প্রুশিয়া থেকে জার্মানি (পর্ব-৪৭): অস্ট্রিয়ার সাথে সংঘাতের সূচনা

১ আগস্ট, ১৮৬৪।

আনুষ্ঠানিকভাবে স্লেশউইগ-হোলস্টেইন চলে এল অস্ট্রিয়ার আর প্রুশিয়ার যৌথ নেতৃত্বে। কিন্তু ভিয়েনা থেকে দুই ডাচিই বহু দূরে, ফলে সেখানে সেনা উপস্থিতি জারি রাখার ইচ্ছা অস্ট্রিয়ার ছিল না। ফলে আগস্টের শেষদিকে অস্ট্রিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেশবাখ শ্যেনব্রুনের এক সম্মেলনে বিসমার্ককে প্রস্তাব দিলেন তারা স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের সম্পূর্ণ দাবি ছেড়ে দেবেন, যদি প্রুশিয়া ইতালি পুনরুদ্ধারে তাদের সাহায্য করে। ফরাসি সহায়তায় ভেনেশিয়া ছাড়া ততদিনে ইতালির একত্রীকরণ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে ইতালিতে হস্তক্ষেপ করলে তৃতীয় নেপোলিয়ন স্বভাবতই বিরক্ত হবেন। বিসমার্কের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এই মুহূর্তে ফ্রান্সের সাথে সংঘাতে জড়াবার। ফলে নানা ছলছুতোয় উইলিয়াম এবং বিসমার্ক প্রস্তাব এড়িয়ে যান। তাদের মনোভাব বুঝে রেশবাখও আর চাপাচাপি করলেন না।  

গ্যাস্টেন কনভেনশন

শ্যেনব্রুনের পর সেই বছরেই অস্ট্রিয়া স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের ব্যাপারে দুটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করল। দুই ডাচি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যার ক্ষমতা নেবে অগাস্টেনবার্গ পরিবার। অথবা সিলিসিয়ার সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা প্রুশিয়া দুই ডাচির বিপরীতে অস্ট্রিয়ার সাথে বিনিময় করতে পারে। স্বাধীন স্লেশউইগ-হোলস্টেইন ভুলেও প্রুশিয়ার কাম্য ছিল না, আর সিলিসিয়ার মতো সমৃদ্ধ অঞ্চলের কিয়দংশও অস্ট্রিয়াকে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

বিসমার্ক দুই প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সাথে তিনি স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের প্রুশিয়ার বিশেষ অধিকারের দাবি জানান। ১৮৬৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি জানিয়ে দেন দুই ডাচির সম্মিলনে স্বতন্ত্র জার্মান রাষ্ট্র প্রুশিয়ার স্বার্থের বিপরীত, এবং এরকম কিছু হলেও তারা থাকবে প্রুশিয়ার অধীনেই। সেখানকার সেনাবাহিনীকে প্রুশিয়ার রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হবে। কার্যত এতে স্লেশউইগ-হোলস্টেইন প্রুশিয়ার একটি প্রদেশে বৈ আর কিছু হবে না।

কথার পাশাপাশি কাজেও দুই ডাচিতে অস্ট্রিয়ার নিস্ক্রিয়তার সুযোগে বিসমার্ক ক্রমেই প্রুশিয়ান প্রভাব বাড়াতে থাকেন। মাসখানেকের মাথায় প্রুশিয়া ডাচির প্রধান শহর কিয়েলে নৌঘাঁটি স্থাপন করলে যুদ্ধের আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দেয়। অস্ট্রিয়া গেল ক্ষেপে। তারা জানত না বিসমার্কের জার্মান একত্রীকরণের মাস্টারপ্ল্যানের দ্বিতীয় অংশ হলো জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়াকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া। তাদের যুদ্ধে প্ররোচিত করবার জন্যই তিনি চাল দিচ্ছেন।

