গ্যলিলিও, ব্রুনো, ওয়েগনারের মতো আমাদের বাংলায়ও একজন ছিলেন যিনি গতানুগতিক সামাজিক ধারা থেকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতেন এবং আধুনিক মনন নিয়ে জন্মেছিলেন। সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি এবং সেই লক্ষেই আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই ব্যক্তিটি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন রায়ের কাজের কিছু দৃষ্টান্ত আমার আগের দুটো লেখায় বিশদভাবে পাওয়া যাবে। বাংলার মানুষ সংস্কৃতের পাশাপাশি ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষায়ও শিক্ষিত হয়েছে। তারা নিজেদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনেছে, যুগে যুগে বাংলার মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে এসেছে। গতানুগতিক ধারার বাইরে চিন্তা করা মানুষদের আবির্ভাব ঘটেছে, সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে।
রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তিনি নতুনকে আঁকড়ে ধরতে শিখিয়েছিলেন। সেজন্য যে সময় কেউ পরিবর্তনের কথা ভাবতেও পারতো না তিনি সেই সময়ে সমাজে পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের আধুনিক সমাজ কতটুকু সার্থক তার বদলে দেওয়া সামাজিক রীতিকে ধরে রাখতে? আমরা কি রামমোহন রায় যেমন সমাজ চেয়েছিলেন ঠিক তেমন সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি? রামমোহন রায় যদি আজকে বেঁচে থাকতেন তাহলে কি তিনি বাংলার মানুষদের মাঝের পরিবর্তন দেখে খুশি হতেন নাকি কষ্ট পেতেন? আজকে এই বিষয় নিয়েই আমাদের আলোচনা।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে একটি আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বে যে বড় ধরনের পরিবর্তনের শুরু হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ’দ্রুতগতি’তে এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পরিবর্তন ঘটেছে অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে। ‘দ্রুতগতি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ তখন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছিলো খুব দ্রুত। বিভিন্ন দেশ শিল্প-কারখানা তৈরির দিকে ঝুঁকেছিল। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ তখন সমাজে প্রযুক্তির যে পরিবর্তন ঘটেছিল তার কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছিলো, যেগুলো এখনও পর্যন্ত সমাজে বিরাজমান।
এরপর বিংশ শতাব্দীতে সমাজ ব্যবস্থায় এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে যেগুলো এর আগে শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানে পাওয়া যেতো। বিমান, গাড়ি, রকেট, টেলিফোন, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তির নতুন নতুন পথ আবিষ্কার, হালের দ্রুতগতির ইন্টারনেট ইত্যাদি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। মানুষ এতসব পরিবর্তন এনেছে শুধুমাত্র জীবনযাত্রাকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন এসব সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে। তিনি তার জীবনের প্রায় পুরোটাই সমাজ পরিবর্তনের পেছনে ব্যয় করেছেন।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে ইংরেজি ভাষার অপরিহার্যতা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে। রামমোহন রায়ও এমনটিই চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, পশ্চিমে নতুন নতুন যা কিছু তৈরি হচ্ছে সেগুলো বোঝার জন্য ইংরেজি ভাষা শিক্ষার বিকল্প নেই। তার সেই চেষ্টা এখন সফল। যদি এখন তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে বাংলাদেশ ইংরেজদের শাসনমুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও যে এই ভাষা তার নিজস্ব জায়গা বজায় রাখবে- সেটা দেখলে হয়তো তিনি অবাক হতেন। আবার ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে নিজ দেশের ভাষা যে হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সেটা দেখলে অবশ্যই তিনি কষ্ট পেতেন।
কারণ এমনটি তিনি নিশ্চয় চাননি। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণার প্রচলন চলে এসেছে যে, নিজ ভাষাটি না জানলে সমস্যা নেই, কিন্তু ইংরেজিটা অবশ্যই জানতে হবে। রাজা রামমোহন রায় যেহেতু একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন সেহেতু এরকম প্রচলন এবং রীতি তার পছন্দ না-ও হতে পারতো। এরকমটি অনুমান করছি, কারণ হিন্দু কলেজ বা সংস্কৃত কলেজ তৈরির সময় তিনি ইংরেজি সহ আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনার উপর জোর দিলেও বাংলা কিংবা সংস্কৃত ভাষাকে ফেলে দেননি।
