দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশের যাত্রার সঙ্গে ইনকা শাসক আটাহুয়ালপা’র নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রাক-কলম্বিয়ান সাম্রাজ্যের সূচনার পূর্বে ওই অঞ্চলের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের শেষ শাসক ছিলেন তিনি, যা বর্তমান পেরু, চিলি, ইকুয়েডর, বলিভিয়া ও কলম্বিয়া নিয়ে গঠিত। ইতিহাসে তাই তিনি একজন বিশাল ক্ষমতাশালী নেতা হিসেবেই উপস্থাপিত হন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের বলি হয়ে ১৫৩২ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারোর নেতৃত্বে স্পেনীয় বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণ করেন। অথচ স্পেনীয় দলটিতে মাত্র ২০০ জনের মতো সৈনিক ছিল, যারা দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী শাসককে পরাজিত করে বন্দি করতে সক্ষম হয়েছিল। স্পেনীয়দের এই বিজয় দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনেবেশ গড়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। ১৫৩২ সালে বিশাল ইনকা সাম্রাজ্যের এমন অপমানজনক পতনের কারণ জানতে হলে আমাদের আরেকটু পেছনের ইতিহাস জানতে হবে।
১৫২৬ সালের দিকে ইনকা শাসক হুয়েনা কাপাক এক সংক্রামক রোগে ভুগে মারা গিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, স্মলপক্স বা এরকম কোনো রোগে ভুগেই মারা গিয়েছিলেন তিনি। মারা যাওয়ার আগে তিনি নিনান কুয়ুচিও-কে শাসক মনোনীত করে যান। কিন্তু নতুন শাসকও কিছুদিন পর স্মলপক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পরপর দু’জন রাজা মারা যাওয়াতে ইনকাদের শাসনকাজ পরিচালনা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়। যার ফলে হুয়েনার দুই ছেলে নিজেদের ভেতর সাম্রাজ্য ভাগ করে নেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইনকা’রা নিজেদের ভেতর বিয়ের রীতি চালু করেছিল, যাতে বাইরের কেউ শাসন ক্ষমতা দখল করতে না পারে। হুয়েনা কাপাকের সন্তান আটাহুয়ালপা কুইটো থেকে সাম্রাজ্যের উত্তর দিকের নিয়ন্ত্রণ নিলেন, আর তার সৎ ভাই হুয়াস্কার রাজধানী কাসকো থেকে দক্ষিণ শাসন করতে শুরু করে।
তবে সাম্রাজ্য ভাগ করেও দুই ভাই একসময় বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, যার ফলে বাবার মৃত্যু্র পাঁচ বছরের মাথায় ইনকা সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। গৃহযুদ্ধের একপর্যায়ে সৎ ভাই হুয়াস্কার বাহিনী আটাহুয়ালপাকে বন্দি করে, কিন্তু তার অনুচরদের সহযোগিতায় এই যাত্রায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন আটাহুয়ালপা। নিজের বাহিনী জড়ো করে দক্ষিণে রওনা হন তিনি এবং যাত্রাপথে শত্রুদের গণহারে মারতে শুরু করে তার বাহিনী। এভাবে ইনকা শহর কাজামার্কায় পৌঁছালে যাত্রাবিরতি নিতে ক্যাম্প করেন সেখানে। এখান থেকেই হুয়াস্কারের উপর আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করতে বসেন। পরিকল্পনামাফিক কুইপাইনের যুদ্ধে আটাহুয়ালপা সৎ ভাই হুয়াস্কাকে পরাজিত করেন।
যুদ্ধ পরবর্তী সমঝোতায় পৌঁছাতে আটাহুয়ালপা সাম্রাজ্যের সকল বড় নেতাদের কাসকোতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সমঝোতার পরিকল্পনা কখনো আটাহুয়ালপার ছিল না। বরং নিজের ভবিষ্যত শাসনকাজ পরিচালনার পথে কেউ যেন বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে, সেজন্য একে-একে সব নেতাকেই মেরে ফেলেন তিনি।
