একে একে চলতে থাকে ক্ষমতা দখলের খেলা, বাস্তব জগতের ‘গেম অফ থ্রোন্স’। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিহত হন রাজা চতুর্থ কানুটে ও দ্বিতীয় উইলিয়াম। শত্রুর হাতে নিহত হয়েছিলেন রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টও। তবে তার মৃত্যুর কাহিনী অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। আজকের আয়োজনে আমরা জানবো দুর্ভাগা এই তিন রাজাকে নিয়েই।
চতুর্থ কানুটে
গত লেখা আমরা শেষ করেছিলাম নাইটদের হাতে চার্লস দ্য গুডের মতো একজন দয়াশীল কাউন্টের নিহত হবার কাহিনী দিয়ে। অবশ্য চার্লসকে নিয়ে লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম যে, মাত্র দুই বছর বয়সে তিনি এতিম হন। এখনের গুপ্তহত্যার কাহিনীটি তাই তার বাবাকে নিয়েই।
১০৮০ থেকে ১০৮৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ডেনমার্কের সিংহাসনে থাকা রাজা কানুটে ‘পবিত্র কানুটে’ ও ‘সাধু কানুটে’ ডাকনামে পরিচিত ছিলেন। ড্যানিশ রাজপরিবারকে শক্তিশালী করার দিকে বেশ মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি, একনিষ্ঠভাবে সমর্থন করতেন রোমান ক্যাথলিক চার্চকে। জনগণের কাছে ধার্মিক হিসেবে পরিচিত এ রাজা পৌত্তলিকতার বিরোধীতা করেছেন সবসময়ই, দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গীর্জার ক্ষমতা।
সমগ্র দেশজুড়ে এত প্রশংসিত কানুটের মৃত্যু কিন্তু হয়েছিলো তার স্বদেশী প্রজাদের হাতেই। ইতিহাসের সেই গল্পই শোনাচ্ছি এখন।
চার্চের প্রতি নিজের ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে কানুটে আইন করেন যে, পাদ্রীদের ভরণপোষণের জন্য স্থানীয় কৃষকদেরকে তাদের উৎপাদিত ফসলের এক-দশমাংশ চার্চে দিয়ে দিতে হবে। ভালোবাসার পাত্র রাজা কানুটের এমন সিদ্ধান্ত ক্ষেপিয়ে তোলে দেশটির কৃষক সম্প্রদায়কে।
আবার কানুটের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন ‘কানুটে দ্য গ্রেট’, যিনি ১০১৬ থেকে ১০৩৫ সাল পর্যন্ত ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন। রাজা চতুর্থ কানুটে তাই ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা প্রথম উইলিয়ামের পরিবর্তে নিজেকেই ভাবতেন ইংল্যান্ডের রাজমুকুটের যোগ্য উত্তরাধিকারী।
১০৮৫ সালে তাই কানুটে ইংল্যান্ডে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৌবহর প্রস্তুতের নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই নৌবহর আর যাত্রা করতে পারে নি। ওদিকে কানুটের নাবিকদের বেশিরভাগই ছিলো পেশায় কৃষক। তাদের ফসল কাটার দিন ততদিনে ঘনিয়ে এসেছিলো। এভাবে দীর্ঘদিন অনিশ্চিতভাবে যুদ্ধযাত্রার আশায় বসে থাকতে থাকতে তারাও অধৈর্য হয়ে যায়। তাই তাদের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তারা কানুটের ভাই ওলাফকে তার কাছে পাঠান। কিন্তু কৃষকদের পক্ষ নিয়ে ওলাফের এমন ওকালতি সন্দেহ জাগিয়ে তোলে কানুটের মনে। তাই তাকে গ্রেফতার করেন তিনি।
