‘আয়না’- আমাদের সবসময়ের বিস্ময়ের বস্তু,অলৌকিক কোনো কৌশলে আমাদেরই মুখচ্ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমরা বিস্মিত হই। না, এটি অবশ্য অলৌকিক ঘটনা নয়, যার ব্যাখা আমরা বিজ্ঞানের কাছ থেকে জেনেছি।
কিভাবে এলো আয়না!
আজকের এই যুগে যে আয়নায় মুখ দেখে আমাদের দিনের শুরু, সেটির উৎপত্তির ইতিহাস কিন্তু অনেক প্রাচীন। সেই প্রায় ২০০ বছর আগের কথা- ‘জাস্টিস ভন লাইবিগ’ নামে একজন জার্মান রসায়নবিদ ১৮৩৫ সালে স্বচ্ছ কাঁচের এক পাশে টিন ও পারদের এক ধরণের প্রলেপ দেওয়ার একটি কৌশল আবিস্কার করেন। এই কৌশলটিই ছিল আয়না আবিষ্কারের মূল বিষয়। পরবর্তীতে আরও বড় পরিসরে এবং বাণিজ্যিকভাবে আয়না উৎপাদনের জন্য এই পদ্ধতিটিকে অবলম্বন করা হয়। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে আজকের আধুনিক আয়নার রূপ আমরা দেখতে পাই।
তবে ১৮৩৫ এর সময়কালকে আধুনিক আয়নার জন্মলগ্ন বলা হলেও গবেষকরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছেন যে, আয়না উৎপত্তির ইতিহাস নাকি আরও অনেক পুরোনো। প্রায় ৮০০০ বছর আগে বর্তমান তুরস্কে প্রাচীনতম আয়না তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং ইতিহাস বলে, সেই চেষ্টা সফলও হয়!
আয়নার আয়নাবাজি
অনেক পুরোনো ইতিহাস থেকে আয়না সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে যে পুরনো আয়নাটি সেটি পাওয়া যায় আনাতোলিয়ার ধ্বংসাবশেষ থেকে, এই জায়গাটি বর্তমান তুরস্কে। ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়ার পর চীন দেশেও আদি আয়নার উৎপত্তির চিহ্ন পাওয়া যায়।
যে আয়নায় আমরা এখন নিজেদের অবয়ব দেখতে পাই, উৎপত্তির শুরুতে সেই আয়নার আদল এমনটা ছিল না। স্বচ্ছ কাঁচের আয়নার ধারণা এসেছে আরও অনেক পরে। কাঁচের বদলে তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও রূপার চকচকে পৃষ্ঠদেশকেই আয়না হিসেবে ব্যবহারের চল ছিল। তবে এই ধাতুগুলো ভীষণ ভারী হওয়ায় আয়নার আকার হত ছোট এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আয়নাগুলি মুখ দেখার চেয়ে ‘লোক দেখাতেই’ বেশি জনপ্রিয় ছিল! এই ইতিহাস থেকে এটি খুব সহজেই অনুমেয় যে, তখনকার সময়ের ঐ দামী আয়নাগুলি সাধারণের নাগালের বাইরে থাকতো এবং শুধুমাত্র অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলিতেই শোভা পেত। আরও একটি তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, অভিজাত পরিবারগুলোতে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল এই আয়না, মানে আয়না বাড়িতে আছে কিনা সেটি দিয়েই আর্থিক অবস্থা অনুমান করা হত! তবে স্বচ্ছ কাঁচের বাণিজ্যিক ব্যাবহারের পর এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। ধীরে ধীরে আয়না সাধারণ জনগণের নাগালের ভেতর আসতে শুরু করে।
আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, এখন যে ধরণের আয়না আমরা দেখতে পাই, মধ্যযুগ থেকে এ ধরনের আয়নার চল শুরু হয় এবং রেনেসাঁস এর অল্প কিছু পরেই আয়না তৈরির কিছু কৌশলগত পরিবর্তন আসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনও এটি অসম্ভব দামী হওয়াতে অভিজাত ও অবস্থাসম্পন্ন পরিবার এবং কিছু শিল্পকর্ম তৈরির কাজেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল। যেহেতু আয়নায় নিজের অবয়ব একদম স্পষ্ট দেখা যেত, এ কারণে অনেক চিত্রশিল্পী নিজ চেহারা রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলতেন এই আয়নার সাহায্য নিয়ে।
আয়নাকে ঘিরে প্রাচীনকালের যত অভিশাপ এবং মজার কিছু তথ্য
আয়না চিরকালই মানুষকে কৌতূহলী করেছে, এজন্যই এই আয়না নিয়ে প্রচলিত আছে নান রূপকথা, অভিশাপ এবং কুসংস্কারের কাহিনী, আছে চমকপ্রদ কিছু কথাও। আসুন জেনে নেই এমনই কিছু তথ্যঃ
- প্রাচীন রোমে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, আপনি যদি বাড়ির পুরনো কোনো আয়না ভেঙ্গে ফেলেন তাহলে পরবর্তী অন্তত ৭ বছর পর্যন্ত আপনার দুর্ভাগ্য কাটবে না।
- রোমানরা এটাও বিশ্বাস করতো পুরনো কোনো আয়না ভেঙ্গে যাওয়া মানে আপনি আপনার ভেতরে থাকা পবিত্র আত্মাকেই নষ্ট করে ফেলেছেন।
- জিউস এর লোকজন বাড়িতে কারো মৃত্যু হলে সবসময় সেই বাড়িতে থাকা আয়নাগুলি ঢেকে রাখতো, তাদের বিশ্বাস ছিল মৃতদেহ থেকে পবিত্র আত্মাকে বন্দি করে রাখার ক্ষমতা আছে আয়নার। আর একবার যদি মৃত ব্যক্তির আত্মা আটকা পড়ে, তাহলে কিছুতেই সেটি আর পরলোকে যেতে পারবে না!
