‘সার্কাস’ শব্দটাই কেমন যেন রোমাঞ্চকর, তাই না? শুধুমাত্র রোমাঞ্চকর বললে ভুল হবে, সার্কাস শব্দটা শুনলেই কেমন ভয়, বিপদ আর রোমাঞ্চের শিরশিরে অনুভূতি মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়োরা পর্যন্ত এই সার্কাস শব্দের মোহের কাছে পরাজিত। ছোটবেলায় পড়াশোনা ঠিকঠাক না করার দরুন বকা খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে সার্কাসের দলে নাম লেখাবে, এমন ফ্যান্টাসি মনের মধ্যে পুষে রাখা মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।
বাইরে থেকে সার্কাসের পশু-পাখি আর মানুষগুলোর জীবন যতটা হাসি তামাশা আর রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ দেখায়, আসলে কিন্তু সেটা ঠিক ততটাই বিপদজনক, অন্তত ইতিহাস তা-ই বলে। একেকটি সার্কাসের তাবু মানেই সার্কাসের কর্মচারীদের জন্য জীবন আর মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখা। প্রতিটি সার্কাস শো চারপাশ কাঁপিয়ে তোলা করতালি আর সাবাশই শুধু পায় না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সারা জীবন মনে রাখার মতো বিভীষিকাময় ইতিহাসও হয়ে যায়।
মেরি দ্য এলিফ্যান্ট
শুরু করবো অতি সুপরিচিত ট্রাজেডি ‘দ্য এক্সিকিউশন অফ অ্যান এলিফ্যান্ট’ দিয়ে। পাঁচ টন ওজনধারী মেরি ছিল একটি এশিয়ান মেয়ে হাতি। সে ‘খুনি মেরি’ নামেও সুপরিচিত। মেরি ‘দ্য স্পার্ক ওয়ার্ল্ড ফেমাস সার্কাস শো’-তে ট্র্যাডিশনাল হাতি হিসেবে খেলা দেখাতো। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯১৬ সালে সেই সার্কাস শোতে রেড অ্যাল্ড্রেজ নামে একজন হোটেল কর্মচারীকে হাতির প্রধান ট্রেইনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। রেড অ্যাল্ড্রেজ ১২ সেপ্টেম্বর কিন্সপোর্ট টেনেসিতে মেরির আঘাতে মারা যান। তিনি একজন অদক্ষ ট্রেইনার হওয়া সত্ত্বেও সার্কাসে এলিফ্যান্ট প্যারেডে লিড দেন, যেখানে কিনা তিনি মেরির পিঠে ওঠার মতো যোগ্যতাও রাখতেন না। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মেরি হঠাৎ করেই মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় এবং মাটিতে পড়ে থাকা এক ফালি তরমুজ শুঁড় দিয়ে তোলার চেষ্টা করে। এই সময় মেরির ট্রেইনার অ্যাল্ড্রেজ ট্রেনিং ভুলে মেরিকে হাতের ষ্টিক দিয়ে খুব বাজেভাবে আঘাত করে। এমতাবস্থায় মেরি তার শুঁড় দিয়ে অ্যাল্ড্রেজকে ধরে শুন্যে ছুঁড়ে মারে এবং পরে অ্যাল্ড্রেজ মাটিতে পড়ে গেলে মেরি তার বিশাল পা দিয়ে অ্যাল্ড্রেজের মাথা গুঁড়িয়ে দেয়।
লোকজন আতঙ্কে জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গেলেও পরে মেরিকে খুনি চিহ্নিত করে তার মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। চারপাশের অবস্থা এতই বিরূপ হয়ে ওঠে যে, সেই সার্কাস শোয়ের কর্ণধার স্পার্ক মেরিকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াই একমাত্র সমাধান ধরে নিয়ে মেরির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেন। ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে মেরিকে ২,৫০০ লোকের সামনে (যাদের বেশিরভাগই ছিল শিশু!) একটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ক্রেনের সাথে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্রথমবার মেরিকে ক্রেনে ঝুলিয়ে দেওয়ার পর ক্রেনের চেন তার গলা পিছলে বেরিয়ে গেলে মেরি মাটিতে পড়ে তার কোমর ভেঙে ফেলে। পরবর্তীতে আরও মজবুত চেন দিয়ে তাকে দ্বিতীয়বারের মতো ক্রেনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রায় আধা ঘণ্টা এভাবেই ঝুলিয়ে রেখে মেরির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়!
