১৫৫৩ সালের গ্রীষ্ম, অটোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট পূর্বে সাফাভিদের বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের মতো অভিযান পরিচালনা করার জন্য রাজধানী ইস্তাম্বুল ছাড়লেন। যা ‘নাহচিভান’ অভিযান নামে পরিচিত।
রাজধানী ছাড়ার আগে সুলতান তার এক দূতকে আমাসিয়ার গভর্নর শাহজাদা মুস্তাফার কাছে পাঠালেন৷ দূত মারফত মুস্তাফাকে তার সৈন্যদের প্রস্তুত করে অভিযানে যোগ দেওয়ার খবর পাঠান৷
এরেগলির কাছে এসে সুলেমান আরেকজন দূতকে মুস্তাফার কাছে পাঠান। এবার তিনি জানান, সরাসরি অভিযানে যোগ না দিয়ে বরং তার সৈন্যরা পরবর্তীতে যেখানে তাঁবু খাটাবেন, সেখানে যেন মুস্তাফা আসে।
একমাত্র পুত্রের আসন্ন বিপদের কথা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন মাহিদেভরান সুলতান। শাহজাদা মুস্তাফার অনুসারীদের সকলেই সুলতানের সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছিলেন।
কিন্তু বাবার অনুগত শাহজাদা মুস্তাফার পক্ষে আদেশ অমান্য করা অসম্ভব ছিল। কেননা সুলতানের আদেশ অমান্য করলে তা হবে বিদ্রোহ ঘোষণার শামিল। তাই নিজের ভাগ্যের উপর ভরসা রেখে রওনা হলেন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় শাহজাদা।
৬ অক্টোবর ১৫৫৩, সৈন্য শিবিরের যে তাঁবুতে সুলতান সুলেমান থাকতেন, তার সামনে এসে উপস্থিত হলেন মুস্তাফা। গায়ে তখন শুভ্র রাজকীয় পোশাক। মাথায় দিয়েছিলেন সাদা পাগড়ি।
ঘোড়া থেকে নেমে সুলতানের তাঁবুতে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলেন শাহজাদা। তাকে বলা হলো, তার অস্ত্র জমা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে। সুলতানের নিরাপত্তা প্রহরীদের কাছে তলোয়ার আর ছোরা জমা দিয়ে তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করলেন শাহজাদা মুস্তাফা।
সুলতান সুলেমান তখন তার সিংহাসনে একটি তীর হাতে বসেছিলেন। মুস্তফা নিয়ম অনুসারে সুলতানের হাতে চুম্বন করতে গেলেন। কিন্তু হাত সরিয়ে গর্জে উঠে সুলতান বললেন,
আরে কুকুর, তোমার এখনো আমাকে অভিবাদন করার সাহস হয় কীভাবে?
শাহজাদা মুস্তাফা কিছু বুঝে উঠার আগে তাকে ঘিরে ধরেন তিনজন বধির জল্লাদ। সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তারা পেছন থেকে শাহজাদাকে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করেন।
শাহজাদা মুস্তাফা প্রায় তাদের হাত থেকে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে কয়েকজন মিলে আবার ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন তারই পিতা সুলতান সুলেমানের আদেশে। মুস্তাফার সাথে আসা এক ঘোড়সওয়ার ও এক আগাকেও হত্যা করা হয়।
শাহজাদা মুস্তাফার মৃত্যু জেনেসারিদের কাছে ছিল বজ্রাঘাতে মতো। শুধু তারাই যে মুস্তাফাকে ভালোবাসতেন- এমনটি নয়। সেই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সৈন্য থেকে শুরু করে আমলা, ধর্মীয় পণ্ডিত, কবি এবং সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি প্রভাবশালী পরিবার ও সাধারণ মানুষ মুস্তাফাকে ভালোবাসতেন।
সেই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করতেন, শাহজাদা মুস্তাফাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন সুলতান সুলেমানের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হুররাম সুলতান এবং তার জামাতা ও উজিরে আযম রুস্তম পাশা। এর কারণ ছিল একটাই- জনগণের প্রিয় শাহজাদাকে সরিয়ে হুররামের সন্তানদের জন্য সিংহাসনের পথ সুগম করা।
অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন এবং সাহিত্য রচনা করেছেন- তাদের সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে, মুস্তাফাকে হত্যার পেছনে হুররাম এবং রুস্তম দায়ী। তারা দুজন শাহজাদাকে সুলতানের চোখে বিদ্রোহী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যার ফলশ্রুতিতে সুলতান সুলেমানের মতো বিচক্ষণ সুলতান তার নিষ্পাপ সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
তবে এতক্ষণ যা পড়লে্ তা হচ্ছে শাহজাদা মুস্তাফার মৃত্যুর সাধারণ বিবরণ। কিন্তু তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হুররাম ও রুস্তমের একেবারে যে সহজ ছিল, তা কিন্তু নয়। এছাড়া এই হত্যার জন্য কে দায়ী তাও জানা উচিত।
যারা মুস্তাফার সম্পর্কে জানেন, তারা সবাই মনে করতে পারেন- এর জন্য একমাত্র হুররাম ও রুস্তম দায়ী। কিন্তু তিন পর্বের এ সিরিজে সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হবে শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যার পেছনের দৃশ্যপট এবং প্রকৃত অপরাধী।
তার আগে জেনে নেওয়া দরকার অটোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে যাওয়ার নিয়ম কী ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসন দখলের কালো আইন
অটোমানদের সিংহাসন লাভের আইন অনেকটা তুর্ক-মঙ্গোলদের মতো। যেখানে সুলতানের প্রত্যেক ছেলের অধিকার ছিল সাম্রাজ্য শাসন করার। তবে তুর্ক-মঙ্গোলদের সাথে অটোমানদের বড় এক পার্থক্য রয়েছে।
তুর্ক-মঙ্গোলদের আইন অনুযায়ী, রাজপরিবারের সকল পুরুষদের মধ্যে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল ভাগ করে দেওয়া হতো। এরপর তাদের মধ্যে যারা সিংহাসন লাভ করতে চাইতেন, তারা নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তেন। আর যদি কেউ সিংহাসনের প্রতি আকৃষ্ট না হতেন, তাহলে তার নিজের অঞ্চল শাসন করেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো।
কিন্তু অটোমানদের নিয়মানুসারে সাম্রাজ্যকে কয়েকটি সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত করার রীতি ছিল না। কিন্তু প্রত্যেক শাহজাদারই সিংহাসন লাভ করার অধিকার ছিল।
এর জন্য শাহজাদারা কৈশোরে পা দেওয়ার পরপরই তাদের প্রাদেশিক গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হতো, যাতে শাহজাদারা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জন করে ভবিষ্যত সিংহাসনের জন্য নিজেদের যোগ্য হিসেবে প্রস্তুত করতে পারে৷
কিন্তু এই নিয়মের কারণে অটোমান সাম্রাজ্যে ভ্রাতৃহত্যার মতো নির্মম এক রীতি তৈরি হয়। আর এই আইন তৈরি করে যান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ৷ তার আইন ছিল এমন,
সাম্রাজ্যের মঙ্গলের স্বার্থে শাহজাদাদের মধ্যে ঈশ্বর যাকে সিংহাসনের জন্য উপযুক্ত হিসেবে মনোনীত করবেন, তিনি তার অন্য ভাইদের আইনগতভাবে হত্যা করতে পারেন।
তার এই আইনকে অধিকাংশ ওলামা সমর্থন করেছিলেন, যা পরবর্তীতে এক হত্যার আইন হয়ে দাঁড়ায়। এই আইনের কারণে যিনি সিংহাসনে বসতেন, তিনি তার অন্য ভাইদের এবং তার সন্তানদেরসহ মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতেন৷ যদি তাদের কোনো অপরাধ নাও থাকে, তবু তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।
