রাজা-বাদশাহদের নানা কীর্তিকলাপের কথা আমরা কম বেশি সকলেই জানি। রাজাদের এমন সুনাম কিংবা দুর্নাম এখন আর কারো অজানা নেই। যদিও এখন আর সেই রাজাও নেই, নেই সেই রাজত্ব। একসময় ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকদের অনুগত হিসেবে অনেক রাজা বহাল তবিয়তে রাজত্ব করতেন। সেই সময় এই ভারত উপমহাদেশে বহু রাজা-মহারাজারা অত্যন্ত দাপটের সাথে রাজত্ব করে গেছেন।তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল বেহিসাবী, ভোগবিলাসে মত্ত। কেউবা ইচ্ছেমত প্রজাদের উপর হুকুমদারী করতেন। কেউ কেউ আবার সমাজে নানা উপকারও সাধিত করেছেন।
আবার এদের কারো কারো ছিল নানা অদ্ভুত বাতিক। যেমন: পাতিয়ালার এক রাজার বাতিক ছিল বছরের একদিন খালি পায়ে প্রকাশ্যে রাজপথে হেঁটে বেড়ানো। আবার জনুগড়ের রাজার মর্জি হয়েছিল তার প্রিয় কুকুরের বিয়ে দেওয়া। যেমন তেমন বিয়ে নয়, নবাব তার প্রিয় কুকুরের বিয়ে দিয়েছিলেন রাজকীয় মর্যাদায়, যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন অন্যান্য দেশের রাজা, মহারাজা, বড় লাট সহ বহু গণ্যমান্য অতিথি। রামগড়ের রাজার বাতিক ছিল প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলেই গরুর মুখ দেখা। গরুর মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠলে রাজার নাকি দিন ভালো যায়। আজগুবি এসব খেয়াল আর নানা বাতিকের জন্য তাদেরকে এখনও অনেকে মনে রেখেছেন। সেইরকম অদ্ভুত, খামখেয়ালিতে ভরা কয়েকজন রাজা-বাদশাহার উদ্ভট বাতিকের কথাই জানাব।
সম্রাট জাহাঙ্গীর
জ্যোতিষদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের। তিনি তার প্রতিটি কাজ করার জন্য ঘড়ি ধরে, শুভ সময় দেখে নিতেন। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময়, অভিযানে গেলে বা অন্য কোনো কাজে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে পাঁজি না দেখে কখনো বেরোতেন না। শুভ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতেন। শুভ সময় এলেই তবেই বের হতেন। কিন্তু একবার পাঁজি দেখে, শুভ মুহূর্ত দেখে বেরোতে পারেননি। বিদ্রোহ দমনে তাকে তাড়াতাড়ি অভিযানে যেতে হয়েছিল্। যিনি সামান্য কাজের জন্য শুভ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতেন, অথচ তিনি এরকম গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের সময় পরিস্থিতির চাপে পাঁজি দেখার সুযোগই পেলেন না। কিন্তু জাহাঙ্গীর সেই অভিযানে বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয়েছিলেন।
শুভ মুহূর্ত না দেখেও জয়ী হয়ে রাজ্যে ফিরে এলও তার কৌতুহল জাগে যে সময়টা তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন, সেই মুহূর্তটা কেমন ছিল। মনে মনে ভাবলেন নিশ্চয় দারুণ শুভ মুহূর্তেই তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন। রাজ জ্যোতিষীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই জ্যোতিষী বললেন, “যে সময়ে আপনি অভিযানে বেড়িয়েছিলেন, সেই সময়টা মোটেই শুভ ছিল না। শুভ মুহূর্ত দেখে যদি আপনাকে বেরোতে হতো তাহলে আপনাকে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হত।” জ্যোতিষীর কথা শুনে জাহাঙ্গীর বিস্মিত হয়েছিলেন।
এরপরও জাহাঙ্গীরের জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস এতটুকু কমেনি। আর এজন্য মুদ্রা তৈরির যে নিয়ম ছিল অর্থাৎ, যে জায়গা থেকে মুদ্রা চালু হয় সেই জায়গার নাম, মাসের নাম, রাজত্বের বছরের তারিখ মুদ্রায় থাকবে- জাহাঙ্গীর তা বদল করেন এবং মুদ্রায় রাশি-নক্ষত্রের নাম ও ছবি খোদাইয়ের ব্যবস্থা চালু করেন।
সুলতান কুতুবুদ্দিন মুবারক শাহ
সুলতান কুতুবুদ্দিন মুবারক শাহের উদ্ভট শখের জন্য অনেকেই বিব্রত হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হঠাৎ তার ইচ্ছে হল নারীর পোশাক পড়েই থাকবেন। নারীর সাজপোশাক ব্যবহার করবেন। আর এই খেয়ালেই তিনি দরবারে সম্রাটের পোশাক না পরে নারীর পোশাক পরে আসতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তার ইচ্ছেতেই সম্রাটের দরবারে রাজ্যের বারাঙ্গনাদের হল অবাধ প্রবেশাধিকার। দরবারে এসব নারীদের সাথে চটুল কথাবার্তায় মত্ত থাকতেন সম্রাট। কতো গণ্যমান্য ব্যক্তি সেই সভায় উপস্থিত থাকত। তা সত্ত্বেও কেউ প্রতিবাদ করেনি সম্রাটের এই অদ্ভুত খোমখেয়ালি আচরণের।
