ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। ইংরেজদের ইচ্ছায় বসানো নবাব এখন তাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। এই বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা গেল না। মাত্র ছয় বছর হলো পলাশীর প্রান্তরে কিছু বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতার সাহায্যে ইংরেজরা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে তারা যে স্বাধীনতার হত্যা করেছিল, সেই স্বাধীনতার ভূত যেন মীর কাসিমের কাঁধে ভর করে পুনরায় ফিরে এসেছে বাংলার বুকে।
কত বড় স্পর্ধা থাকলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গলা উঁচু করে কথা বলতে পারে? মীর কাসিমের সাহসিকতা এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব কোম্পানির ইংরেজদের ভাবিয়ে তুলেছে। খুব দ্রুত কিছু না করলে হয়তো এক বছরের মাথায় ইংরেজদের বিতাড়িত করে দেবেন নবাব মীর কাসিম। কিন্তু সেটা হতে দেয়া যায় না।
যেই ভাবা সেই কাজ। ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। পর পর তিনটি যুদ্ধ হলো। মীর কাসিমকে হত্যা করা সম্ভব হলো না। নবাব পরাজিত হলেন, কিন্তু হার মানলেন না। ইংরেজদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওদিকে আত্মগোপনকারী নবাবও একদম অলস বসে নেই। তিনি ভারতবর্ষের অন্যান্য নবাবদের সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করছিলেন। স্বয়ং মোঘল সম্রাটের সাথেও তার যোগাযোগ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতে বেশ বড় একটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো ইংরেজরা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই অবধারিত যুদ্ধের নাম ছিল বক্সার যুদ্ধ।
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৫৭ সালে বাংলার মসনদে আসীন হয় বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর। কিন্তু মীর জাফরের বেপরোয়া জীবনযাপন ইংরেজদের মনে ধরলো না। তাই তারা ষড়যন্ত্র করে মীর জাফরের সন্তান মিরনকে হত্যা করে এবং ১৭৬০ সালে মীর জাফরকে বাংলার মসনদ থেকে অপসারণ করে। মীর জাফরের পর বাংলার সিংহাসনের আসীন হন তারই জামাতা মীর কাসিম। অভিজাত ঘরের সন্তান মীর কাসিম ছিলেন কিছুটা স্বাধীনচেতা। বংশগত দিক থেকে তিনি গুজরাটের সুবেদার সৈয়দ ইমতিয়াজের দৌহিত্র ছিলেন।
১৭৬০ সালের ২০ অক্টোবর তাকে বাংলার নবাব হিসেবে নির্বাচিত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মসনদে আসীন হওয়া মাত্র মীর কাসিম ঘুণে ধরা শাসনব্যবস্থা সংস্কারের কাজে হাত দেন। নবাবের সৈন্যদলের জন্য আধুনিক সমরাস্ত্র প্রস্তুত করা শুরু করেন। এমনকি নবাবের ভরণপোষণ এবং প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্ধারিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস করে দেন। নিজের অবস্থান শক্ত করতে নবাবের প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থ। মীর কাসিম তাই খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। তিনি যখন রাজধানী হিসেবে মুর্শিদাবাদকে নির্বাচন করেন, তখন ইংরেজরা বুঝতে পারে বেশ বড় ভুল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ইংরেজদের হাত থেকে বাংলা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আর এর পেছনে নবাব মীর কাসিম দায়ী। ইংরেজরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে।
ইংরেজদের কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা দিয়ে মীর কাসিম তাদের দস্তক প্রথা বাতিল করতে চাইলেন। এই প্রথা অনুযায়ী ইংরেজরা নামেমাত্র করের বিনিময়ে বাংলার বুকে অবাধে লবণ ব্যবসা করতো। অন্যান্য সাধারণ ব্যবসায়ীরা নিয়ম অনুযায়ী উচ্চ করের আওতাধীন ছিল। মীর কাসিম এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। ইংরেজদের সাফ জানিয়ে দিলেন, হয় কর দাও, নাহয় সবার জন্য দস্তক প্রথা চালু কর। ইংরেজ ও বাঙালির মাঝে ব্যবসায়িক ভেদাভেদ থাকবে না।
ইংরেজরা এই সিদ্ধান্তে রাজি হলো না। নীতিগত দ্বন্দ্ব এবার যুদ্ধে পরিণত হলো। ১৭৬৩ সালের জুনে সর্বপ্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন নবাব মীর কাসিম। মীর কাসিম এবং ইংরেজদের মধ্যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধ হয়। প্রতিটি যুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভ করে। কিন্তু তারা মীর কাসিমকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। মীর কাসিম এলাহাবাদ পালিয়ে যান এবং সেখানে অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সাথে সাক্ষাৎ করেন। মীর কাসিমের মতো সুজা-উদ-দৌলাও স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই ইংরেজদের বিরোধিতা করতেন। তাই মীর কাসিম এবং সুজা-উদ-দৌলা হাত মেলালেন।
ভারতবর্ষে তখন মোঘল সিংহাসনে আসীন ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। তিনি তার সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটি প্রদেশকে একত্রিত করতে চাইলেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা প্রদেশ তখন ব্রিটিশদের আওতাধীন থাকায় সম্রাট তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। তাই সুজা-উদ-দৌলা এবং মীর কাসিম সম্রাট শাহ আলমের সাথে জোট তৈরি করলেন। তাদের তিনজনের সাথে ইংরেজদের দ্বন্দ্বের সাধারণ কারণ ছিল বাংলার অধিকার। ইংরেজদের একচেটিয়া অধিকার রদ করে বাংলার সার্বভৌমত্ম ফিরিয়ে আনতে তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধের দিন ঠিক করা হয় ২৩ অক্টোবর, ১৭৬৩ সাল।