সুলতান প্রথম সেলিমের মৃত্যুর পর সিংহাসনের একমাত্র দাবিদার ছিলেন সুলেমান। কারণ তার আর কোনো ভাই ছিল না। এ কারণে তিনি প্রায় বিনা বাধায় সিংহাসনে আরোহন করেন এবং নিজ ঘরে কোনো শত্রু না থাকায় সাম্রাজ্যে আরোহন করেই সীমানা বিস্তৃত করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
কিন্তু তার সন্তানদের সেই সৌভাগ্য ছিল না। সুলতান সুলেমান যখন মানিসার গভর্নর ছিলেন, তখন তার সঙ্গী মাহিদেভরান ১৫১৫ সালে শাহজাদা মুস্তাফাকে জন্ম দেন। এরপর সুলেমান তার সঙ্গী হিসেবে হুররামকে বেছে নেন। তার গর্ভে পরপর মেহমেদ (জন্ম: ১৫২১), সেলিম (জন্ম: ১৫২৪), বায়েজিদ (জন্ম: ১৫২৫) এবং জাহাঙ্গীর (জন্ম: ১৫৩১) নামে চার শাহজাদার জন্ম হয়৷ এছাড়া তাদের মিহরিমা নামে একটি কন্যা সন্তান ছিল।
তবে ধারণা করা হয়, মুরাদ ও আব্দুল্লাহ নামে সুলতান সুলেমানের আরো দুইজন ছেলে ছিল৷ কিন্তু তারা শৈশবেই মারা যান। এছাড়া হুররাম সুলতানের বড় ছেলে মেহমেদও কৈশোরে মারা যান।
অটোমান সাম্রাজ্যে নিয়মানুসারে একজন দাসীর মাধ্যমে একজন সন্তান জন্ম দেওয়ার রীতি ছিল। কিন্তু সুলেমান হুররামকে শুধু প্রাণাধিক ভালোবাসেননি, দিয়েছিলেন স্ত্রীর মর্যাদা। এবং একমাত্র সুলতান হিসেবে লাশের খাট নিজের কাঁধে বহন করেছিলেন সুলেমান। আর সেই লাশ ছিল হুররাম সুলতানের।
তিন সন্তান মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে যাওয়ার সুযোগ ছিল চারজনের। এর মধ্যে শাহজাদা জাহাঙ্গীর অসুস্থ ছিলেন। ফলে তার সিংহাসন লাভের সম্ভাবনা ছিল না।
বাকি ছিলেন মুস্তাফা, সেলিম এবং বায়েজিদ। এই তিনজনের মধ্যে তাই লড়াই ছিল অনিবার্য। তবে যোগ্যতার দিক থেকে এগিয়ে ছিলেন মুস্তাফা। তারপরই ছিলেন বায়েজিদ। আর সেলিম ছিলেন মদ্যপ ও কবি, সাম্রাজ্য পরিচালনার মতো দক্ষতা ছিল না তার।
সুলতান সুলেমান বেঁচে থাকা অবস্থায় নিজের মতো যোগ্য দুই শাহজাদাকে হত্যার অনুমতি দিয়েছিলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত সিংহাসন লাভ করেন শাহজাদা সেলিম। ভ্রাতৃহত্যার যে আইন, তার নিষ্ঠুর প্রয়োগ করেছিলেন সেলিমের পুত্র সুলতান তৃতীয় মুরাদ। তিনি তার পাঁচ ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন।
তবে তিনি বাবা সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের চেয়ে যোগ্য ছিলেন না। মুরাদের ছেলে তৃতীয় মাহমুদ অটোমান সাম্রাজ্যে সবচেয়ে বড় ভ্রাতৃহত্যার ইতিহাস রচনা করেন। তিনি একসাথে ১৯ ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
শাহজাদা মুস্তাফার প্রতি সুুলতান সুলেমানের মনোভাব এবং রুস্তম পাশার ষড়যন্ত্র
উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন সুলতান সুলেমান। এরপরও তিনি সিংহাসনে বসার পর প্রথম ১০ বছর বেশ কয়েকটি উচ্চ বিলাসী অভিযান পরিচালনা করে সাম্রাজ্যের সীমানা আরো বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে যান।
তিনি আরবের নতুন ভূমি তো বটেই, দখল করে নেন বেলগ্রড এবং রোডস। প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেন হাঙ্গেরির রাজপরিবারকে। সেই সাথে লড়াই করেছেন হাবসবুর্গের সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সাথে।
উচ্চাভিলাষী অভিযানগুলো শেষ করার পর সুলতান সুলেমান কিছুটা ক্লান্ত ছিলেন। এ কারণে তিনি ১৫৪০ এর দশকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেন৷ সুলতান সুলেমান তখন বিশ্বের অধিপতি থেকে নিজেকে আঞ্চলিক এক সম্রাটে পরিণত করেন।