- আয়না আপনাকে নিয়ে যেতে পারে হ্যালুসিনেশনের দুনিয়ায়। একটা ছোট্ট পরীক্ষা করে দেখা যাক। একটা অন্ধকার ঘরে বড় আয়নার সামনে দাঁড়ান, তবে শুধুমাত্র হাতে একটা মোমবাতি এমনভাবে ধরে রাখুন যেন আপনার মুখের ওপর পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো পড়ে। এবার আয়না থেকে ১ মিটারের ব্যবধানে দাঁড়ান এবং একটানা অন্তত মিনিট দশেক নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকুন! নিজেকে ছাড়া আর কিছু কি দেখতে পেলেন?!
- আয়না শুধুমাত্র অবয়ব বা ছবি-ই নয়, শব্দও প্রতিফলিত করে। এই ধরণের আয়নাগুলিকে বলা হয় “অ্যাকুয়িস্টিক মিরর”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে এই আয়নাগুলি শত্রুপক্ষের বিমানের শব্দতরঙ্গ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হত।
- ফ্যান্টাসির খাতিরে অনেকেই ভেবে থাকেন আয়নার মধ্য দিয়ে “টাইম ট্র্যাভেল” করা সম্ভব!
- আয়নায় আমরা নিজেকে দেখে চিনতে পারবো- এটা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই না? কিন্তু কারো কারো কাছে এই সহজ জিনিসটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, মানে তারা আয়নায় নিজেকে দেখলে চিনতে পারে না! বাচ্চাদের কথাই ধরা যাক, ছোট বাচ্চারা তো তাদের ২৪ মাস বা ২ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত বুঝতেই পারে না আয়নায় কাকে দেখছে!
- এই ‘নিজেকে আয়নায় চিনতে পারা’র পরীক্ষাটি বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে চালিয়েছিলেন পশুপাখিদের ওপরও, যেখানে প্রথমবারেই পাশ করতে ব্যর্থ হয় গরিলা। তবে কেউ কেউ আবার উতরে গেছে পরীক্ষা দিয়ে, এদের মধ্যে আছে বেবুন, শিম্পাঞ্জী, কয়েক প্রকারের পাখি এবং ডলফিনেরা!
ঘর সাজাতে আয়না
আয়না এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, নিজের প্রিয় গৃহকোণ সাজিয়ে নিতে যার জুড়ি মেলা ভার।
কাজের পাশাপাশি আয়না আজকাল ব্যাবহৃত হচ্ছে ঘর সাজানোর চমৎকার একটা অনুষঙ্গ হিসেবেও। ছোট, বড়, মাঝারি, চারকোণা, গোল, আয়তাকার এমনকি ত্রিভুজাকৃতি- নানা রকমের আয়না দেখতে পাওয়া যায়। তবে এখনকার চলতি ট্রেন্ড-এ বড় আকারের আয়নার কদর সবথেকে বেশি। এসব আয়নার পাশের ফ্রেমটিতে কাঠের এবং ধাতুর বিভিন্ন ধরণের মনকাড়া নকশা লক্ষণীয়। আমাদের দেশীয় ফ্যাশন হাউস ‘আড়ং’ এ খুঁজলেই দেখা মিলবে গ্রাম বাংলার নানান মোটিফের ওপর করা আয়না- পুতুল, ফুল ও পাতা, পিঠাপুলি আরও কত কি! কিছু কিছু আয়না আছে যেগুলি দেখতে অনেকটা জানালার মতো, সামনের পাল্লার মতো অংশটা খুললেই চোখে পড়বে ভেতরে থাকা আয়নাটির। আজকাল ‘রিকশা পেইন্ট’ এর ডিজাইনের আয়নাও চোখে পড়ার মতো। একটু অন্যরকম দেখাতে অনেকেই এখন ঘরের সিলিং এ লাগিয়ে নিচ্ছে ছোট বা বড় আকারের আয়না।
এই বিভিন্ন ডিজাইনের আয়নাগুলি দিয়ে সাজিয়ে নিতে পারেন আপনার প্রিয় গৃহের কোণ। শোবার ঘর, বসার ঘর, কিংবা বাচ্চাদের ঘরে লাগিয়ে নিতে পারেন চমৎকার নকশার আয়না। একটি সুন্দর নকশা করা আয়না আপনার ঘরকে মুহূর্তেই অন্যদের কাছে করে তুলবে আকর্ষণীয়। ঘর সাজাতে ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের যে নিয়ম কানুন রয়েছে সেখানে দেখা যায়, ছোট্ট একটা ঘরকে বড় এবং খোলামেলা দেখাতে একটা চমৎকার আয়না-ই যথেষ্ট!
আয়নার দরদাম আসলে নির্ভর করে মান, আকার এবং নকশার ওপর। তবে কম বেশি ৪০০ টাকা থেকে শুরু হয় নকশা করা নানা ধরণের আয়নার দাম, যেটি সর্বোচ্চ ৭০০০ থেকে ১০০০০ টাকা অবধি পৌঁছুতে পারে। নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, গাউসিয়া, বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিঊচার পার্ক এর মতো জায়গাতে পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দসই মনের মতো একটা আয়না।