কলকাতার ব্যতিক্রমধর্মী প্রকাশনা সংস্থা- মনফকিরা থেকে প্রকাশিত বীরেন দাশ শর্মার রচিত গ্রন্থ গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প। সেখানে লেখক গ্রাফিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে যে, “এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প।”
ইটালিয়ান শব্দ ‘Grafitiato’ থেকে এসেছে ‘গ্রাফিতি’ যার অর্থ ‘খচিত’। গ্রাফিতিকে বলা হয় কাউন্টার কালচার, অর্থাৎ যা গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত। যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতি-নীতি-সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে একধরনের শিল্প বিপ্লব গড়ে তোলে, তাকে গ্রাফিতি বলে। এর উপাদান মূলত সমাজের অবক্ষয়, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতা বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র ইত্যাদি। গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যাঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অব্যবস্থায় বাস করছো তুমি, কী তোমার পরিণতি, কীসে তোমার পরিত্রাণ। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাভাবনা প্রকাশের মাধ্যম গ্রাফিতি। তাই এই স্বতোজাত ভাবনা প্রকাশের স্থান দেয়াল। বিশ্বের সকল দেয়াল একজন গ্রাফিতি শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত ক্যানভাস। তাই বিভিন্ন দেশের দেয়ালে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা, দেখতে পাই সেই দেশের প্রকৃত দৃশ্য একজন গ্রাফিতি শিল্পী বা গেরিলা শিল্পীদের চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সে, আটষট্টির ছাত্র বিপ্লবে।
আন্দোলনের বীজ বোনা শুরু হয়েছে বহুপূর্বেই। ১৯৪৭-এ কমিউনিস্টদের বিদায়ে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হয় ফরাসি সমাজ। কিন্তু বিভিন্ন প্রভাবে, রাষ্ট্রপতির কর্মকাণ্ড জনগণের মধ্যে কেবলই ক্ষোভ সৃষ্টি করতে থাকে।
ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ ফ্রেঞ্চ স্টুডেন্টস(UNEF) ছিল ফরাসি ছাত্রদের একটি ইউনিয়ন। সেখানে ফরাসির অস্থিতিশীল অবস্থায় সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বশিক্ষিত ছাত্রদের মাধ্যমে ইউনিয়নটি একটি উপদ্বীপে পরিণত হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। গোটা দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছিল এই ইউনিয়নের কার্যক্রমে সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ। তারা বেড়ে উঠছিলো অন্য এক জগতে, অন্য এক আদর্শে। অন্যদিকে, দেশে দেখা গেলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার, এক শ্রেণির লোকের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন আর বামপন্থী দলের অবনতি ছিল তখনকার স্বাভাবিক চিত্র। বুর্জোয়া সমাজ যখন দেশের উন্নয়নে হাততালি দিচ্ছে, ছাত্রসমাজ আর কৃষিজীবী সমাজ তখন কিছুতেই মানতে পারছে না এই আধুনিকীকরণ। ১৯৬৫ তে শার্ল দ্য গল ছাত্র, শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে ভোট হারালেও পদ হারালেন না বটে, কিন্তু ইউএনইএফ আরও জঙ্গি র্যাডিকেলদের হাতে চলে গেলো। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলেন।
এবার শুরু হলো ক্ষমতার দামামা। কমছে মজুরি, হচ্ছে ছাঁটাই এবং বাড়ছে বেকারত্ব।