কিন্তু এরপরও সুলতান সুলেমানের লড়াই থেমে থাকেনি। তাকে প্রায় প্রতি বছরই পূর্ব অথবা পশ্চিমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে৷ কিন্তু তখন এই অভিযানগুলোতে সুলতান সরাসরি উপস্থিত না থেকে উজিরে আযমদের পাঠাতেন।
ওদিকে তিনি তখন ইস্তাম্বুলেই থাকতে পছন্দ করতেন। শীতকাল কাটাতেন এদির্নে। রাজকীয় বাগানে ঘুরে বেড়াতেন এবং মাঝেমাঝে শিকার করে সময় কাটাতেন৷
কিন্তু তার রাজধানীতে থাকার পেছনে অন্য কারণ ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার সন্তানদের মধ্যে লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে। তার অবর্তমানে কোনো শাহজাদা যাতে তাকে সিংহাসনচ্যুত করতে না পারে, তার জন্যই রাজধানীতে থাকতেন তিনি।
সুলেমান নিজেও মানুষের কাছে শাহজাদা মুস্তাফার সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জানতেন। সুলেমান তখন নিজেকে সেনাদের নেতৃত্ব দেওয়া থেকে সরে আসেন। রুস্তম পাশাকে উজিরে আযম হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর তাকে সেই দায়িত্ব দেন।
তখন অনেক সেনা শাহজাদা মুস্তাফাকে সিংহাসন দখলের জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। মুস্তাফা সায় দেননি। সৈন্যরা শাহজাদাকে এমন প্ররোচনা দিতে পারে, সে বিষয়ে সুলতান সুলেমান নিজেও অবগত ছিলেন।
শাহজাদা মুস্তাফার যোগ্যতা এবং মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা থাকলেও সুলতান সুলেমান তার উত্তরসূরি হিসেবে কখনোই তাকে বিবেচনা করেননি। তার প্রথম পছন্দ ছিল হুররাম সুলতানের বড় ছেলে মেহমেদ।
অটোমান সাম্রাজ্যের প্রত্যেক শাহজাদাকে সানজাকে যাওয়ার রীতি ছিল। প্রাদেশিক গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণই হচ্ছে সানজাক। আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সানজাক ছিল মানিসা।
১৫৩৪ সালে প্রথমে শাহজাদা মুস্তাফাকে মানিসায় পাঠানো হয়। এর ছয় বছর পর তাকে সেখান থেকে আমাসিয়াতে পাঠিয়ে দেন। আর মানিসার দায়িত্ব দেন মেহমেদকে।
আমাসিয়া থেকে ইস্তাম্বুলের দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। সেই তুলনায় রাজধানীর সাথে মানিসার দূরত্ব খুবই কম। তবে মানিসার চেয়ে আমাসিয়ার গুরুত্ব ছিল অনেক। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাসিয়াতে যোগ্য শাসক থাকা দরকার ছিল।
তবে শাহজাদা বুঝতে পারেন যে, সিংহাসন পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা পিছিয়ে পড়লেন। কিন্তু গুরুত্বের কথা ভেবে পদোন্নতি হিসেবেই ধরে নিলেন। ১৫৪৩ সালে শাহজাদা মেহমেদের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে শাহজাদা মুস্তাফা আবারো সিংহাসনের নিকটবর্তী হন। এমনকি সুলতান সুলেমান নিজেও তখন ছোট ছেলে শাহজাদা জাহাঙ্গীরের কাছে উত্তরসূরি হিসেবে মুস্তাফার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন,
আমার পুত্র মুস্তাফাই সুলতান হবে এবং তোমাদের সবাইকে বঞ্চিত (সিংহাসন) করবে।
শাহজাদা মুস্তাফাকে মানুষ কী পরিমাণ ভালোবাসতেন- তা এই লেখা পড়ে কিংবা কোনো সিরিয়াল দেখে পুরোপুরি অনুধাবন করা খুবই কঠিন। সাম্রাজ্যের উচ্চবিত্ত থেকে দাস পর্যন্ত সকলেই মুস্তাফাকে সুলেমানের উত্তরসূরি হিসেবে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি তার সাহসিকতা, উদারতা এবং স্বচ্ছতার জন্য সুনাম অর্জন করেছিলেন।
