পাঠক, জোডিয়াক কিলারের ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত হত্যার ইতিহাস, তখনকার বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে পাঠানো তার চিঠি, সাংকেতিক ভাষায় লেখা ধাঁধা, সেই ধাঁধার অর্থ- এসব নিয়ে পূর্বের একটি লেখায় আপনারা জেনেছেন। যারা সেই লেখাটি পড়েননি তারা “জোডিয়াক কিলার: ফ্ল্যাশ লাইট হাতে ভয়ঙ্কর এক সিরিয়াল কিলার” আর্টিকেলটি পড়ে নিবেন, তাহলে আজকের রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়তে বেশ সুবিধা হবে।
আজকের রক্তহিম করা সেই অহংকারী সিরিয়াল কিলারের লেক বেরিসিয়ার হত্যাকান্ডের পরের সম্পূর্ণ ইতিহাস নিয়ে লিখতে যাচ্ছি।
প্রেসিডিয়ো হাইটস অ্যাটাক
১১ অক্টোবর, ১৯৬৯ সাল; লেক বেরিসিয়াতে এক প্রেমিক যুগলকে আক্রমণের মাত্র দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। সান ফ্রান্সিস্কোর ইউনিয়ন স্কয়ারের এক ব্লক পশ্চিমে ম্যাসন এবং গিয়ারি স্ট্রিটের মিলনস্থলে অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছেন এক লোক। রাতের অন্ধকার দূর করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে রাস্তার স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো। ঘড়িতে তখন আনুমানিক ৯:৩৫-৯:৪৫ এর মতো বাজে। একটি হলুদ রঙয়ের ট্যাক্সি ক্যাব দেখে হাত দিয়ে ইশারা করলেন তিনি। হালকা ব্রেক করে ট্যাক্সি ক্যাবটিকে থামালেন মাত্র ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে প্রেসিডিয়ো হাইটের ম্যাপল স্ট্রিটে নিয়ে যেতে বললো।
একটানা প্রায় ১৫ মিনিট চলার পর, ৯টা ৫৫ মিনিটে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ম্যাপল স্ট্রিট পার করে এক ব্লক দূরের চেরি স্ট্রিটে গিয়ে ক্যাবটি থামালো এর তরুণ চালক। গাড়ি থামাতেই ঘটল সেই মর্মান্তিক ঘটনা। গাড়ির যাত্রী চালকের মাথায় ৯ এম এম লুগার দিয়ে গুলি করে বসল। মাথার ঠিক ডানপাশে। গল গল করে বের হওয়া লাল রক্তে ভিজে গেল চালকের জামা। যাত্রীর বেশ ধরা মানুষটি চালকের ওয়ালেট, গাড়ির চাবি এবং তার রক্তে ভেজা জামার একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে একদম লাপাত্তা হয়ে গেল।
৬০ ফুট দূরে রাস্তাটির ঠিক বিপরীত দিকের একটি বাড়ি থেকে তিনজন কিশোর দেখে ফেলে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা। তারা চোখের সামনে এই ঘটনাটি দেখে প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়। তবে ঘটনা ঘটার মাত্র ৩ মিনিটের মাঝেই তারা পুলিশকে ফোন দিয়ে ঘটনাটির কথা জানায়।
তবে এসময় একটি ভুল হয়ে যায়। এটা নিশ্চিত নয় যে, ক্রস কানেকশান নাকি ভুলভাবে ম্যাসেজ গ্রহণের জন্য রেডিও অপারেটার তথ্যে গড়মিল করে ফেলে। ৩ জন কিশোরের বর্ণনামতে শ্বেতাঙ্গের পরিবর্তে রেডিও অপারেটার ভুল করে খুনীর বর্ণনা দেয়ার সময় সে কৃষ্ণাঙ্গ বলে অভিহিত করে।
ঘটনাস্থলের মাত্র ২ ব্লক দূরেই অবস্থান করছিলেন পুলিশ অফিসার ডন ফুকে। অফিসার ডন ফুকে এক শ্বেতাঙ্গকে তার রাস্তায় দেখতে পান। কিন্তু সে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে খুঁজছিলো বলে তাকে কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনই তিনি মনে করলেন না। শুধু তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে সন্দেহজনক কাউকে দেখেছে কিনা।
সেই ৩ জনের বর্ণনামতে, খুনী ছিল একজন শ্বেতাঙ্গ, যার বয়স ২৫-৩০ এর মাঝে। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি – ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির মাঝে তার উচ্চতা, বেশ শক্তসমর্থ দেখতে। লালচে-বাদামী চুল তার। ক্রিউ কাট নামে একধরণের বিশেষ ধরণের চুলের কাট ছিল তার মাথায়। চোখে ভারী রিমের চশমা।
