সুপ্রিয় পাঠক, আমরা এখন ইতিহাস ও ইতিহাসতত্ত্ব সিরিজের তৃতীয় এবং সর্বশেষ পর্বে এসে পৌঁছেছি। ইতোপূর্বে প্রথম পর্বে ইতিহাস, ইতিহাসতত্ত্ব, এর প্রকারভেদ এবং প্রাক-গ্রিক ইতিহাসতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এবং দ্বিতীয় পর্বে এসেছে গ্রিক ইতিহাসতত্ত্ব এবং মধ্যযুগীয় ইতিহাসতত্ত্ব। এই পর্বে রেনেসাঁ যুগের ইতিহাসতত্ত্ব এবং আধুনিক ইতিহাসতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে। ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা-গবেষণা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ সেটাও এ পর্বের শেষভাগে সংক্ষেপে আলোচিত হবে।
রেনেসাঁ পর্ব
ইতিহাসতত্ত্বের এ পর্বটি মধ্যযুগের ঠিক পরপরই শুরু হয়। এই পর্বে বিভিন্ন মহাদেশ, উপমহাদেশ আবিষ্কৃত হতে থাকে। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। এ পর্বে মধ্যযুগের ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে ইতিহাসতত্ত্ব পরিত্রাণ লাভ করে। এ পর্বের ঐতিহাসিকগণ স্বাদেশিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করেন।
এ পর্বে ইতিহাসে ধর্ম বিষয়ে প্রাধান্য নির্ধারণ থেমে গেল, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সূক্ষ্ম পাণ্ডিত্যপূর্ণ চিন্তন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলো। ঈশ্বরের সৃষ্টি পরিকল্পনার তুলনায় মানুষের কার্যাবলি তখন আর কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হলো না। বুদ্ধিমত্তা দ্বারা মানুষের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ ও ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত মধ্যযুগীয় দর্শন পরিবর্তিত হয়ে মানুষ এখন আবেগ ও ভাবোচ্ছ্বাসসম্পন্ন একটি উৎকৃষ্ট সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হলো। ইতিহাস এখন মানুষের আবেগের এবং মানব প্রকৃতির অত্যাবশ্যক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পরিগণিত হলো।
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজ দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর জ্ঞানের মানচিত্রকে কাব্য, ইতিহাস, দর্শন এই তিনটি বড় পরিসরে বিভাজন করেন। তিনি এসবের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কল্পনা (imagination), স্মৃতিশক্তি (memory), আয়ত্তকরণ (understanding) এর ভূমিকার উল্লেখের মাধ্যমে রেনেসাঁ পর্বের চিন্তন জগতের উৎকর্ষের এক সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এ মতে, রেনেসাঁ পর্ব ইতিহাস হলো অতীতে আগ্রহ, ঐতিহাসিকগণ ভবিষ্যৎ অনুধাবন করতে পারেন এবং তার মূল কাজ হলো ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির মহাপরিকল্পনা আবিস্কার করা- এ জাতীয় মধ্যযুগীয় ইতিহাস ধারণাকে নাকচ করে দেয়। তবে উল্লেখ্য, অতীতকে পুনঃআবিষ্কার করা রেনেসাঁ ঐতিহাসিকদের মূল উদ্দেশ্য হলেও কোন পদ্ধতিতে তা করতে হবে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা তারা প্রণয়ন করেননি। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এ পর্বের ইতিহাসচর্চাকে দ্রুত সম্প্রসারিত করে।
এ যুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইতালীয় পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দ) প্রণিধানযোগ্য। এছাড়াও লিওনার্দো ব্রুনি (১৩৭০-১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ), ফাভিও বিয়োন্ডো (১৩৯২-১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দ), লরেঞ্জো ভাল্লা (১৪০৭-১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দ), নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ); জার্মানির জোহান্স টুমার বা এডেন্টিনাস (১৪৭৭-১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ), সেমুয়েল ফন পুফেন্ডর্ফ (১৬৩২-১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ); হল্যান্ডের হুগো গ্রোসিয়াস (১৫৮৩-১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ); ইংল্যান্ডের পলিডোর ভার্জিল (১৪৭০-১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ), স্যার টমাস মুর (১৪৭৭-১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ), স্যার ওয়াল্টার বেলি (১৫৫২-১৬১৮ খ্রিস্টাব্দ), বিশপ গিলবার্ট বার্নেঢ (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রিস্টাব্দ); ফ্রান্সের জিন বোদিন (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ), জেকুইস্ট অগাস্ট দ্য থু বা থুয়েনাস (১৫৫৫-১৬১৭ খ্রিস্টাব্দ), জন ফকস (১৫১৬-১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক ইতিহাসতত্ত্ব
