পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে ইংরেজ কোম্পানির প্রভাব বাড়তেই থাকে, ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে ভিড়তে থাকে ব্যবসায়ী জাহাজ। সেই জাহাজে ব্যবসায়ীদের ভিড়ে খুব অল্প হলেও খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে আসতে শুরু করেন মিশনারীরা। কিন্তু ব্যবসা কিংবা ধর্মপ্রচারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষা।
ভারতবর্ষ আশ্চর্য এক এলাকা, এর ভাষার ভীষণ বাহার। কয়েকশো মাইল পাড়ি দিলেই মানুষের মুখের ভাষা বদলে যায়। হিন্দি, বাংলা, উর্দু, ফারসি, তামিল আরো কত শত ভাষা। তাই সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ইংরেজির পাশাপাশি বেশ অনেকগুলো ভারতীয় ভাষা জানে এমন কিছু পণ্ডিত নিয়োগ দেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। তাদেরকে মুন্সী নামে ডাকা হতো। মূলত, ফারসি ভাষায় মুন্সী শব্দের অর্থ পণ্ডিত। মুন্সীদের প্রধান দায়িত্ব ছিল দোভাষীর কাজ করা এবং ব্যবসায়িক ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া।
এই মুন্সীগিরি করে অনেকেই সমাজে বিশাল প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন সেই আমলে। মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর প্রথম জীবনে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সী। উর্দু, ফারসি, আরবি আর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ছিল তার। তুখোড় বুদ্ধির অধিকারী নবকৃষ্ণ বাহাদুর পরে রবার্ট ক্লাইভেরও মুন্সী হয়েছিলেন। মুন্সীর কাজ করতে গিয়েই দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তির খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেন তিনি। ইংরেজদের আনুকূল্যে মহারাজা উপাধি নিয়ে কলকাতার মাথা হয়ে উঠেছিলেন এই নবকৃষ্ণ বাহাদুর।
তবে সব মুন্সীদের ভাগ্যে এমন জমিদারি আর প্রভাব প্রতিপত্তি জুটেনি। অনেকেই নীরবে কাজ করে গেছেন। ধর্মপ্রচার করতে গেলে মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারা আর মুখের ভাষা পড়তে পারা দুইটাই জরুরী। এই কাজে মুন্সীরা সেতুবন্ধন তৈরি করে দিতেন। এমনই এক মুন্সী ছিলেন রামরাম বসু, অল্প বয়সেই তিনি মুন্সীগিরি শুরু করেন। উইলিয়াম চেম্বার্সের সাথে ফারসী দোভাষী হিসেবে কাজ করে ইংরেজীও শিখে নিয়েছিলেন ভালোই।
১৭৮৩ সালে ভারতে আসেন ব্যাপটিস্ট ধর্মপ্রচারক জন টমাস। এদেশের মানুষের সাথে কথা বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করবেন। কিন্তু দরকার ভাষা শিক্ষা, উইলিয়াম চেম্বার্সের সুপারিশে রামরাম বসুকে টমাস তার মুন্সী নিয়োগ দিয়েছিলেন ১৭৮৭ সালে। সেই থেকে রামরাম বসুর যাত্রা শুরু, এরপর সারা জীবনই তিনি মিশনারীদের মুন্সীগিরি করেছেন, সাথে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এক নতুন পথ তৈরি করে দিয়েছেন।
সে বছরেই ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে টমাস বেরিয়ে পড়লেন মালদহে, সেখানে কোম্পানির রেশম কুঠির রেসিডেন্ট জর্জ উডনীর সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল তার। মুন্সীর সহায়তায় খুব দ্রুত বাংলা আর ফারসী শিখে সাধারণের মাঝে বেরিয়ে পড়লেন টমাস।