যেহেতু পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশীরভাগ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়, সেহেতু আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা উন্নত শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কিংবা মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার না দেয়াটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করতেন, এমনকি জাতি-বিদ্বেষও তিনি পছন্দ করতেন না। আজীবন এগুলোর বিরোধিতা করে এসেছেন এবং সতীদাহ প্রথাকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছেন। এখন আর সতীদাহ প্রথা দেখা যায় না। কিন্তু জাতিগত বৈষম্য কতটুকু দূর হয়েছে সমাজ থেকে- আমরা কি তা ভেবে দেখেছি? সতীদাহ প্রথার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তখনকার সমাজ থেকে বিধবা উচ্ছেদ করা। তখনকার সমাজে বিধবা হওয়াটা ছিল পাপ। অথচ ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েদেরকে কিন্তু বুড়ো বুড়ো মানুষদের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো, আর সেই বুড়ো মানুষগুলো বিয়ের কিছুদিন পরেই হয়তো মৃত্যুবরণ করতো। তখন সেই বাচ্চা মেয়েগুলো, যাদের একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে ছিল, তাদেরকে তখনকার সমাজের নিয়ম অনুসারে স্বামীর দগ্ধ হওয়ার সাথে সাথে নিজেকেও পুড়ে মরতে হতো। এটা কেমন বর্বরতা? রামমোহন রায় এই প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতেন।
তিনি এখন বেঁচে থাকলে হয়তো খুশি হতেন যে সমাজের অন্যান্য মানুষ তার চিন্তাধারাকে আপন করে নিয়েছে। এখন আর এসব প্রথা নেই। কিন্তু ‘যৌতুক’ নামক যে একটি প্রথা মানুষ নিজেরাই শুরু করেছে সেটা দেখলে তিনি কী ভাবতেন? ভারতীয় উপমহাদেশে এখনও বিভিন্ন জায়গায় এই প্রথার প্রচলন আছে। এমনকি শহরের বড় বড় শিক্ষিত মানুষদের ভিতরেও এই যৌতুক নিতে দেখা যায়। যৌতুক দিতে না পারলে হয় বিয়ে ভেঙ্গে যায়, আর যদি বিয়ে হয়ও তাহলে বিয়ের পর সেই মেয়ের উপর করা হয় অত্যাচার এবং জুলুম। এমনকি অনেক সময় অত্যাচারের কারণে সেসব মেয়েকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে দেখা যায়। একটি শিক্ষিত সমাজ, একটি শিক্ষিত পরিবারের মানুষজন কীভাবে এরকম আচরণ করতে পারে? রাজা রামমোহন রায় যেমন মানুষ ছিলেন, তাতে আমরা হলফ করে বলতে পারি তিনি এসব দেখে কষ্ট পেতেন। কারণ এমন সমাজ তিনি চাননি যেখানে শিক্ষিত সমাজ এবং পরিবারের মধ্যেও বর্বর আচরণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। এমন নয় যে সবাই একরকম। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের এমন আচরণের জন্য পুরো একটা জাতির নাম খারাপ হয়। আগেও এমনটি হয়েছে।
জাতিগত যে বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে সমাজে কি এখনও তা দেখা যায় না? অনেক পরিবার থেকে ইচ্ছা করে মেয়েদের, এমনকি ছেলেদেরকেও স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে দেয়া হয় না। ফলে বড় হয়ে তাদেরকে ছোট (!) কাজ করে নিজের জীবন চালাতে হয়। সমাজের যারা শিক্ষিত মানুষ তাদের মধ্যে অনেকেই এসব মানুষদের দেখতে পারে না, এমনকি তাদের কাছেও ঘেঁষতে চায় না। এমন ভাব তারা করে যেন সেই মানুষগুলো অচ্ছুৎ।
একজন কৃষক কৃষি কাজ করে আমাদের জন্য ফসল ফলাচ্ছে, একজন গার্মেন্টসের কর্মী আমাদের জন্য পোশাক তৈরি করছে, একজন রিকশাচালক আমাদেরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় রিকশা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, একজন ঝাড়ুদার রাস্তার ময়লা একপাশে সরিয়ে রাখছে যাতে আমাদের পরিবেশ সুন্দর থাকে। এই যে এসব মানুষ নিজেদের শরীর খাটিয়ে কাজ করছে এরা কি মানুষ নয়? আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের লোকেরা কাউকে গালি দেয়ার সময় কিংবা বকা দেয়ার সময় এসব মানুষকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনে। এমনকি এমনও বলতে শোনা যায় যে কাজ না করলে বা পড়াশোনা না করলে সেসব মানুষের মতো হতে হবে। কেন? যারা এরকম কাজ করে তারা কি মানুষ নয়? শিক্ষিত (!) সমাজে বসবাসরত মানুষদের এমন আচরণের মধ্যে কি জাতিগত বৈষম্য ফুটে উঠে না? রাজা রামমোহন রায় কি এমন সমাজই চেয়েছিলেন?
একজন মানুষ নিজের শরীর থেকে ঘাম ঝরিয়ে কিংবা নিজের মাতগা কাজে লাগিয়ে যদি একটা পয়সাও উপার্জন করে তাহলে সে সম্মানের যোগ্য। কারণ সে কাজ করে খাচ্ছে। শিক্ষিত এবং পয়সাওয়ালা পরিবারের বেকার সন্তান, যারা বাবার টাকায় খাচ্ছে আর পড়ছে, তাদের থেকে কোটি কোটি গুণ সম্মানের পাত্র এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো। রাজা রামমোহন রায় যদি আজকে বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো ভাবতেন যে তিনি সমাজকে শিক্ষিত এবং সমাজের পরিবর্তন করতে পেরেছেন ঠিকই, কিন্তু সমাজের মানুষগুলো একে অপরের থেকে দূরে চলে গিয়েছে।
তথ্যসূত্র
[১] Jayant Narlikar (2003) The Scientific Edge, Penguin Books
[২] রাজর্ষি রামমোহন- জীবনী ও রচনা – অনিলচন্দ্র ঘোষ
ফিচার ইমেজ সোর্স: Wikimedia commons