অস্ট্রিয়া বিসমার্কের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে কনফেডারেট ডায়েটে প্রুশিয়ার বিপক্ষে অভিযোগ দায়ের করে, সেই সাথে অগাস্টেনবার্গ পরিবারকে স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের শাসনক্ষমতায় বসানোর কথা পুনরায় উত্থাপন করল। এদিকে ১৮৬৫ সালের মে মাসে প্রুশিয়াতে এক গোপন সভায় রাজা এবং জেনারেল মল্টকে যেকোনো উপায়ে স্লেশউইগ-হোলস্টেইনকে প্রুশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার মত দেন, কিন্তু রাজপুত্র ফ্রেডেরিক এজন্য অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধের জোর বিরোধিতা করেন। বিসমার্ক তখনও হাতের তাস মেলে ধরলেন না। তিনি প্রস্তাব করলেন অস্ট্রিয়াকে চাপে রেখে ইউরোপে তার বিরুদ্ধে মিত্র সন্ধান করবার।

বিসমার্ক এরপর স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের প্রশাসনিক বিষয়ে প্রচুর অভিযোগ করতে থাকেন ভিয়েনাতে।অগাস্টেনবার্গদের বিপক্ষে লিবারেলদের সাথে ষড়যন্ত্রের কথা বলে তাদের ডাচি থেকে নির্বাসন দেবার দাবি জানান। ইউরোপেও তিনি ফ্রান্স আর ইতালির সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন। অস্ট্রিয়া তখন বেকায়দায়, সবেমাত্র তাদের সরকার পরিবর্তন হয়েছে। রেশবাখের জায়গায় এসেছেন মেন্সডোর্ফ। হাঙ্গেরিয়ানরাও স্বাধীনতার দাবিতে কলরব করছে।

পরিস্থিতি ক্রমেই বিষিয়ে উঠতে থাকলে অস্ট্রিয়ান সম্রাট ফ্রাঞ্জ জোসেফ সরাসরি উইলিয়ামের শরণাপন্ন হন। ১৮৬৫ সালের ১৪ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় গ্যাস্টেন কনভেনশন। বিসমার্কের রূপরেখা অনুযায়ী দুই ডাচিতে অস্ট্রিয়া এবং প্রুশিয়ার যৌথ অধিকার স্বীকৃত হলো। তবে প্রশাসনিক সুবিধার্থে স্লেশউইগ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় প্রুশিয়া আর হোলস্টেইনের দায়িত্ব নিল অস্ট্রিয়া। ল্যুনবার্গ শহর, যা ডেনমার্কের ডাচির সাথে সাথে হস্তগত হয়েছিল, তা-ও প্রুশিয়া অর্থের বিনিময়ে (২.৫ মিলিয়ন থেলার/ প্রায় ১.৮ মিলিয়ন ডলার) কিনে নেয় অস্ট্রিয়ার থেকে। বিসমার্ক ভাল করেই জানতেন এই ব্যবস্থা সাময়িক, অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই। খুব শিগগির তারাও সেটা বুঝতে পারবে।

অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রাঞ্জ জোসেফ © Encyclopedia Britannica

কাস্টমস ইউনিয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব

দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধের পরে অস্ট্রিয়ার ধারণা হয়েছিল প্রুশিয়া তাদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তারা নতুন করে মিটেলইউরোপা পরিকল্পনা মোতাবেক জার্মান কাস্টমস ইউনিয়নে অস্ট্রিয়ার অন্তর্ভুক্তির দাবি তোলে। রেশবাখ জানতেন কাস্টমস ইউনিয়নের চুক্তির মেয়াদ ১৮৬৫ সালে শেষ, পুনরায় চুক্তির জন্য প্রুশিয়ার ছোট ছোট জার্মান রাষ্ট্রগুলির সমর্থন দরকার হবে। এরা আবার অস্ট্রিয়ার দিকে ঝুঁকে আছে। 