মুন্সী রামরাম বসুও ছিলেন চালাক চতুর লোক। তিনিও খুব দ্রুত বাইবেল আত্মস্থ করে নিলেন। কথায় কথায় বাইবেলের প্রসঙ্গ টেনে মুগ্ধ করে দিতেন টমাসকে। পাশাপাশি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যাও দিতে শুরু করলেন। টমাস খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন তার মুন্সী বিদ্বান লোক, তাকে ছাড়া কাজ চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে।
১৭৯২ সালে টমাস টমাস যখন ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন তখন সাথে নিয়ে গেলেন মুন্সী রাম বসুর রচনাকৃত ‘খ্রীস্ট মহিমা সংগীত’। টমাস ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রস্তাব দিলেন উইলিয়াম কেরীকে ভারতে গিয়ে ধর্মপ্রচারের জন্য। স্ত্রী ডরোথির অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেরী ইংল্যান্ডের নিশ্চিত জীবন ছেড়ে সপরিবারে পাড়ি জমালেন অনিশ্চিত রাজ্য ভারতের দিকে। ভারতে বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করার সংকল্প নিয়ে জাহাজে বসেই টমাসের কাছে বাংলা শেখা শুরু করে দিয়েছিলেন।
কলকাতার বন্দরে নেমেই কেরীর সাথে টমাস পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মুন্সী রামরাম বসুকে। সেই শুরু, তারপর তিনি দীর্ঘ সময় কেরীর সাথে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন।
উইলিয়াম কেরী আর তার মুন্সীর এই দীর্ঘ পথচলা নিয়ে আছে উপন্যাসও। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ নামের ঐতিহাসিক উপন্যাসে কেরী আর রাম বসুর পথচলার পাশাপাশি তখনকার সমাজের চিত্রটিও তুলে ধরেছেন উপন্যাসের লেখক প্রমথনাথ বিশী।
উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায়, কলকাতার ঘাটে নামার পরেই কথাবার্তা শুরু হয়ে যায় কেরী আর বসুর। বসুর সাথে কথা বলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বাকপটু রাম বসু জানেন কীভাবে মানুষের মন রক্ষা করতে হয়। মাসপ্রতি বিশ টাকা বেতনে কেরী তৎক্ষণাৎ রাম বসুকে মুন্সী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
উপন্যাসে কেরী, রামরাম বসু, টমাসের মতো খাঁটি ঐতিহাসিক চরিত্র ছাড়াও আরো কিছু চরিত্র আছে যেগুলোকে লেখক আখ্যা দিয়েছেন ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত। প্রথমেই বলতে হয় টুশকি চরিত্রের কথা, রাম বসুর সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্ক টুশকির। স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বিবাদ করে টুশকির কাছে আশ্রয় খুঁজে রাম বসু। তার ঘরে বসেই যীশু খ্রীস্টকে নিয়ে গীত রচনা করে।
কেরীর সংসারেও শান্তি নেই। কেরীর স্ত্রী ডরোথি ভারতের ব্যাপারে শুরু থেকেই নানা ভয়ের গল্প শুনে এসেছিল, বন জঙ্গল সাফ করে ঘেঁষে গড়ে উঠা লোকালয় কলকাতা, সন্ধ্যার পরেই শেয়ালের ডাক চারদিক থেকে। বাঘ শেয়ালের ভয়ে শুরু থেকেই কাবু ছিলেন তিনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভারতবর্ষের ব্যাপারে তার ভয় থেকে গিয়েছিল।
নানা ঘটনাচক্রের সম্মুখীন হয়ে কেরী চিন্তা করলেন কলকাতার বাইরে গিয়ে ধর্মপ্রচার করবেন। জর্জ উডনী নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ীর নীল আর রেশমের কুঠির দায়িত্ব নিয়ে কেরী গেলেন মালদহ জেলার মদনাবাটিতে।
বজরা নিয়ে কলকাতা থেকে মদনাবাটির পথে কেরী সতীদাহের হাত থেকে রক্ষা করলেন এক তরুণী বিধবা রেশমীকে। চিতা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামের গোঁড়া নেতাদের ক্রোধানলে পড়ে যায় রেশমী। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল পিতা-মাতাহীন রেশমীকে সরিয়ে দিয়ে তার সম্পত্তি দখল করা। রেশমী পালিয়ে যাওয়ায় তাদের উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যায়।