সাম্রাজ্যের এমন টালমাটাল অবস্থায় স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো পিজারো ইনকায় পা রাখেন। এর প্রায় দেড় বছর পর তিনি কাসকোর দিকে যাত্রা শুরু করেন। মাত্র ২০০ জন সশস্ত্র জনবল নিয়ে ইনকা সাম্রাজ্যের একেবারে ভেতরে যাওয়ার এই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে অনেক সাহসের ব্যাপার ছিল। তবে ফ্রান্সিসকো ইনকাদের ভেতরকার মনোমালিন্য এতদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। স্পেনের রাজার কাছ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল তার। দামি আর দুষ্প্রাপ্য সব জিনিসপত্রের লোভ দেখানো হয়েছিল রাজা চার্লকে। এতেই রাজা গলে গিয়ে ফ্রান্সিসকোর জন্য যাতায়াতের সবরকম ধরনের ব্যবস্থা করে দেন। মাত্র ২০০ জন সৈনিকের বহর যখন ইনকাদের মূল শহরে প্রবেশ করে, তখন রাজা আটাহুয়ালপা নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন। সদ্যই নিজের সাম্রাজ্যের সকল ঝামেলা মিটিয়েছেন তিনি, তাছাড়া যোদ্ধাদের হাতে তখনো শত্রুর রক্ত লেগে ছিল। রাজা তাই ৮০,০০০ সৈন্য নিয়ে ফ্রান্সিসকোর মুখোমুখি হন। মাত্র ২০০ জন সৈনিক দেখে রাজা তাদের হুমকি হিসেবে না দেখে বরং তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
ফ্রান্সিসকো ইনকা রাজাকে একটি ভোজে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান কাজামার্কায়। আটাহুয়ালপা নিজের বাহিনীকে কাসকোয় রেখে মাত্র ৫,০০০ নিরস্ত্র যোদ্ধাসহ কাজামার্কায় রওনা দেন। অপরদিকে স্পেনীয়রা রাজাকে বন্দি করার সবরকম আয়োজন তৈরি করতে বসল। অবশ্য বিনা রক্তপাতে রাজাকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিতে ফ্রান্সিসকো একটা উপায় বের করলেন। আটাহুয়ালপা যখন কাজামার্কায় পা রাখলেন তাকে ভিসেন্তে দে ভালভার্দে নামক এক খ্রিষ্টান ভিক্ষু বরণ করে নিলেন, যাকে ফ্রান্সিসকো দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আটাহুয়ালপার কাছে। রাজাকে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন এবং তাকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেন। আটাহুয়ালপা মনোযোগ দিয়ে খ্রিষ্টান ভিক্ষুর কথা শুনলেন, তবে তিনি ধর্ম বদলানোর এই প্রস্তাব হাসিমুখে ফিরিয়ে দেন। দ্বিতীয় প্রস্তাব হিসেবে ভালভার্দে ইনকা রাজাকে স্পেনের রাজা পঞ্চম চার্লস এর অনুগত হয়ে রাজ্য পরিচালনা করার অনুরোধ জানান। ভালভার্দে তাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন, এতে করে সবারই মঙ্গল হবে। এবার আটাহুয়ালপা রেগে গেলেন এবং তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
তাড়া খেয়ে এসে ভালভার্দে ফ্রান্সিসকোর কাছে রিপোর্ট করলেন। এবার ফ্রান্সিসকো চূড়ান্ত আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেই ২০০ জন সৈনিক ইনকা শহরে প্রবেশ করে এবং অতর্কিত গুলি চালাতে শুরু করে। প্রায় নিরস্ত্র এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় ৫,০০০ ইনকা সৈনিক এক ঘণ্টার ভেতর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অন্যদিকে পাহাড়ের ওপাশে ইনকাদের মূল বাহিনী জানতেই পারল না ওপারে কী ঘটে গেছে এই মাত্র। সবাইকে মেরে ফেললেও আটাহুয়ালপাকে বাঁচিয়ে রাখা হলো পরবর্তীতে কাজে লাগতে পারে ভেবে। কারণ ওপারে অপেক্ষা করা ৮০,০০০ সশস্ত্র ইনকা সৈনিকের মুখোমুখি হতে হলে তাদের রাজাকে দরকার।
