ঐতিহ্য যত বেশিই থাকুক- ঐতিহ্যের পাহাড় অনেক সময় সামনে এগোনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আঠারো ও উনিশ শতকে এশিয়ার অনেক সমৃদ্ধশালী দেশের ক্ষেত্রেও এমন দেখা যাচ্ছিলো। ফলে ইউরোপ থেকে আসা বণিক সংগঠনের পক্ষে এশিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিজেদের একক আধিপত্য গড়ে তুলছিলো।
এশিয়ার শক্তিগুলোর মধ্যে সবার আগে জাপানের চোখ খুলেছিলো। সুদূর পূর্বে সাগরের তীরের এই দেশটির শাসকরা সম্ভাব্য মহাবিপদের আঁচ করতে পেরেছিলেন। স্থবির রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা ইউরোপের তখনকার উন্নত সামরিক আধিপত্যবাদ থামানো যাবে না- এই সত্য পরিষ্কার হচ্ছিলো।
জাপানের ১২২তম সম্রাট মেইজি তেন্নো এই সত্যের ভিত্তিতে দেশকে আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলেন। বিশেষ করে ১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর পক্ষে কমোডর ম্যাথু ক্যালব্রেইথ পেরির জাপান উপকূলে আগমন সবাইকে চকিত করে দিয়েছিলো। বড় রণতরীসহ তার আগমনের কারণ ছিলো জাপান উপকূল পশ্চিমা বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া। জাপানী শাসকগোষ্ঠী ভাবলেন- এই প্রস্তাব মেনে নিলে জাপানের পক্ষে পশ্চিমের কারিগরি উন্নয়নের অভাবনীয় সাফল্যের রহস্য আয়ত্ত করা সহজ হবে। জাপানের অন্যতম সামন্ত প্রভু শিমাজু নারিয়াকিরা এই মনোভাব পোষণ করতেন।
১৮৬৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সম্রাট মেইজি তেন্নো সিংহাসনে আরোহণ করলেন। তার পিতা দুই বিবাদমান সামুরাই গোষ্ঠীর এলাকা সাৎসুমা ও চোশুর প্রধান সাইগো তাকামোরি ও কিদো তাকায়োশিকে এক সংস্কারের নিচে আনার মাধ্যমে পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন।
তবে শুধু সংস্কারই যথেষ্ঠ ছিলো না। পশ্চিমা বড় শক্তিধর দেশগুলোর প্রকৃতি বোঝার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতারও প্রয়োজন ছিলো। যে তৎপরতা ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর জার্মানির মতো বাড়ন্ত শক্তির সরকার পদ্ধতি, সামরিক নীতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও শিক্ষানীতি সম্পর্কে কাজে লাগার মতো ধারণা দেবে। ‘ইওয়াকুরা মিশন’ ছিলো এমন এক সফল কূটনৈতিক তৎপরতা।
ইওয়াকুরা তমোমি তৎকালীন জাপানের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনিই এই মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন ওকুবু তোশিমিচি, কিদো তাকায়োশি এবং ইতো হিরোবুমি। তারা জাপানের মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। এছাড়া জাপানের ট্র্যাডিশনাল স্কলার ও অন্যান্য প্রশাসক মিলিয়ে ৪৮ জনের দল গঠিত হয়েছিলো। মিশনের প্রতিটি খুঁটিনাটি লিখে রাখবার জন্য জাপানের অন্যতম ইতিহাসবিদ কুমে কুনিতাকে-কেও মিশনে রাখা হয়েছিলো।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে বেশ ফলপ্রসূ ও সার্থক হয়েছিলো। তা হচ্ছে- তরুণ ও যুবা জাপানীদের শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যকে জানায় উৎসাহ দেওয়া। ইওয়াকুরা মিশনে যুবা শিক্ষার্থী হিসেবে সুদা উমেকো, নাগাই শিগেকো ও ইয়ামাকাওয়া সুতেমাৎসু ছিলেন। এরা প্রত্যেকে পশ্চিমে পাওয়া শিক্ষার অভিজ্ঞতা নিজের দেশে অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে কাজে লাগিয়েছিলেন।