পুলিশ অফিসার ডন ফুকে ঘটনার পরপরই যে শ্বেতাঙ্গকে দেখেছিলেন তার উচ্চতা ছিল মোটামুটি ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি, ওজন ছিল ৮২ থেকে ৯০ কেজির মাঝে। বয়স ছিল ৩৫-৪৫ বছরের মাঝে। মাথার চুলে টিন এজারদের বর্ণনামত ক্রিউ কাট দেয়া। বেশ লম্বা একটা নেভী ব্লু কালারের জ্যাকেট ছিল তার গায়ে। চোখে ছিল চশমা। ফুকে এই লোকটিকে দেখেছিল জ্যাকসন এবং ম্যাপল স্ট্রিটের মিলনস্থলে। আর টিন এজারদের বর্ণনামতে, খুনী চেরী স্ট্রিট থেকে জ্যাকসন এবং ম্যাপল স্ট্রিটের মিলনস্থলের দিকেই লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলো।
আগের লেখার বর্ণনা থেকে আমরা জোডিয়াক কিলারের যে বর্ণনা পেয়েছিলাম সে, অনুসারে তার ব্যবহৃত গাড়ির নাম্বার প্লেট থেকে ধারণা করা যায়, জোডিয়াক ক্যালিফোর্নিয়ারই কেউ, বয়স ৩০ এর কাছাকাছি, পুরুষ, গায়ের রঙ সাদা, উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি-৬ ফুট, গাটাগোট্টা, ৯০-১০০ কেজি, ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল, চুলের রং হালকা বাদামী, মুখমণ্ডল বেশ বড়, ব্যবহৃত গাড়ি বেশ হালকা রঙের, ব্রিটিশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, নেভিতে কর্মরত ছিল বা আছে এমন একটি সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থাৎ টিনেজারদের বর্ণনা এবং পুলিশ অফিসার ফুকে ঘটনার পরপরই যাকে দেখেছিলেন তাদের বর্ণনার সাথে জোডিয়াকের বর্ণনা প্রায় হুবহু মিলে যায়। এছাড়াও পরে জোডিয়াকের পাঠানো চিঠি থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, জোডিয়াকই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল। তাই এই ঘটনাকেই জোডিয়াককে ধরার সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল বলে একবাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়। শুধুমাত্র রেডিও অপারেটরের একটা ভুল তথ্যের জন্য (কৃষ্ণাঙ্গ) জোডিয়াক সম্ভবত পুলিশের হাত গলে বেরিয়ে যায়।
ক্রাইম সিন এবং পুলিশী তদন্ত
ক্রাইম সিনে ১০টা ৪৬ মিনিটে এক পুলিশ অফিসার লক্ষ্য করেন, ট্যাক্সি ক্যাবের ভাড়া উঠেছে ৬ ডলার ২৫ সেন্ট। হত্যাকান্ডের সময় গোয়েন্দাদের জানা ছিল। পুলিশ সেখান থেকে পেছন দিকে ক্যালকুলেশান শুরু করেন যে, কোথায় থেকে খুনি পল স্টাইনের ট্যাক্সি ক্যাবে উঠেছিল তা বের করার জন্য। ৬ ডলার ২৫ সেন্ট ভাড়া হওয়ার জন্য কত দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে তা তারা হিসেব করে বের করেন।। এছাড়াও ট্যাক্সি ক্যাবটি পল স্টাইনের নিজস্ব ছিল না। সে ভাড়া খাটতো। তাই তার আগের যাত্রী কোথায় নেমেছিল সেটাও তার কোম্পানির ভ্রমণ তালিকা থেকে পুলিশ জেনে যায়। ফলে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, খুনী ইউনিয়ন স্কয়ারের গিয়ারী স্ট্রিটের ওয়েস্টিন সেন্ট ফ্রানিস হোটেলের সামনে থেকে এই ট্যাক্সি ক্যাবে উঠেছিল।
পুলিশ ট্যাক্সির ভেতরে ভালোভাবে খোঁজার পরে পল স্টাইনের একটি ভ্রমণ ডায়েরী খুঁজে পায়। ট্যাক্সি ড্রাইভার পল স্টাইন এই ভ্রমণ ডায়েরীতে তার শেষ যাত্রার ঠিকানা হিসেবে ওয়াশিংটন এবং ম্যাপলের নাম লিখে রেখেছে, যার এক ব্লক দূরেই তাকে খুন করা হয়।
ট্যাক্সি ক্যাবের বাইরে একটি বিশেষ অংশে একটি রক্তমাখা আঙ্গুলের ছাপ উদ্ধার করতে পুলিশ সমর্থ হয়। পুলিশ এই হাতের ছাপটি খুনীর বলেই মনে করে। তবে খুনীকে কেন ট্যাক্সি ক্যাবের এই বিশেষ অংশে হাত দিতে হল তা এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছে। এছাড়াও পুরুষের হাতের বড় আকৃতির এক জোড়া গ্লাভসও ক্যাবের ভেতরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