বিসমার্ক অনেক আগেই অস্ট্রিয়ার খেলা আঁচ করেছিলেন। তাই ১৮৬৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ঘোষণা দিয়ে দেন কাস্টমস ইউনিয়নের/জলভেরিনের (zollverein) চুক্তি নবায়ন হবে পরের বছর। ফলে জার্মান রাষ্ট্রগুলো দ্বিধায় পড়ে গেল, চুক্তি কি ১৮৬৪ সাল শেষ না ১৮৬৫ সালে? এভাব তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে বিসমার্ক ১৮৬৪ সালের মে মাসে দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধের মধ্যেই স্যাক্সোনির সাথে বাণিজ্যচুক্তি করেন। এই ঘটনা এবং যুদ্ধের ফলাফল প্রুশিয়ার অনুকূলে দেখে ছোট ছোট জার্মান দেশগুলোর বুঝতে বাকি রইল না হাওয়া কোনদিকে বইছে। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে তারা যদিও অস্ট্রিয়ার নিকটবর্তী, কিন্তু অর্থনীতি হচ্ছে তাদের টিকে থাকার চালিকাশক্তি। ফলে ১৮৬৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়াকে বাইরে রেখেই কাস্টমস ইউনিয়নের চুক্তি নবায়ন হয়। 

জার্মান কাস্টমস ইউনিয়ন/জলভেরিনের ক্রমবিবর্তন© Encyclopedia Britannica

বারুদে আগুন

গ্যাস্টেন কনভেনশন জার্মানদের প্রচন্ডভাবে আশাহত করে। জার্মান ডায়েটেও অগাস্টেনবার্গের সমর্থকেরা রুষ্ট হল। একে তারা অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে প্রুশিয়ার বিজয় বলেই গণ্য করল। তাদের মনে হচ্ছিল অস্ট্রিয়া জার্মানি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। বিসমার্ক জানতেন কয়েকদিন পরেই জার্মানিতে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি নজর দিলেন ইউরোপে। ফ্রান্সে এসে তিনি তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে দেখা করেন। ফরাসি সম্রাট ভয় পাচ্ছিলেন তাকে অন্ধকারে রেখে অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়া তলে তলে গাঁটছড়া বেধেছে। বিসমার্ক তাকে আশ্বস্ত করেন।

তৃতীয় নেপোলিয়ন এবং বিসমার্ক; image source: akg-images.co.uk

বার্লিনে ফিরে এসে অস্ট্রিয়াকে বিরক্ত করতে বিসমার্ক আগের মতোই প্রশাসনিক ব্যাপারে অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেন। দুই ডাচিতে অগাস্টেনবার্গের অধিকারের ব্যাপারে অস্ট্রিয়ার অনুকূল মনোভাব তিনি কাজে লাগান। বিসমার্ক ভিয়েনাকে গ্যাস্টেন কনভেনশন লঙ্ঘন করে অগাস্টেনবার্গকে মদদ দেবার অভিযোগ উত্থাপন করেন। ১৮৬৬ সালের জানুয়ারিতে হোলস্টেইনে অগাস্টেনবার্গের একদল সমর্থক অস্ট্রিয়ান গভর্নরের অনুমতিতে সভার আয়োজন করলে প্রুশিয়া কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করল। উইলিয়াম আবারও কঠোর নীতি গ্রহণের পক্ষে সমর্থন দিলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি বার্লিনে অনুষ্ঠিত হল রাজকীয় সভা। বিসমার্ক সেখানে মত দিলেন যে জার্মান একীভূতকরণ এবং নেতৃত্বগ্রহণ প্রুশিয়ার জন্মগত অধিকার, অস্ট্রিয়া এখানে অন্যায্যভাবে বাগড়া দিচ্ছে। একমাত্র রাজপুত্র ফ্রেডেরিক ছাড়া আর সবাই এবার সরাসরি অস্ট্রিয়ার সাথে লড়াইয়ের পক্ষে মত দিল।

