ভারতবর্ষের ইতিহাসে জগৎশেঠ বংশের মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ওসওয়াল জৈন পরিবার, যারা একইসঙ্গে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক সকল ক্ষেত্রেই অতুলনীয় অর্জন ও প্রভাবের অধিকারী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ১৪৯৫ সালে খিচি গাহলোট রাজপুত গোত্র থেকে জগৎশেঠ পরিবারের পূর্বপুরুষদের উদ্ভব।
১৬৫২ সালে এ বংশের একজন উত্তরপুরুষ হীরানন্দ সাহু মারওয়ারের নাগোর থেকে পাটনায় এসে উপস্থিত হন। সেসময় এ শহরটি বাণিজ্যের দিক দিয়ে অনেক উন্নতি করেছিল। তিনি এখানে ব্যাংকিং ব্যবসা শুরু করেন এবং উত্তরোত্তর উন্নতি করতে থাকেন। সর্বত্র তার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তার ব্যবসা তার সাত ছেলের মধ্যে বন্টন করে দেন।
বড় ছেলে মানিকচাঁদ ঢাকার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। মূলত তার মাধ্যমেই জগৎশেঠ পরিবারের জগৎশেঠ হয়ে ওঠার শুরু হয়। পরবর্তীতে ফতেচাঁদ, মহাতপচাঁদ এ বংশের উন্নতির ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তারা একইসঙ্গে সম্রাট, নবাব, ইংরেজ সকলের সঙ্গেই ব্যবসা করেছিলেন এবং তাদের সবার উপরই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। এ পরিবার যেমন উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল, তেমন করেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষাবলম্বন করায় আজও ইতিহাসে ঘৃণিত হয়ে আছে।
জগৎশেঠ পরিবারের অর্থের উৎস নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। এ নিয়ে কাহিনীও প্রচলিত আছে। তেমনই একটি কাহিনী হলো এমন,
১৬৫২ সালে হীরানন্দ সাহু পাটনায় ভাগ্যান্বেষণে আসেন। ব্যবসা করার মতো তেমন পুঁজি ছিল না। পাটনায় তার দেশীয়রাও তেমন কোনো সহযোগীতা করতে পারছিল না। এভাবেই কিছুদিন কেটে যায়। একদিন ঘুরতে পথ হারিয়ে এক বনে ঢুকে পড়েন। এমন সময় মানুষের আওয়াজ শুনতে পান করুণ কাতরোক্তি। তিনি এগিয়ে যান।
একটি ভাঙা বাড়ি দেখতে পান। ভেতরে একজন মৃতপ্রায় বৃদ্ধ ব্যক্তিকে দেখতে পান। আপ্রাণ সেবা করেন। কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারেননি। মারা যাওয়ার আগে ঘরের কোনে আবর্জনার স্তুপ দেখিয়ে কিছু বলতে চান। কিন্তু কিছু বলার আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হীরানন্দ তার সৎকার করে সেই ঘরে ফিরে আসেন। আবর্জনার দিকে এগিয়ে যান। আবর্জনা সরিয়ে সেখানে অনেক সোনা দেখতে পান। এ সোনা নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। আর এর মাধ্যমেই তার ব্যবসায়ী জীবনের সূত্রপাত।
এটি প্রচলিত কাহিনী। তবে ইতিহাসে এর কোনো যথার্থ প্রমাণ নেই। কেউ জানে না কিভাবে হীরানন্দ ধনবান হয়েছিলেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, পাটনায় ইংরেজদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হীরানন্দের। তাদের সঙ্গে ব্যবসা করেই হীরানন্দ ধনবান হয়েছিলেন। তবে এসবই অনুমান। সঠিক ইতিহাস আজও অন্ধকারে।
শেঠ মানিকচাঁদ
যখন মানিকচাঁদ ঢাকার ব্যবসার হাল ধরেন, তখন ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী। রাজনৈতিকভাবে কলুষিত। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অধীনস্থ রাজ্যগুলোর ওপর তার প্রভাব হারাচ্ছিলেন। এ সময় ঢাকার নবাব ছিলেন আজিমুশ্বান, আওরঙ্গজেবের নাতি। আওরঙ্গজেব তার দেওয়ান হিসেবে মুর্শিদ কুলি খাঁকে ঢাকায় পাঠান।