যে তিনজন কিশোর এই খুনের ঘটনা সরাসরি দেখেছিল, তারা খুব হালকা স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো এবং রাতের কুয়াশার জন্য খুনীর চেহারা এবং অবয়ব খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পারেনি। তারপরও তাদের বর্ণনা শুনে শুনে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এক চিত্রকর জোডিয়াকের মুখমন্ডলের সম্ভাব্য ছবি এঁকে ফেলেন। এই ছবিটি একটি ওয়ান্টেড পোস্টার হিসেবে গোটা ক্যালিফোর্নিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তখন এই হত্যার সাক্ষী কিশোরেরা আবার পুলিশের কাছে আসে এবং ছবিটি খুব একটা ভালো হয়নি জানিয়ে নতুন করে আঁকতে বলে। পুলিশের সেই চিত্রকর নতুন করে আবার খুনীর সম্ভাব্য মুখমন্ডলের ছবি আঁকে এবং তা আবার ওয়ান্টেড পোস্টার হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরের ছবিটিতে আগের ছবির চেয়ে বয়সের ছাপ কিছুটা বেশি ছিল।
গোয়েন্দা বিল আর্মস্ট্রং এবং ডেভ টসিকে এই হত্যার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। ডেভ টসিকে এখনো পৃথিবীর অন্যতম সেরা গোয়েন্দাদের একজন হিসেবে ধরা হয়। সান ফ্রান্সিস্কো পুলিশ বিভাগ এই মামলায় প্রায় ২,৫০০০ সন্দেহভাজনের উপর তদন্ত চালিয়েছিল।
জোডিয়াকের নতুন চিঠি
অক্টোবর ১৪, ১৯৬৯, দ্যা ক্রোনিকল পত্রিকা জোডিয়াকের কাছ থেকে নতুন একটি চিঠি পেল। চিঠির সাথে ছিল ট্যাক্সি ড্রাইভার পল স্টাইনের রক্তে ভেজা জামার একাংশ, যা খুনী ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল।
নিচে জোডিয়েকের চিঠিটি তুলে ধরা হল-
“This is the Zodiac speaking. I am the murderer of the taxi driver over by Washington St + Maple St last night, to prove this here is a blood stained piece of his shirt. I am the same man who did in the people in the north bay area.
The S.F. Police could have caught me last night if they had searched the park properly instead of holding road races with their motorcycles seeing who could make the most noise. The car drivers should have just parked their cars and sat there quietly waiting for me to come out of cover.
School children make nice targets, I think I shall wipe out a school bus some morning. Just shoot out the front tire + then pick off the kiddies as they come bouncing out.”
যা সংক্ষেপে বাংলা করলে দাঁড়ায়, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যে খুন করেছে সে জোডিয়াক নিজেই। তার রক্তে ভেজা জামার কাপড়ের একটা অংশ সে চিঠির সাথে পাঠাচ্ছে, যা প্রমাণ করে সে-ই খুনী। পুলিশ তাকে সে রাতে ধরতে পারতো যদি তারা একে অপরের সাথে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে রেস করা এবং শব্দ সৃষ্টি করা বাদ দিয়ে পার্ক এলাকা ভালোভাবে খোঁজ করতো। স্কুলের বাচ্চারা খুব সুন্দর লক্ষ্যবস্তু। কোনো একদিন একটি স্কুল বাসে হামলা চালাবে। সে বাসের সামনের চাকায় গুলি চালাবে এবং আতঙ্কে বাস থেকে নামতে যাওয়া বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাবে।
জোডিয়াকের এই চিঠির পর সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলে বাসে আক্রমণ চালানোর হুমকি সবাই খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা শুরু করে এবং প্রতিটি স্কুল বাসে একজন করে পুলিশ অফিসার দিয়ে দেয়া হয় বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য।
জোডিয়াকের ফোন কল
২০ অক্টোবর, ১৯৬৯ সাল; সময় দুপুর ২টা। অকল্যান্ড পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ফোন বেজে উঠল। টেলিফোনকারী নিজেকে জোডিয়াক পরিচয় দিতেই পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সবাই নড়েচড়ে বসল। জোডিয়াক দাবী করে বসল, শহরের দুজন সেরা আইনজীবী এফ. লি. বেইলী অথবা মেলভিন বেল্লিকে স্থানীয় টিভি চ্যানেলের সকালের একটি অনুষ্ঠান এ. এম সান ফ্র্যান্সিস্কোতে উপস্থিত থাকতে হবে। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতেন জিম ডানবার। এফ. লি. বেইলী তখন শহরে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু মেলভিন বেল্লি অনুষ্ঠানে আসতে সম্মত হলেন।
