় স্কন্ধছেদি (Shoulder Piercer/ Arabic Dhu-al-Aktaf)। তিনি আরবদের তাড়িয়ে দিয়ে পারস্য উপসাগরের বিরাট এলাকা এবং আরব উপদ্বীপের অনেকাংশে সাসানিদ প্রভুত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। অনেক আরব উপজাতিকে তিনি উচ্ছেদ করে অন্য জায়গাতে পাঠিয়ে দেন। এছাড়াও কুফার দক্ষিণে প্রাচীন হিরা শহরের নিকটে ভবিষ্যতের আরব হামলা ঠেকাতে তিনি একটি প্রাচীরও নির্মাণ করেছিলেন যা পরিচিত হয়ে উঠে খন্দক-ই-শাপুর নামে।
প্রাক-ইসলামিক কাল: সম্রাট খসরু
প্রথম খসরু: ৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে সাসানিদ সিংহাসনে আরোহণ করলেন প্রথম খসরু। ইতোমধ্যে তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল ওমান হয়ে আরবের বেশ কিছু অংশে। তিনি নিজ ক্ষমতা শক্তিশালী করে সামাজিক ও আইন সংস্কারে হাত দেন। সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। সাম্রাজ্য চার ভাগে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলের আলাদা আলাদা শাসক নিযুক্ত করা হয়, যারা সরাসরি খসরুর কাছে জবাবদিহি করত।
খসরু রোমের থেকে অনেক এলাকা ছিনিয়ে নেন, যার মধ্যে ছিল অ্যান্টিওখ, আর্মেনিয়া, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া এবং ককেশাসের অনেক এলাকা। সাসানিদ সীমানা পৌঁছে যায় ইয়েমেন পর্যন্ত। ৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর চতুর্থ হরমুযদ ক্ষমতায় বসলেও নিজের অদক্ষতা আর অহঙ্কারের কারণে অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন। তার সময় ৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্বদিকে তুর্কি আগ্রাসন হলে সাসানিদ জেনারেল ওয়াহরাম চুবিন (Wahram Chubin) তা প্রতিহত করতে সক্ষম হন। কিন্তু তার সাফল্য সম্রাটকে সন্দিহান করে তোলে এই ভেবে যে জেনারেল হয়তো সিংহাসন দখল করে নিতে পারেন। সম্রাটের সাথে বচসার জের ধরে জেনারেল ওয়াহরাম তাকে উৎখাত করতে ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে টেসিফোনের দিকে রওনা হন। তখন সাসানিদ অভিজাত আর পুরোহিতেরা একত্রিত হয়ে হরমুযদকে হত্যা করে তার সন্তানকে দ্বিতীয় খসরু হিসেবে অভিষিক্ত করেন।
দ্বিতীয় খসরু: দ্বিতীয় খসরু পড়লেন বিশাল বিপদে। তাড়াহুড়ো করে তাকে রাজা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওয়াহরামের সাথে লড়াই করার সামর্থ্য তো তার নেই। এদিকে জেনারেলও বদ্ধপরিকর। রাজা পরিবর্তন হয়েছে তো কি, সিংহাসন তার চাই-ই চাই। ফলে দ্বিতীয় খসরু পালিয়ে চলে যান পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে, সহায়তা চাইলেন সম্রাট মরিসের কাছে। রোমান সাহায্যে খসরু ওয়াহরামকে হটিয়ে দেন। ওয়াহরাম পালাতে সক্ষম হলেও তুর্কিদের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন। মনে করা হয়, এর পেছনে খসরুর উস্কানি ছিল। ক্ষমতা সংহত করতে তিনি পিতার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।
এরপর তিনি রাজ্যবিস্তারের দিকে মনোযোগ দিলেন। দিকে দিকে দূত পাঠিয়ে তিনি বিভিন্ন সাম্রাজ্যের খবর নিতে থাকলেন। তার পাঠানো দূত মক্কা শহরেও এসেছিল। খসরু হিরা নগরীর শেষ রাজা আল-মুন্দিরকে হত্যা করে সেখানে সাসানিদ প্রভুত্ব স্থাপন করেন। একই সময়ে রোমান সাম্রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। একে কাজে লাগিয়ে খসরু প্রথমে আর্মেনিয়া দখল করেন, এরপর তার সেনানায়ক শাহিন এবং শাহ্রওয়ারাজ ঝড়ের বেগে ৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়া অধিকার করে নেন।
৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম চলে যায় খসরুর নিয়ন্ত্রণে। বলা হয়, শহরে প্রবেশ করে সাসানিদ সেনারা ৩০,০০০-৩৫,০০০ এর মতো খ্রিষ্টান অধিবাসীকে হত্যা করে। জেরুজালেমে ছিল ‘ট্রু ক্রস’, যার উপরে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল বলে খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করত। খসরু এর সন্ধান পেলে তার নির্দেশে এই ট্রু ক্রস নিয়ে যাওয়া হলো সাসানিদ রাজধানী টেসিফোনে। এর ফলে খ্রিষ্টানদের মধ্যে তুমুল চাঞ্চল্য দেখা দেয়। খসরুর এই কাণ্ডকে কাজে লাগিয়ে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস পরে নিজের সেনাদলকে সংগঠিত করতে সক্ষম হন এবং সাসানিদদের বিরুদ্ধে সফল আঘাত হানেন।
৬১৯ সালের মধ্যে বর্তমান প্যালেস্টাইন আর ইজিপ্টে সাসানিদ ঝাণ্ডা উত্তোলিত হয়, তাদের সেনা পৌঁছে যায় লিবিয়া পর্যন্ত। ৬১৯-৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ভেতরে আনাতোলিয়া/ এশিয়া মাইনরের বহু এলাকা চলে যায় সাসানিদদের হাতে। দ্বিতীয় খসরুর অসামান্য সাফল্য রোমানদের হতচকিত করে দেয়। তাদের নেতা তখন হেরাক্লিয়াস, যিনি ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা নিয়েছিলেন। খসরুর সামনে রোমানদের অসহায় অবস্থা দেখে একসময় তিনি নাকি সাসানিদদের কাছে সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা সমর্পণের কথাও ভেবেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তা করেননি এবং ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাশার ছক উল্টে যায়। রোমানদের হাতে মার খেতে খেতে সাসানিদদদের পিঠ দেয়ালে থেকে যায়। অব্যাহত পরাজয়ে অতিষ্ঠ হয়ে সাসানিদ অভিজাত সম্প্রদায় ৬২৮ সালে খসরুকে মেরে ফেলে।
দ্বিতীয় খসরুর ধর্ম: জরথ্রুস্ত্রবাদে বিশ্বাসী হলেও দ্বিতীয় খসরু খ্রিষ্টধর্মের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন। তার অন্যতম স্ত্রী শিরিন রাজ্যে খ্রিষ্টীয় মতবাদ প্রচার করেছিলেন বলে অনেক খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক দাবি করেন। এছাড়া তিনি এক রোমান রাজকুমারি মরিয়ম/মেরির সাথেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় খসরুর সময়ে মোটামুটিভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় ছিল। জরথ্রুস্ত্রবাদের উপাসনাতে তিনি কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন। আহুরা মাজদাকে সর্বময় প্রভু মেনে নিলেও তিনি পার্সিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় আর্টাক্সেসের সময়কালের দেবতা মির এবং আনাহিদের উপাসনাও চালু করেন। ফলে রাষ্ট্রীয় পুরোহিতদের সাথে তার বিবাদ ছিল। খসরু প্রচণ্ড জাঁকজমকপ্রিয় ছিলেন এবং তার প্রাসাদ ও দরবারের চাকচিক্য ছিল খুব বিখ্যাত।
মদিনা থেকে চিঠি
দ্বিতীয় খসরুর সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মদিনা থেকে মহানবী (সা.)-এর পাঠানো চিঠি। বলা হয়, হিজরতের সপ্তম বর্ষে দিকে দিকে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রাথমিকভাবে ছয়টি চিঠি পাঠান ছয় জায়গার নৃপতির কাছে- রোম, পারস্য, ইথিওপিয়া, মিশর, বাহরাইন আর জর্ডান। জানা যায়, খসরু চিঠি পেয়ে ক্রোধে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি চিঠি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মুসলিম দূতকে প্রাসাদ থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। এরপর তিনি ইয়েমেনের সাসানিদ শাসনকর্তা বাজানকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে নির্দেশ দেন। তবে মুসলিম ঐতিহাসিক ইয়াকুবি (Ya’qubi ) দাবি করেছেন, খসরুর চিঠি ফেলে দেবার ঘটনা সত্য নয়। তিনি আসলে পুরো চিঠিই পড়েছিলেন এবং মহানবীর (সা.) কাছে উপহারস্বরূপ কিছু সুগন্ধি এবং রেশমি কাপড়ও প্রেরণ করেছিলেন। তবে আহমাদ বিন হানবাল বাদে আর কোনো মুসলিম ঐতিহাসিক এই মত সমর্থন করেন না।