সামরিক কর্তাদের কাছে সাধারণ মানুষের জানমাল যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ না তার অনেক উদাহরণ আছে। স্বার্থে আঘাত লাগলে সামরিক সরকার যে কী পরিমাণ নৃশংস হয়ে উঠতে পারে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশেষ করে গত শতাব্দীর ষাট থেকে আশির দশক জুড়ে এমন অনেক রক্তপিপাসু সামরিক সরকারের কথা জানা যাবে যারা মূলত কাজ করতেন পশ্চিমা আর সোভিয়েত নেতাদের প্রক্সি হিসেবে। সোভিয়েত সমর্থিত সিয়াদ বারে বা হাফিজ আল আসাদ এর তুলনায় পশ্চিমা ঘুঁটি ফার্দিনান্দ মার্কোস, অগুসো পিনোশে কিংবা বোকাসা কম নৃশংস ছিলেন না।
এমনই একজন নৃশংস সামরিক কর্তা ষাটের দশকে উদয় হন ইন্দোনেশিয়াতে। আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ, সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ এই জেনারেলের নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়াতে ১৯৬৫-৬৬ সাল জুড়ে এক ভয়াবহ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে লক্ষ লক্ষ কম্যনিস্ট ও কম্যুনিস্ট সমর্থক। লোকটির নাম জেনারেল মুহাম্মাদ সুহার্তো। ১৯৬৭-৯৮ সাল পর্যন্ত ৩১ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়া শাসন করে এসেছেন ডানপন্থী এই রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতা।
পটভূমি
হল্যান্ড শাসিত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের জাভা দ্বীপে ১৯২১ সালে সুহার্তোর জন্ম হয়। কৈশোরে নানা তুকতাক মন্ত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আজীবন এগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। দারিদ্রের চাপে পড়াশোনা শেষ না করতে পেরে সুহার্তো ১৯৪০ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরে জাপান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমলে ইন্দোনেশিয়াতে নতুন করে জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে তুললে তিনি তাতে যোগ দেন। যুদ্ধশেষে দ্রুত উন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেলের পদ অধিকার করেন। ইন্দোনেশিয়া এসময় সুকর্নের নির্দেশে পাপুয়া অঞ্চল এবং মালয়েশিয়ার জঙ্গলে সৈন্য পাঠায়। সুহার্তো এসব অভিযানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে একইসাথে ভয় পেয়ে যান যে কম্যুনিস্টরা সুকর্নের আশকারা পেয়ে ক্ষমতা দখল করবে।
১৯৫৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও জাতির জনক সুকর্ন সেনাবাহিনীর আর কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থন নিয়ে ঘোষণা দেন, ইন্দোনেশিয়া এখনো পশ্চিমা গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। কাজেই তিনি প্রবর্তন করলেন গাইডেড ডেমোক্রেসি নামের এক ছদ্মবেশী একনায়কতন্ত্র। সুকর্নর এই নাসাকম সরকার (ন্যাসনালিসমো/জাতীয়তাবাদ, আগামা/ধর্ম, কমুনজমে/সমাজতন্ত্র) দেশে অনেকটা একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। তবে সুকর্ন সবসময় সেনাবাহিনী, ইন্দোনেশিয়ার সমাজতান্ত্রিক দল এবং ধর্মীয় দলগুলোকে একে অপরের সাথে বিরোধে লিপ্ত থাকতে দিতে চাইতেন। এই বিপদজনক খেলায় শেষমেষ তার নিজের ক্ষমতাই খোয়া যায়।
১৯৬২ সালে ইন্দোনেশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি সুকর্নের সরকারে যোগ দেয়। দলটি ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, ভুল করলে তারা স্বয়ং প্রেসিডেন্টকেও ছেড়ে কথা বলতো না। কাজেই দেশের শ্রমিক আর কৃষকদের মধ্যে তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। একইসাথে তারা ছিল সামরিক বাহিনী আর ধর্মীয় দলগুলোর দুই চোখের বিষ।