এভাবেই মূলত বিশাল এক বাহিনী থাকার পরও ইনকা সাম্রাজ্যের সূর্য ডুবতে শুরু করে। স্পেনীয়দের হাতে বন্দি হওয়ার পরও রাজা আটাহুয়ালপা যথেষ্ট ক্ষমতাশালী ছিলেন। তিনি যখন জানতে পারেন তার সৎ ভাই হুয়াস্কারকে স্পেনীয়রা ইনকার রাজা বানাতে চলেছে, তখন তার বাহিনীকে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন যাতে হুয়াস্কার এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। হুয়াস্কার তখন অন্য এক শহরে আটাহুয়ালপার বন্দি হিসেবে কড়া নিরাপত্তার ভেতর ছিলেন। স্পেনীয়রাও কম যায় না, তারা পুরো ইনকাজুড়ে প্রচার করতে থাকে বন্দি অবস্থায়ও আটাহুয়ালপা রাজার মতো ক্ষমতা ব্যবহার করছে। তার বাহিনীর লোকজন তাকে উদ্ধারের জন্য কাজামার্কা অভিমুখে মার্চ করছে। আদতে এমন কিছুই ঘটেনি বরং স্পেনীয়দেরই ছড়ানো বায়বীয় বিদ্রোহের অভিযোগে ১৫৩৩ সালে আটাহুয়ালপাকে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইনকাদের ভেতর একটা বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, কাউকে যদি পুড়িয়ে মারা হয় তবে তার আত্না পৃথিবীতেই রয়ে যায়। এই ভয় থেকে আটাহুয়ালপা স্পেনীয়দের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি করতে চাইলেন। তাদের বিপুল পরিমাণ সোনা-রূপা উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব দেন আটাহুয়ালপা, বিনিময়ে তার প্রাণভিক্ষা চান ফ্রান্সিসকোর কাছে। কিন্তু তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ফ্রান্সিসকো পিজারো।
নিজেকে পুড়ে মরার হাত থেকে বাঁচাতে এবার আটাহুয়ালপা ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ইনকা রাজা রোমান ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তার নাম হয়ে যায় ফ্রান্সিসকো আটাহুয়ালপা। তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচাতে পারেনি এসব কৌশল, বরং আগুনে পোড়ানো থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। অনেক নাটকীয় অবস্থার পর ২ জুলাই ১৫৩৩ সালে শ্বাসরোগ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ইনকা রাজা আটাহুয়ালপার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর তাকে খ্রিস্টান রীতি মেনে দাফন করা হয়েছিল।
তার মৃত্যুর পর অনুসারীরা তার দেহটি আবার কবর থেকে তুলে নেয় সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। তারা তাদের রীতি মেনে মৃতদেহের সৎকার করে এবং আটাহুয়ালপার দেহকে মমি করে রাখা হয়। এই অবস্থায় উত্তরের কোনো এক গোপন জায়গায় সমাহিত করা হয় তাদের রাজাকে।
আটাহুয়ালপার মুক্তির জন্য যেসব সোনা-রূপা জমানো হয়েছিল সেগুলোর খোঁজ আর কখনো পাওয়া যায়নি। ইতিহাস ঘেঁটে বহু মানুষ পরবর্তীতে ইনকাদের শহরগুলো ঘুরে বেরিয়েছেন গুপ্তধন পাওয়ার আশায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই সফল হতে পারেননি। হয়তো স্পেনীয়দের ছড়ানো অনেকগুলো গুজবের মতো বিপুল পরিমাণ এসব রত্নের আসল রহস্যও লুকানো হয়েছে বাইরের পৃথিবীর কাছে।
আটাহুয়ালপার মৃত্যুর পর তার আরেক ভাই টুপাক হুয়ালপাকে সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু বাস্তবে তিনি পুতুল রাজা ছিলেন এবং কোনো ক্ষমতাও তার হাতে ছিল না। আড়াল থেকে স্পেনীয়রাই ইনকাদের পরিচালনা করছিল। টুপাক হুয়ালপা এই অবস্থায় স্মলপক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরবর্তীতে তার ছেলে টুপাক আমারুকে ক্ষমতায় বসানোর ইচ্ছা থাকলেও তাকে মেরে ফেলে স্পেনীয়রা। এভাবেই পৃথিবীর ইতিহাস থেকে ইনকা যাত্রার আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ইনকা সভ্যতা নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