জাহাজমারা যুদ্ধ: কাদেরিয়া বাহিনীর পাকিস্তানী জাহাজ দখল

১৯৭১ সালের আগস্ট মাস। গেরিলা হামলায় এরই মধ্যে ধরাশায়ী পাক বাহিনী। তবে দেশে তখনও নিয়মিত বাহিনীর অভিযান শুরু হয়নি। পুরো দেশকে দখলকৃত বাংলাদেশ বলা গেলেও দেশের মাঝেই এমন এক এলাকা আছে, যেটা পাক বাহিনীর দখলে নেই। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এলাকার বিশাল এক জঙ্গল এলাকার নিয়ন্ত্রণ কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে। একজন বেসামরিক ব্যক্তি হয়েও কাদের সিদ্দিকী বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছেন। অনবদ্য এক রণকৌশল এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে তারা। কয়েকদিন আগেও এশিয়ার  স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ বাহিনী দাবি করা পাক বাহিনীকে একেবারে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়ছে। আশেপাশের অঞ্চলের পাকসেনারা ভয়ে ঘাঁটি ছেড়েই বের হচ্ছে না!

৫ই আগস্ট, ১৯৭১ সাল। মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর এক ওয়্যারলেস বার্তা ধরে ফেলে। সদরঘাটে কয়েকটি বড় বড় জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করা হচ্ছে। গন্তব্য বগুড়ার ফুলতলি, তারপর রংপুর। উল্লেখ্য, তখন মুক্তিবাহিনী সীমান্ত সংলগ্ন বিওপিগুলোতে অতর্কিত হামলা শুরু করেছে। সম্ভবত এজন্যই উত্তরের সীমান্তে বাড়তি অস্ত্র পাঠানো। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর মমতাজ খান চলে যান ঢাকায়। সত্যতা যাচাই করে আসেন। জানা যায়, কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করা এলাকার ভেতর দিয়েই যাবে জাহাজগুলো। মূল লক্ষ্য ইউএসএ ইঞ্জিনিয়ারিং এলসি-৩ এবং এসটি রাজন নামের দুই জাহাজ। শুরু হয় পরিকল্পনা।

মানচিত্রে ভুয়াপুরের অবস্থান; Image source: google map

কাদেরিয়া বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাগ করেছে। জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর ঘাট ঘেঁষে যাবে জাহাজগুলো। যমুনা নদীর ভুয়াপুর ঘাটের অপরদিকে সিরাজগঞ্জ ঘাট। সিরাজগঞ্জ পাক বাহিনীর দখলে। ৩০ কিলোমিটার দূরেই পাক বাহিনীর ঘাঁটি। তবে এই জায়গা বেছে নেয়ার কারণ হলো পানির কম গভীরতা এবং সামনে থাকা কিছু চর। ভুয়াপুর আঞ্চলিক দপ্তরকে কড়া সতর্কতায় রাখা হয়। দায়িত্ব পান কমান্ডার হাবিব। ১০-১৫ জন সেরা যোদ্ধা বাছাই করেন তিনি।

হাবিবুর রহমান বীর বিক্রম; Imager source: wikimedia.org

৯ আগস্ট, ১৯৭১।

সিরাজকান্দি ঘাটে (বর্তমান যমুনা সেতুর অদূরে) এসে ভেড়ে ৭টি জাহাজ। বিশালাকারের জাহাজগুলোতে বেশ ক’টা বড় শহর একেবারে জ্বালিয়ে দেবার মতো গোলাবারুদ ছিল। জাহাজের আলো রাতের অন্ধকার ভেদ করে শহরের মতো আলোকিত করে ফেলে নদীর ঘাট। জনগণ ভীত হয়ে ওঠে। কমান্ডার হাবিব মোতাহার, জিয়া এবং জামশেদকে নিয়ে জেলের ছদ্মবেশ ধরেন। আক্রমণের আগে আরো তথ্য চাই তার। বিপদ আসার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জাহাজের কাছে গিয়ে তিনি মাছ ধরতে শুরু করেন। একপর্যায়ে টহল স্পিডবোটের মুখোমুখিও হন তারা। পাক বাহিনীর সাথে গল্প জুড়ে দেন তিনি। যুদ্ধের ক্লান্তিতে থাকা পাকসেনারা জানতে চায় তাজা খাবারের কথা। তরতাজা মুরগি আর চমচমের খোঁজ দেন তাদের। কৌশলে জেনে যেন দরকারি তথ্যগুলো। যেমন- সব জাহাজের লোক খাওয়াতে কয়টা মুরগি চাই?