এই করুণ অবস্থায় বাবার সাথে শিশুরাও স্কুল ছেড়ে কাজ খুঁজছে। ১৯৬৭ সালে বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেলো। আর সহ্য করতে না পেরে সহিংস ধর্মঘটের ডাক দিল শ্রমিকশ্রেণি। চেম্বার অফ কমার্সে তারা প্রথম হামলা করল। কিন্তু ক্ষতিও তাদেরই বেশি হলো, পুলিশ পিটিয়ে বের করলো তাদের। কিন্তু দমে না গিয়ে আরও দ্বিগুণ হারে ধর্মঘট ডাকা হলো।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেলে পদ্ধতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং সরকারের ক্ষমতার সমালোচনায় মত্ত। পরিবর্তনের তাগিদে তারাও যেন অনুভব করছিল শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার ব্যাপারটি। ১৯৬৮ সালের মে মাসে বিক্ষিপ্ত ছাত্ররা শিক্ষা সংস্করণের দাবিতে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলন শুরু করলো। পুলিশের আক্রমণে সব ভণ্ডুল হয়ে শ’খানেক মানুষ আহত হলো এবং অর্ধেক ছাত্র হলো গ্রেফতার। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলো। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা লাতিন কোয়ার্টার দখল করে আন্দোলন শুরু করলো এবার। ৬ই মে সেখানে ছাত্র ও পুলিশে সংঘর্ষ হলো। ৪২২ জন গ্রেফতার, ৩৪৫ জন পুলিশ এবং প্রায় ৬০০ ছাত্র আহত হলো সেই সংঘর্ষে। এসময় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভ শুরু করলো এবং তরুণ শ্রমিকরাও ছাত্রদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলো। এরপরও শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধই রইলো। ১০ই মে লাতিন কোয়ার্টারে রাতে তুমুল হানাহানি হলো ছাত্র ও পুলিশে। প্রায় ৭০০ ছাত্র আহত, সাড়ে ৪০০ গ্রেফতার, ২০০ গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বললেন,“না আছে ওদের কোনো মত, না আছে বিশ্বাস না আইন সম্পর্কে ধারণা।” এরপর ছাত্রদের সাথে সংহতি প্রকাশকারী শ্রমিকদল সিজিটি, সিএফডিটি এ এফফইএন– তিনটি প্রধান ইউনিয়ন ধর্মঘট ডাকলো। চাপের মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রী জর্জ পপিদু ১৩ই মে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দিলেন। ছাত্ররা ফিরে পেলো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র ও শ্রমিকশ্রেণি তখন রাস্তায় নেমে এলো এবং লাগাতার ধর্মঘট ডাকতে থাকলো। এই সময় রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্য গল পাড়ি দিলেন রোমানিয়ায়। আড়াই হাজার শিক্ষার্থী দখল করে নিলো ওদেয় থিয়েটার। ফ্যাক্টরি দখল করে নিল শ্রমিকেরা। এমনকি, পত্র-পত্রিকা বিলি বন্ধ হলো, বিমান পরিবহনেও লাগলো ধর্মঘট। পুরো অচল হয়ে গেলো ফ্রান্স। হাতে হাত মিলিয়ে চলছিলো ছাত্র-শ্রমিক বিপ্লব, পরিবর্তনের বিপ্লব।
এমতাবস্থায়, রাষ্ট্রপতি গ্যলের বক্তব্য ভেসে এলো,“সংস্কার ঠিক আছে, কিন্তু বিশৃঙ্খলা চলবে না।” ২০শে মে বন্ধ হলো স্টক এক্সচেঞ্জ অফিস। আনুমানিক ১০ মিলিয়ন শ্রমিক হাজির হলো ২০শে মে-র ধর্মঘটে। এরপর আরও গণ্ডগোল জারি থাকলো রাষ্ট্রপতি এবং প্রতিবাদীদের মধ্যে। আস্তে আস্তে সরকারি গণমাধ্যম টেলিভিশন রেডিও সংস্থাতেও লাগলো ধর্মঘট। সরকার একটা চুক্তিতে আসতে চাইছিলো ইউনিয়নসমূহের সাথে, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি তা অস্বীকার করে অনড় থাকলো। এরপর আসে নির্বাচনের আবহাওয়া। নির্বাচনের পূর্বে শ্রমিকদের শ্রমমূল্য বাড়ানো হলো