দেসি ইস্পানা দ্য শিফন অ্যাক্রোব্যাট
সার্কাস দুর্ঘটনার ইতিহাসের খুব সাম্প্রতিক একটি ঘটনা হলো দেসি ইস্পানার মৃত্যু। দেসি ইস্পানা একজন গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী বুলগেরিয়ান আমেরিকান শিফন অ্যাক্রোব্যাট পারফর্মার। ২০০৪ সালে তিনি রিংলিং ব্রাদার্স অ্যান্ড বারনুম অ্যান্ড বেইলি সার্কাস শো’তে পারফর্ম করার সময় ৩০ ফুট উঁচু থেকে নিচে কংক্রিটের ফ্লোরে পড়ে গিয়ে মারা যান।
ইস্পানা ৩০ ফুট উঁচুতে এরিয়াল অ্যাক্ট করার সময় টেকনিক্যাল সমস্যার দরুন নিচে পড়ে যান, পড়ার সময় তার মাথা নিচে ছিল। ফলে কংক্রিটের ফ্লোরে পড়ে তিনি মাথায় মারাত্মক আঘাত পান। সে আঘাত নিয়ে পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।
মাসারতি, দ্য লায়ন টেমার
১৮৭২ সালের ৩ জানুয়ারি বুধবার থমাস ম্যাকার্ট একজন লায়ন টেমার হিসেবে তার জীবনের শেষ পারফর্ম করেন ল্যাঙ্কাশায়ারের বল্টনে। তিনি সে সময়ের একজন বিখ্যাত, সাহসী ও বেপরোয়া একহাতি লায়ন টেমার ছিলেন।
সার্কাসে পারফর্মেন্সের সময় থমাসের টাইরেন্ট নামের একটি সিংহ হঠাৎ করেই তাকে আক্রমণ করে বসে। দেখাদেখি আরও তিনটি সিংহ এসময় থমাসকে ঘিরে ধরে আক্রমণ করে এবং পাঁচ হাজার দর্শকের সামনে থমাসের মাথার খুলি শরীর থেকে আলাদা করে ফেলে। সজ্ঞানে থাকা অবস্থায় থমাস প্রাণপণ চেষ্টা করেন নিজেকে সিংহদের কাছ থেকে মুক্ত করতে। কিন্তু তার সেই চেষ্টা বৃথা যায় এবং তিনি শো চলাকালীন সময়েই মৃত্যুবরণ করেন।
দ্য সেন্ট লুইস ট্র্যাপিজ অ্যাকসিডেন্ট
ট্র্যাপিজ নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর দুঃসাহসিক ও বিপদজনক সার্কাস খেলা। এই খেলার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে অসীম শারীরিক শক্তি ও ফ্লেক্সিবিলিটি।
১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রেড লিজিলি ও বিলি মিলসন নামের দুজন বিখ্যাত ট্র্যাপিজ শিল্পী পারফর্মেন্স চলাকালীন যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে নিচে জর্জ নামের আরেকজন শিল্পীর উপর পড়ে যান। তিনজন সার্কাস আর্টিস্টই মারাত্মক আঘাত পান। লিজিলি কিছুটা কম ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বিলির পাঁজর ভেঙে যায় এবং জর্জের অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত।
দ্য ডুলুথ লিনচিংস
১৯২০ সালে সার্কাস ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক দুর্ঘটনা ঘটে। শুধু সার্কাস বললে ভুল হবে, গোটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেই একটা কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করে এই দুর্ঘটনা।