এ সময় মুর্শিদ কুলি খাঁর সাথে তার ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু আজিমুশ্বানের সঙ্গে মুর্শিদ কুলির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৭০৩ সালে সম্রাটের অনুমতি নিয়ে ও মানিকচাঁদের পরামর্শে মুর্শিদ কুলি দেওয়ানি ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদ স্থানান্তর করেন। মানিকচাঁদও মুকসুদাবাদে তার ব্যবসা স্থানান্তরিত করেন। সেখানে মহিমাপুরে মানিকচাঁদ তার তেজারতি ব্যবসা শুরু করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ মুকসাদাবাদের নতুন নামকরণ করলেন মুর্শিদাবাদ।
মানিকচাঁদ নবাবের পোদ্দারী ও তহবীলদারী পেলেন। এতদিন পর্যন্ত সুদ ও বাট্টার কাজ করতেন। হুন্ডি ভাঙাতেন। কিন্তু এখন নবাব টাকা জমা রাখে। তার উপর অতিরিক্ত আয় হয়। এছাড়া পোদ্দারী থেকে তার নির্দিষ্ট অনুপাতে আয় হয়। দেখতে দেখতে তার কারবার ফুলে ফেঁপে ওঠে। এরপর ১৭০৬ সালে মুর্শিদকুলি টাকশাল ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। টাকশালের কাজ দেখাশোনা করেন মাণিকচাঁদ। সোনা রুপোর ঘাটতি পড়লে বা বাজারে টাকার টানাটানি পড়লে নিজের ভাড়ার থেকে রুপা পাঠাতেন টাকশালে।
১৭১৭ সালে টাকশালর পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পান। এরই মধ্যে ১৭১৩ সালের ১০ জানুয়ারি আগ্রার এক যুদ্ধে জাহান্দর শাহ পরাজিত এবং ফররুখশিয়র সম্রাট হন। ১৭১৫ সালে সম্রাটের কাছ থেকে মানিকচাঁদ শেঠ উপাধি পান। এরপর মানিকচাঁদ নবাবের পেস্কার নির্বাচিত হন। অর্থাৎ জমিদারেরা সব খাজনা মানিকচাঁদের কাছে জমা দেবে। এখান থেকে তিনি একটা অংশ মজুরী হিসেবে রেখে বাকিটা নবাবের কোষাগারে জমা দেন। এছাড়া প্রতিবছর যে রাজস্ব আয় হয় তা গুছিয়ে রাখার দায়িত্বও মাণিকচাঁদের। এর বিপরীতে তিনি কমিশন পান। পরবর্তীতে ডাকাতের ভয় এড়াতে হুন্ডির মাধ্যমে রাজস্ব দিল্লিতে পাঠানো হতো। এত টাকার জিম্মাদার হওয়ার ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র শেঠ মানিকচাঁদেরই ছিল। এটাও তার আয়ের একটা বড় অংশ ছিল।
মানিকচাঁদের ইচ্ছে ছিল ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করার। ইতোমধ্যে ডাচ ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু তারা ব্যবসার চেয়ে আমোদ প্রমোদের প্রতি বেশি মনোযোগী। বিভিন্ন সময় মুর্শিদ কুলি খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব হয়েছে। এ সময় মানিকচাঁদ ইংরেজদের হয়ে নবাবের সঙ্গে রফা করতেন। এতে করে ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতি হয়। এছাড়া তারা সুদ দেয় অন্যদের তুলনায় বেশি। ফলে ব্যবসায়িক উন্নতিও উভয় পক্ষেই হয়।
শেঠ মানিকচাঁদ ১৮ শতকের বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার ২,০০০ সৈন্যের সেনাবাহিনী ছিলো। তার অগুনতি পরিমাণ সোনা-রুপা ছিলো। এছাড়াও বিপুল সংখ্যক চুনী-পান্না ছিল। বলা হয়ে থাকে, সেসময়ে ভারতবর্ষে তার সমতুল্য ধনী আর কেউ ছিল না। ১৭১৪ সালে মানিকচাঁদ মারা যান।
জগৎশেঠ ফতেচাঁদ
মানিকচাঁদের ছেলে ছিল না। তাই তিনি তার ভাগনে ফতেচাঁদকে দত্তক নেন। মানিকচাঁদের মৃত্যুর পর তিনিই শেঠ বাড়ির প্রধান হন এবং তার অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। ১৭২৪ সালে তাকে সম্রাট কর্তৃক জগৎশেঠ উপাধি দেওয়া হয়। ফরমান জারি করে বলা হয়, জগৎশেঠ উপাধি এ বংশের প্রত্যেক পুরুষের বড় ছেলে পাবে এবং অন্যরা পাবে মহারাজা উপাধি।
