ইউরোপ থেকে যারা ভাগ্য বদলাতে নতুন মহাদেশে এসে স্থায়ীভাবে থেকেছেন, তাদের বংশধররাই আজকের আমেরিকান নাগরিক। সে হিসেবে আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহিরাগতদেরই দেশ। তবে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, সকল বহিরাগতই দেশটিতে সমান মর্যাদা পেতো। বরং বহিরাগতদের এই দেশে খোদ বহিরাগতদের মধ্যে অন্য বহিরাগতদের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ দেখা গেছে। ফলে সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিরোধী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। হতাহত হয়েছে অনেক মানুষ।
তখনকার মার্কিন আইন প্রায়ই সকল অধিবাসীর প্রতি সমান ব্যবহার দেখাতে ব্যর্থ হতো। উনিশ শতকে আফ্রিকা থেকে আনা কালো মানুষদের উপর চাপানো দাসপ্রথা ইস্যুতে ভয়ানক গৃহযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য শুধু কালো মানুষদের উপরই করা হতো না। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে প্রচুর চীনা অভিবাসী সুলভ মূল্যের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। তারাও বর্ণবাদ ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছে, যার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১৮৮২ সালে করা মার্কিন আইন ‘চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’।
উনিশ শতকে চীন সাম্রাজ্য চিং রাজবংশের অধীনে ছিলো। চীনের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেসময় দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের সাম্রাজ্যবাদী লোভের সামনে দুর্বল চীনা সাম্রাজ্য একরকম নতজানু হতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন এলাকায় শর্তহীনভাবে স্বাধীন বিদেশী অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উপর চীন সরকারের কোনো এখতিয়ার থাকতো না। এছাড়া আমেরিকার বেড়ে চলা ব্যবসায়িক আধিপত্য ও লোভ বজায় রাখার জন্য প্রচুর সুলভ মূল্যের শ্রমিকের প্রয়োজন ছিলো। সেজন্য আমেরিকানরা চীনে তাদের দখলকৃত এলাকা থেকে আমেরিকায় শ্রমিক পাঠানো শুরু করে।
১৮৪৮ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো। ফলে রাতারাতি এ অঞ্চলে ভাগ্য বদলাতে আসা বহিরাগতদের ভিড় বাড়তে থাকে। আমেরিকায় চীনাদের আগমনের শুরু সেসময় থেকেই। কারণ প্রথম মহাদেশীয় রেলপথের নির্মাণ কাজ চলছিলো আর এজন্য প্রয়োজন ছিলো প্রচুর সুলভ মূল্যের শ্রমিকের। যতদিন খনিগুলোতে সোনা সহজলভ্য ছিলো, ততদিন বহিরাগত চীনারা স্থানীয় আমেরিকান নাগরিক ও আইন ব্যবস্থায় কোনো অন্যায়ের শিকার হয়নি। কিন্তু একসময় খনিগুলোতে সোনা দুর্লভ হয়ে গেলো। ফলে এককালের প্রচুর কাজের সুযোগের জায়গায় শীঘ্রই নেমে এলো কাজের তীব্র অভাব। ফলে স্থানীয় মানুষ ও ব্যবসায়ীরা চীনা ও বিদেশী শ্রমিকদেরকে এই অভাবের জন্য দায়ী করতে থাকে।
খনি এলাকাগুলো থেকে বিতাড়িত হবার পর বেকার চীনা শ্রমিকরা সান ফ্রান্সিসকো অঞ্চলের দরিদ্র এলাকাগুলোতে এসে বসবাস করতে থাকে। এখানে এসে তারা রেস্তোরাঁর বেয়ারা, লন্ড্রির শ্রমিক ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত হয়। গৃহযুদ্ধ শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো চলছিলো না। আমেরিকার পশ্চিম ভূখণ্ডে এই কারণে কিছুটা অসন্তোষ বিরাজ করছিলো। বিশেষ করে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ন্যূনতম মজুরি ও বেকারত্বসহ নানা ইস্যুতে ক্ষুব্ধ ছিলো। তারা শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্য বহিরাগত চীনাদের দায়ী করতে থাকে। বিশেষ করে সান ফ্রান্সিসকোর তৎকালীন শ্রমিক সংগঠন ওয়ার্কিংমেন’স পার্টির নেতা ডেনিস কার্নি মনে করতেন, চীনা শ্রমিকদের জন্যই আমেরিকান শ্রমিকদের এই দুর্দশা। এমনকি ক্যালিফোর্নিয়ার সেসময়কার গভর্নর জন বিগলার চীনাদের মজুরির কম চাহিদাকে শ্রমমূল্য কমে যাওয়ার জন্য দায়ী করেছিলেন।
মজার ঘটনা হচ্ছে, ১৮৫০ সালের দিকে আমেরিকার প্রায় সব জায়গায় চীনা বহিরাগতদের বহিষ্কার করার বিরোধিতা করা হতো। কারণ চীনা বহিরাগতরা যে কর দিতেন, তা ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের বাজেট ঘাটতি পূরণে বেশ সাহায্য করতো! এদিকে চীনের তৎকালীন রাজবংশ দেশটির অধিবাসীদের শ্রমিক হিসেবে আমেরিকায় যাওয়ার বিরোধী ছিলো। কেননা, এতে চীনের নিজস্ব শ্রমশক্তি কমে যাবার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো।
১৮৫৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া আইনসভা একটি বৈষম্যমূলক আইন পাশ করে, যাতে বলা হয়েছিলো, “চীনা অথবা মঙ্গোলীয় কোনো মানুষ এই প্রদেশে প্রবেশ করতে পারবে না।” তবে ১৮৬২ সালে রাজ্যটির সুপ্রিম কোর্ট এই আইনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে।
আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে চীনারা সাধারণত নিজেদের মধ্যে সমাজ তৈরি করে শ্বেতাঙ্গদের থেকে আলাদা বসবাস করতেন। আমেরিকান জনগণের স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান তারা ব্যবহার করতেন না। এছাড়া পরিবেশগত পার্থক্য ও জীবনধারার বিভিন্ন দিকের কারণে বয়স্ক চীনা পুরুষরা নীরোগ ও দীর্ঘজীবি হতেন। ফলে শ্রমিক হিসেবে তাদের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিলো। এজন্য কাজের আশায় অধিক হারে চীনাদের আগমন আমেরিকানদের রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ বেড়ে যায়।
১৮৭৮ সালে মার্কিন কংগ্রেস আমেরিকায় চীনা অভিবাসীদের আগমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। দেশটির ১৯তম প্রেসিডেন্ট রাদারফোর্ড বিচার্ড হেইসের ভেটো প্রদানের ফলে এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ১৮৭৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় চীনাদের চাকরি, ব্যবসা ও অন্য পেশা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাশ হয়। অনেকে ধারণা করে থাকেন, উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে চলা খ্রিস্টধর্মীয় উগ্রতা এসব বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক নীতির অন্যতম কারণ। তবে তার পেছনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এই বর্ণবাদী আইন আমেরিকার ইতিহাসে এটাই প্রথম ছিলো, এমন নয়। ১৭৯০ সালে গৃহীত আইন ‘ন্যাচারালাইজেশন অ্যাক্ট’ এর অধীনে শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো বর্ণের মানুষের সাধারণ নাগরিক অধিকার রুদ্ধ করা হয়েছিলো। ১৮৭৫ সালে প্রণীত ‘পেজ অ্যাক্ট’ এ এশিয়ার শ্রমিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিলো।
১৮৮২ সালের ৬ মে আমেরিকার ফেডারেল সরকারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পুরো একটি জাতির জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইন তৈরি হলো। এই আইনে বলা হয়েছিলো, “খনি এলাকায় নিযুক্ত করার জন্য চীনা মজুর ও দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো।”
এই আইন প্রণয়নের ফলে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিলো। আইনটিতে চীনা শ্রমিকদের কথা উল্লেখ ছিলো, কিন্তু আইনটি সব চীনাদের জন্য প্রযোজ্য ছিলো না। কূটনৈতিক কর্মকর্তা, তাদের পরিবার ও তাদের অফিসিয়াল ও ব্যক্তিগত কর্মচারীদের জন্য এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে ছোট জটিলতা তৈরি হয়েছিলো। কোনো চীনা ব্যক্তিকে প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে হলে ‘শ্রমিক নই’ মর্মে প্রমাণপত্র দেখানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা গেলো!
আইনটি আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়া চীনা নাগরিকদের ক্ষেত্রেও বেশ জটিলতা তৈরি করেছিলো। যারা বিভিন্ন প্রয়োজনে আমেরিকার বাইরে গিয়েছিলো, ফিরে আসার জন্য তাদের নতুন করে বৈধ কাগজপত্রের প্রয়োজন হলো। আর যারা আমেরিকাতেই ছিলো, তাদের প্রয়োজনে বাইরে যাবার বৈধ উপায় এক হিসেবে একেবারেই শেষ হয়ে গেলো। অনেকে আর কখনও পরিবার পরিজনের সাথে জীবনে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারেননি।
১৮৮৪ সালে এই আইনটিতে একটি সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনের ফলে পুরনো চীনা অভিবাসীদের আইনের কঠোরতা কিছুটা কমানো হয়। একইসাথে নিষিদ্ধ করার পরিধি দেশ বা জন্মস্থানের জায়গায় একেবারে সরাসরি বর্ণবাদের জায়গায় চলে আসে। ফলে চীন ছাড়া অন্য যেকোনো স্থান থেকে আসা চীনাদের জন্যও আমেরিকা যাত্রা বন্ধ হয়ে গেলো!
১৮৮৮ সালে ‘স্কট অ্যাক্ট’ নামে ‘এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’ এর আরেকটি ব্যাখ্যা দেওয়া হলো। এই আইনের ফলে যেকোনো কারণে আমেরিকা ত্যাগ করা কোনো চীনা নাগরিকের জন্য আবার দেশটিতে প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে চায়ে চানপিং নামের একজন চীনা-আমেরিকান মামলা দায়ের করেন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট দেশটির সরকারের পক্ষেই রায় দেয়।
১৮৯২ সালে এই বর্ণবাদী আইন ‘গিয়ারি অ্যাক্ট’ নামের এক নতুন ধারা দিয়ে নবায়ন করা হয়। এর ফলে যেকোনো চীনা বংশোদ্ভূত পুরুষ বা নারীর জন্য রেসিডেন্স সার্টিফিকেট ছাড়া বাধ্যতামূলকভাবে আমেরিকা ত্যাগের বিধান রাখা হয়েছিলো।
আমেরিকা মহাদেশের ইতিহাসে শুধু যে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারাই আদিবাসী বা কালো মানুষ বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়েছে, তা নয়। শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বিভিন্ন সময় সামান্য কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। আইরিশ অভিবাসীরা দেশটিতে কম বৈষম্য দেখেনি। বৈষম্যের কারণে ইতালীয় অভিবাসীরা একসময় অপরাধের দিকে ঝুঁকেছে। দরিদ্র চীনা জনগোষ্ঠী সাধারণত সস্তা শ্রমের খোরাক হিসেবে আমেরিকায় আসতো। কাজে প্রাণহানির জন্য তাদের পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হতো না। ১৮৮২ সালের ‘চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’ এ ধারারই একটি বর্ণবাদী আইন।