সত্যি সত্যিই অনুষ্ঠানে এমন একজনের ফোন কল আসলো যে নিজেকে জোডিয়াক হিসেবে দাবী করল। সে নিজের নাম বলেছিল “স্যাম”। সে জানিয়েছিল, তার অনেক মাথাব্যথা আর এই মাথাব্যথা শুরু হয়েছে যখন সে এক বাচ্চা ছেলেকে হত্যা করেছিল তারপর থেকে। বেল্লি তার সাথে ডালি সিটিতে দেখা করার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কখনোই জোডিয়াক সেখানে তার সাথে দেখা করতে আসেনি।
তবে জোডিয়াকের একজন জীবিত শিকার এবং তার সাথে ফোনে কথা বলা আরো দুইজন পুলিশ এই ফোন কলের অডিও টেপের কণ্ঠস্বর শুনে একমত হয়েছিল যে, স্যাম আসলে একজন নকল জোডিয়াক।
আরো চিঠি, আরো ধাঁধা
৮ নভেম্বর, ১৯৬৯ সালে জোডিয়াক ৩৪০ সংকেতের আরেকটি ধাঁধা বা ক্রিপ্টোগ্রাম পাঠিয়ে দেয়। এই ধাঁধাটি কখনোই সমাধান করা সম্ভব হয়নি। অনেকেই অনেকরকম সমাধান প্রস্তাব করলেও কোনোটিই সঠিক হিসেবে ধরে নেয়ার মতো নয়।
পরদিন জোডিয়াক সাত পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে পাঠাল। এখানে সে লিখলো সে যখন পল স্টাইনকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ তাকে আটকেছিল এবং কিছুক্ষণ কথাও বলেছিল। সে এতে দাবী করে, সে তখনও পর্যন্ত ৭ জনকে হত্যা করেছে। সে এটাও জানায় যে, পুলিশ তার সম্বন্ধে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তাই পরের খুনগুলো করে সে পুলিশকে আর জানাবে না। সেগুলো সাধারণ ডাকাতি বা দুর্ঘটনা বলেই সবাই মনে করবে। সে আরও জানায়, পুলিশ তাকে কখনোই ধরতে পারবে না। কারণ সে তাদের চেয়ে অনেক চালাক। সে এই চিঠিতে বোমা বানানোর কিছু উপকরণের নাম লিখেছিল। এই বোমার বিস্ফোরণ করার কথা বলেছিল এবং বোমা বানানোর উপকরণগুলো তার বাসার বেজমেন্টে লুকিয়ে রাখা আছে বলে দাবী করেছিল।
২০ ডিসেম্বর, ১৯৬৯; তারিখটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঠিক এক বছর আগের ২০ ডিসেম্বরে লেক হারমান রোডের লাভারস লেনে দুজনকে হত্যার মাধ্যমেই সম্ভবত শুরু হয়েছিল জোডিয়াকের যাত্রা। তার ঠিক ১ বছর পর জোডিয়াক আইনজীবী মেলভিন বেল্লিকে একটি চিঠি পাঠায়। কোনো কারণে কি এই ২০ ডিসেম্বর তারিখটি জোডিয়াকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল? ইনি সেই আইনিজীবী যিনি জোডিয়াকের জন্য টিভিতে গিয়েছিলেন। এই চিঠিতে সে পল স্টাইনের রক্তভেজা জামার আরেক অংশ পাঠায়। জোডিয়াক এতে লেখে যে, সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে এবং নবম বা দশম শিকারের সন্ধানে রয়েছে। জোডিয়াক আরো জানায়, সে চায় বেল্লি যাতে তাকে সহযোগীতা করে। কিন্তু আইনগত সহযোগীতা নাকি অন্য কোনো ধরনের সহযোগীতা তা জোডিয়াকের চিঠি থেকে জানা যায়নি।
এছাড়াও ১৯৭০ সালের ১৪ জানুয়ারি একজন পুলিশ অফিসার রিপোর্ট করেন, জোডিয়াক মেলভিন বেল্লিকে ফোন করেছিল। কিন্তু এই সময় বেল্লি ঘরে ছিলেন না। তাই জোডিয়াক তার গৃহ পরিচারিকাকে বলে “আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আজ আমার জন্মদিন।”
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০; টেলিভিশন স্টেশনে নিজেকে জোডিয়াক দাবী করে মেলভিন বেল্লিকে যে কল করেছিল সে ধরা পড়ল। কলগুলো করা হয়েছিল একটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে। এরিক উইল নামে এক মানসিক রোগী এই কলগুলো করেছিল। পুলিশ পরে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছিল যে, এরিক উইল কোনোভাবেই জোডিয়াক কিলার নয়।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০; জন ফ্রাঙ্কলিন হুড (২৪) এবং সান্দ্রা গার্সিয়া (২০) ইস্ট বিচ, সান্তা বারবারায় এক সন্ধ্যা কাটাতে গিয়েছিলেন। তারা পূর্ণ চাঁদের আলোয় একটি কম্বলের নিচে শুয়ে সময়টা উপভোগ করছিলেন। কিছুদিনের মাঝেই এই জুটির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লেক বেরিসিয়ার জোডিয়াক খুনের ঘটনার ঠিক অনুরুপ ঘটনা ঘটে। দুজনকেই চাকু দিয়ে অনেকবার বিক্ষিপ্তভাবে আঘাত করে মেরে ফেলা হয়। তবে ঘটনাটি জোডিয়াকের পূর্বের ঘটনার অনুরুপ হলেও এই খুন ২টি জোডিয়াকই করেছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মোডেস্টোর ঘটনা