১৭২২ সালে ভারতবর্ষজুড়ে টাকার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাদশার তহবিল শূন্য। নবাবের অবস্থাও তথৈবচ। এ সময় ফতেচাঁদ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। তিনি তার দিল্লির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে হুন্ডি ছাড়েন। কেনাবেচার সময় সমানভাবে গ্রাহ্য হয় এ হুন্ডি। এরপর দাম পড়ে যায় এবং অবস্থা স্বাভাবিক হয়। এ সময়ই ফতেচাঁদ জগৎশেঠ উপাধিপ্রাপ্ত হন। ফতেচাঁদের এ সাফল্যের হাত ধরে সম্রাট ও নবাবের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতি হয়। বাদশাহ জগৎশেঠ নামাঙ্কিত সীল পাঠিয়েছিলেন, যা আগাগোড়া পান্না দিয়ে মোড়া।
ফতেচাঁদের সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। ইংরেজ আর নবাবের দ্বন্দ্বে তিনিই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৭২৬ সালে ঢাকার কুঠিতে টাকার টান পড়লে ফতেচাঁদ কোম্পানির সাহায্যে এগিয়ে আসেন। কিন্তু একসময় তাদের মধ্যে বিবাদ বাধে। ১৭৩০ সালে কোম্পানির দালাল কান্তবাবু বিভিন্ন সময় কোম্পানির নাম করে শেঠদের কাছ থেকে টাকা ধার করেন। একসময় তিনি পালিয়ে যান। ফতেচাঁদ তার পাওনা টাকা কোম্পানীর কাছে দাবী করেন, কিন্তু তারা দিতে অস্বীকার করে। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর জের ধরে অন্য মহাজনরা ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকে। কোম্পানির ক্ষতি হয়। কুঠি উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। অবশেষে কোম্পানি টাকা দিয়ে বিবাদ মিটিয়ে নেয়।
১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর সুজাউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। শেঠ ফতেচাঁদ তার উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। সকল নবাবের কাছ থেকে ফতেচাঁদ সুযোগ সুবিধা পেয়েছিলেন। ফলে তার ব্যবসা আরও প্রসারিত হয়। ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দৌলা মারা যান। তার স্থলে তার ছেলে সরফরাজ খাঁ নবাব হন। এ সময়ও ফতেচাঁদ তার উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এ নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে।
নবাব সরফরাজ ফতেচাঁদের নাতি মহাতপচাঁদের স্ত্রীর অতুলনীয় সৌন্দর্যের কথা শুনে তাকে দেখতে চান। এটা ফতেচাঁদ ও তার পরিবারের জন্য অপমানজনক ছিল। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও নবাব নিবৃত্ত না হলে বাধ্য হয়ে ফতেচাঁদ তার প্রস্তাবে রাজি হন। রাতের অন্ধকারে মহাতপচাঁদের স্ত্রীকে নবাব মহলে পাঠানো হয়। কিন্তু এরপর মহাতপচাঁদ তার স্ত্রীকে আর গ্রহণ করেননি।
এ বিষয়টি ইংরেজ অফিসার হলওয়েলের কাছ থেকে জানা যায়। তবে ইতিহাসবিদরা এর যথাযথ কোনো প্রমাণ পাননি। এছাড়া আরও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।
মুঘল আমলে নবাবের ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার নিয়ম ছিল না। কিন্তু নবাবেরা এ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পারেননি। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ফতেচাঁদের কাছে জমা রাখতেন। শেঠ বাড়ির মতে, মুর্শিদ কুলি সাত কোটি টাকা জমা রেখেছিলেন। সরফরাজ এই টাকার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। ফতেচাঁদ দিতে অস্বীকার না করলেও বিভিন্ন অযুহাত দিতে থাকেন। এতে সরফরাজ ও তার সম্পর্কের অবনতি হয়। সেসময় সাত কোটি টাকা দেয়া ফতেচাঁদের জন্য কোনো বড় বিষয় ছিল না। কিন্তু তবু এ আচরণ তার ও নবাবের সম্পর্কে চিড় ধরায়।