১৯২০ সালের ১৪ জুন ডুলুথ মিনেসোটাতে জেমস রবিনসন সার্কাসের আইরিনি তাস্কেন নামের এক মেয়ে অভিযোগ করে তাকে বন্দুকের মুখে রেখে সার্কাসের ছয়জন আফ্রিকান-আমেরিকান কর্মচারী ধর্ষণ করে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তৎক্ষণাৎ ছয়জন কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়। এর কিছুদিন পরেই পাঁচ থেকে দশ হাজার লোকের একটি দল গঠন করে জেল ভেঙে সেই ছয়জনকে বের করে আনা হয় এবং তাদের বেধড়ক পিটিয়ে পরবর্তীতে ল্যাম্পপোষ্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
দ্য ফ্লাইং ওলেনডাস
‘দ্য ফ্লাইং ওলেনডাস’ সার্কাস ইতিহাসের অন্যতম প্রবীণ সার্কাস পার্টি। এই সার্কাস পার্টির কর্ণধার কার্ল ওলেনডাস তার স্ত্রী হেলেন ও ভাই হেরমান সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে পারফর্ম করতেন। ১৯৬২ সালে ফ্লাইং ওলেনডাস সার্কাস দল এক বিভীষিকাময় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন, যা কিনা তাদের পুরো পরিবারকে একদম মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়।
ফ্লাইং ওলেনডাসের একটি অন্যতম পারফর্মেন্সের নাম হচ্ছে ‘সেভেন পারসন চেয়ার পিরামিড’, যেখানে সাত জন মানুষ মাটি থেকে ৩২ ফুট উপরে শূন্যে একটি শক্ত দড়ির উপর চেয়ার রেখে তারপর পারফর্ম করেন কোনো প্রকার সেফটি নেট ছাড়াই। সেই সময়কার দুঃসাহসী ও স্বনামধন্য অ্যাক্রোব্যাট পারফর্মার হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্য একদিন তাদের প্রতি নির্দয়তা দেখায়। সেদিন পারফর্মেন্সের সময় দলনেতা হুট করেই তাল হারিয়ে ফেলেন এবং তিনজন পারফর্মার নিচে পড়ে যান। কার্ল ওলেনডাসের মেয়ের জামাই এবং ভাতিজা সেখানেই মারা যান, আর দত্তক নেওয়া এক ছেলে কোমর ভেঙে সারা জীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান এই দুর্ঘটনায়।
দ্য গ্রেট ‘ওয়ালাস ব্রাদার্স’ সার্কাস ট্রেন ডিজাস্টার
শেষ করবো সার্কাস ইতিহাসের আরও একটি করুণ দুর্ঘটনা দিয়ে। ১৯০৩ সালে ওয়ালাস ব্রাদার্সের পৃথক দুইটি ট্রেন মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, এই দুর্ঘটনা সার্কাস কর্মী সহ অনেক পশুপাখির জীবন কেড়ে নেয়।
সার্কাস ট্রেনটি যখন রেল লাইন ধরে এগিয়ে আসছিল, তখন দ্বিতীয় ট্রেনটির চালক ওয়ার্নিং লাইট জ্বলতে দেখা সত্ত্বেও ট্রেনের ব্রেক কাজ না করার দরুন কিছুই করতে পারেননি। ফলাফল মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩০ জন সার্কাস কর্মী নিহত হন এবং বাকী ২৭ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। দুর্ঘটনায় প্রায় সব জন্তু-জানোয়ার মারা যায়। এদের মধ্যে ছিল একটি আরবীয় ঘোড়া, একটা বিগ ডেন (বড় প্রজাতির কুকুরের ব্রিড), তিনটি উট এবং মোড নামের একটি হাতি।
ফিচার ইমেজ- Time Magazine