অন্যদিকে রামরাম বসু মদনাবাটিতে কেরীকে বাংলা, সংস্কৃতের শিক্ষা দিতে থাকেন। কেরী সাহেবের উদ্দীপনায় নীলকুঠীতে চালু হয় ছেলে-মেয়েদের স্কুল। সেখানেও চলতে থাকে শিক্ষা। রেশমী খুব দ্রুতই শিখে নিতে থাকে ইংরেজী। সময় গড়িয়ে যায়, রেশমীকে ভালো লেগে যায় রামরাম বসুর।
আলোকে সামনে রেখে দাঁড়ালে পেছনে যেমন ছায়া পড়ে, ঠিক সেভাবে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ উপন্যাসে ইতিহাসের আলোতে তুলে আনা হয়েছে কেরী, রামরাম বসুকে। তাদের মূল চরিত্রকে দিয়ে এই উপন্যাস কখনোই বিচার কিংবা যাচাই করা সম্ভব নয়।
ইংরেজদের আসার পর বাংলাসহ পুরো ভারতে এক পরিবর্তনের রেশ শুরু হয়েছিল। ইংরেজ কুঠিগুলোর আশপাশ থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই পরিবর্তন ছড়িয়ে যায়। সতীদাহ প্রথা অমানবিক ঠেকে দূরদেশ থেকে আসা হর্তাকর্তা এই বণিক আর পাদ্রীদের কাছে। কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক সমাজে চিতার আগুন থেকে বাঁচালেই কি তাকে মানুষের লালসার আগুন থেকে বাঁচানো যায়?
তবে উপন্যাস কিংবা ইতিহাসের পাতায়, দৃঢ় প্রত্যয়ী উইলিয়াম কেরী ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। স্ত্রী, পুত্রকে হারিয়েছেন কিন্তু মনোবল অটুট রেখে কাজ করে গেছেন। কেরী আর তার মুন্সীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ্রীরামরামপুরে স্থাপিত প্রেস থেকে বাইবেলের বাংলা আর সংস্কৃত অনুবাদ বেরিয়েছে। তেরোটি ভারতীয় ভাষাকে আয়ত্ত্ব করে একটি বহুভাষিক অভিধানও রচনা করেছিলেন কেরী। তবে অভিধান ছাপাকালীন সময়ে শ্রীরামপুর প্রেসে আগুন লেগে হাজারখানেক মূল্যবান বই, পাণ্ডুলিপি আর কাগজ পুড়ে যায়।
কেরীকে সহায়তার পাশাপাশি তার মুন্সী হিসেবে রামরাম বসুও বাংলা সাহিত্যের ভিত গড়ার কাজটি করে দিয়ে গিয়েছেন। ১৮০১ সালে যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ চালু হয় সেখানে রামরাম বসুকে সহকারী মুন্সী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কলেজের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বারো ভুঁইয়াদের একজন রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ নামের এই বইটিকেই বাংলা ভাষায় বাঙালীর রচিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইতিহাসের সাক্ষী এই বইটিও ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকে। এই বইয়ের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কাউন্সিল তাকে পুরস্কৃত করে। এর পরের বছর ‘লিপিমালা’ নামে বিভিন্ন কাজের উপযোগী একটি চিঠিপত্রের সংকলন রচনা করেন, এটিও মিশন প্রেস থেকে ছাপা হয়। এছাড়া খ্রিস্টের প্রশংসা করে স্তবগান রচনায়ও তিনি ছিলেন পটু। তার স্তবগানে খ্রিস্টের প্রতি ভক্তি আর খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি অনুরাগ দেখে পাদ্রীরা ভাবতেন এই বুঝি রামরাম বসু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেবে। কিন্তু সেটি আর কোনোদিনই হয়নি। বাকপটু, জ্ঞানী আর চালাকচতুর এই মানুষটি শেষজীবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সহকারী মুন্সী হিসেবে।