বীরবলের গল্প শোনেননি বা বীরবলকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছোটকালে বাহারি মলাটের গল্পের বইয়ে বীরবলের বুদ্ধিদীপ্ত মজাদার কাহিনী পড়ে মনে মনে অনেক বুদ্ধিমান একজন মানুষ হয়ে ওঠার বাসনা হয়নি এমন শিশুও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলা শিশুতোষ সাহিত্যে অনেক পরিচিত এক নাম এই বীরবল। কিন্তু কতটা জানেন এই বীরবলের সম্পর্কে? আসুন যতটা পারি জেনে নিই ইতিহাসের এই স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে।
মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারে গুণী ব্যক্তিদের যে বিশাল সমারোহ ছিলো, এর মধ্যে নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বলা হতো ‘নবরত্ন’। এই নবরত্নের সবচেয়ে ‘উজ্জ্বল রত্নটি’ ছিলেন বীরবল। পাশাপাশি আকবরের উজির বা উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বীরবল তার বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার জন্যে আকবরের ভীষণ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাকে ও আকবরকে নিয়ে লোকমুখে তৈরি অনেক মজাদার গল্প আমাদের লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বীরবলের বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে লোকসাহিত্যের সাথে মিশে গেছে।
বীরবলের আসল নাম ছিলো মহেশ দাস ভট্ট। ১৫২৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কল্পি গ্রামের নিকট এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম। লোককথা অনুযায়ী, তার জন্ম যমুনা নদীর তীরবর্তী তিকাওয়ানপুর গ্রামে। তার বাবার নাম ছিলো গঙ্গা দাস আর মায়ের নাম ছিলো অনভা দেবী। অনেক আগে থেকেই তার পরিবারের কবিতা ও সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক ছিলো। হিন্দি, সংস্কৃত আর ফার্সীতে দক্ষ বীরবল কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া তিনি গদ্যও লিখতেন এবং ‘ব্রজবুলি’ নামক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মধ্য প্রদেশের রেওয়াতে রাজপুত রাজা রামচন্দ্রের রাজসভায় বীরবল রাজ সেবাকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দরিদ্র ছিলেন। এক ধনীর কন্যাকে বিয়ে করার পরে তার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। তবে সম্রাট আকবরের দরবারে সুনাম অর্জনে তার নিজস্ব মেধাই যথেষ্ট ছিলো।
আকবরের সাথে বীরবলের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৫৫৬ সালে। তাদের সাক্ষাৎ নিয়েও একটি কিংবদন্তী আছে। একবার নাকি আকবর এক শিকার অভিযানে গিয়ে বীরবলের সাথে প্রথম মুখোমুখি হন। তার কোনো এক বুদ্ধিদীপ্ত কাজে খুশি হয়ে সম্রাট তাকে একটি আংটি দিয়ে প্রাসাদে এসে দেখা করতে বলেন। বীরবল যখন প্রাসাদের প্রধান ফটকে উপস্থিত হন, তখন তার জীর্ণবস্ত্র দেখে প্রহরীরা তাকে বাধা দেয়। সম্রাটের আংটি দেখে তারা বুঝতে পারে যে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে কোনো পুরস্কারের দাবীদার। প্রাপ্ত পুরষ্কারের অর্ধেক তাদের দিতে হবে এই শর্তে প্রহরীরা তাকে ভেতরে যেতে দেয়।
