ভাষার জন্যে পূর্ব বাংলার আপামর বাঙালিদের আন্দোলন শুধু বাংলা নয় বিশ্বের ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা আছে। প্রাপ্তির খাতায় আছে ২১ এ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। কিন্তু আমরাই একা নই যারা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলেছি। বাংলার জন্যে লড়াই করেছেন আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যের বাংলাভাষী সাধারণ মানুষ। আজকে সেই সোনালী ইতিহাসের আদ্যোপান্ত জানবো।
আসাম ভারতের উত্তরপুর্বাংশে বহ্মপুত্র আর বরাক নদীবিধৌত এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভুমি। বাংলাদেশ আর ভুটানের সাথে এর সীমান্ত। পাশাপাশি এই রাজ্য ভারতের পাহাড়ঘেরা সেভেন সিস্টার্স এর একটি। সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাত পাহাড়ি কন্যা হলো ভারতের উত্তরপুর্বের ৭ টি রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মিজোরাম ও মনিপুর।
আসামের ভাষাচিত্র
বৈচিত্রের এই প্রদেশ আসামের ভাষা হলো “আসামীজ” বা “অসমিয়া” যা বাংলার একই গোত্র ইন্দো-ইউরোপীয়র অন্তর্গত। বাংলার লিখিত রুপ যেখানে ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত সেখানে ‘অসমিয়া’ র লিখিত রুপের উতপত্তি হলো নাগ্রী লিপি থেকে। তাই ‘অসমিয়া’ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবিদদের কাছে বাংলার সবচেয়ে কাছের পুর্ণাংগ ভাষা হিসাবে স্বীকৃত।[1]
নীচে অসমিয়াতে খচিত কিছু রৌপ্যমুদ্রার চিত্র দেয়া হলো –
আসাম প্রদেশে কিন্তু অসমীয়ই একমাত্র ভাষা নয়, প্রচলিত আছে বাংলা, বদো, হিন্দি, নেপালি, মিশিং, কারবি সহ আরো বেশ কয়েকটি ভাষা। মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ) কথা বলেন অসমিয়া ভাষায়। বাংলা ভাষায় কথা বলেন প্রায় ২৭.৫ শতাংশ।[2]
ভাষা নিয়ে বিপত্তির শুরু
১৯৪৭ – এ দেশভাগের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তি্ত হয় বহ্মপুত্র বিধৌত এই উর্বর ভুমিতে। চুড়ান্ত বিপত্তি বাধে যখন ১৯৬০ এর এপ্রিলে আসামের প্রাদেশিক পরিষদে বিল উঠে অসমিয়া কেই একমাত্র প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেবার বিল উঠবার পরে। [2]
বহ্মপুত্র আর বরাক তীরের এই আসামের রাজনীতিসচেতন বাঙ্গালিরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয় আসামে। দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান পশ্চিমবঙ্গ সহ আশপাশের রাজ্যগুলোতে।[2]
দাঙ্গা যখন একটু শান্ত হয় তখন ১০ অক্টোবর আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমল প্রসাদ আবারো বিল তোলেন অসমিয়াকে একমাত্র প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার। অনেক বিতর্কের পর ২৪ অক্টোবর তা প্রাদেশিক পরিষদে পাশ হয়ে যায়।[2]
ভাষার জন্যে সংগ্রামে আপামর জনতা
আসাম সরকারের এই অবিচারের প্রতিবাদে বাংলা ভাষাভাষীরা ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ “গণসংগ্রাম পরিষদ” গঠন করেন। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ে ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ, হালিয়াকান্দি তে পালিত হয় “সংকল্প দিবস”।[2]
২৪ এপ্রিল পরিষদ এক পদযাত্রার আয়োজন করে বরাক পার, শিলচর আর করিমগঞ্জের সাধারণ মানুষ্কে তাদের দাবির পক্ষে সংগঠিত করা শুরু করেন। পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোশনা দেন যদি ১৩ এপ্রিল ১৯৬১ এর মধ্যে যদি অসমিয়ার সাথে বাংলাকে ও প্রাদেশিক ভাষার স্বীকৃতি দেয়া না হয় তবে ১৯ এপ্রিল সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালন করবে। অন্যান্য ক্ষুদ্র ভাষাভাষীরা ও যোগ দেয় এই পরিষিদে তাদের নিজ নিজ ভাষার মর্যাদা বুঝে পেতে।