তাই মুস্তাফার মতো শাহজাদার সাথে লড়াই করা খুবই কঠিন ছিল। যেখানে অধিকাংশ মানুষ তাকে ভালোবাসেন, তাকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
জেনেসারিরা সুলেমানের মৃত্যুর আগেই মুস্তাফাকে সিংহাসনে দেখতে চেয়েছিলেন। কারণ সুলেমানের বয়স হওয়ায় তিনি সৈন্যদের নেতৃত্ব দিতে পারছিলেন না। জেনেসারিদের আশা ছিল, মুস্তাফা সুলতান হলে তারা পূর্ব ও পশ্চিমে সমানতালে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হবে।
জেনেসারিরা মুস্তাফাকে তার দাদা সুলতান প্রথম সেলিমের কথা মনে করিয়ে দেন। সুলতান প্রথম সেলিম তার বাবা সুলতান প্রথম বায়েজিদকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। যদিও সুলতান বায়েজিদ উত্তরসূরি হিসেবে শাহজাদা আহমেদকে পছন্দ করতেন।
তখন সেলিম জেনেসারি ও সিপাহীদের সহায়তায় রুমেলিতে তার বাবাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন৷ চাপের মুখে সুলতান বায়েজিদ ১৫১২ সালে সেলিমের হাতে সিংহাসন দিয়ে ইস্তাম্বুল ছেড়ে দিমেতোকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু যাত্রা পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মুস্তাফা তার দিক থেকে জেনেসারিদের পরিকল্পনাকে একেবারে নাকচ করে দেননি। তার আগে তিনি চারপাশে সাম্রাজ্যের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভেড়াতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি এরজুরামের গভর্নর আয়াজ পাশাকে নিজের ইচ্ছার কথা খুলে বলেন।
তবে মুস্তাফা তাকে বলেছিলেন, তিনি কখনোই তার বাবাকে সিংহাসনচ্যুত করবেন না; বরং তার মৃত্যুর পরই সিংহাসনে বসতে চান৷ সেই সময়ে তার সাথে পাশে থাকার এবং প্রস্তুতি নেওয়ার আবেদন জানান। আয়াজ পাশা তখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমলা। তিনি শাহজাদা মুস্তাফাকে আশ্বস্ত করেন।
সুলতান সুলেমান সবসময়ই হুররাম সুলতানকে সুবিধা দিয়েছেন। তার জন্য নিয়ম লঙ্ঘনও করেছেন। সুলতান সুলেমান হুররামকে বিয়ে করলে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীতে পরিণত হন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি চেয়েছিলেন সুলেমানের মৃত্যুর পরও তার এই ক্ষমতা বজায় থাকুক। যার একমাত্র উপায় ছিল তার কোনো সন্তানকে সিংহাসনে বসানোর ব্যবস্থা করা।
হুররাম সুলতান অটোমানদের নিয়ম লঙ্ঘন করে মেহমেদের সাথে মানিসায় থাকেন। নিয়মানুসারে কোনো শাহজাদার মা তা করতে পারেন না। কিন্তু মেহমেদের মৃত্যু তাকে লড়াই থেকে পিছিয়ে দেয়। তখন তিনি আরো মরিয়া হয়ে উঠেন।
১৫৪০ সালের শেষ এবং ১৫৫০ সালের শুরুর দিকে সুলতান সুলেমানের ছেলেদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। এই কারণেই সুলেমান তখন কোনো অভিযানে না গিয়ে রাজধানীতেই থাকতেন, যা পূর্বেও একবার উল্লেখ করা হয়েছে।
১৫৪৫ সালের শেষের দিকে শাহজাদাদের মধ্যে বিরোধের কারণে রুস্তম পাশা হাবসবুর্গের সাথে শান্তিচুক্তি করার প্রস্তাব দেন। ১৫৪৭ সালে হাবসবুর্গের দূত জেরার্ড ভেল্টউইক এবং ১৫৫০ সালের ফেব্রুয়ারীর দিকে মেলভেজ্জি খবর পাঠান যে রুস্তম পাশা শাহজাদা মুস্তাফাকে সরিয়ে দিতে চান৷
এই চক্রান্তে শুধু রুস্তম পাশা ছিলেন না৷ হুররাম সুলতান, মিহরিমা সুলতান এবং রুস্তম পাশা অটোমান সিংহাসনে বায়েজিদ অথবা সেলিমকে বসাতে চেয়েছিলেন।