দরবারে সম্রাট যখন বীরবলকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কী পুরষ্কার আশা করেন, তখন বীরবল নিজের জন্য একশোটি চাবুকের আঘাত চেয়ে বসেন। এই বিস্ময়কর আব্দারের কারণ জানতে চাইলে বীরবল পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তার উপস্থিত বুদ্ধিতে চমৎকৃত হয়ে আকবর তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীদের পঞ্চাশটি করে চাবুকের আঘাত করতে নির্দেশ দেন এবং বীরবলকে তার একজন উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেন। সম্রাট আকবরই তার নাম পরিবর্তন করে ‘বীরবল’ রাখেন এবং নামের আগে সম্মানসূচক ‘রাজা’ উপাধি যোগ করেন। তার ‘বীরবল’ নামটি এতো বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে সেটা তার আসল নামকে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। এমনকি তিনি নিজেও তার অনেক কবিতায় ‘বীরবল’ নামটি ব্যবহার করেছেন।
সম্রাট আকবরের অভ্যেস ছিলো তার গুণী সভাসদদের হিন্দু রীতি-নীতি, ইতিহাস ও পুরাণ অনুযায়ী বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা। মনে করা হয়, ‘বীরবল’ নামটি আকবর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ থেকে গ্রহণ করেন। এই বইয়ের একটি গল্পে ‘বীরবর’ নামক এক প্রভুভক্ত রাজকর্মচারীর নাম থেকে বীরবল নামের উৎপত্তি। সংস্কৃত উচ্চারণরীতি অনুযায়ী শব্দে পরপর দু’টি ‘র’ ধ্বনি থাকলে পরেরটি ‘ল’ হয়ে যায়।
১৫৫৬ সালে আকবরের রাজসভায় অন্তর্ভুক্ত হবার পর প্রায় ৩০ বছর ধরে বীরবল একনিষ্ঠভাবে তার বিশ্বস্ততা পালন করে যান। নিজ বিজ্ঞতা, রসবোধ ও বুদ্ধির জোরে খুব কম সময়ে তিনি রাজসভায় অনেক উচ্চপদ লাভ করেন, যে কারণে রাজসভার অনেকেরই ঈর্ষার পাত্র ছিলেন তিনি। বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে সম্রাট আকবরকে সঙ্গ দেন বীরবল, যা থেকে বুঝা যায়, শুধু কলম চালনায় নয়, তলোয়ার চালনাতেও তিনি যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন।
সম্রাট আকবরের সাথে বীরবলের অনেক মজার ঘটনা আছে। প্রায়ই সম্রাট তাকে অদ্ভুতুড়ে সব বুদ্ধিবৃত্তিক বা দর্শনসম্বন্ধীয় প্রশ্ন ধরে বসতেন, আর বীরবল সবসময়ই কোনো না কোনো উচিত জবাব নিয়ে তৈরি থাকতেন। এদের মধ্যে অনেক কাহিনীই আমরা শিশুতোষ বইগুলোতে পেয়ে থাকি। যেমন একটি কাহিনীতে আছে- একবার সম্রাট আকবর আর বীরবল বাগানে হাঁটছিলেন। এমন সময় হঠাৎ আকবর জিজ্ঞেস করে বসলেন, “বলতো বীরবল, আমার রাজ্যে কতগুলো কাক আছে?” বীরবল সাথে সাথে জবাব দিলেন, “পচানব্বই হাজার চারশ তেষট্টিটি।” সম্রাট বললেন, “যদি এর বেশি থাকে?” “তাহলে অন্য রাজ্য থেকে কিছু কাক এই রাজ্যে বেড়াতে এসেছে।” “আর যদি কম থাকে?” এবার বীরবল বললেন, “সহজ ব্যাপার, এই রাজ্য থেকে কিছু কাক বাইরে বেড়াতে গেছে।” এমন সব মজাদার রসাত্মক কাহিনীতে ভরা বীরবলের কিংবদন্তী। তবে এসব কাহিনীর মধ্যে কোনটি সত্য আর কোনটি লোকমুখে বানানো তা নির্ণয় করা মুশকিল। সত্যাসত্য যাচাইয়ে না গিয়ে কাহিনীর অন্তর্নিহিত শিক্ষাগুলো গ্রহণ করলেই বরং পাঠককুল উপকৃত হবেন।