জানা গেল, ভেতরে অন্তত ১ ব্যাটালিয়ন সেনা আছে। এই ১০-১৫ জনের দল কয়েক মিনিটও টিকতে পারবে না। রিইনফোর্সমেন্টের বদলে আসলো এক রহস্যময়ী বার্তা।

“এই মাত্রা সর্বাধিনায়কের (বঙ্গবীর ওসমানী) কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, সুবিধামতো অবস্থান থেকে শুধু আক্রমণ করো, আক্রমণ করা মাত্রই জাহাজের পতন ঘটবে”

এই বার্তার মর্মোদ্ধার করতে পারে না কেউই। তবে সবাই বুঝতে পারে, ভালো কিছুর ইঙ্গিত করা হয়েছে। হয়তো গোপন কিছু আছে যেটা আক্রমণের আগে কাউকে জানানো ঠিক হবে না।

১০ আগস্ট মাটিকাটা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম একটি শক্তিশালী দল নিয়ে পজিশন নেন। এই দলটিতে ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিল। এছাড়াও আশেপাশে আরো কয়েকটি দল পজিশন নেয়। কোনোভাবেই টার্গেটকে ছেড়ে দেয়া যাবে না। গভীর রাতে কমান্ডার হাবিব নদীর কিনারে গিয়ে দেখে আসেন হানাদাররা কী করছে। মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণ উদগ্রীব আক্রমণের জন্য। কিন্তু কমান্ডারের নির্দেশ, প্রথম গুলি তিনি চালাবেন। তারপর বাকিরা।

১১ তারিখ মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে সরে একটু পেছনে অবস্থান নেয়। একটু পরে এসেই একজন খবর দেয় যে, জাহাজগুলো উত্তরে যাত্রা শুরু করেছে, অর্থাৎ তাদের সামনেই আসছে। সকাল ৯টায় আবার জাহাজ থেমে যায়। নদীতে ডুবোচর থাকতে পারে এবং সেখানে বড় জাহাজটি আটকে যেতে পারে। এই আশংকা থেকে ছোট একটি জাহাজ আগে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে এটি মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। সারাদিন বাকি জাহাজগুলো থেকে থাকে। 

পরেরদিন জাহাজগুলো আবার চলতে শুরু করে। প্রথমে ছোট দুটি জাহাজ ঠিক মুক্তিবাহিনীর সামনে দিয়ে চলে গেল, কিন্তু কমান্ডার গুলি চালালেন না। এবার বহরের বড় দুটি জাহাজ মেশিনগানের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে।

৩ দিন ধরে পজিশন নিয়ে থাকা মুক্তিবাহিনী তাদের নীরবতা ভাঙলো। কাদেরিয়া বাহিনী একঝাঁক বুলেট দিয়ে স্বাগত জানালো জাহাজ দুটিকে। পেছনে থাকা দুটি জাহাজ তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা রেজাউলের নিখুঁত নিশানায় ১২টি মর্টার নিখুঁতভাবে দুই জাহাজের ব্রিজে আঘাত করে। তিনি। ডানপাশে ছিলেন মঞ্জু, প্রায় কুড়িটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেন তিনি। তবে জাহাজের পুরু লোহার কাছে মর্টার ছিল সামান্য টোকা। এই ক্ষতি নিয়ে দুই জাহাজ অনায়াসেই পালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীনভাবে জাহাজদুটো সামনের চরে গিয়ে আটকে যায়

কিছুক্ষণ গুলি চলতে থাকে। ৩ জন শহীদ হন। ২০-২৫ জন পাক সেনা নিহত হয়। একপর্যায়ে গুলি বন্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজের দখল নেয়। বন্দী করা হয় সবাইকে।

মুক্তিযোদ্ধারা অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, গোলাবারুদের অভাবে ঠিকমতো যুদ্ধ করতে পারছে না সেই আধুনিক অস্ত্র ও গোলা-বারুদে ঠাসা জাহাজটি। অন্যটি ছিল তেলের ট্যাংকার, যাতে ১ লাখ ৮০ হাজার গ্যালন ডিজেল ছিল। অস্ত্র ছাড়াও জাহাজের রান্নাঘর ভর্তি মুরগির মাংস এবং প্রচুর উপাদেয় খাদ্যও ছিলো।