মল্লভূমের রাজা গোপাল রায়
অদ্ভুত খেয়ালিপনায় মল্লভূমের রাজা গোপাল রায়ও কম যেতেন না। হঠাৎ একদিন তার অদ্ভুত খেযাল চেপেছিল। তিনি নিয়ম করে তার সমস্ত প্রজাদের এক ঘন্টা হরি নাম কীর্তন করার বিধান চালু করেন। শুধু এতই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না, প্রত্যেক প্রজাকে একাদশীর দিন উপোস করার নির্দেশ দেন। তার এই নির্দেশ সকলে ঠিকমতো মেনে চলছে কিনা তা দেখার জন্য লোকলস্কর নিয়োগ দেন। এমনকি তিনি নিজেও মাঝেমাঝেই ছদ্মবেশে তা দেখতে বের হতেন।
গোয়ালিয়রের রাজা জিবাজি রাও সিন্ধিয়া
জিবাজি রাওয়ের শখ ছিল খাবার টেবিলে খাবারের পরিবেশনে বৈচিত্রময়তা আনার ব্যাপারে। একবার তিনি ঠিক করলেন রেলগাড়ি করে খাবার পরিবশেন করবেন যেখানে খাবার আপনা-আপনি থালায় পরিবেশিত হবে। আর এজন্য তার খাবারের টেবিলে এমন ব্যবস্থা ছিল যে রুপোর রেল লাইনের উপর দিয়ে নানা কারুকার্য করা সুদৃশ্য রেলগাড়িটি রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে আসত। তারপর তা সোজা টেবিলের উপর এসে প্রত্যেকের আসনের সামনের থালার উপর নিজে থেকেই খাবার পরিবেশিত হত। রাজা নীচে সুইচ টিপলেই রেলগাড়িটি খাবার নিয়ে চলতে শুরু করতো।
তবে তার এই উদ্ভট খেয়ালের জন্য তাকে বিপদেও পড়তে হয়েছিল। একবার জিবাজি রাও এক সম্রাটকে তার ভোজ সভায় নিমন্ত্রণ করেন। ভোজসভা দারুণভাবে সাজানো হয়েছে। সবারই কৌতুহল রেলগাড়িটির দিকে। খাবার সময় সকলে টেবিলে উপস্থিত। নানারকম সুখাদ্যে ভর্তি রেলগাড়িটি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে টেবিলের কাছাকাছি এসেছে। সম্রাটের কাছে এসে থামল সেটি। গাড়ির প্রথম দরজা খুলে বেরিয়ে এল সুস্বাদু হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি। হঠাৎ তখনি ঘটল এক বিপত্তি। দরজা খুলে বিরিয়ানি ভর্তি ট্রে সম্রাটের পাতে না পড়ে আচমকাই ট্রে থেকে খাবার পড়ল এক্কেবারে সম্রাটের কোলের উপর। চারিদিকে হৈচৈ লেগে গেল। রাজার রাজত্বই যায় আর কী! অনেক কষ্টে সে যাত্রায় রেহাই পেলেন জিবাজি রাও।
ভাওয়ালপুরের নবাব সাদিক মোহাম্মদ (চতুর্থ)
বিলাসী রাজাদের কিছু কিছু বাতিক ছিল ব্যয়বহুল। ঠিক তেমনি একজন ভাওয়ালপুরের নবাব সাদিক মোহাম্মদ(চতুর্থ)। শখের পালঙ্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে তিনি অদ্ভুত বাতিকের পরিচয় দিয়েছেন। তার পালঙ্ক ছিল গাঢ় রঙের রোজউড ফ্রেমের। প্যারিসের এক নামকরা শিল্পী এই কারুকার্য নির্মাণ করেন। পালঙ্কটি ছিল খুবই দেখার মতো। এর চার কোণে ছিল চারটি প্রমাণ সাইজের নারী মূর্তি। এই চারটি নারীর মূর্তি ছিল চারটি দেশের। ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালি ও গ্রীক নারীর। পালঙ্কের মধ্যে এমন কিছু কায়দা-কানুন করা ছিল যে, বিছানায় শুয়ে নড়াচড়া করলেই গানের সুর ভেসে আসে। আর সেই গানের তালে তালে নারীমূর্তিগুলো নাচতে শুরু করে। কি অদ্ভুত, তাই না!
মাহেশ্বরের মহারাণী অহল্যা বাঈ
রাজাদের মতো মহারাণীদেরও ছিল নানা উদ্ভট বাতিক। যেমন ছিলেন মাহেশ্বরের মহারাণী অহল্যা বাঈ। সুশাসক হিসেবে সুনাম থাকলেও তার এক বাতিক ছিল ভারি অদ্ভুত। প্রতিদিন তিনি শিব পুজো করতেন ঘটা করে। একবার তার হঠাৎ খেয়াল চাপল, তিনি প্রতিদিন বারো জন ব্রাক্ষণকে দিয়ে এক লক্ষ শিবলিঙ্গ গড়িয়ে তার পুজো দিবেন। তারপরই তিনি তার প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করবেন। তারপর থেকেই তার প্রাসাদ সংলগ্ন শিব মন্দির প্রাঙ্গনে প্রতিদিন ভোরে বারো জন ব্রাক্ষণকে দিয়ে শিবলিঙ্গ গড়িয়ে শিবের পুজো দিতে শুরু করেন। পুজো শেষ করতে করতে তার পক্ষে সেদিনের মতো রাজকার্য করার সময় থাকত না।
রাজাদের এসব আজব খেয়ালের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ভোগ বিলাসে কাটানো, প্রজাদের কষ্টকে উপেক্ষা করা এসব রাজাদের শেষ পরিণতি তেমন ভালো হয়নি। আজব খেয়ালের নানা ঝক্কি তাদেরকে নানা সময় পোহাতে হয়েছিল। এসব রাজাদের গুণের কথা তেমন শোনা না গেলেও তাদের নানা উদ্ভট খামখেয়ালিপনার গল্প আজো অনেক লেখকের গল্প উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়।