নবম-দশম শতকের স্পেনের আন্দালুসীয় সভ্যতাকে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম গৌরবোজ্জ্বল সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকাও যখন আবিষ্কৃত হয়নি, ইউরোপও যখন হানাহানিতে ব্যস্ত, তখন এই আন্দালুসে গড়ে উঠেছিল এমন একটি সভ্যতা, যা হয়ে উঠেছিল সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য এবং স্থাপত্যবিদ্যা চর্চার প্রাণকেন্দ্র। আন্দালুসের উদার সামাজিক পরিবেশ এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদেরকে তাদের মেধা ও মনন বিকশিত করার সুযোগ করে দিয়েছিল।
সামান্য দাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে রাজদরবারের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন উদারহণ আন্দালুসীয় সভ্যতার ইতিহাসে প্রচুর পাওয়া যায়। আর এ ধরনের দৃষ্টান্ত শুধু পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সংখ্যায় কম হলেও এমন অনেক নারীরও সন্ধান পাওয়া যায়, যারা সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘লুবনা অফ কর্দোবা’ ছিলেন এরকমই একজন নারী যিনি সামান্য দাসী থেকে হয়ে উঠেছিলেন আন্দালুসের রাজধানী কর্দোবার খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমান এবং পরবর্তীতে তার পুত্র, খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের সেক্রেটারি।
লুবনা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কিন্তু যেটুকু জানা যায়, সেটুকুই প্রায় অবিশ্বাস্য। আন্দালুসীয় ইতিহাসবিদ ইবনে বাশকাওয়ালের বর্ণনা অনুযায়ী, “লুবনা ছিলেন একইসাথে একজন বুদ্ধিমতী লেখক, ব্যাকরণবিদ, কবি এবং গণিতবিদ। তার জ্ঞান ছিল ব্যাপক, বিস্তৃত এবং রাজদরবারে তার মতো অভিজাত অন্য কেউ ছিল না।” অন্যান্য ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন একইসাথে একজন ক্যালিগ্রাফার এবং দক্ষ লিপিকার, যিনি পরবর্তীতে কর্দোবার প্রধান লাইব্রেরিয়ান হিসেবে এবং আরও পরে খলিফার সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
লুবনার জন্মসন বা জন্মস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানা যায় না। তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে, সে থেকে ধারণা করা যায় তার জন্ম হয়েছিল দশম শতকের শুরুর দিকে। তার জন্মস্থান নিয়েও মতভেদ আছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাকে উত্তর আফ্রিকার ফাতেমীয় সাম্রাজ্য থেকে আসা দাসী বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও অধিকাংশ ইতিহাসবিদই মনে করেন তিনি ছিলেন স্প্যানিশ দাসী। পরবর্তীতে কোনো এক সময় তিনি মুক্তিলাভ করেন, পড়াশোনার সুযোগ পান এবং কর্দোবার লাইব্রেরিতে অথবা খলিফার বই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে লিপিকারের চাকরি পান।
সে সময় কাগজের বই ছিল একটি নতুন প্রযুক্তি। অষ্টম শতকে মুসলমানরা চাইনিজদের কাছ থেকে কাগজ নির্মাণের পদ্ধতি শেখার পর দশম শতকের শুরুর দিকে তা আন্দালুসে এসে পৌঁছায়। এর পরপরই শুরু হয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বই অনুবাদ করে সেগুলোকে কাগজের বই হিসেবে সেখানকার লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করার বিশাল কর্মযজ্ঞ। লুবনা ছিলেন সেই প্রকল্পের একজন ক্ষুদ্র কর্মী। তিনি বইয়ের অনুলিপি তৈরি করার পাশাপাশি সেসব বই থেকে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন এবং একসময় নিজের যোগ্যতার বলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
সে সময়ের আন্দালুসীয় সমাজে নারীদেরকে পড়াশোনার কাজে উৎসাহিত করা হতো এবং তাদের যোগ্যতাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হতো। দ্বিতীয় আল-হাকামের শাসনামলে শুধুমাত্র পূর্ব কর্দোবাতেই ১২৭ জন নারী কুরআন শরিফের অনুলিপি তৈরির মতো সম্মানজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এদের অনেকেই ছিলেন দাসী, যাদের অনেককে পরবর্তীতে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় আল-হাকাম নিজেই এক উপলক্ষ্যে একসাথে ১০০ দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। লুবনা হয়তো ছিলেন এ ধরনেরই একজন দাসী, যিনি পরবর্তীতে মুক্তি পেয়েছিলেন।