বক্সার বর্তমান বিহার রাজ্যের একটি জেলা শহর হিসেবে পরিচিত। ভারতের গঙ্গা নদীর দক্ষিণে অবস্থিত এই শহরটিতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এদের একটি ছিল বক্সারের যুদ্ধ। বক্সার এলাকা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাটকাউলি ময়দানে সেই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরেকটি চসুয়ার যুদ্ধ।
হিন্দু ধর্মানুসারীদের নিকট বক্সার বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মোঘল এবং নবাব বাহিনী মিলে প্রায় ৪০ হাজার যোদ্ধার একটি দল ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ওদিকে মেজর হেক্টর মুনরো নামক এক ইংরেজ সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রায় ১০ হাজার সৈনিকের ছোট দল নিয়ে হাজির হয় ইংরেজরা। এদের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার সৈনিক পূর্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিল। ক্ষুদ্র বাহিনী হলেও ব্রিটিশদের অস্ত্রশস্ত্র নবাব বাহিনীর তুলনায় আধুনিক এবং উন্নত ছিল। ইংরেজ গোলন্দাজ বাহিনী বেশ দূর থেকে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম ছিল। নির্দিষ্ট দিনে দু’দল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো।
মির্জা নাজাফ খানের নেতৃত্বে নবাব ও মোঘল বাহিনী ডানদিক থেকে আক্রমণ করা শুরু করে। ব্রিটিশরা যুদ্ধের শুরুতে আক্রমণের তীব্রতায় সামান্য পিছু হটতে বাধ্য হয়। মোঘল-নবাব বাহিনী একটি গ্রামের দখল নিয়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলে। হেক্টর মুনরো ইংরেজদের তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। ডানদিকে মেজর স্টিবার্ট, বামদিকে মেজর চ্যাম্পিয়ন এবং মধ্যভাগে চার কোম্পানির অশ্বারোহী দল নিয়ে সাজানো ইংরেজরা সেই গ্রামে আক্রমণ করে বসে। তিনদিক থেকে আসা আক্রমণে জোট বাহিনী গ্রামের অধিকার হারিয়ে ফেলে। বিশৃঙ্খল জোট বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মেজর স্টিবার্টের পদাতিক সেনারা।
গ্রামের অধিকার হারানোর পর ইংরেজরা সুজা-উদ-দৌলাকে বিশ্বাসঘাতকতা করার আহ্বান জানায়। সুজা-উদ-দৌলা এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পালিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে তিনি গোলা দিয়ে নৌকাসেতু গুঁড়িয়ে দেন। ফলে নবাব মীর কাসিম এবং সম্রাট শাহ আলম বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফের পলাশীর স্মৃতি বক্সারে ফিরে এলো। সেবারের মীর জাফর ফিরে এলো সুজা-উদ-দৌলা পলায়নের মাধ্যমে।
মীর কাসিম ৩০ লক্ষ রুপি এবং কিছু সৈনিক নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। ওদিকে মির্জা নাজাফ খান এবং সম্রাট শাহ আলম ইংরেজদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধে ইংরেজদের ৮০০ সৈনিকের বিপরীতে প্রায় ২০০০ বাঙালি সৈনিক নিহত হয়।
স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর মীর কাসিম যুদ্ধের পরাজয় মেনে নিতে পারলেন না। তিনি যুদ্ধের পর পরই আত্মহত্যা করেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে বাংলার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। ওদিকে সুজা-উদ-দৌলা বক্সারের যুদ্ধের পরাজয় ঘুচাতে পুনরায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি বার বার পরাজিত হন। পরবর্তীতে তিনি রোহিলাখন্দ পালিয়ে যান। এর মাধ্যমে বাংলার বুকে স্বাধীনচেতা নবাবদের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়।
১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ মোঘল সম্রাট শাহ আলমের সাথে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলার প্রথম গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। ব্রিটিশরা চুক্তি অনুযায়ী বর্তমান বাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং উত্তর প্রদেশের রাজস্ব আদায়ের অধিকার অর্জন করে। বিনিময়ে সম্রাট শাহ আলম ২৬ লাখ রুপি ভর্তুকি পাবেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে। সম্রাট শাহ আলম এলাহাবাদ দুর্গে নির্বাসিত হন। সেখানে তার রাজসভায় নজরদারির উদ্দেশ্যে একজন ইংরেজ আইনজীবী অবস্থান করেন।
বক্সার যুদ্ধের পরে ইংরেজরা অযোধ্যা, বেনারস এবং এলাহাবাদ দখল করে নেয়। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির খেসারতস্বরূপ সুজা-উদ-দৌলা ইংরেজদের প্রায় ৫০ লাখ রুপি জরিমানা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ইংরেজরা ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের সম্পূর্ণ দখল করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের গাজীপুর এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল কোম্পানির দখলে চলে আসে। কয়েক বছর পর ইংরেজরা সম্রাটকে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ করে দিলে মোঘলরা ইংরেজদের দাসে পরিণত হয়ে যায়। তারা দ্রুত বাংলার প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করে ফেলে।
বক্সারের যুদ্ধ পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে ভারতের বুকে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার হয়। যা পরবর্তীতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। একই সাথে তা মোঘলদের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা এবং প্রশাসনিক দূর্বলতার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। এই পরাজয়ের প্রভাব থেকে ভারতবর্ষের জেগে উঠতে আরো একশত বছর পেরিয়ে যায়।
ফিচার ইমেজ- Youtube