বিসমার্ক মিত্রের জন্য ইতালির দিকে তাকালেন। তারা ততদিনে বুঝতে পেরেছিল অস্ট্রিয়া এমনি এমনি তাদের হাতে ভেনেশিয়া তুলে দেবে না। ফলে প্রুশিয়ার সাথে একটি স্বল্পমেয়াদী সামরিক জোটের ব্যাপারে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে। ইতালিয়ান জেনারেল গ্যাভোন এই উদ্দেশ্যে বার্লিনে এসে পৌঁছালে বিসমার্কের কাজ সহজ হয়ে যায়। ফ্রান্সের ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন এবং প্রুশিয়াতে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বেনেডেটকে সব খবারখবর জানাচ্ছিলেন। তৃতীয় নেপোলিয়ন তার কাছ থেকে সমস্ত সংবাদ পেয়ে ইতালিয়ানদের প্রুশিয়ার অনুকূলে পরামর্শ দিলে ১৮৬৬ সালের এপ্রিলের ৮ তারিখ গ্যাভোন ইতালির পক্ষে প্রুশিয়ার সাথে চুক্তি সই করেন। শর্ত ছিল তিন মাসের মধ্যে যদি প্রুশিয়া অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে ইতালিও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। বিসমার্ক আর জেনারেল মল্টকের পরিকল্পনা ছিল এর ফলে অস্ট্রিয়ান সামরিক শক্তি দু’দিকে ভাগ হয়ে যাবে।

কিংডম অফ ইতালি © Encyclopedia Britannica

শঙ্কিত অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের দিকে হাত বাড়ায়। জুনের ১২ তারিখ ফ্রান্সের সাথে গোপনে সম্পাদিত চুক্তিতে অস্ট্রিয়ান বিজয়ের বিপরীতে ভেনেশিয়া ইতালির কাছে সমর্পণের কথা হয়। এছাড়া অস্ট্রিয়া, বাভারিয়া, স্যাক্সোনি আর ভুর্তেমবার্গ বিজিত অঞ্চল ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার কথা ছিল। তৃতীয় নেপোলিয়নের চাওয়া অনুযায়ী রাইনের তীর জুড়ে প্রথম নেপোলিয়নের সময়ের মতো ফরাসিপন্থি একটি জার্মান কনফেডারেশন গঠনের ব্যাপারেও অস্ট্রিয়া সম্মতি দেয়। ফলে নেপোলিয়ন নিরপেক্ষ থাকবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইতোমধ্যে বিসমার্কও তার সাথে যোগাযোগ করেছেন, এবং তিনিও নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার আদায় করে নিয়েছেন।

অস্ট্রো-প্রুশিয়ান সংঘাতে অস্ট্রিয়াই বিজয়ী হবে বলে নেপোলিয়ন নিশ্চিত ছিলেন। তবে কে জিতবে তা নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। যে-ই জিতুক না কেন এই সংঘাত দীর্ঘ হবে এবং ফ্রান্সই শেষ পর্যন্ত লাভের গুড় খাবে বলে তার বিশ্বাস। এদিকে বিসমার্ক রাশিয়ার সাথেও যোগাযোগ করেন। ক্রিমিয়ান যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার ভূমিকায় হাবসবুর্গরা তাদের চক্ষুশূল। ফলে সানন্দে তারা নিরপেক্ষ থাকতে সম্মত হয়। বিসমার্ক হাঙ্গেরিয়ান বিদ্রোহীদের সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন, তবে সেদিক থেকে অনুকূল সাড়া পাননি।