এসব কারণে ১০৮৬ সালের শুরুর দিকে রাজা কানুটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে কৃষক জনতা। ওডেন্সে এক চার্চে তাকে ঘিরে ফেলে বিদ্রোহীরা। সেখানে প্রার্থনারত অবস্থায়ই জানালা দিয়ে ছোড়া একটি বর্শা এসে বিদ্ধ হয় কানুটের শরীরে। পরবর্তীতে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে বিদ্রোহীদের দলটি। একঝাঁক তীরের আঘাতে মুহূর্তের মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এককালে সকলের প্রিয় এই রাজা।
দ্বিতীয় উইলিয়াম
১০৮৭ সালে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন রাজা দ্বিতীয় উইলিয়াম। নরম্যান্ডি ও স্কটল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার ক্ষমতা। মুখে কিছুটা রক্তিম আভার উপস্থিতির জন্য ‘উইলিয়াম দ্য রেড’ নামে পরিচিত এ রাজার মৃত্যু ঘটেছিলো বেশ অদ্ভুতভাবে। যার ফলে এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মনে হরেক রকম প্রশ্ন ও উত্তর আজও ঘুরে বেড়ায়।
১১০০ সালের দোসরা আগস্টের কথা। সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নিউ ফরেস্টে শিকারে গিয়েছিলেন রাজা। দুপুরে ভরপেট আহারের পর সামান্য বিশ্রাম নিয়েই রাজা সেদিন বেরিয়ে পড়েছিলেন শিকারের উদ্দেশ্যে। অবশ্য অন্যান্যরা তখন আরাম-আয়েশে ব্যস্ত থাকায় অল্প ক’জন লোক নিয়েই গিয়েছিলেন রাজা, যাদের মাঝে উইলিয়াম টাইরেল নামে এক ব্যক্তিও ছিলেন।
কিছুক্ষণের মাঝেই শিকার নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলো। তাই আলাদা হয়ে গেলো দলের সবাই। রাজার সাথে থেকে গেলেন শুধু টাইরেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে গোধূলীলগ্ন নেমে এসেছে তখন প্রকৃতির বুকে। এমন সময়েই কোথা যেন একটি হরিণ ছুটে আসলো তাদের সামনে। হরিণটিকে দেখে নিজের তীর-ধনুক প্রস্তুত করে নিলেন টাইরেল। তারপর একসময় তার হাত থেকে ছুটে গেলো সেই তীরটি। কিন্তু হরিণটির ভাগ্য ভালোই ছিলো বলতে হবে। কারণ টাইরেলের ছোড়া তীরের আঘাতে সামান্যই আহত হয়েছিলো প্রাণিটি।
এরপরেই ঘটে যায় দুঃখজনক ঘটনা। আহত হরিণটিকে ধরতে ছুটে যান রাজা উইলিয়াম। ওদিকে হরিণটির প্রাণবায়ু একেবারে বের করে দিতে আরেকটি তীর ছোঁড়েন উইলিয়াম টাইরেল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ তীরটি গিয়ে বিঁধে যায় হরিণের কাছে থাকা রাজার ঠিক বুকে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাজা। এ ঘটনার পর টাইরেলও আর সেখানে অবস্থান করেন নি। সাথে সাথেই নিজের ঘোড়ায় চেপে দ্রুতবেগে ফ্রান্সের দিকে পালিয়ে যান তিনি।
এখানেই ঐতিহাসিকদের মাঝে বাঁধে সবচেয়ে বড় বিতর্ক। রাজা দ্বিতীয় উইলিয়ামের এমন আকস্মিক মৃত্যু কি কোনো পরিকল্পিত হত্যাকান্ড নাকি কেবলই এক দুর্ঘটনা?