ইতিহাসবিদ হান্টার এটি মেনে নিয়েছেন। তবে সত্য যা-ই হোক না কেন, সরফরাজ ও ফতেচাঁদের মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তাই সরফরাজের পতনের উদ্দেশ্যে অন্য বিরোধীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ফতেচাঁদ আলিবর্দি খাঁকে নবাব হিসেবে নির্বাচিত করেন। কিন্তু এ চক্রান্তের অংশ হয়ে তিনি মূলত তার ব্যবসায়িক আদর্শ থেকে দূরে সরে আসেন, যার জন্য ভবিষ্যতে এ বংশের কপালে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে।
জগৎশেঠের সঙ্গে ইংরেজ, ডাচ, ফরাসিদের ব্যবসা জমে ওঠে। বিশেষ করে ইংরেজদের সঙ্গে। আলিবর্দি খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ বাঁধলে ফতেচাঁদ সহায় হন। আলিবর্দি খাঁর সময়ে বাংলায় অনেকবার মারাঠা বর্গীরা হামলা করে। উপর্যুপুরি আক্রমণে বাংলার আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। এ সময় বাংলার আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে নবাবের প্রধান সহায় ছিলেন জগৎশেঠ ফতেচাঁদ। ১৭৪৪ সালে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ মারা যান। মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি বিলাসী জীবনযাপন করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার সময় তার দুই নাতির প্রত্যেকের জন্য ১ কোটি পাউন্ড রেখে যান।
জগৎশেঠ মহাতপচাঁদ
১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদ মারা যাওয়ার পর তার নাতি মহাতপচাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান এবং তার ভাই স্বরুপচাঁদ মহারাজ উপাধি পান। কলকাতা থেকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি দিলেন। বাদশার ফরমান এলো। পুরুষানুক্রমিক অধিকার থাকলো নবাবের দরবারে।
শেঠবাড়ীর অর্থ প্রচুর। প্রতিদিন শুধুমাত্র মহিমাপুরেই কোটি টাকার লেনদেন হত। এরকম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিল। এ টাকার উৎস অনেক। ব্যাংকারের সত্যিকারের কাজ ক্রেডিট সৃষ্টি। তারা তা করতে পেরেছিল। পাশাপাশি বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দাঁড়িয়েছিল শেঠবাড়ীর উপর ভর করে।
মহাতপচাঁদের সময়ে বর্গীদের হাঙ্গামা চুড়ান্তভাবে বন্ধ হয়। আলিবর্দী মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। এরপর বর্গীদের হাঙ্গামা বন্ধ হয়। কিন্তু ততদিনে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটা সামাল দিতে জগৎশেঠকেই দায়িত্ব নিতে হয়। তারা শুধু নবাবের ব্যাংকার নয়, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারও ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাজারদর ওঠা-নামা, টাকার মূল্য হেরফের, বাট্টা সুদের চড়ামন্দা- সবই নির্ভর করতো শেঠবাড়ির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। ১৭৫০ সালের ৯ই জানুয়ারি নবাব ফর্মান জারি করেন, “এখন থেকে শেঠরা ছাড়া আর কেউ রুপো কিনতে পারবে না। আর্কট টাকা ভাঙিয়ে দেবে জগৎশেঠ।”
