আবার ইউরোপের দিকে তাকানো যাক।
সপ্তদশ শতক থেকেই ইউরোপে প্রায় প্রতিনিয়তই চলছিল যুদ্ধ। ক্ষমতার খেলায় ইউরোপের পরাশক্তিগুলো বারে বারে এক অপরের সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছিল। সাম্রাজ্যের সীমারেখা পরিবর্তিত হচ্ছিল কিছুদিন পর পরই। প্রুশিয়ান রাজ্য তখনও তার শৈশবে, কিন্তু চারদিকের অস্থিরতা থেকে সে-ও মুক্ত নয়। বরঞ্চ বিভিন্ন সাম্রাজ্যের পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়া এবং পরে প্রুশিয়ার শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছেন। ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বড় রাষ্ট্রগুলোর সংঘাতে প্রুশিয়ার ভূমিকা ছিল।
এই চলমান হানাহানিই ছিল প্রুশিয়ার সাম্রাজ্য হয়ে ওঠার মূল চালিকাশক্তি। সুতরাং সেই বিবেচনায় প্রুশিয়ার কথা বয়ান করতে গেলে তৎকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাস চলে আসবেই। ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের সময়ের কিছু ঘটনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, যার পরিপূর্ণ প্রভাব আমরা দেখতে পাবো পরবর্তীতে তার সন্তান ফ্রিটজ সিংহাসনে আসীন হলে। এই ধারাতে ফ্রিটজের সিংহাসনে বসার আগে দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য, একটি হলো প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন, আরেকটি পোলিশ সাকসেশন ওয়ার। আমরা ধারাবাহিকভাবে এই দুটি ঘটনা তুলে আনার চেষ্টা করব।
হাবসবুর্গ উত্তরাধিকারী
স্প্যানিশ উত্তরাধিকার যুদ্ধে হলি রোমান এম্পেয়ার প্রথম লিওপোল্ডের ছেলে চার্লসকে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স স্পেনের সিংহাসনের জন্য মনোনীত করেছিল। তিনি ছিলেন হাবসবুর্গ বংশীয়। এই হাবসবুর্গরা ইতিহাসের অন্যতম ক্ষমতাশালী এক রাজপরিবার। ১৪৩৮ সাল থেকে বিলুপ্ত হওয়া অবধি হলি রোমান এম্পেরর হতেন এই পরিবার থেকেই। যদিও এম্পেররের পদ ছিল নির্বাচিত, বংশগত নয়, তথাপিও নানা কারিকুরি করে হাবসবুর্গরা একে তাদের আয়ত্বে রেখেছিল। এছাড়া আলাদা করে সুবিশাল এক সাম্রাজ্যও তাদের অধীনে ছিল, যার অন্তর্ভুক্ত অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস আর জার্মানির বোহেমিয়া (যে কারণে হলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্গত হলেও সেখানকার শাসনকর্তা নিজেকে রাজা দাবি করতে পারতেন)।
এদিকে ১৭০৫ সালে লিওপোল্ডের মৃত্যু হলে তার বড় ছেলে জোসেফ হলেন এম্পেরর। ১৭০৩ সালে তিনি ও ভাই চার্লস একমত হন- যদি তারা কেউই ছেলে সন্তান না রেখে মারা যান, তাহলে মেয়েরা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে জোসেফ বড় ভাই বলে তার মেয়েরা অগ্রাধিকার পাবে। তখন পর্যন্ত হাবসবুর্গ আইন ছিল কেবল ছেলে সন্তানই ক্ষমতার দাবিদার হতে পারবে। চার্লস আর জোসেফের ঐকমত্য হাবসবুর্গ মেয়েদেরও ক্ষমতার স্বাদ পাবার পথ করে দেয়। কিন্তু একে কাজে পরিণত করতে আইন সংশোধনের প্রয়োজন ছিল।