মিশনের লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে একে তিনটি সহায়ক গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিলো। তার মধ্যে একটি গ্রুপের কাজ ছিলো গন্তব্য দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও গঠন ভালোভাবে বুঝে নেওয়া। সংবিধান, প্রশাসন ও আইনের গতি প্রকৃতি এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরেকটি গ্রুপকে অর্থনৈতিক দিকগুলি আয়ত্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। শিল্পকারখানার পদ্ধতি ও প্রযুক্তি, শ্রম, ব্যবসায়িক নীতি, ব্যাংক, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা, বাণিজ্য ও তার পদ্ধতি হিসেবে যোগাযোগ এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তৃতীয় ও শেষ গ্রুপের দায়িত্ব ছিলো দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ভালোভাবে জানা। সামরিক বিষয়াদি জানা অন্যতম উদ্দেশ্য থাকলেও প্রকাশ্যে সে বিষয়ে গ্রুপ করা হয়নি। তিন গ্রুপের কাজের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব মিশনের প্রধান ইওয়াকুরা নিজের হাতেই রেখেছিলেন।
১৮৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর এই মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো। জাপানের ইয়োকোহামা বন্দর থেকে এই মিশনের যাত্রা শুরু হলো। প্রশান্ত মহাসাগরের অপর প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো বন্দরে প্রথম বিরতি দেওয়া হলো। সেদিন ছিলো ১৮৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি। সেখান থেকে ট্রেনে করে ওয়াশিংটন অভিমুখে যাত্রা শুরু হলো। ৪ মার্চ রাজধানী ওয়াশিংটন ডি. সি. তে অবতরণের পর মিশনের প্রতিনিধিদল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউলেসিস গ্র্যান্টের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হ্যামিলটন ফিশ নতুন চুক্তির জন্য জাপানের সরকারী প্রতিনিধিদের স্বাগত জানালেন। কিন্তু চুক্তি করার ক্ষমতা মিশনকে দেওয়া ছিলো না। এছাড়া কিছু মতবিরোধও দেখা গিয়েছিলো। এছাড়া মিশন তাদের ইউরোপের কর্মসূচী নিয়ে ভাবছিলো। তবে পাঁচ মাস অবস্থানের কারণে মিশন তাদের সফলতা পেতে শুরু করেছিলো।
ওয়াশিংটন থেকে বোস্টন হয়ে মিশন আগস্ট মাসে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
১৮৭২ সালের ১৭ আগস্ট ইওয়াকুরা মিশন ইংল্যান্ডের লিভারপুলে পৌঁছায়। তারা লন্ডন অভিমুখে যাত্রা করলেন। মহারানী ভিক্টোরিয়ার সাথে সাক্ষাতের আবেদন করা হলো। সে বছরের ৫ ডিসেম্বর ভিক্টোরিয়ার সাথে দেখা করবার আগে তারা তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্পোন্নত দেশটিকে ভালোভাবে দেখা ও বোঝার সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। তারা ব্রিটিশ কলকারখানা, রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা ও বৈশ্বিক অর্থনীতি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। ব্রিটেনের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের গঠন কাজের পদ্ধতি অবলোকন করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যালয়, লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামও বাদ পড়লো না। ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণী ও রাজপরিবারের পারিবারিক সংস্কৃতি ও সামাজিক আচার ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেলেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র, দুর্গ ও কারিগরি দক্ষতা বুঝে ওঠার সুযোগও ছাড়লেন না।
ব্রিটেন থেকে তারা ইউরোপ মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৮৭২ সালের ডিসেম্বরে তারা ফ্রান্সে পৌঁছান। সে মাসের ১৬ তারিখ তারা ফরাসি প্রেসিডেন্ট এডলফে চেঁয়ো’র (Adolphe Thiers) সাথে সাক্ষাৎ করেন। মিশন ফ্রান্সে প্রায় দুই মাস অবস্থান করে। এসময় তারা ফ্রান্সের আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। ফ্রান্সের নতুন উদারনৈতিক সংবিধান ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাও বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন।
ইওয়াকুরা মিশন ফ্রান্সে ভ্রমণ শেষে ১৮ ফেব্রুয়ারি বেলজিয়ামে পৌঁছায় ও রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের সাথে সাক্ষাৎ করে। বেলজিয়াম থেকে নেদারল্যান্ডসে গিয়ে এই মিশন রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের সাক্ষাৎ লাভ করে।