১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল আলিবর্দি খাঁ মারা যান। তার মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা মসনদে আসীন হন। সিরাজ মসনদে বসে প্রথমেই মোতিঝিল প্রাসাদ অবরোধ করেন। ঘষেটি বেগমের সমস্ত ধনসম্পদ নিজের প্রাসাদে তোলেন। মীরজাফর সিপাহসালার, নতুন দেওয়ান হলেন মোহনলাল। মঞ্চসফল মোহনলাল চরিত্রটি ঐতিহাসিকদের কাছে বিরুপ বিশেষণ পায়। ইংরেজ কোম্পানির ল সাহেবের মতে, “The greatest scoundrel of earth has ever borne”।
মোহনলালের সঙ্গে শেঠদের শত্রুতা ছিল। মোহনলাল দায়িত্ব নেয়ার পর শেঠরা সরে আসে। নবাবের সঙ্গেও বিরোধ শুরু হয়। সিরাজউদ্দৌলা সর্বদা উদ্ধত ও অসহিষ্ণু প্রকৃতির ছিলেন। নবাব শুধু শেঠদের অর্থ চেয়েছিলেন। খুব শীঘ্রই তার ভুল ভাঙে।
তবে তখন আর কিছু করার ছিল না। ইংরেজদের ঘৃণা করতেন সিরাজ। তার ধারণা ছিল, বিলেত যাযাবরের দেশ। কারও মতে, ইংরেজরা যেভাবে অত্যাচার ও লুন্ঠন করে যাচ্ছিল এবং প্রতিনিয়ত শক্তি বৃদ্ধি করছিল, সেজন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজ বিদ্বেষী ছিলেন। সিরাজের কলকাতায় ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করা এ বিদ্বেষের পরিণতি, যা পলাশীর যুদ্ধের ভিত তৈরি করেছিল। জগৎশেঠ নবাবকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবাব শুধু তাকে চড় মেরেই ক্ষান্ত হননি, বরং তার কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, জগৎশেঠ ইংরেজদের হয়ে দালালি করবেন না।
এ ঘটনা জগৎশেঠের মনে বেশ প্রভাব ফেলে। তিনি সিরাজ বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দেন তাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। এ লক্ষ্যে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, মীরজাফর, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একত্রিত হয়ে ঠিক করেন ইংরেজদের সহায়তা নেবেন তারা। তারাও সিরাজ বিরোধী। এর ফলাফল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যাস্ত।
এরপর মীরজাফর নবাব নির্বাচিত হন। নবাব মহলের ও কোষাগারের টাকা সব ভাগ হয় কোম্পানির কর্মচারী, নবকৃষ্ণ, মীরজাফর, আমীরবেগ, রাজবল্লভ, রামচাঁদ প্রমুখের মধ্যে। ৬ জুলাই একশ নৌকা সাতশ সিন্দুক বোঝাই লুটের বখরা নিয়ে কোম্পানির জাহাজ ডঙ্কা বাজিয়ে কলকাতায় আসে। নবাবী রীতি অনুযায়ী এসকল অর্থ জগৎশেঠের হাত দিয়ে পাচার হয়। লর্ড ক্লাইভ পেলেন অতিরিক্ত ১২ লাখ টাকা।
জগৎশেঠ এবার তার ভুল বুঝতে পারলেন। এ কোম্পানি তার অচেনা। এরা আর ব্যবসায়ী না, এরা শাসনকর্তা। কোম্পানির অনেক দিনের ইচ্ছে এবার পূরণ হলো। কলকাতায় টাকশাল বসলো, যেটা এত বছর শেঠ বাড়ি আটকে রেখেছিল। কিন্তু এবার আর কোনো উপায় রইল না। এখানে তাদের হাত দেয়ার কোনো এখতিয়ার রইল না। এত বছর শেঠ বাড়িতে বাংলার রাজস্ব জমা পড়ত। কিন্তু এখন ৩ জেলার খাজনা আদায় করবে নন্দকুমার। জমা পড়বে ইংরেজ কুঠিতে। ফলে আর্থিক ও প্রভাব উভয় দিকেই শেঠ বাড়ির ক্ষতি হলো। দিন দিন ইংরেজদের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাড়তে থাকলো।
এর মধ্যে মীরজাফরের ছেলে মীরণ বজ্রাঘাতে মারা যায়। এ শোক সইতে পারেনি মীরজাফর। মীরজাফরের পর তার জামাতা মীরকাসিম মসনদে বসেন। মীরকাসিম চেয়েছিলেন ইংরেজদের প্রতাপ দূর করে আলিবর্দির সময় ফিরিয়ে আনতে। এর ফলাফল ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধ জগৎশেঠ পরিববারকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। মীর কাসিম বক্সারের যুদ্ধে হেরে যান এবং যাওয়ার আগে জগৎশেঠ মহাতপচাঁদ ও তার ভাই স্বরুপচাঁদকে বন্দী হিসেবে মুঙ্গেরে নিয়ে যান।