বীরবল সম্রাট আকবরের অতিশয় স্নেহভাজন ছিলেন। কলকাতার ভিক্টোরিয়া হলে রাখা একটি চিত্রে দেখা যায় আকবরে একেবারে ডানপাশের আসনটিতে বসে আছেন বীরবল। ফতেহপুর সিক্রিতে নিজের আকবরের মহলের ভেতরের প্রাঙ্গনে তার ব্যাক্তিগত কক্ষের পাশেই বীরবলকে একটি দোতলা বাসস্থান দেয়া হয়। বীরবল ‘ব্রহ্মকবি’ নাম নিয়ে আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্যচর্চা করতেন। তার রচনাবলি রাজস্থানের ভারতপুর মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
আকবরের সাথে বীরবলের অতিরিক্ত বন্ধুবাৎসল্য ও সুসম্পর্কের জন্যে রাজসভার কতিপয় গোঁড়া মুসলিম সভাসদ বীরবলের উপর চটে ছিলেন। এমনই এক সভাসদ ছিলেন জৈন খান। রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধু নদের তীরবর্তী এলাকায় ইউসুফজাই ও মান্দার আফগান উপজাতিদের লাগাতার আক্রমণ ঠেকাতে আকবর জৈন খানকে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে জৈন খানের অবস্থা সঙিন হয়ে পড়লে তার সাহায্যের জন্যে আকবর একে একে শেখ ফরিদ, শেখ ফৈজি ও শের খাজা ফতেউল্লাহকে পাঠান। এরাও ব্যর্থ হলে সর্বশেষ আকবর বীরবলকে পাঠান। বীরবলের উপর অনেকদিনের জমানো ক্রোধের বদলা নিতে জৈন খান তাকে ভুলপথে চালিত করেন।
বর্তমান পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় এক সংকীর্ণ গিরিপথে প্রবেশ করলে শত্রুসেনা দু’পাশের পাহাড় থেকে বীরবলের বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই সংঘাতেই বীরবলের মৃত্যু হয়। তারিখটি ছিলো ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৫৮৩। প্রায় ৮০০০ সৈন্য মারা যায় এই আক্রমণে। এটাই ছিলো আকবরের সবচেয়ে বড় সামরিক ক্ষতি। বীরবলের ছিন্নভিন্ন দেহটিও আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বীরবলের করুণ মৃত্যুতে আকবর নিদারুণ কষ্ট পান। জীবদ্দশায় আকবর দুইবার বীরবলের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। একবার ‘চৌগান’ (আধুনিক পোলো) খেলার সময় বীরবল ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর আকবর নিজে তার শূশ্রুষা করে সারিয়ে তোলেন, আরেকবার শিকারের সময় এক হাতি বীরবলকে আক্রমণ করতে এলে আকবর নিজে ঘোড়া চালিয়ে হাতি আর বীরবলের মাঝে উপস্থিত হয়ে হাতিকে পিছু হটতে বাধ্য করেন। সৎকারের জন্যে সেই বীরবলের দেহটিও পাওয়া যায়নি বলে আকবর প্রচন্ড মনোক্ষূণ্ণ হন। শোকে বিহবল হয়ে তিনি টানা দু’দিন অন্ন-পানি স্পর্শ করেননি এবং রাজসভায় যোগদান ও করেননি। সমগ্র জীবনে মাত্র ৫ বার আকবর সভায় যোগ দেননি। এর মধ্যে বীরবলের মৃত্যুপরবর্তী সময়টিও একটি।
বীরবল আজীবন নিগুঢ় বিশ্বস্ততার সাথে সম্রাট আকবরকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। হিন্দুধর্ম ও ইসলাম এক করে আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত দীন-ই-ইলাহী ধর্মের যে কয়েকজন অনুসারী ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ও একমাত্র হিন্দু অনুসারী ছিলেন বীরবল। আকবরের মতো একজন দৃঢ়প্রাণ শাসকের জন্য বীরবলের মতো একজন সুনিপুণ কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন উপদেষ্টার দরকার ছিলো। নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক কাহিনী আর রসাত্মক লোককথায় যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন বীরবল।