দুই মেয়ে রেখে জোসেফ মারা গেলেন ১৭১১ সালে। বড় মেয়ে মারিয়া জোসেফা, ছোটজন অ্যামেলিয়া। জোসেফা স্বামী তৃতীয় আগাস্টাসের সূত্রে পরে হন পোল্যান্ডের রানী। স্বামী অগাস্টাস পোল্যান্ডের রাজা ছাড়াও জার্মান স্যাক্সোনির অধিকর্তা ছিলেন। অ্যামেলিয়ার বিয়ে হয় বাভারিয়ার কর্তা চার্লস আলবার্টের সাথে। এই বিয়ের ফলে হাবসবুর্গ উত্তরাধিকারে ছোট করে হলেও বাভারিয়ার দাবি তৈরি হয়। এদিকে জোসেফের ভাই হিসেবে চার্লস একইসাথে হাবসবুর্গ আর হলি রোমান এম্পায়ারের সিংহাসনে বসেন। তার উপাধি হলো ষষ্ঠ চার্লস। তখনও তিনি নিঃসন্তান। জোসেফের সাথে চুক্তি অনুযায়ী চার্লসের ছেলে না হলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন মারিয়া জোসেফা।
এদিকে চার্লসের হাতে হাবসবুর্গ সাম্রাজ্য চলে গেলে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স আশঙ্কা করল যে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্পেনও তাকে দিয়ে দেয়া হলে তো বিপদ। চার্লসের সুবিশাল সাম্রাজ্য সকলের স্বার্থের জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে। দ্রুত ফ্রান্সের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু হলো এবং স্পেনে চতুর্দশ লুইয়ের নাতি ফিলিপের ক্ষমতা মেনে নেয়া হয়। ফলে ফ্রান্সের পাশাপাশি স্পেনেও বুর্বন বংশের ক্ষমতা জারি হলো। ক্ষতিপূরণ হিসেবে উট্রেখট চুক্তি মোতাবেক নেপলস, মিলান আর সিসিলি তুলে দেয়া হয় চার্লসের হাতে।
চার্লসের নতুন আইন
চার্লস চিন্তা করলেন, নিজ সাম্রাজ্য ভাইয়ের মেয়েদের হাতে ছেড়ে দেয়া কি ঠিক হবে? তিনি কেন নিজের পরিবারে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারবেন না? তিনিই তো রাজা, তার কথাই আইন। ফলে ১৭১৩ সালের ১৯ এপ্রিল জারি করা হলো রাজকীয় ডিক্রি, যা ইতিহাসে বিখ্যাত দ্য প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন (The Pragmatic Sanction) নামে। এখানে উল্লেখ করা ছিল, “ছেলে সন্তানের অনুপস্থিতিতে সিংহাসনের উত্তরাধিকার বর্তাবে বৈধ মেয়ে সন্তানের কাছে, যিনি নির্বাচিত হবেন জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে।”
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, সাম্রাজ্যের অখন্ডতা বজায় রাখতেই চার্লসের এই সিদ্ধান্ত। কারণ পূর্বে হাবসবুর্গদের প্রবল প্রতিপক্ষ অটোমান আর পশ্চিমে ফরাসিরা তাদের যেকোনো দুর্বলতার সুযোগ নিতে মুখিয়ে আছে। সিংহাসন নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলে নিশ্চিতভাবেই তারা হাবসবুর্গ এলাকা ছিনিয়ে নিতে চাইবে। চার্লসের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, এ কথা অনস্বীকার্য যে ইউরোপের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নে এই ডিক্রির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তবে চার্লস জানতেন এই ডিক্রি কাজে পরিণত করতে গেলে তার শুধু ইউরোপিয়ান রাজবর্গই নয়, অধীনস্থ রাজ্যগুলোরও সমর্থন দরকার।
মারিয়া থেরেসা