মীর কাসিম যুদ্ধের সময় তার কাছে যে অর্থ দাবী করেছিল তা মেটাতে পারেননি জগৎশেঠ। এতে নবাবের ধারণা হয় যে, শেঠরা ইচ্ছে করে এ কাজ করে। তাই তিনি তাদের বন্দী হিসেবে নিয়ে যান। সেখানেই তাদের হত্যা করেন। তাদের কীভাবে মারা হয়েছিল তা সঠিক জানা যায় না। এ নিয়ে বিভিন্ন কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। ইতিহাসবিদগণ সঠিক ইতিহাস আজও জানতে পারেননি। তবে পলাশী যুদ্ধের অন্যতম কুচক্রী জগৎশেঠ মহাতপচাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জগৎশেঠ পরিবারের সোনালী সময়ের সূর্যাস্ত হয়।
জগৎশেঠ খোসালচাঁদ
১৭৬৬ সালে সম্রাট শাহ আলমের ফরমান অনুযায়ী মহাতপচাঁদের বড় ছেলে খোসালচাঁদ জগৎশেঠ আর স্বরুপচাঁদের ছেলে উদায়তচাঁদ মহারাজ উপাধি পান। লর্ড ক্লাইভ খোসালচাঁদকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করেন। ১৯ বছর কাজ করার পর ১৭৮২ সালে খোসালচাঁদ মারা যান। লোকমুখে শোনা যায়, খোসালচাঁদ প্রচুর ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কোথায় তা জানা যায়নি।
পরবর্তী জগৎশেঠ
জগৎশেঠ খোসালচাঁদের এক ছেলে ছিল, তার নাম গোকুলচাঁদ। কিন্তু সে তার পিতার জীবদ্দশায় মারা যায়। তখন খোসালচাঁদ তার ভাইপো হীরকচাঁদকে দত্তক নেন। প্রথানুযায়ী তিনি জগৎশেঠ উপাধি পান। ১৮৭০ সালে তিনি মারা যান।
হীরকচাঁদের মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলে বিসেনচাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান। তার এক ছেলে ছিল কিসেনচাঁদ। লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়ে তিনি ইংরেজ সরকার কর্তৃক জগৎশেঠ উপাধি পান। তার মৃত্যুর পর হীরকচাঁদের বড় ছেলে ইন্দ্রচাঁদ জগৎশেঠ হন। কোম্পানি তাকে বাৎসরিক ১,২০০ পাউন্ড পেনশন দিত। তিনি মারা গেলে তার দত্তক পুত্র গোপালচাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পান। ১৮৪৩ সালে লর্ড অকল্যান্ড তাকে ৩০০ রুপি পেনসন দিতে চাইলে তিনি সেটা ফিরিয়ে দেন।
তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী প্রাণ কুমারী দেবী গোলাপচাঁদকে দত্তক নেন। তার চার ছেলে ছিল। বড় ছেলের নাম ফতেচাঁদ। ১৯১২ সালের ৭ই এপ্রিল তিনি কলকাতায় মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সোবাগ চাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান। সোবাগ চাঁদ মহিমাপুরের বাড়িতে ডাকাতের হাতে মারা যান। তখন তার দুই ছেলে বর্তমান ছিল, জ্ঞান চাঁদ জৈন ও বিজয়চাঁদ। এদের পর আর জগৎশেঠ পরিবার সম্পর্কে জানা যায় না। ১৯১২ সালের পর আর কেউ জগৎশেঠ উপাধি ধারণ করেননি।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বলে খ্যাত ছিল জগৎশেঠ পরিবার। ১৭০৪-১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ছিল তাদের উত্তরণের সবচেয়ে সুন্দর সময়। হীরানন্দ সাহু যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মানিকচাঁদ, ফতেচাঁদ ও মহাতপচাঁদ তাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। দেশে ও দেশের বাইরে তাদের ব্যাংকিং ব্যবসা প্রসার লাভ করেছিল। তাদের সম্পত্তির সঠিক হিসাব জানা যায়নি। তাদের এই গৌরবময় ইতিহাস কলঙ্কিত করে দিয়েছে পলাশীর যুদ্ধে তাদের ভূমিকা। এরপর তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু তবু তাদের কলঙ্কিত ইতিহাসের জন্য আজও তারা ঘৃণিত।