২২ মার্চ, ১৯৭০; রাত ১১টা ৪৫ মিনিট। ক্যাথলিন জোন্স নামের এক নারী সান বার্নারডিনো থেকে পেটালুমায় তার মায়ের কাছে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ৭ মাসের গর্ভবতী ছিলেন। তার ১০ মাস বয়সী মেয়েও তার সাথে ছিল। মোডেস্টোর কাছে এসে হাইওয়ে ১৩২ এ পৌঁছে পশ্চিমদিকে যাত্রা করলেন। সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেডলাইটেও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। হঠাৎ তার পেছনে থাকা একটি গাড়ি বারবার তার হেড লাইট জ্বালাতে এবং নেভাতে লাগল আর হর্ন বাজাতে লাগল। ক্যাথলিন জোন্স কোনো জরুরী বিষয় ভেবে তার গাড়িটি থামালেন। লোকটিও তার নিজের গাড়ি ক্যাথলিন জোন্সের গাড়ির পেছনে এসে থামাল। লোকটির গাড়িটি ছিল পুরাতন মডেলের দুই দরজাওয়ালা। গাড়িটির নাম্বার প্লেট ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার।
লোকটি এসে ক্যাথলিন জোন্সকে বলল, সে দেখেছে ক্যাথলিন জোন্সের গাড়ির ডান পাশের পেছনের চাকাটি বেশ নড়বড়ে হয়ে আছে। লোকটি চাকাটির নাট বল্টু টাইট করে দিতে চাইলে ক্যাথলিন জোন্স রাজি হয়ে গেলেন। নাট বল্টু টাইটের কাজ শেষ করে লোকটি ক্যাথলিন জোন্সকে বিদায় জানিয়ে তার গাড়িটি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু জোন্স তার গাড়িটি রাস্তায় আনার পরপরই চাকাটি তার গাড়ি থেকে খুলে আসে। লোকটি তার রিয়ার ভিউ মিররে এই ঘটনা দেখে আবার পেছনে ফিরে আসে এরপর লোকটি ক্যাথলিন জোন্সকে কাছের গ্যাস স্টেশানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করে, যাতে তারা সেখান থেকে গাড়ি সারাবার লোক আনতে পারে। ক্যাথলিন জোন্স তার মেয়েকে নিয়ে লোকটির গাড়িতে উঠে পড়ে।
কিন্তু চোখের সামনে একের পর এক গ্যাস স্টেশান পার হয়ে যেতে থাকে। লোকটির গাড়ি থামানোর নাম গন্ধ নেই। প্রায় ৯০ মিনিট ধরে লোকটি এদিক সেদিক গাড়ি চালাতে থাকল। জোন্সের কপালে এবারে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। যখনই জোন্স জিজ্ঞাসা করছিল সে কেন গাড়ি থামাচ্ছে না, তখনই লোকটি অন্য বিষয়ে কথা বলা শুরু করে। যখন লোকটি একটি ট্রাফিক চিহ্নের কাছে একটি মোড়ে গিয়ে তার গাড়িটি থামাল, জোন্স তার বাচ্চাকে নিয়ে গাড়ি থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। এরপর চালকটিও গাড়ি থেকে নেমে একটি ফ্লাশ লাইট বের করল। সে ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে জোন্সকে খুঁজতে থাকল আর জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো যে, সে তার কোনো ক্ষতি করবে না। অবশেষে জোন্সকে খুঁজে না পেয়ে সে তার গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
জোন্স নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে যায়। জোন্স তার পুরো ঘটনা সেখানকার পুলিশ অফিসারকে খুলে বলে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে পল স্টাইনের খুনীর চেহারা আঁকানো ছবিটির দিকে। জোন্স জানায় এই লোকটিই তাকে তার গাড়িতে লিফট দিয়েছিল। এরপর পুলিশ জোন্সের গাড়িটি খুঁজে বের করে। কিন্তু গাড়িটিতে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তবে এই ঘটনাটি জোডিয়াকই ঘটিয়েছিল কিনা সে বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত নয়।