তবে যা-ই হোক, ১৯৬৫ সাল নাগাদ চীন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পরে পিকেআই বিশ্বের বৃহত্তম কম্যুনিস্ট পার্টিতে পরিণত হয়। তিরিশ লক্ষের বেশি সদস্য ছিল তাদের। অনেকে ধারণা করেন, ইন্দোনেশিয়ার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষকে সংগঠিত করবার মত ক্ষমতা রাখতো দলটি। মালয়েশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতা দখল করতে সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে অনেক ইন্দোনেশীয় গেরিলা গিয়েছিল সেদেশে। তারা সফল হয়নি, তবে পিকেআই এর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ছিল এক ভয়ের কারণ, বিশেষ করে তাদের পেমুদা রাকায়াত নামক যুব সংগঠনটি ছিল মারাত্মক মারমুখী। ১৯৬৫ এর এপ্রিলে কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রধান আহমেদ ইয়ানি ঘোষণা দেন যে, তিনি একটি পৃথক কম্যুনিস্ট মিলিশিয়া গঠন করবেন। সুকর্ন এতেও সায় দেন।
সেনাবাহিনী এটাকে ভাল চোখে দেখতো না। যুবসমাজের মধ্যে কম্যুনিজমের জনপ্রিয়তা, সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতি সুকর্নের দুর্বলতা দেখে তারা শংকিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এরই মধ্যে একদল কম্যুনিস্ট গেরিলা করে ফেললো মারাত্মক এক ভুল। আর ইন্দোনেশিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সমনও যেন জারি হয়ে গেল সেই সাথে।
একটি অপহরণ ও হত্যাকান্ড
সুকর্নের কয়েকজন দেহরক্ষী আর সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্য মিলে ১৯৬৫ এর তিরিশ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশীয় সামরিক বাহিনীর সাতজন সব থেকে সিনিয়র জেনারেলকে অপহরণ করে এবং মারদেকা চত্ত্বর দখল করে নেয়। তবে ক্যু এ অংশগ্রহণকারীরা জাকার্তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট সুকর্ন সেনাবাহিনীকে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাতে নিষেধ করলেও ততদিনে সুহার্তোর পেছনে সকল সামরিক কর্তারা এক কাট্টা। শুরু হয়ে গেল রক্তপাত।
সুহার্তোর প্রতিশোধ
দীর্ঘদিন ধরে সুহার্তো ভয় পেয়েছেন এই বুঝি কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা দখল করলো। তাদেরকে জব্দ করবার সুযোগ তিনি ছেড়ে দেবেন কেন? সুকর্নকে ক্ষমতাহীন আর গৃহবন্দী করা হল। নাসাকম সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সুকর্ন সামরিক অভিযান আর বিশ্ব রাজনীতির পিছনে ছুটতে গিয়ে নিজের দেশের অর্থনীতির ওপরে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে জনসাধারণের মধ্যেও অসন্তুষ্টি ছিল ব্যাপক। আর ধর্মীয় দলগুলো তো মারমুখী হয়েই ছিল। ইন্দোনেশিয়ার শহরে গ্রামে শুরু হয়ে গেল একের পর এক হত্যাকান্ড।
সবার আগে মাঠে নামলো পঞ্চশীলা ইউথ নামের একটি আধা সামরিক সংগঠন। জেনারেল আব্দুল হারিস নাসিতিওনের এই সংগঠনের মূল শক্তি ছিল রাস্তার ভাড়াটে গুন্ডা, মাফিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন এবং উগ্র ডানপন্থী যুবারা। শহরে, গ্রামে নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রু থেকে শুরু করে যেকোনো সমালোচক এবং কম্যুনিস্ট ছিল এই সংগঠনের শত্রু। আর্মির লোকেরাও স্রেফ বসে ছিল না, তারা পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে কম্যুনিস্ট নিধনের ডাক দিত। অনেক ক্ষেত্রে খ্রিস্টান আর হিন্দুদেরকে হত্যাকান্ডে অংশ নিতে বাধ্য করা হত না, তবে সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে নাকি প্রায়ই আর্মি আর ডানপন্থী সংগঠনগুলোর যোগসাজশে দলে দলে মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল বামপন্থী মানুষজনের ওপরে। লুটপাট আর খুনের হোলিতে মেতে উঠেছিল গোটা দেশটা।
ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনী, সুহার্তো এখন যার সর্বেসর্বা, শুধু যে কম্যুনিস্টদের ওপরেই হামলা চালিয়ে সন্তুষ্ট ছিল তা কিন্তু নয়। তাদের বলি হল ইন্দোনেশিয়াতে বসবাসকারী চীনা লোকেরাও। বহু শত বছর ধরে মূল চীন ভূখন্ড থেকে মানুষ ইন্দোনেশিয়াতে এসে বসতি স্থাপন করেছে। এই চীনাদেরকে সরকার চীনের দালাল, গুপ্তচর, নাস্তিক ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করলো। চীনারা ব্যবসায়ী হিসেবে ইন্দোনেশিয়াতে খুবই সফল ছিল। এবারে পালে পালে ক্ষিপ্ত জনগণ তাদের সম্পত্তি লুটপাটে মেতে উঠলো। চললো খুনের পসরা। হাজার হাজার চীনাকে এ সময় হত্যা করা হয়।