ঘণ্টায় তিন ফ্রা। ধর্মঘট তুলে নিলো তারা। প্রচারণার সময় এক সংঘর্ষে ১৫০০ লোক গ্রেফতার হলো এবং ৪০০ জন আহত। এর ফলস্বরূপ নিষিদ্ধ হলো বিক্ষোভ সমাবেশ। ওদেয় এবং সরবোন থেকে ছাত্রদের হটিয়ে দেওয়া হলো এবার। নির্বাচনে হেরে গেলো বামপন্থী ও কমিউনিস্ট ফেডারেশন। ১৯৬৯ এর জুন মাসে গণভোটে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট দ্য গ্যল ক্ষমতাচ্যুত হলেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন জর্জে পপিদু।
এই আন্দোলনের সময় ছিল বহুদিনের। দীর্ঘ দিন চলেছে অস্থিতিশীলতা। এই আন্দোলনকে তারা নতুন রূপ দেয় গ্রাফিতি এবং দেয়াললিপির মাধ্যমে। ফরাসির ছাত্রবিপ্লবের অসামান্য কৃতিত্ব এই সকল অবাচনিক যোগাযোগ মাধ্যমের। প্রত্যেকটি এত রূঢ়, এত সত্য, এত স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছিলো, যা হয়ত বাচনিক যোগাযোগকেও হার মানায়। দেখে নেওয়া যাক সেইসব শক্তিশালী লেখনী ও চিত্র।
দেয়াললিপি
#Commute, work, commute, sleep.
পা চালাও, কাজ করো, পা চালাও, ঘুমাও।
#Meanwhile everyone wants to breathe
and nobody can
and many say, “we will breathe later”
And most of them don’t die
because they are already dead.এরই মাঝে সবাই চাইলো শ্বাস নিতে
কিন্তু কেউই তা পারলো না
অনেকে বললো, ‘ও আমরা পরে নেব।’
বিশেষ কেউ মরলো না অবশ্য
কারন অনেকেই তখন মৃত।#Don’t beg for the right to live—take it.
বাঁচার অধিকার চাইতে যেও না, ছিনিয়ে নাও।
#The liberation of humanity is all or nothing.
মানবের মুক্তি হয় সম্পূর্ণ, নাহয় শূন্য।
#Don’t liberate me—I’ll take care of that.
আমায় মুক্ত করতে যেও না, সে আমি নিজেই বুঝে নেব।
#Warning: ambitious careerists may now be disguised as ‘progressives’.
Don’t be taken in by the politicos and their filthy demagogy.সতর্কবাণী: ধান্ধাবাজেরা হয়ত আজ ভেক ধরেছে ‘প্রগতিশীল’ এর
রাজনীতিবাজের বাজে কথায় আর ভুলবেন না।
#In a society that has abolished
all kind of adventure
the only adventure that remains
is to abolish the society.সমস্ত রোমাঞ্চ যে সমাজ শেষ করেছে
শেষ করো তাকে—সেই তোমার শেষ রোমাঞ্চ।#Down with the state.
When the national assembly becomes
a bourgies theater, all the bourgies theatres
should be turned into national assemblies.চুলায় যাক এই রাষ্ট্র।
জাতীয় সংসদ যখন বুর্জোয়াদের মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে,
ওদের সব মঞ্চকে তখন জাতীয় সংসদে বদলে দেওয়া দরকার।#Abolish class society.
Nature created neither servants nor masters.
I want neither to rule nor to be ruled.শ্রেণিসমাজের বিলোপ ঘটাও।
প্রকৃতি না কাউকে দাস করেছে, না প্রভু।
শাসিত কিংবা শাসক, চাই না হতে কিছুই।#We want structures that serve people
not people serving structures.আমরা সেই ব্যবস্থা চাই, যা জনগণের সেবা করবে।
এমন ব্যবস্থা না, যার সেবা জনগনকে করতে হয়।#Don’t negotiate with bosses . Abolish them.
The boss needs you, you don’t need them.মালিকের সঙ্গে কোন দরাদরি নয়, উচ্ছেদ করো তাকে।
মালিকেরই তোমায় দরকার,
মালিককে তোমার দরকার নেই কোনো।#Professors, you are as senile as your culture,
your modernism is nothing but
the modernization of the police .