অভ্যন্তরীণ দিকে জনগণের সমর্থন আদায়েও বিসমার্ক সচেষ্ট হন। তখন অবধি জার্মানিতে সকলের ভোটাধিকার ছিল না। প্রুশিয়াতে যেরকম সামাজিক শ্রেণীর ভিত্তিতে নির্বাচন হত, সেরকম ব্যবস্থাই কার্যকর ছিল ফেডারেল ডায়েটের জন্য। বিসমার্ক জানতেন লিবারেলরা এবং সাধারণ মানুষ কনফেডারেশনের সংস্কার চায়, চায় ভোট দেবার সুযোগ। ফলে ইতালির সাথে চুক্তির একদিন পরেই তিনি সকল জার্মান পুরুষের সরাসরি ভোটে ডায়েটে সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাব করেন। তিনি খুব ভাল করে জানতেন এই প্রস্তাব ধোপে টিকবে না। তার লক্ষ্য ছিল ডায়েটকে ব্যস্ত রাখা। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি জার্মান জনগণকে বোঝাতে পারবেন প্রুশিয়া তাদের ভালর জন্যই কাজ করছে, কিন্তু অস্ট্রিয়ার চাপে অন্যান্য জার্মান রাষ্ট্রগুলো তাদের বিপক্ষে। তবে বিসমার্কের এই কাজ খুব একটা সফল হয়নি। জার্মান জনগণ, বিশেষ করে ছোট রাষ্ট্রগুলো প্রুশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। বাইরে থেকে রাশিয়া, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডও নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।

প্রুশিয়ার সাথে চুক্তির পরপরেই ইতালি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ফলে ২১ এপ্রিল অস্ট্রিয়া সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। প্রুশিয়ার প্রতিবেশী অস্ট্রিয়ান অধীনস্থ বোহেমিয়া ছিল অরক্ষিত, এখানে প্রচুর অস্ট্রিয়ান সেনা প্রবেশ করল। ইতালির সাথে সীমান্তেও তারা সেনা পাঠায়। ইটালিয়ান সংসদে অবিলম্বে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে। ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে তারা জানিয়ে দেয় দেশ রক্ষায় ইতালি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে বিসমার্ক আরেকটু সময় চাচ্ছিলেন। তার দিক থেকে নিস্ক্রিয়তা দেখে ইতালিয়ানরা প্রশ্ন তুললে তিনি জানান প্রুশিয়া সম্পাদিত চুক্তি মেনে চলবে।

ইংল্যান্ড মধ্যস্থতার চেষ্টা করল। তাদের তরফ থেকে লর্ড কাউলি একটি সম্মেলনের প্রস্তাব নিয়ে ফরাসি সম্রাটের সাথে দেখা করেন। তবে এর আগে ১৮৬৪ সালে স্লেশউইগ-হোলস্টেইন নিয়ে ফরাসি সম্মেলনের চেষ্টা ইংল্যান্ডের অনিচ্ছুক মনোভাবে নাকচ হয়ে গিয়েছিল, কাজেই নেপোলিয়ন একটু বিরক্তই হলেন। ইংল্যান্ডের অনিচ্ছুক মনোভাবের কারণ ছিল। রানী ভিক্টোরিয়ার মেয়ে প্রুশিয়ার যুবরাজ ফ্রেডেরিকের সহধর্মিণী, আবার ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স অফ ওয়েলসের স্ত্রী ছিল ড্যানিশ রাজকন্যা।

মে মাসের ৫ তারিখ নেপোলিয়ন ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠান। প্রস্তাব দেন প্রুশিয়ার পক্ষ ত্যাগের বিনিময়ে অস্ট্রিয়া ভেনেশিয়া তুলে দেবে ফ্রান্সের হাতে, ফ্রান্স তখন তা আবার ইতালিকে দিয়ে দেবে। তার মতিগতি বিসমার্ককে ভাবনায় ফেলে দিল। তবে এই প্রস্তাবে ইটালিয়ানদের আঁতে ঘা লাগল। তারা লড়াই করে ভেনেশিয়া নিতে চায়, কাপুরুষের মতো এভাবে পেছনদিকে দিয়ে নয়। ফলে তারা নেপোলিয়নকে ফিরিয়ে দেয়। বিসমার্ক ইতালিয়ানদের পক্ষ ত্যাগের চিন্তায় ইতোমধ্যে রাজার অনুমতিতে প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর একাংশ সেদিকে প্রেরণ করেছেন।