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের দার্শনিক দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) এর মতে ইতিহাস মজাদার, এবং শিক্ষাদানমূলক ও মানুষের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে মূল্যবান- এমন কিছু হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না। কারণ, কোনো ঘটনার বর্ণনা ইতিহাস যেভাবে দেয়, ঘটনাটি ঠিক সেভাবে ঘটেনি। এজন্য তিনি চারটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন:
১) ঐতিহাসিক দূরত্ব বা পলায়নপরতা (Historical escapism)
২) ঐতিহাসিক সন্দেহবাদিতা (Historical pyrrhonism)
৩) ইতিহাসের উপযোগবাদ বিরোধিতা এবং
৪) অভিলাষপ্রসূত ইতিহাস রচনা
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে আরেক শ্রেণীর ইতিহাসচর্চার আবির্ভাব ঘটে, যার নাম কার্তেসিয় ইতিহাসতত্ত্ব (Cartesian Historiography)। এ ইতিহাসতত্ত্ব পদ্ধতিগত সংশয়বাদ এবং সমালোচনামূলক নীতির সুস্পষ্ট স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যুক্তিবাদ (rationalism) এ তত্ত্বের মূল বিষয়। দেকার্তে যুক্তি দেখান, কারও নিজের অস্তিত্বের নির্দিষ্ট জ্ঞান রয়েছে। কারণ, কেউ নিজে বিদ্যমান আছে এটা না জেনে কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না। এই অন্তর্দৃষ্টি তাঁর গবেষণায় ‘Discourse on Method’ বইয়ে ল্যাটিনে “Cogito, ergo sum” হিসেবে ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় বললে কিছুটা এরকম হতে পারে, “আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি।” এটিই ‘Meditations’ বইয়ে “I think, I am” হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর এই নতুন ইতিহাসতত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য হলো লিখিত দলিলাদি গৃহীত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্তত তিনটি নীতি বা পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত সমালোচনা বা নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম না করে। এ তিনটি মানদণ্ড হলো:
১) পূর্বে সংঘটিত ঘটনাকে সরাসরি সত্য বলে মেনে না নেওয়া
২) পূর্বের বিভিন্ন ঘটনাকে পরস্পর মুখোমুখি করানো ও সমন্বিত করা
৩) অলিখিত অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল দ্বারা লিখিত উৎসাদির নিরীক্ষা করা
এ পর্যায়ের ঐতিহাসিক হলেন বোলান্ডিটস, টিলেমেন্টস প্রমুখ। এরপর কার্তেসীয় ইতিহাসবিরোধী (Anti-cartesian) ঐতিহাসিক হিসেবে খ্রিস্টীয় অষ্টক শতকে ভিকো (Vico), লক (Locke) বার্কলে, হিউম প্রমুখের আবির্ভাব ঘটে। তারা প্রশিক্ষিত পেশাদার চৌকস ইতিহাসবিদ। সেকারণে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় অষ্টাদশ শতক থেকে আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের গোড়াপত্তন হয়। এ পর্বকে রেনেসাঁ পর্বের ব্যাপক ও বহুমুখী রুপান্তরও বলা যায়। আধুনিক ইতিহাসচর্চার বহুমুখীতার জন্য একে বিভিন্ন ভাগ ও উপভাগে বিভক্ত করা যায়। তবে এতদসত্ত্বেও এ পর্বের ইতিহাসতত্ত্বের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- তথ্য উৎসের বিপুলতা
- বিষয়বস্তুর সবিস্তার বর্ণনা
- যুক্তিবাদী উপস্থাপনা
- প্রগতিবাদী চেতনার উন্মেষ
- রোমান্টিক ভাবধারার অনুপ্রবেশ প্রভৃতি।
তবে বিজ্ঞানসম্মত, প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাজীবী ইতিহাসচর্চা আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের মৌলিক ও স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত।
শীর্ষস্থানীয় আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভলতেয়ার (১৬৯৭-১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ), ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ), উইলিয়াম রবার্টসন (১৭২১-১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ), এডওয়ার্ড গিবন (১৭৩৭-১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ), এডমান্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ), জেমস মিল (১৭৭৩-১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ), স্টিন (১৭৫৭-১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ), জন বগলেন বিউরি (১৮৬১-১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এবার কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলা যাক।
ঐতিহাসিক কে?