We refuse the role assigned to us
we will not be trained as police dogs.ওহে অধ্যাপকেরা,
বিকল তোমাদের রুচি
তোমার আধুনিকতার নাম স্রেফ পাহারাদারি।
চাই না তালিম– কুত্তাগিরির।#Every teacher is taught, everyone taught teaches.
সব শিক্ষকই তোতাপাখি, তোতা-ই আবার শেখায়।
#Abolish alienation.
Obedience begins with consciousness;
consciousness begins with disobedience.
First disobey; then write on the walls.
I don’t like to write on walls.
Write everywhere.বিচ্ছিন্নতা দূর করো।
মান্যতার শুরু চেতনায়
চেতনার শুরু অমান্যতায়।
আগে অমান্য করো; তারপর লেখো, দেয়ালে।
দেয়ালে লিখতে আমার ভালো লাগে না
সবখানে লেখো।#To be free in 1968 means to participate
I participate
You participate
We participate
They profit.১৯৬৮ তে স্বাধীন হতে চাও, মানে অংশ নাও।
আমি অংশ নিচ্ছি
তুমি অংশ নিচ্ছো
আমরা সবাই অংশ নিচ্ছি
আর মাল কামাচ্ছে ওরা।
গ্রাফিতি
‘Grève Illimitée’, অর্থাৎ ‘Unlimited Strikes’ বা সীমাহীন ধর্মঘট। গ্রাফিতিটির তিনটি আকার- ছাত্র, ইউনিয়নের সদস্যগণ এবং শ্রমিকশ্রেণির হাতে হাত মিলিয়ে বিপ্লবে অংশগ্রহণের প্রতীক।
‘We are the power’। একই সাথে পথে যখন নেমেছি, আমরাই আনবো পরিবর্তন। আমরাই শক্তি, আমরাই বল!
বোতলের গায়ে “PRESSE NE PAS AVALER” , অর্থাৎ ‘Press do not swallow’ বা প্রেসকে যেন বিশ্বাস না করা হয়। কারন তখনকার সময়ে সংবাদমাধ্যমগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ছিল।
লেখা ছিল দেওয়ালে Plants, universities, union। কারখানা, ইউনিয়ন এবং শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের সমাগম ঘটে ফরাসির আটষট্টির এই আন্দোলনে। গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয় তাদের একতা।
‘Lalutte continue’, অর্থাৎ ‘Struggle continues’। সংগ্রাম চলছে, চলবেই। কোনোপ্রকার বৈষম্যকে পেছনে ফেলে সবার একই লক্ষ্য অর্জনে সকলে সংঘবদ্ধ। তাদের সংগ্রাম চলছে, চলবেই।
এই গ্রাফিতিতে ছবিতে পাশাপাশি লেখা ‘The beauty in the streets’। পথেঘাটে মানুষের ঢল, দেয়ালে গ্রাফিতি, দেয়াললিপিতে সজ্জিত বিপ্লবের জয়গান। পথেই যেন সকল সুখ, সকল তৃপ্তি। বুর্জোয়াদের বিলাসবহুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত সমাজে যা নেই, তার অধিক সৌন্দর্য শোভা পায় আন্দোলনরত জনগণের রাজপথে।
প্রতীকি অর্থে তুলে ধরা হয়েছে চুপ থাকার নির্দেশকে। ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গ্যল কারো মুখ চেপে ধরে বলছেন “Be young and shut up”, সকল তরুণকে, তরুণ সমাজকে যেন চুপ করে থাকার আদেশ দেন তিনি।
‘Information libre’ মানে ‘Free information’। গণমাধ্যমের গলা তখন চেপে ধরা হয়েছিলো। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ছিল না। আন্দোলনকে বাধা দিতে সকল ব্যবস্থা জারি রেখেছিলো উচ্চ শ্রেণি, তথা বুর্জোয়া সমাজ।
উপরের সকল দেয়াললিপি এবং গ্রাফিতি বহন করছে অগ্নিশক্তি। কথাগুলো যেমন সত্যসুন্দর, ছবিগুলো তেমন উন্মুক্ত-বিশুদ্ধ। যেন শুধু ছবি নয়, তারাও কথা বলছে। স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা, বুর্জোয়াদের ক্ষমতার জোর আর শোষিত শ্রেণির অধিকার আদায়ের সংকল্প।