জোডিয়াকের আরো চিঠি
জোডিয়াক ১৯৭০ সালের পুরোটা জুড়েই তার চিঠি পাঠানো অব্যাহত রাখে। ১৯৭০ সালের ২০ এপ্রিল পাঠানো তার চিঠিতে সে প্রথমেই একটি ১৩ সংকেতের কোড পাঠায়। সে জানায় এই কোডে তার নাম দেয়া আছে। যদিও কেউই সেই কোডের মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারেনি। সে আরো জানায়, সম্প্রতি সান ফ্রান্সিস্কো পুলিশ স্টেশনে যে বোমা হামলা হয়েছে তার জন্যও সে দায়ী নয়।
১৯৭০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সান ফ্রান্সিস্কো পুলিশ স্টেশনে এক বোমা হামলায় সার্জেন্ট ব্রায়ান ম্যাকডোনাল্ড মারা যান। এর ২ দিন আগেই গোল্ড গেট পার্কেও একটি বোমা হামলা হয়েছিল। যদিও জোডিয়াক বলছিল এই বোমা হামলাগুলো তার কাজ নয়, কিন্তু সে এ-ও বলেছিল যে, পুলিশকে হত্যা করার মাঝে বাচ্চাদের হত্যা করার চেয়ে বেশি সম্মান আছে। কারণ তারা পাল্টা গুলি ছুঁড়তে পারে। চিঠিতে সে বোমা বানানোর নতুন একটি নকশাও পাঠিয়েছিল। সে বলে, এই বোম দিয়ে সে একটি স্কুল বাস উড়িয়ে দেবে। এছাড়াও সে আরো জানায়, এখন পর্যন্ত সে ১০ জনকে হত্যা করেছে। জোডিয়াকের পাঠানো এই বোমের নকশাটি বেশ অন্যরকম হলেও একদম সঠিক এবং কার্যকর ছিল।
২৮ এপ্রিল, ১৯৭০; জোডিয়াক দ্য ক্রনিকল পত্রিকায় আরো একটি চিঠি পাঠালো, এতে সে দুটি জিনিস দাবী করে।
(১) তার পাঠানো বোমের নকশাটি পুরো বর্ণনা সহ প্রকাশ করতে হবে।
(২) সান ফ্রান্সিস্কোর লোকদের জোডিয়াক সংকেতের বোতাম তাদের জামা কাপড়ে ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে সে বোমা মেরে পাবলিক বাস উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়।
১৯৭০ সালের ২৬ জুন পাঠানো এক চিঠিতে জোডিয়াক বলে, সে চিন্তিত যে মানুষজন জোডিয়াক চিহ্নের বোতাম তাদের পোষাকে লাগাচ্ছে না। তাই সে তাদের শাস্তি দেবে। কিন্তু তখন স্কুল ছুটি থাকায় সে স্কুল বাসে বোমা মারতে পারছে না। তাই সে গাড়িতে বসে থাকা একজনকে .৩৮ ক্যালিবার পিস্তল দিয়ে হত্যা করেছে।
জোডিয়াক সম্ভবত সার্জেন্ট রিচার্ড রেডটিককে হত্যার কথা বলছিল। চিঠিটি আসার এক সপ্তাহ আগে ১৯ জুন, সকাল ৫টা ২৫ এ রেডটিক তার স্কোয়াড গাড়িতে বসে থাকার সময় মাথায় .৩৮ ক্যালিবারের একটি পিস্তল দিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। এর ১৫ ঘন্টা পর তিনি মারা যান। সান ফ্রান্সিস্কো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এই হত্যাকান্ডের সাথে জোডিয়াকের সংশ্লিষ্টতা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। যদিও এই খুনের ঘটনা এখনো অমীমাংসীতই রয়ে গেছে।
চিঠির সাথে ফিলিপ্স ৬৬ নামে সান ফ্রান্সিস্কোর এক জায়গার রাস্তার একটি মানচিত্র ছিল। এতে এক স্থানে জোডিয়াক তার জোডিয়াক চিহ্নটি আঁকায়। এই চিহ্নের চারপাশে সে ক্রমান্বয়ে 0, 3, 6, 9 সংখ্যাগুলো লিখে রেখেছিল। এর সাথে সে আরো ৩২টি সংকেতের একটি সাইফার পাঠায়। জোডিয়াক জানায়, এই কোডটি ব্রেক করতে পারলে পুলিশ তার বসানো বোমার সন্ধান পাবে, যা খুব দ্রুতই বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কখনোই তার কোড ভাংতে পারেনি। অন্যদিকে জোডিয়াকের কথামতো কোনো বোমার বিস্ফোরণও কখনও ঘটেনি।
২৪ জুলাই, ১৯৭০; দ্য ক্রনিকলে পাঠানো এক চিঠিতে জোডিয়াক ক্যাথলিন জোন্সকে তার ১০ মাস বয়সী মেয়ের সাথে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার কৃতিত্ব দাবী করে। জোডিয়াক জানায়, সে-ই তাদের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। ২৬ জুলাই জোডিয়াক আরেকটি চিঠি পাঠায়। এতে সে আবার জোডিয়াক চিহ্নের বোতাম পরিধান করতে বলে। এতে সে দ্য মিকাডো নামের একটা কমিক অপেরা থেকে কিছু গানের লাইন নিজের মতো করে লিখে পাঠিয়েছিল।