আক্রান্ত দুই জাহাজ; Image source:  টাঙ্গাইল প্রতিদিন

শুরু হয় অস্ত্র নামানো। আশেপাশের সব গ্রামের শারীরিকভাবে সক্ষম সব লোক এসে যোগ দেয় এই কাজে। আটক সারেংয়ের কাছ জানা গেল, পাক বাহিনী বারবার সাহায্য চেয়ে ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠাচ্ছিল। যেকোনো সময় পাল্টা আঘাত হানতে পারে তারা। রাত ১০টা নাগাদ কমান্ডার জাহাজ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। জাহাজে তখনও প্রচুর অস্ত্র। কিন্তু বিপদের আশংকা ছিল। নিরাপদ দূরত্ব থেকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজে আগুন ধরানো হয়। ৩০ কিলোমিটার উপরে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখা শুধু জাহাজ দুটি নয়, পাক বাহিনীর মনোবলকে একেবারে ভেঙে চুরমার করে দেয়। তেলের ট্যাংকারটি ছিল পাবনার কুখ্যাত মুসলিম লিগ নেতা মতিনের। রাজাকারদের দম্ভও সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ হয় আগুনের ফুলকিতে।

পরদিন আঞ্চলিক ক্যাম্পে স্বয়ং কাদের সিদ্দিকী এসে হাজির হন। আটক সারেংকে হাজির করা হয় তার সামনে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবাক করে সারেংকে বুকে জড়িয়ে ধরেন কাদের সিদ্দিকী।

চট্টগ্রামের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা। ২৫শে মার্চের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি তার পরিবার। চালনা বন্দরে কর্মরত গোলাম মোস্তফা নজরবন্দী হন। পরে তাকে অনেকটা জোর করেই জাহাজে কাজ দেয়া হয়। মাতৃভূমির ঘ্রাণে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু এক বন্ধুর পরামর্শে পাকিস্তানের সাথে থেকেই বড় রকম ক্ষতি করার ছক কাটেন তিনি। মুক্তিবাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল তার, আক্রমণের পুরো ছকই জানতেন তিনি। এজন্যই আক্রমণ শুরু পরপরই তিনি জাহাজ থামিয়ে দেন।

জাহাজ থেকে ১,৭০,০০০ মর্টার শেল উদ্ধার করা হয়। ৭০,০০০ গ্রেনেড, ১০ লক্ষের বেশি গুলি, ৫০০ এর অধিক বন্দুকসহ নানা রকম অস্ত্র পাওয়া যায়। মুক্তিবাহিনীর হাতে এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র (হানাদারদের হিসাবমতেই ২১ কোটি টাকা, যা বর্তমানে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি) হারিয়ে পাক বাহিনীর অনেক ক্ষতি হয়েছিল যে, তারা এই অঞ্চলে আবার নতুন করে অভিযান শুরু করে। অস্ত্র উদ্ধারের প্রাণপণ চেষ্টা করে তারা। উল্লেখ্য, ১২-১৪ই আগস্ট পর্যন্ত চলা পাক বাহিনীর এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিয়াজি। পাক বাহিনীর ৪৭ ব্রিগেড এই অঞ্চল দখলের চেষ্টা করে। বিমান বাহিনীর দুটি স্যবর বোমা হামলা চালায়। কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনী লুট করা অস্ত্র দিয়েই পাক বাহিনীকে সফলভাবে প্রতিহত করে।

এই যুদ্ধটিকে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। যুদ্ধের পর কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদানের সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখলের কথা পরিষ্কারভাবে জানা যায়। হাবিবুর রহমানের নাম হয়ে যায় জাহাজমারা হাবিব। তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কাদের সিদ্দিকী দুর্ধর্ষ এই যোদ্ধাকে “মেজর” বলে ডাকতেন। 

কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদান; Image source: wikimedia.org

This article is in Bangla language. It's about a pakistani militay ship convoy attack in occupied Bangladesh.

References:

১। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; আবু ওসমান চৌধুরী
২। একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)
৩। মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই; সেজান মাহমুদ 

Related Articles

Exit mobile version