যিনি ইতিহাস রচনা করেন, তিনিই ঐতিহাসিক। আর জি কলিংউডের মতে, ইতিহাস যেহেতু ধর্মতত্ত্ব বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় একটি বিশেষ চিন্তনক্ষেত্র, তাই এর প্রকৃতি, বিষয়বস্তু, পদ্ধতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর কাউকে দিতে হবে। বস্তুত, ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরদাতাই এখানে ঐতিহাসিক। কলিংউডের মতে, দুটি গুণসম্পন্ন ব্যক্তি ঐতিহাসিকের ভূমিকা পালন করবেন:
১) সেই ব্যক্তি ঐতিহাসিক, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিহাস শিখেছেন এবং ঐ শিখনের বিষয়বস্তুতে তার মনে অনেক সন্দেহ ও প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে। সেসব সন্দেহ দূরীকরণে তিনি বিভিন্ন সূত্রের বিচার বিশ্লেষণ শুরু করেন এবং এভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাস-চিন্তার সাথে পরিচিতি লাভ করেন।
২) অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাসজ্ঞান ঐতিহাসিকের মানসপটে প্রতিফলিত হতে হবে অর্থাৎ তিনি দর্শনের মনোভাব নিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন সমস্যার গভীরে প্রবেশ করবেন। এরপর অভিজ্ঞতাপ্রসূত উপলব্ধির আলোকে সমস্যাবলি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন।
তাই ইতিহাসে অভিজ্ঞ দার্শনিকই প্রকৃত ঐতিহাসিক। অর্থাৎ ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি এই দুয়ের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক।
প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আল কাফিজির (১৩৮৬-১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ) মতে, ঐতিহাসিকের হাদিসবেত্তা বা হাদিস সরবরাহকারীর ন্যায় কতিপয় গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। কলিংউড এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের চারটি অতি প্রয়োজনীয় গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, একজন ঐতিহাসিককে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, সুচতুর, নির্ভুল এবং স্বচ্ছ ও স্পষ্টবাদী হতে হবে। আর সবকিছুর উপরে তাকে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত তথ্য-উৎস নির্ভর করে ইতিহাস লিখতে হবে।
আধুনিক ইতিহাস গবেষক অমলেশ ত্রিপাঠি তাই যথার্থই মন্তব্য করেছেন,
ঐতিহাসিকের নেই কবির মতো কল্পনার স্বাধীনতা, দার্শনিকের মতো বিশ্বজনীন তত্ত্ব নির্মাণের অধিকার, শিল্পীর মতো অপরুপকে মূর্ত রূপ দেওয়ার আকুতি, বৈজ্ঞানিকের মতো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কারের ও প্রয়োগের অভীপ্সা। তবে ঐতিহাসিকের সাথে সবারই লেন-দেন আছে।
ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তথ্য-উৎস তথা মাল-মশলা। এই মাল-মশলাকে মোটা দাগে সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অধ্যাপক এম. আর. তরফদারের মতে, প্রত্নতত্ত্বের আওতা থেকেই জন্ম নিয়েছে সহায়ক বিজ্ঞান, যা ইতিহাস রচনায় অত্যন্ত প্রয়োজন, কখনো বা অপরিহার্য। এ শ্রেণীর সহায়ক বিজ্ঞান হচ্ছে স্মৃতিসৌধাদির আলোচনাবিদ্যা, লিপিতত্ত্ব, হস্তলিপি-বিজ্ঞান, মুদ্রাতত্ত্ব ইত্যাদি। সাহিত্যিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে ইতিবৃত্ত, জীবনীসাহিত্য, ভ্রমণবৃত্তান্ত, কাব্য-সাহিত্য, ব্যক্তিগত ও সরকারি দলিল দস্তাবেজ প্রভৃতি। ধর্মীয় সাহিত্য, বিশেষ করে ধর্মযাজক ও সুফি সাধকদের জীবন-কর্ম ও আলাপচারিতা এক স্বতন্ত্র ইতিহাস উৎস হিসেবে পরিগণিত।
ইতিহাস কেন পড়বেন?