উল্লেখ্য, তখন অবধি চার্লস ছেলে সন্তানের আশা ছেড়ে দেননি। কাজেই তিনি খুব জোরদারভাবে ডিক্রির সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন না, কেবল একটি সিদ্ধান্ত হিসেবে একে ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৭১৬ সালে স্ত্রী ক্রিস্টিনার গর্ভে ছেলে এক সন্তান জন্মালে চার্লস ভাবলেন উত্তরাধিকারের ফাঁড়া বোধহয় কাটল। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই শিশু রাজপুত্রের মৃত্যু হয়। এরপর ১৭১৭ সালে কন্যা মারিয়া থেরেসা আর ১৭১৮ সালে মারিয়া অ্যানার জন্ম হয়। চার্লস উঠে-পড়ে লাগেন মারিয়া থেরেসার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে। এক্ষেত্রে তার মূল লক্ষ্য ছিল হাবসবুর্গ অধিপতি হিসেবে, যা বংশানুক্রমিক, মারিয়া থেরেসার অভিষেক। ১৭২০ সালে চার্লসের প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের সংবিধানভুক্ত হলো। কিন্তু রোমান এম্পায়ারের আইন ছিল আলাদা, যা চার্লসের একার পক্ষে পরিবর্তন অসম্ভব। হলি রোমান এম্পায়ারের প্রধান নিযুক্ত হতেন নির্বাচনের মাধ্যমে, এবং কোনো নারী সেই পদ অধিকার করতে পারতেন না।
চার্লস আর তার প্রধান পরামর্শদাতা বার্টেনস্টেইন (Johann Christoph von Bartenstein) প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন কাজে পরিণত করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান দশ বছর ধরে। এ সময় মারিয়া থেরেসার বিয়ের ব্যাপার সামনে চলে আসে, কারণ তিনি সম্রাজ্ঞী হলে তার স্বামী রাজ্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। নানা দিক বিবেচনা করে চার্লস ডাচি অফ লরেইনের ডিউক লিওপোল্ডের পুত্র স্টেফানকে মেয়ের হবু জামাতা নির্বাচন করেন। লিওপোল্ড ছিলেন চার্লসের অতীব বিশ্বস্ত, অন্যদিকে মারিয়া থেরেসা এবং স্টেফান ছোটবেলা থেকেই পরিচিত এবং একে অপরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
কূটনৈতিক দর কষাকষি
চার্লসের পরিকল্পনায় তার নিজের লোকদের অনেকেরই মত ছিল না। তার অন্যতম উপদেষ্টা, স্যাভয়ের ইউজিন তাকে অনুরোধ করলেন বাভারিয়ার শাসকের ছেলের সাথে মারিয়া থেরেসার বিয়ে দিতে। কিন্তু চার্লস ব্যক্তিগতভাবে বাভারিয়ার শাসক আলবার্টকে অপছন্দ করতেন, তাই তিনি এই সম্বন্ধে আগ্রহী ছিলেন না। স্পেন থেকে তাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তৃতীয় চার্লসের সাথে মারিয়া থেরেসার বিয়ের প্রস্তাব ছিল সেই তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয়, এবং এই বিয়ে হলে সম্ভবত ইউরোপের ইতিহাস পাল্টে যেত। তবে মারিয়া থেরেসাকে আশ্বস্ত করে চার্লস এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।
স্টেফানের সাথে থেরেসার বিয়ে ঠিক হওয়ায় ফরাসিরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কারণ ডাচি অফ লরেইন ছিল তাদের সীমান্তবর্তী এবং ফরাসি সম্রাট একে কুক্ষিগত করতে চাচ্ছিলেন। মারিয়া থেরেসার সাথে স্টেফানের বিয়ে চিরশত্রু হাবসবুর্গদের ঘরের দোরগোড়ায় নিয়ে আসবে- এটা মেনে নেয়া যায় না। কাজেই ১৭৩২ সালে ফ্রান্স এবং স্পেনের বুর্বন’রা চুক্তি করল- যদি বিয়ে হয়েই যায় তাহলে তারা লরেইন দখল করে নেবে।