১৯৬৮ সালের মে মাসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, তাদের সঙ্গে ফরাসি শ্রমিকরাও যোগ দিয়ে নতুন মাত্রা দেয় বিপ্লবের। পুঁজিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তরুণরা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে উঠেপড়ে লাগে। তারা স্বপ্ন দেখতো রক্ষণশীল ভাবধারা ও কড়া নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার, স্বপ্ন দেখতো বৈষম্যহীন সমাজের, স্বপ্ন দেখতো সাম্যাবস্থা ফিরে পাওয়ার। অসংখ্য প্রাণ যায়, অসামান্য ক্ষতিগ্রস্ততা, গ্রেফতারকৃত ছাত্র-শ্রমিক রাত-দিন এক করে আন্দোলন করে যায়। শুধু মুখের ভাষাকে পুঁজি করে নয়, তারা হাতিয়ার করে দেয়ালচিত্র এবং দেয়াললিপিকে। লেখনী ও আঁকিয়েদের ধার মনে দাগ কাটে গোটা বিশ্ববাসীর। সর্বস্তরের মানুষের একতা পরিবর্তন আনে। ছোট ছোট বিষয়ে জয়ী হতে শুরু করে তারা। এরপর একসময় সরকারের পতন হয়। সেদিনের ছাত্র আন্দোলনের সফলতার ছায়া পড়েছিল দুনিয়া জুড়েই। তাই আজও ফ্রান্সে শ্রমিক অধিকারসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে।
তাদের আন্দোলনে দেয়ালচিত্রগুলোর অবদান অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি বিপ্লবে দ্বিগুণ মাত্রা যোগ করে। এরকম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে বহু সময়ে বহু দেশে। ভারতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ আন্দোলন, ব্রাজিলের ক্ষুধার্ত শিশুর দেয়ালচিত্র, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরায়েল-সিরিয়ার যুদ্ধসহ আরও অনেক অস্থিরতার সময়গুলোতে ছিল গ্রাফিতির জয়জয়কার। বাংলাদেশেও সময়ে সময়ে দেখা গেছে দেয়ালচিত্র। তবে খুব সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাফিতি দেখা যাচ্ছে আবার। ‘সুবোধ’ নামের গ্রাফিতি ২০১৭ সালের শেষার্ধে জনগণকে আকৃষ্ট করেছিল। এর সব ক’টিতে লেখা:
- ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’
- ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’
- ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’
- ‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের মনে’
- ‘সুবোধ, কবে হবে ভোর?’
- ‘সুবোধ তুই ঘুরে দাঁড়া’
পাশে ছোট্ট করে লেখা আছে, ‘HOBEKI?“। সুবোধ চরিত্রের গ্রাফিতিগুলো যেন জনসাধারণের প্রশ্নের চিত্রায়িত রূপ। যদি চিত্রগুলোকে ব্যখ্যা করা হয়, তাহলে দেখা যায় সুবোধ চরিত্রটিকে প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সুবোধ একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের জনগণ। সে ক্লান্ত, হতাশ, বিক্ষুব্ধ। সুবোধ অনেক কষ্টে আছে। যে সমাজে ভালোবাসা নেই, সে মুক্ত হতে চায় সেই সমাজ থেকে। সে জানতে চায় কবে ভোর হবে, সুন্দর সকাল কবে আসবে। তবে মুক্তি মেলে না তার, তাই সে হয়ত পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাকে বেছে নেওয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু পালানো কোনো সমাধান না, তাই তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
শুধু সুবোধ নয়, এখন দেশের অনেক প্রান্তেই দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদের গ্রাফিতিচিত্রগুলোকে। বাচনিক যোগাযোগের চেয়ে এই অবাচনিক যোগাযোগের মাধ্যম গ্রাফিতির শক্তি কিন্তু ঢের বেশি।