ইতিহাসের প্রায়োগিক মূল্য সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত আছে। দার্শনিক ও ঐতিহাসিক দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও হেগেল (১৭৭০-১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ) এর মতে, ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ঐতিহাসিক সংশয় বা সন্দেহবাদ (Historical Pyrrhonism)। তাই এটি উপযোগ বিরোধী। তাদের মতে, ইতিহাস একটি অভিলাসপ্রসূত বিষয়, যা প্রশংসা ও স্তুতিমূলক বক্তব্যে ভরপুর। তারা মনে করেন, ইতিহাসের বাস্তব শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ কখনও কিছু শেখে না।
এ বক্তব্যের বিপরীতে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই মনে করেন, ইতিহাসের প্রায়োগিক মূল্য অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন গ্রিক ও হেলেনীয় ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে উপস্থাপন প্রয়োজন। হেরোডোটাসের (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫) ইতিহাস চেতনা বা প্রেরণা পার্সিক শৃঙ্খল মোচনের উল্লাসে উদ্দীপ্ত। বিদেশী বর্বরদের প্রতিরোধে গ্রিসের নৈতিক ও আত্মিক ঐক্যের সুরে বাঁধা। তার ভূগোল হারকিউলিসের স্তম্ভ থেকে পারস্য পর্যন্ত প্রসারিত। তার অনুসন্ধিৎসা নৃতত্ত্ব, প্রাণীতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, পুরাণ এমনকি অবিশ্বাস্য কাহিনীও বাদ দেয় না। কাল শতাব্দীর গণ্ডির পরিসীমা ছাড়িয়ে। এভাবে তার আলোচনা শুধু মানুষের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা নয়, জীবনের সামগ্রিক রূপ, এক বাস্তব প্রতিফলন।
থুসাইডিডিসের (খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৫-৪০০) ইতিহাস প্রেরণার পশ্চাতে রয়েছে গ্রিক জাতির অন্তর্নিহিত দ্বৈতবাদ, শক্তিতে প্রতিযোগিতা ও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বৈরি, কেন্দ্রাতিগ উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ভয়াবহ শ্রেণী-সংঘর্ষ। সেগুলোর বিশ্রুত নায়কদের অদূরদর্শিতা, অর্থলিপ্সা এবং সাধারণ নাগরিকদের অন্ধ ঈর্ষা ও গড্ডালিকাসুলভ আচরণ। তার দিগন্ত গ্রিক জগতেই সীমাবদ্ধ এবং নাগরিক একান্তভাবেই এরিস্টটলীয় জীব।
হেলেনীয় ঐতিহাসিক পলিবিয়াস ও লিভির ইতিহাসতত্ত্বে ইতিহাসের প্রায়োগিক মূল্য উদ্ভাসিত হয়েছে। পলিবিয়াস খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ত্ব, স্মরণীয় ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। রোমানদের বিশ্বজয় থেকে শুরু করে দেড়শ বছর পর্যন্ত পাঁচ প্রজন্মের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। লিভি (খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে) রোমের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখেছেন। তিনি বলেন, তার পাঠকগণ অতীতের ইতিহাস জানতে চায়, আর তিনি তাদেরকে দূর অতীত সম্পর্কে ধারণা দিতে চান। তিনি তাদেরকে পূর্ববর্তী রোমানদের সহজ সরল জীবনযাপন সম্পর্কে অবগত করাতে চান। বস্তুত লিভির ইতিহাস সুস্পষ্ট মানবীয়।
মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিক আত-তাবারি, আল-মাসুদি, জিয়া বরানি, ইবনে মিশকাওয়াইহ, আবুল ফজল প্রমুখের লেখনীতেও মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। কেউ কেউ আবার তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও তথ্যেরও উপস্থাপনা করেছেন। এসবের অধ্যয়ন সমসাময়িক ও পরবর্তী সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তাই সবকিছু বিবেচনায় বলা যায়, ইতিহাসের বাস্তব ও প্রায়োগিক গুরুত্বের কারণেই এর অনুসরণ ও চর্চা অপরিহার্য।