মারিয়া থেরেসার সাথে স্টেফানের বিয়ে হয়ে যায় ১৭৩৬ সালে। এদিকে এই সময় চলছিল পোলিশ সিংহাসনের লড়াই (পোলিশ সাকসেশন ওয়ার্স), যার সমাপ্তিতে চার্লসকে ঠিকই লরেইনসহ আরো কিছু অঞ্চল বিসর্জন দিতে হয়। বিনিময়ে ফরাসিরা মারিয়া থেরেসাকে বিরক্ত না করার অঙ্গীকার করে। থেরেসার সিংহাসনে আরোহণ বৈধ করতে ফরাসিদের ছাড়াও চার্লসকে আরো ছাড় দিতে হয়। ইংল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডস নৌ-বাণিজ্যের জন্য গঠন করেছিল যথাক্রমে ইংলিশ এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের সমর্থনের বিনিময়ে চার্লসকে অস্ট্রিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী অস্টেন্ড (Ostend) কোম্পানিকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে নিতে হয়।
১৭৩১ সালের ১৬ মার্চ এই বিষয়ে ইংল্যান্ডের সাথে সম্পাদিত হয় সেকেন্ড ট্রিটি অফ ভিয়েনা, যেখানে ডাচরাও একটি পক্ষ হিসেবে যুক্ত ছিল। চুক্তির ধারা অনুযায়ী পারমা আর টাস্কানির উপর অস্ট্রিয়ান দাবি প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলগুলোকে ১৭২০ সালের ট্রিটি অফ হেগ মোতাবেক স্পেনের হাওলা করে দেয়া হলো। এই চুক্তির ফলে উট্রেখট চুক্তির পর থেকে স্পেন ও রাশিয়াকে ঠেকাতে ফরাসি-ইংলিশ যে জোট গড়ে উঠেছিল তার অবসান হয়।
অন্যদিকে প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন ঘোষণার পর থেকেই হাঙ্গেরি দোনোমনা করছিল। তারা আইনের দোহাই দিয়ে বলতে থাকে হাঙ্গেরিয়ানরা কেবল কোনো পুরুষ হাবসবুর্গকে নিজেদের রাজা স্বীকারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, চার্লসের কোনো ছেলে না হলে তাই তারা নিজেরাই নিজেদের রাজা নির্বাচন করেবে।
চার্লস কঠোর হলেন। হাঙ্গেরিয়ান সংসদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বহুলাংশে কমিয়ে দেয়া হলো। চাপে পড়ে হাঙ্গেরিয়ানরা চার্লসের উত্তরাধিকারী হিসেবে মারিয়া থেরেসাকে বৈধতা দিয়ে আইন পাশ করে। জার্মান রাষ্ট্রগুলোও গররাজি হয়। প্রুশিয়াও ব্যতিক্রম ছিল না। সিংহাসনে একজন নারীকে মেনে নিতে ইতস্ততভাব থাকলেও চার্লসের ক্ষমতার কাছে সেই মুহূর্তে নতি স্বীকার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
চার্লসের মৃত্যু এবং নতুন সংঘাত
দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারিয়া থেরেসার অভিষেক ছিল কণ্টকাকীর্ণ। ১৭৪০ সালের অক্টোবর মাসে চার্লস মারা গেলে অনেক রাজাই প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ফ্রান্স এবং প্রুশিয়ার মদদে বাভারিয়া থেকে চার্লস আলবার্ট স্ত্রীর সূত্র ধরে মারিয়া থেরেসার কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেন। ফলে শুরু হয় অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকারের সংঘাত। প্রুশিয়া এই খেলাতে ছিল অন্যতম খেলোয়াড়, এবং বিশ্বমঞ্চে শক্তিশালী রাজা হিসেবে ফ্রিটজের আগমনী বার্তা ঘোষিত হয় এখান থেকেই, ইতিহাসে যিনি ভিন্ন এক নামে বিখ্যাত হয়ে আছেন।