৭ অক্টোবর, ১৯৭০; দ্য ক্রনিকল ১৫ বর্গ ইঞ্চির একটি কার্ড পায়, যাতে জোডিয়াকের চিহ্ন দ্বারা স্বাক্ষর করা ছিল। এতে রক্ত দিয়ে ছোট একটা ক্রস আঁকানো ছিল। কার্ডের কথাগুলো দ্য ক্রনিকলের একটি পত্রিকা থেকে শব্দ এবং বর্ণ কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছিল। এতে সে ১৩ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করে। কার্ডে ১৩টি ছোট ছোট ছিদ্রও করা ছিল। সম্ভবত তার ১৩টি খুনকে নির্দেশ করতে সে এই ছিদ্রগুলো করেছিল। ইন্সপেক্টর আর্মস্ট্রং এবং টসির মতে, খুব বড় সম্ভাবনা রয়েছে যে কার্ডটি জোডিয়াকই পাঠিয়েছিল।
পল এভেরির কাছে লেখা চিঠি
২৭ অক্টোবর, ১৯৭০; ক্রনিকলের সাংবাদিক পল এভেরির কাছে একটি হ্যালোইন কার্ড আসে। পল এভেরি দ্য ক্রনিকলে জোডিয়াকের কেসটির দায়িত্বে ছিলেন। এতে “Z” লেখা ছিল এবং জোডিয়াকের চিহ্ন আঁকানো ছিল। এতে সে বলে, তার খুনের পদ্ধতিগুলো হলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া, গুলি করা, চাকু দিয়ে এবং দড়ি দিয়ে হত্যা করা। যদিও আগুন বা দড়ি দিয়ে হত্যার কোনো ঘটনার সাথে জোডিয়াকের সংশ্লিষ্টতা পুলিশের জানা ছিল না। চিঠিটি দ্য ক্রনিকলের ১ম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়েছিল। এর পরপরই এভেরি একটি বেনামী চিঠি পান। এতে চিঠির লেখক জোডিয়াকের খুনের ধরনের সাথে চার বছর আগের চেরি জো বেটসের অমীমাংসীত খুনের ধরনের মাঝে মিলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। খুনটি রিভারসাইডের সিটি কলেজে হয়েছিল, যা সান ফ্রান্সিস্কো থেকে ৪০০ মাইল দূরে ছিল। নভেম্বর ১৬-তে এই চিঠির কথা দ্য ক্রনিকল পত্রিকায় আসে।
১৯৬৬ সালের ৩০ অক্টোবর চেরি জো বেটসের এই খুনের ঘটনাটি ঘটেছিল। চেরি জো বেটসের বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর, যা জোডিয়াকের অন্যান্য শিকারের কাছাকাছি। সে রিভারসাইড কমিউনিটি কলেজের একজন ছাত্রী ছিল। সেদিন গ্রন্থাগার বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত অর্থাৎ রাত ৯টা পর্যন্ত সে ক্যাম্পাসের গ্রন্থাগারেই ছিল।
পরদিন সকালে বেটসের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। তার দেহে নৃশংসভাবে আঘাত করা হয়েছিল এবং কয়েকবার চাকু দিয়ে আঘাত করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। চুরি বা যৌন নির্যাতনের মতো কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কোনো চাক্ষুষ সাক্ষীও ছিল না। একজনের টাইমেক্স নামের একটি কোম্পানির ঘড়ি ও হাতের ব্যান্ডের ছেঁড়া অংশ বেটসের মৃতদেহের কাছাকাছি পাওয়া গিয়েছিল। ঘড়িটি ১২:২৪ মিনিটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও পুলিশের ধারণা, হত্যার ঘটনাটি আরো আগে ঘটেছিল।
ঘটনার আশেপাশের বাসিন্দারা রাত সাড়ে দশটার দিকে একটি চিৎকার শুনেছিলেন। তার গাড়িটি ১০০ গজ দূরে নষ্ট হয়ে পড়েছিল। আলামত দেখে পুলিশের ধারণা, সেটি ইচ্ছা করে নষ্ট করা হয়েছিল।
এক মাস পর ২৯ নভেম্বর টাইপরাইটারে লেখা প্রায় একইরকম ২টি চিঠির একটি রিভারসাইড পুলিশ, আরেকটি রিভারসাইড প্রেস এন্টারপ্রাইজের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিটির শিরোনাম ছিল ‘দ্য কনফেশান’ বা স্বীকারোক্তি। এতে চিঠির লেখক এই হত্যাকান্ড সম্বন্ধে এমন কিছু কথা বলে যা পুলিশ ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়। এতে সে আরো হুমকি দেয়, চেরি জো বেটসই প্রথম নয় এবং চেরি জো বেটস শেষও নয়। রিভারসাইড সিটি কলেজের গ্রন্থাগারের একটি ডেস্কে ঐ বছর ডিসেম্বর মাসে খোঁদাই করা কিছু লেখা পাওয়া যায়। এতে লেখা ছিল, “এভাবে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না, আবার মরে যেতেও ভয় করে।” লেখাটির ভাষা এবং হাতের লেখার ধরন জোডিয়াকের সাথে অনেকটাই মিলে যায়।