সুলতান সুলেমানের উজিরে আযম এবং জামাতা রুস্তম পাশা ছিলেন ‘ডেভসিরমে’ পদ্ধতিতে আসা খ্রিস্টান বালক। এই পদ্ধতিতে বলকান অঞ্চল থেকে ৮-২০ বছরের খ্রিস্টান বালকদের তুলে নিয়ে লালনপালন করে সাম্রাজ্যের কাজে লাগানো হতো৷ তবে তারা কিন্তু খ্রিস্টান থাকতেন না, তাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হতো।
রুস্তম পাশা শুরুতে হারেমের আস্তাবলের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর হুররাম সুলতানের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। হুররাম সুলতান তাকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে নিয়ে আসেন। এবং শেষ পর্যন্ত ১৫৪৪ সালে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানের পরে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধরদের একজন হন।
এরপর রুস্তম পাশার বিয়ে হয় সুলতান সুলেমান ও হুররাম সুলতানের একমাত্র মেয়ে মিহরিমার সাথে। এই বিয়ের ফলে হারেম ও দরবারের সাথে তার এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে।
রুস্তম পাশা নিজের স্বার্থে মুস্তাফাকে প্রতিহত করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন। তিনি জানতেন, যদি হুররাম সুলতানের কোনো এক ছেলে সিংহাসনে বসতে পারেন, তাহলে তিনি তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। এর জন্য মুস্তাফার সুনাম নষ্ট করে কীভাবে সুলতানের চোখে খারাপ বানানো যায়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
উদাহরণ হিসেবে দুইটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। ১৫৪৯ সালে জর্জিয়ানরা এরজুরামের গভর্নরকে হত্যা করেন। আমাসিয়া থেকে মুস্তাফা তখন সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু রুস্তম পাশা কোনো সাহায্যই পাঠাননি।
পরের বছর ইরান থেকে কিছু ডাকাত অটোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করে স্থানীয় লোকজনের বাড়িঘরে ডাকাতি শুরু করে। মুস্তাফা আবারো সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু এবারো রুস্তম পাশা তা নাকচ করেন। এর কারণ সাহায্য পাঠানোর পর মুস্তাফা যদি সফল হন, তাহলে তার সম্মান আরো বেড়ে যাবে।
রুস্তম পাশা সাহায্য পাঠানোর পরিবর্তে মুস্তাফার উজির লালা পাশাকে ইস্তাম্বুল নিয়ে এসে সেখানে বসনিয়ান আহমেদ পাশাকে পাঠান। আহমেদ পাশাকে পাঠানো হয়েছিল মুস্তাফার উপর নজরদারি করার জন্য। কিন্তু রুস্তম পাশার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আহমেদ পাশার সাথে শাহজাদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি।
তোপকাপি প্রাসাদের জাদুঘরে সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, মুস্তাফা সাফাভিদের সাথে মিত্রতা করছেন- এমন একটি সাজানো নাটক সুলতানের সামনে তুলে ধরেন রুস্তম পাশা। এ নিয়ে সুলতানের মনোভাব জানা যায়নি। তবে রুস্তম তার লোকদের দিয়ে শাহজাদার সিল চুরি ইরানের শাহ তামাস্পের কাছে বন্ধুত্বের চিঠি পাঠান।
শাহ কোনো কিছু ধরতে না পেরেই ইতিবাচকভাবে চিঠির উত্তর দেন, যা পরবর্তীতে রুস্তমের হাতে এসে পৌঁছালে, তিনি তা সুলতান সুলেমানের হাতে তুলে দেন। রুস্তম পাশার চক্রান্তের কারণে একসময় শাহজাদা মুস্তাফাকে মৃত্যুদণ্ড দেন সুলতান সুলেমান। সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন পরের কিস্তি।