সরকার এই দাবিকে অযৌক্তিক ঘোষণা করে এবং ১৮ মে আসাম পুলিশ এই আন্দলনের তিন নেতা নলিনীকান্ত দাশ, রথীন্দ্রনাথ সেন এবং বাংলাভাষায় প্রকাশিত এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের মুখপাত্র “যুগশক্তি” পত্রিকার সম্পাদক বিধুভুষণ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। [2]
এই ঘটনার জের ধরে আসামে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯ মে হরতাল পালিত হয়। আসামের যোগাযোগের মুল ব্যবস্থা রেল চলাচলকে কার্যত অচল করে দেন আন্দোলঙ্কারীরা শান্তিপুর্ণ অসহযোগ পালনের মাধ্যমে, রেলওয়ে ট্রেনের টিকেট ব্রিক্রি থেকে সকল ক্ষেত্রে বাঙ্গালিরা মুলত শান্তিপুর্ণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ অসহযোগে বাধ সাধে “আসাম পুলিশ” এবং “আসাম রাইফেলস”। [2]
আসাম পুলিশ নির্বিচারে এইদিন তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে লাঠিচার্জ করে এবং ছত্রভংগ করে দেয়। এই সময় পুলিশ আসাম রাইফেলস বাহিনীর ট্রাকে করে গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে যেতে উদ্যত হয়, ঠিক তখনি এই শান্তিপুর্ণ আন্দোলন রুপ নেয় সহিংস আন্দোলনে। আন্দোলনকারীদের কেউ একজন ট্রাকে আগুন দেয় এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়।
সামরিক বাহিনী স্টেশনের নিয়ন্ত্রনে আনতে গুলি চালায় জনতার উপরে। ১২ জন বুলেটবিদ্ধ হন এবং ৯ জন ঐ স্থানেই মারা যান।[2]
পরবর্তীতে বুলেটবিদ্ধ আরো দুজন হাসপাতালে মারা যান, এর মধ্যে কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি বুলেটের আঘাত নিয়ে ২৪ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হার মানেন।[2]
নৃশংস এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আসামবাসী ফুসে ঊঠেন। পরদিন অর্থাৎ ২০ মে ১৯৬১ শিলচররের বাসিন্দারা মৃতদেহ কাধে নিয়ে এক র্যালিতে অংশ নেন। সরকারের এই ঘৃণ্য কর্মকান্ডের প্রতিবাদে তারা সোচ্চার হোন।
মোট এগারোজন এই আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। এর মধ্যে নয়জন সরাসরি বুকের তাজা রক্তে লিখে গেছেন ইতিহাস। আর দুজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে পরাজিত হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।[2]
স্বীকৃতি
এই ঘটনার পর সারা ভারতজুড়ে সাড়া পড়ে যায় এবং আসাম রাজ্য সরকার বাধ্য হয়ে অসমিয়াকে একমাত্র প্রাদেশিক ভাষা করার আইনটি রহিত করে দেয় এবং বাংলাকে অন্যতম প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়।
শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে স্তাপিত হয়েছে ভাষা শহিদ স্মরণে একটি স্মৃতিফলক। প্রতিবছর ১৯ মে আসামে পালিত হয় প্রাদেশিক ভাষা সংগ্রাম দিবস।[4]
এই সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রাদেশিক সরকার শিলচর স্টেশনের নামকরণ করেন “ভাষা শহিদ স্টেশন” [4]
ইতিহাস কথা কয়
১৯৫২ সালের ২১ এ ফেব্রুয়ারি যেমন পাকিস্তানিরা আমাদের চাপিয়ে দিতে পারেনি বাংলা ঠিক তেমনি আসাম সরকার সংখ্যালঘু বাংলা ভাষাভাষীদের উপর অন্য ভাষা চাপিয়ে রেহাই পায়নি। এই আন্দোলন সংঘঠকদের ইশতেহারে মুলমন্ত্র ছিলোঃ
“আমাদের আন্দোলন অসমিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বরং বাংলা সহ সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার নায্য দাবিতে” [2]
কারো ভাষা কারো উপর চাপিয়ে না দেয়ার মানসিকতাই হোক প্রতিটি রাষ্ট্রের সংস্কৃতির ভিত্তি। প্রথম বারের মত বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় রচিত বইগুলো পৌছে যাবে জানুয়ারির ১ তারিখের বই উৎসবে, ভাষার জন্যে জীবন দেয়া জাতির এই সাহসী উদ্যোগে সাফল্য কামনায় পুরো বাংগালি জাতি।