সে সময় বইয়ের অনুলিপি তৈরির কাজ ছিল বেশ সম্মানের, যেখানে কেবল যোগ্য এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিরাই কাজ করার সুযোগ পেত। লিপিকারদেরকে ভালো পড়াশোনা জানতে হতো, আরবি ভাষার উপর তাদের বেশ ভালো জ্ঞান থাকতে হতো এবং তাদের হাতের লেখা হতে চমৎকার। ফলে দেখা যেত তাদের অনেকেই পরবর্তীতে নিজেরাই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। লুবনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চার সুযোগ পেয়ে তিনি পরবর্তীতে সাহিত্য, ব্যাকরণ, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।
সে সময় লিপিকারদের অনেকেরই কাজ শুধুমাত্র দেখে দেখে কপি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী ছিলেন, তারা নিজেরাও বিভিন্ন বইয়ের মূল বিষয়বস্তুর পাশাপাশি নিচে বা পাশে নিজেদের মন্তব্য বা ব্যাখ্যা যোগ করে দিতেন। লুবনা ছিলেন এ ধরনেরই একজন লিপিকার। তার দায়িত্বের মধ্যে ছিল ইউক্লিড এবং আর্কিমিডিসের লেখা বইয়ের অনুবাদ করা, কিংবা সেগুলোর অনুবাদের অনুলিপি তৈরি করা। সেখানেও তিনি শুধু অনুলিপি না করে নিজের মন্তব্য ফুটনোট আকারে জুড়ে দিয়েছিলেন।
একপর্যায়ে নিজের যোগ্যতার বলে লুবনা কর্দোবার রাজকীয় লাইব্রেরির প্রধান লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ পান। এটা সে সময়ের কথা, যখন কর্দোবার লাইব্রেরি ছিল বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে একটি। বাগদাদের বাইতুল হিকমা ছাড়া এর সংগ্রহের সাথে তুলনা করার মতো লাইব্রেরির সংখ্যা তখন কম ছিল। কর্দোবার লাইব্রেরিতে তখন বইয়ের সংখ্যা ছিল ৫ লাখেরও বেশি! অনেকে দাবি করেন, লুবনা শুধু লাইব্রেরিয়ানই ছিলেন না, তিনি একইসাথে লাইব্রেরির সংগ্রহ সমৃদ্ধ করার দায়িত্বেও ছিলেন। লাইব্রেরির জন্য বই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি কায়রো, দামেস্ক এবং বাগদাদে গিয়েছিলেন বলেও অনেক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন। অনেক সময় তিনি এসব জায়গায় একাই ভ্রমণ করতেন।
ভাষা এবং ব্যাকরণের পাশাপাশি লুবনা গণিতেও বেশ দক্ষ ছিলেন। তিনি গণিত এতোই ভালোবাসতেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি খেলাধুলায় মগ্ন ছেলেমেয়েদেরকে ডেকে তাদেরকে নামতা এবং গণিতের বিভিন্ন সূত্র শেখাতে শেখাতে হাঁটতেন। তারা তার সাথে সাথে নামতা আওড়াতে আওড়াতে তার পিছু পিছু হাঁটত, যতক্ষণ না তিনি প্রাসাদের দরজায় গিয়ে পৌঁছতেন। শিক্ষক হিসেবেও লুবনা নিশ্চয়ই অতুলনীয় ছিলেন, কারণ তার ছাত্রছাত্রীরা তাকে দেখলেই দৌড়ে আসত নতুন কিছু শেখার জন্য।
তবে লুবনার একইসাথে সর্বগুণে গুণান্বিত হওয়া নিয়ে কিছু কিছু গবেষক প্রশ্নও তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটিশ-পাকিস্তানি গবেষক এবং সাহিত্যিক কামিলা শামসি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যে সময়ের মধ্যে লুবনাকে একইসাথে লিপিকার, লাইব্রেরিয়ান, লাইব্রেরির বই সংগ্রাহক, খলিফার সেক্রেটারি দাবি করা হয়, তা আসলেই সম্ভব ছিল কি না। বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা পর্যালোচনা করে তিনি দাবি করেছেন, বাস্তবে সে সময় কর্দোবাতে দুইজন নারী ছিলেন। একজন লুবনা এবং অপরজন ফাতিমা।
তার গবেষণা অনুযায়ী, লুবনা ছিলেন সত্যি সত্যিই একজন গণিতবিদ, লিপিকার, কবি এবং হয়তো খলিফার সেক্রেটারি। অন্যদেকি ফাতিমা ছিলেন লাইব্রেরিয়ান, যিনি কায়রো, দামেস্ক এবং বাগদাদে গিয়ে বই সংগ্রহ করেছেন। শামসির এ দাবির যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। কারণ তিনি দেখিয়েছেন কোনো প্রাথমিক সূত্রেই লুবনাকে একইসাথে সব ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দাবি করা হয়নি। একেক ইতিহাসবিদ তার একেক ধরনের গুণ বর্ণনা করেছেন, যা পরবর্তীতে একত্রিত করে তার একটি চরিত্র দাঁড় করানো হয়েছে।
তবে শামসির দাবি সত্য হলে সেটা লুবনার অর্জনকে মোটেও খর্বিত করে না। বরং সেটা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়, মধ্যযুগের আন্দালুসে নারীরা যে তাদের যোগ্যতাবলে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, সেটা ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা ছিল না। একজন নারী রাজকীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা পেলে তাকে ব্যতিক্রম বলে এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু যখন একই সময়ে যখন একাধিক নারী সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের মধ্যে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তখন সেটা সেই সমাজের উদারতা এবং আধুনিকতাকেই নির্দেশ করে।