জাকার্তা হয়ে গোটা জাভা, বালি এবং সুমাত্রা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে হত্যাকান্ড। কম্যুনিস্টরা একেবারে ছেড়ে কথা বলেনি ভাবলে ভুল হবে। অন্তত জাভা অঞ্চলে বেশ কিছু জায়গায় তারা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরকে রাজনৈতিক দল হিসেবেই সংগঠিত করে এসেছে এতদিন। প্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা বিশেষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান দিপা নুসানতারা আইদিতকে ১৯৬৫ সালেই খুন করা হয়। বালি অঞ্চল হিন্দুপ্রধান হলেও সেখানেও কম্যুনিস্টরা পার পায়নি। শুধু কি কম্যুনিস্ট? জাভা অঞ্চলের আবাংগান মুসলিমদেরকেও (কিছুটা নরমপন্থী মুসলিম) রেয়াত করা হয়নি। কোনো কোনো ঘটনায় খ্রিস্টানরাও হত্যায় অংশ নিয়েছে বলে জানা যায়।
যদিও ইন্দোনেশিয়ার কম্যুনিস্টরা নিজেদেরকে ‘লাল মুসলিম’ বলতো, সেনাবাহিনী ও ডানপন্থীরা তাদেরকে স্রেফ নাস্তিক হিসেবেই দেখতো। আর উগ্রপন্থীদের কাছে তখন নাস্তিক মানেই বধ্য। এছাড়া এমন অরাজক পরিস্থিতির সুযোগ যে অন্যরা নিবে তা জানা কথা। এই যেমন সুমাত্রা অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ জাভাদেশীয় মানুষকে খুন করা হয় সেই চিরাচরিত ‘সেটেলার/আদিবাসী’ বিতর্ককে কেন্দ্র করে। ১৯৬৬ এর মার্চ নাগাদ রক্তপাত বন্ধ হয়ে আসে। জেনারেল সুহার্তো তুকতাক মন্ত্রে দারুণ বিশ্বাসী। সে বছর সুলু নদীর পানি অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তার ধারণা হয় যে এটা হত্যাকাণ্ড বন্ধের নির্দেশ। ফলে তিনি ইতি টানেন এই নৃশংসতার।
ঠিক কত মানুষকে খুন করা হয়েছিল তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া ১৯৬৫ পরবর্তী দশ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ আর সরকারি জেল-জুলুম অগণিত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে রবার্ট এফ কেনেডি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্দ্রেই শাখারভ ছাড়া আর কাওকে এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে উচ্চবাচ্চ করতে দেখা যায়নি সে সময়। এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত নীরব ছিল। চীন অবশ্য খুবই কড়া প্রতিবাদ জানায়, তবে তাতে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকার বিশেষ পাত্তা দেয়নি। ইন্দোনেশীয় সরকারের হিসেবে মৃতের সংখ্যাটা আশি হাজারের মতো হলেও স্বাধীন গবেষকদের ধারণা কমপক্ষে ১০ লক্ষ অথবা প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় এই সময়ে।
পরিশিষ্ট
১৯৬৮ সালের মার্চ নাগাদ জেনারেল সুহার্তো পাকাপোক্তভাবে ইন্দোনেশিয়ার সর্বেসর্বা হয়ে বসেন। সুকর্নকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং সেখানেই তিনি সালে মৃত্যুবরণ করেন। সুহার্তো বার্কলে মাফিয়া নামে পরিচিত একদল অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন সাহায্যে রাতারাতি ইন্দোনেশিয়াকে বদলে ফেলেন। সরকারি সম্পত্তি বেসরকারিকরণ করা হয়। ধনী গোষ্ঠী গজিয়ে ওঠে যত্রতত্র, বাড়তে থাকে ধনী-গরিব বৈষম্য, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্র সমর্থিত মাফিয়াদের যন্ত্রণা। জেনারেল সুহার্তোর এই নতুন ঘরানার সরকারকে বলা হয় ‘নিউ অর্ডার’। ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে কম্যুনিস্টদের ইতি টানা হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে এই সুহার্তোর নির্দেশেই তার খুনে জেনারেলরা পূর্ব তিমুরে হামলা চালায় এবং ঠিক একইভাবে ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটায়।
জেনারেল সুহার্তো ১৯৯৮ সালে এক গণ অভ্যুত্থানের সামনে পদত্যাগ করেন। বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার তছরুপ করা এই খুনে ব্যক্তিকে আদালতের সামনে দাঁড় করানো যায়নি। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি মারা যান ২০০৮ সালে। ইন্দোনেশিয়ার এই গণহত্যা নিয়ে ‘অ্যাক্ট অব কিলিং‘ নামের একটি তথ্যচিত্র বানানো হয়েছে। আগ্রহী দর্শক চাইলে ‘দ্য ইয়ার অব লিভিং ডেঞ্জারাসলি‘ ও দেখতে পারেন।
সুকর্নের মেয়ে মেঘবতী সুকর্নপুত্রী পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
ফিচার ইমেজ – The New York Tomes