নেদারল্যান্ডসে এক সপ্তাহ থাকার পর মিশনের সদস্যগণ ১৮৭৩ সালের ৭ মার্চ জার্মানির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১১ মার্চ কায়জার উইলহেমের সাথে তাদের সৌজন্য কথাবার্তা হয়। এসময় জার্মানির একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংবিধান ও আইনের বিভিন্ন দিক তাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। ২৮ মার্চ তারা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে জার্মানি ত্যাগ করেন। ৩ এপ্রিল সেন্ট পিটার্সবার্গে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সাথে তারা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। রাশিয়া থেকে ফিরে জার্মানি হয়ে তারা সুইডেন ও ডেনমার্কে যান। ১৯ এপ্রিল ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের সাথে তারা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ২৫ এপ্রিল সুইডিশ রাজা দ্বিতীয় অস্কার জাপানি মিশনকে অভ্যর্থনা জানান। পুনরায় জার্মানি হয়ে মিশন ইতালি গমন করে। ১৩ মে রাজা ভিক্তর ইমানুয়েলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। জুন মাসে মিশন ভিয়েনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ৮ জুন রাজা ফ্রানজ জোসেফের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়।
২১ জুন তারা সুইজারল্যান্ড যাত্রা করলেন। সুইস কনফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পল সেঁসোলে তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করলেন। জুলাই মাসে জাপানি মিশনের ইউরোপ ভ্রমণ সমাপ্তির দিকে এলো। ফ্রান্সের সমুদ্র উপকূল থেকে পূর্ব দিকের পথে তারা জাপানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে ইউরোপের শক্তিগুলোর অধীনে থাকা উপনিবেশগুলো ভালো করে দেখতে চেয়েছিলেন। সুয়েজ, অ্যাডেন, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও সাংহাই দেখার সুযোগ পেলেন। দারিদ্র্য আর দাসত্বের শেকলে দেশ, জনপদ ও মানুষ কীভাবে জর্জরিত হচ্ছে তা দেখে সচকিত হয়েছিলেন। সাংহাই থেকে যাত্রা করে ১৮৭৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মিশন ইয়োকোহামা ফিরে আসে।
এই মিশন ছিলো জাপান কর্তৃক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার ও নিরীক্ষা করার মতো। মিশনের প্রতিটি দিন এর সদস্যগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বিজ্ঞ মতামত প্রদান করতেন। তারা শুধু উপস্থিত বুদ্ধি নয়- চাক্ষুস অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি বুঝতে চাইছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। এমন এক ব্যবস্থা তারা চেয়েছেন- যাতে জাপানী ঐতিহ্য ও পশ্চিমের আধুনিকতা একসাথে থেকে পরিবর্তন আনতে পারে। তারা একে ‘ওয়াকন ইয়োসাই’ নাম দিয়েছেন- যার অর্থ ‘জাপানী নীতিতে পশ্চিমের আধুনিকতা’। ‘ফুকোকু কিয়োহেই’ দ্বারা বোঝাতো রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী নতুন উপায়ে শক্তিশালী করা- ‘শোকুসান কোগয়ো’ দ্বারা বোঝানো হয়েছিলো শিল্পকারখানার প্রসার ও উৎপাদন বাড়ানো।
মিশনের সিদ্ধান্ত থেকে প্রথমেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন হয়েছিলো। তার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কিছু অভ্যন্তরীন সংস্কার করা হলো। ওকুবো তোশিমিচি আরো অনেকের সহায়তায় সম্রাটকে কেন্দ্রে রেখে শক্তিশালী শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ইওয়াকুরা মিশন সর্বাংশে সফল- এ দাবি করা যাবে না। কিন্তু সীমিত আকারে হলেও এটি জাপানে পরিবর্তন শুরু করেছিলো। এই পদক্ষেপের ফলে ঘুমন্ত এশিয়ার সুদূর উত্তর পূর্বে সাগরের পারের দেশ সবার আগে বিদ্যমান বিশ্ব ও তার অগ্রগতি নিয়ে সচেতন হয়েছিলো। সে হিসেবে এর অবদান অনস্বীকার্য।