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে- উইলিয়ামের মতো ধূর্ত একজন রাজার জন্য এটাই ছিলো স্রষ্টা প্রদত্ত শাস্তি। কেউ কেউ বলেন যে, হয়তো উইলিয়ামের কোনো শত্রুই নিয়োগ দিয়েছিলো টাইরেলকে। কারণ তখনকার দিনে একজন দক্ষ তীরন্দাজ হিসেবে বেশ সুনাম ছিলো টাইরেলের। ওদিকে উইলিয়ামের পরে সিংহাসনে বসেন তার ভাই হেনরি। সন্দেহের আঙুল তার দিকেও তুলেছিলেন কেউ কেউ। তবে তৎকালীন সমাজে ভ্রাতৃহত্যাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হতো, যা কিনা একজন রাজা হিসেবে হেনরির গ্রহণযোগ্যতাকে করে তুলতো প্রশ্নবিদ্ধ। তাই তার বিরুদ্ধে জমে ওঠা সন্দেহের দানাও ততটা মজবুত না। ফলে আধুনিক কালের ইতিহাসবিদদের মতে রাজা দ্বিতীয় উইলিয়ামের এমন মৃত্যু দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট
১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন রাজা প্রথম রিচার্ড। যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ নেতৃত্ব ও অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য পরবর্তীকালে তিনি ‘রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট’ নামেই সকলের কাছে পরিচিত হন। সিংহ-হৃদয়ের এ রাজার মৃত্যুকালীন ঘটনা আমাদের সকলের জন্যই বেশ শিক্ষণীয়।
১১৯৯ সালের ২৫ মার্চ বিকেলের কথা। নিজের সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ শাত্যু দ্য শালুস-ক্যাব্রল দুর্গের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন রিচার্ড। তার লোকেরা দুর্গের দেয়ালে কতটা ভাঙন ধরাতে পেরেছে সেটাই দেখছিলেন রাজা। তবে সেই সময় গায়ে বর্ম জড়িয়ে রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন নি তিনি। দুর্গ থেকে প্রতিপক্ষ দল একটু পরপরই তীর নিক্ষেপ করছিলো। তবে সেটাকে খুব একটা পাত্তা দিলেন না রাজা।
প্রতিপক্ষের একজন তীরন্দাজকে দেখে খুব মজা পেলেন রিচার্ড। দুর্গের দেয়ালে দাঁড়ানো সেই লোকটির এক হাতে ধরা ছিলো একটি ক্রসবো (Crossbow)। আর অন্য হাতে ধরা ছিলো একটি ফ্রাই প্যান যা দিয়ে তার দিকে ছুটে আসা তীরগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলেছিলো সে। একসময় সেই লোকটি রাজার দিকে তীরের নিশানা করলে আরো মজা পান তিনি। হাততালি দিয়ে তার সাহসের প্রশংসাও করেন রিচার্ড। এখানেই ছিলো তার মস্ত বড় ভুল। কারণ ফ্রাই প্যান আর ক্রসবো হাতে ধরা প্রতিপক্ষের সাথে মজা করতে গিয়ে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, তার দিকে অন্য শত্রুরাও আক্রমণ করে বসতে পারে। আর হলোও ঠিক তাই। হঠাৎ করে আরেকদিক থেকে একটি তীর এসে বিঁধলো সোজা তার বাম কাঁধে, গলার খুব কাছাকাছি জায়গায়।
আহত রাজা দ্রুত ফিরে গেলেন তার তাঁবুতে। নিজেই চেষ্টা করলেন তীরটি তুলে ফেলার। কিন্তু সেটি এতটাই গভীরভাবে বিঁধেছিলো যে, রিচার্ড ব্যর্থ হলেন। পরে ডাক পড়লো তার চিকিৎসকের। সেই চিকিৎসক খুব কষ্ট করে তীরটি বের করতে পারলেও রাজার বাম হাত এতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে রিচার্ডের। মজা নিতে গিয়ে এমন দুরবস্থার শিকার হলেন তিনি। তীরটি তুলে ফেললেও আঘাতের জায়গায় ইনফেকশন হয়ে একসময় গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়।
একসময় রিচার্ড বুঝতে পারেন যে, তার অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই তিনি তার দিকে তীর ছুঁড়ে মারা লোকটিকে যেভাবেই হোক তার সামনে উপস্থিত করার নির্দেশ দেন। একসময় রাজার লোকেরা তাকে এনে হাজিরও করে। আশ্চর্য হয়ে রিচার্ড লক্ষ্য করেন যে, তাকে তীর ছুঁড়েছিলো একটি কিশোর! ছেলেটির বাবা এবং দুই ভাইকে হত্যা করেছিলেন রাজা রিচার্ড। এর বদলা নিতেই সে খুন করতে চেয়েছিলো রিচার্ডকে। নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলো সে। তবে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে আর কোনো প্রতিশোধের নিশানা উড়াতে চাইলেন না রিচার্ড। তাই ছেলেটিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে দেন তিনি। শুধু তাই না, সেই সাথে ১০০ শিলিংও দেয়া হয় রাজার পক্ষ থেকে।
অবশেষে ৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট।
এ সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব
২) ক্ষমতার লড়াইয়ে নিহত নিষ্পাপ শিশু দিমিত্রি ও অন্যান্য
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Richard_I_of_England
২) en.wikipedia.org/wiki/Canute_IV_of_Denmark
৩) en.wikipedia.org/wiki/William_II_of_England