৩০ এপ্রিল, ১৯৬৭; বেটসের মৃত্যুর ঠিক ৬ মাস পর বেটসের বাবা, দ্য প্রেস এন্টারপ্রাইজ এবং পুলিশের কাছে প্রায় একইরকম তিনটি চিঠি আসে। চিঠিগুলো ছিল হাতে লেখা। এতে লেখা ছিল, বেটসকে মরতেই হত। আরো অনেককেই মরতে হবে। চিঠির শেষ দিকে কলমের কালির কিছু দাগ দেখতে পাওয়া যায়, যা দেখতে অনেকটাই “Z” এর মত।
সাংবাদিক পল এভেরি যখন রিভারসাইডে বেটসের হত্যাকান্ডের সাথে জোডিয়াক জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহ প্রকাশ করেন, তার প্রায় ৫ মাস পর জোডিয়াক লস অ্যাঞ্জেলস টাইমে একটি চিঠি পাঠিয়ে বেটসের হত্যাকান্ডের কৃতিত্ব দাবী করে। সে জানায়, পুলিশ তার করা খুনগুলোর মাঝে সহজ একটা খুঁজে পেয়েছে। এরকম আরো হত্যা সে আগে করেছে যা পুলিশ জানে না। যদিও তারপরও জোডিয়াক এবং বেটসের হত্যাকান্ডের মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। আবার খুনটি আসলেই জোডিয়াক করেছিল তারও শক্ত কোনো প্রমাণ নেই।
ডন্না লাসের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া
১৯৭১ সালের ২২ মার্চ দ্য ক্রনিকলের পল এভেরির কাছে আরেকটি পোস্ট কার্ড আসে, যেটি জোডিয়াকের কাছ থেকে এসেছিল বলে মনে করা হয়। এতে ১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ডন্না লাসের অদৃশ্য হওয়ার সাথে চিঠির লেখক নিজে জড়িত বলে দাবী করেন। এটিও পত্রিকা এবং বিজ্ঞাপনের শব্দ কেটে কেটে কাগজে বসিয়ে বানানো হয়েছিল। এতে জোডিয়াকের দুটি চিহ্নও আঁকা ছিল।
ডান্না লাস সাহারা হোটেল এবং ক্যাসিনোর একজন নার্স ছিলেন। সেসময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর। অদৃশ্য হওয়ার দিন তিনি রাত ২টা পর্যন্ত নার্সের কাজ করেছিলেন। রাত ১টা ৪০ মিনিটে তিনি তার শেষ রোগীকে দেখেছিলেন। ঐদিনই পরে ডন্না লাসের হোটেলের মালিকের কাছে এক অচেনা পুরুষ ফোন দিয়ে জানায়, জরুরী পারিবারিক কাজে ডান্না লাস শহরের বাইরে গিয়েছে, যা মিথ্যা ছিল। ডন্না লাসের বাড়ির বাইরে তার গাড়িটিও অক্ষত ছিল, যা প্রমাণ করে লাস রাতে তার বাসায় ফিরেছিলেন। এরপর ডান্না লাসকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার সাথে জোডিয়াকের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সে বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ট্যাক্সি ড্রাইভার পল স্টাইনের হত্যার ঘটনার কয়েক ব্লক দূরেই লাসের বাড়ি ছিল।
সান্তা বারবারার ঘটনা
ভ্যালেহো টাইমস হেরাল্ডে ১৯৭২ সালের ১৩ নভেম্বর সান্তা বারবারার এক পুলিশ অফিসার বিল বেকার একটি রিপোর্ট লেখেন। এতে তিনি ১৯৬৩ সালের ৪ জুন রবার্ট ডমিঙ্গোস এবং তার বাগদত্তা লিন্ডা এডওয়ার্ডসের খুনের ঘটনাকে জোডিয়াকের করা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
জোডিয়াকের শেষ চিঠি
১৯৭১ সালের ২২ মার্চ পাঠানো চিঠির পর প্রায় ৩ বছর জোডিয়াকের কাছ থেকে কোনো চিঠি আসেনি। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি দ্য ক্রনিকলের কাছে একটি চিঠি আসে। এতে তেমন কিছুই লেখা ছিল না। শুধু দ্য মিকাডো নামের এক কমিক অপেরার একটি বাক্য ছিল। চিঠির শেষে একটি অস্বাভাবিক চিহ্নও আঁকানো ছিল, যার মানে কখনই আবিষ্কার করা যায়নি। এতে জোডিয়াক মোট ৩৭ জনকে খুন করার দাবী করে। এটিই জোডিয়াকের কাছে থেকে আসা শেষ নিশ্চিত চিঠি। এরপর আর কখনোই জোডিয়াকের কাছ থেকে কোনো চিঠি আসেনি। জোডিয়াক আরো খুন করেছে এমন সন্দেহও আর কখনোই তৈরি হয়নি।
শেষের কথা
এটিই ছিল জোডিয়াকের কুকীর্তির সম্পূর্ণ কাহিনী। কিন্তু জোডিয়াক কে? পুলিশ কাদের সন্দেহ করেছিল? কী কী কারণে তাদের সন্দেহ করা হয়েছিল? সব পরোক্ষ প্রমাণ কার দিকে ইঙ্গিত করে? পুলিশের তদন্ত কিভাবে এগিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কি জোডিয়াক ধরা পড়েছিল? এসব নিয়ে পরবর্তীতে কোনো এক লেখায় লেখার ইচ্ছা থাকল।