গ্যাব্লেঞ্জ মিশন

জার্মানদের চোখে অস্ত্রিয়া-প্রুশিয়া সংঘাত ভ্রাতৃঘাতি লড়াই। শেষ চেষ্টা হিসেবে দুই ভাই অ্যান্টন আর লুদ্ভিগ গ্যাব্লেঞ্জ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অ্যান্টন ডায়েটে প্রুশিয়ার ডেপুটি, আর লুদ্ভিগ অস্ট্রিয়ান সেনা কর্মকর্তা এবং হোলস্টেইনের বর্তমান গভর্নর। তাদের রূপরেখায় প্রুশিয়ার অধীনে স্লেশউইগ-হোলস্টেইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মেইন নদী বরাবর জার্মান সামরিক কম্যান্ড ভাগ হবে প্রুশিয়া আর অস্ট্রিয়ার মধ্যে। ভিয়েনা নীতিগতভাবে এই প্ল্যান মেনে নেয়, যদি প্রুশিয়া ইতালির বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে সেনা সহায়তা দেয়। বিসমার্ক পাল্টা প্রস্তাব দিলেন। প্রুশিয়ার রাজাকে জার্মান ফেডারেল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রিয়ার থেকে বেশি ক্ষমতা দিতে হবে। অস্ট্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই রাজি হলো না এবং ২৮ মে, ১৮৬৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাব্লেঞ্জ ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো।

গ্যাব্লেঞ্জ ভাইদের একজন, লুদ্ভিগ ভন গ্যাব্লেঞ্জ; image source: discorsi.at

জার্মান ডায়েটের অবসান

১৮৬৬ সাল। মে মাসের ৯ তারিখ।

সম্মিলিত জার্মান ডায়েটে প্রুশিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রিয়ার সাথে জোট বেধেছে বেশিরভাগ রাষ্ট্রই। প্রুশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতির উপযুক্ত কারণ জানতে তারা বিধি জারি করে। জুনের ১ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রিয়া স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের উপর থেকে তাদের অধিকার জার্মান ডায়েটের কাছে হস্তান্তর করে। ৯ তারিখ প্রুশিয়ান সেনারা ঢুকে পড়ে হোলস্টেইনে। কিন্তু অস্ট্রিয়ানরা সেখানে নেই, তারা হ্যানোভারে সরে গেছে। দু’দিন পর জার্মান ডায়েটে অস্ট্রিয়ার প্রতিনিধি হোলস্টেইনে অবৈধ দখলদারিত্বের জন্য প্রুশিয়াকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে তাদের বিরুদ্ধে জার্মান কনফেডারেট বাহিনী নামানোর আহবান করলেন। ১৪ জুন ডায়েটের সর্বশেষ সভায় ৯-৫ ভোটে অস্ট্রিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিবাদে প্রুশিয়ান দূত ওয়াকআউট করলেন। তিনি শাসিয়ে দিলেন জার্মান ডায়েট এখন থেকে প্রুশিয়ার কাছে মৃত। পরদিন প্রুশিয়া হ্যানোভার, স্যাক্সোনি আর হেসে-কেসেলের কাছে হুঁশিয়ারি পাঠাল অস্ট্রিয়ার সাথে যোগ না দিতে। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে অস্ট্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৫ জুন প্রুশিয়া আর ২০ জুন ইতালি অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধের ডাক দিল। প্রুশিয়ার সেনারা অগ্রসর হলো বোহেমিয়ার দিকে।

This is a Bengali language article about the rise and eventual downfall of Prussia and how it led to a unified Germany. Necessary references are mentioned below.

References

  1. Clark, C. M. (2007). Iron kingdom: The rise and downfall of Prussia, 1600-1947. London: Penguin Books.
  2. Abbott, J. S. C. (1882). The history of Prussia. New York, Dodd, Mead, and company.
  3. Kent, George O. (1978). Bismarck and His Times. Southern Illinois University Press.

Feature image: reddit.com

Related Articles

Exit mobile version