দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বর্তমান ভারতের সর্বপশ্চিমের রাজ্যটি হচ্ছে গুজরাট। প্রায় ৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত আধুনিক ভারতের এই রাজ্যটির আয়তন প্রায় ১,৯৬,০২৪ বর্গ কিলোমিটার। গুজরাটের পশ্চিমে আরব সাগর আর পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ অবস্থিত, উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর রয়েছে রাজস্থান রাজ্য, পূর্বে মধ্য প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দাদড়া-নাগর হাভেলী আর মহারাষ্ট্র, দক্ষিণে রয়েছে দামান এবং দিউ। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম এই রাজ্যটির রাজধানী হচ্ছে গান্ধীনগর। আর গুজরাটের সবচেয়ে বড় নগরী হচ্ছে আহমেদাবাদ, যা মুজাফফরি সালতানাতানের শাসক আহমাদ শাহ’র স্মৃতিবিজড়িত। তিনিই সর্বপ্রথম আধুনিক ভারতের এই শহরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন এবং এটিকে নিজের রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করতেন।

প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার সমুদ্রতটরেখা-সমৃদ্ধ গুজরাট প্রাচীনকাল থেকেই ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বেশ গুরুত্ববহ ছিলো। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই গুজরাটের সাথে বাইরের বিভিন্ন রাজ্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিলো। সেই সুবাদে আরবরাও বাণিজ্যিক কারণে গুজরাটের বিভিন্ন বন্দরে অবতরণ করতেন।

১২৯৬ সালে দিল্লি সালতানাতের সিংহাসনে বসেন খিলজি রাজবংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। গুজরাটের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি গুজরাটে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সিংহাসনে বসার তিন বছর পর আলাউদ্দিন খিলজি নুসরত খান আর উলুঘ খানকে গুজরাটে অভিযান চালানোর জন্য প্রেরণ করেন।

১৭ শতকের দিকে অঙ্কিত সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির একটি তৈলচিত্র; Source: Wikimedia Commons

সুলতানের নির্দেশ মোতাবেক নুসরত খান ১২৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী দিল্লি ত্যাগ করেন। আর অন্যদিকে উলুঘ খান সিন্ধু থেকে নতুন সেনাবাহিনী নিয়ে নুসরত খানের সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। যাত্রাপথেই তিনি জয়সালমারে একটি ছোট অভিযান পরিচালনা করে একই বছর মার্চ মাসের দিকে নুসরত খানের সাথে মিলিত হতে সক্ষম হন।

নুসরত খান আর উলুঘ খানের এই সম্মিলিত বাহিনী চিতোরের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে বানাস নদী অতিক্রম করে রাভোসা দুর্গ দখল করেন। তাদের এই আক্রমণের ফলে গুজরাটের রাজা দ্বিতীয় কর্ণদেব পালিয়ে দেবগিরিতে আশ্রয় নেন। আর এর ফলে খুব সহজেই সমগ্র গুজরাট মুসলিমদের অধিকারে চলে আসে। খুব সহজেই গুজরাট মুসলিম অধিকারে চলে আসায় এটা বোঝা যায়, গুজরাটের রাজা তার জনগণের কাছে তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না।

আলাউদ্দিন খিলজির এই সহজ বিজয়ের পর পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর গুজরাট সরাসরি দিল্লি সালতানাতের অধীনে একটি প্রদেশ হিসেবে শাসিত হতো।

খিলজি রাজবংশের পতনের পর ১৩২০ সালে হিন্দুস্তানের দিল্লি সালতানাতের কর্তৃত্ব লাভ করেন তুঘলক বংশের শাসকরা। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এই সাম্রাজ্যটি। ১৩৫১ সালে দিল্লি সালতানাতের সিংহাসনে বসেন এই রাজবংশের শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক। ১৩৮৮ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবী নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ফিরোজ শাহ তুঘলকের পুত্র মুহাম্মদ শাহ তুঘলক সালতানাতের সিংহাসনে বসেন। তার শাসনামলেই ফিরোজ শাহ’র আরেক পুত্রকে গুজরাটের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ঐতিহাসিকগণ ফিরোজ শাহ’র এই শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ বেশ ভালোভাবেই গুজরাট শাসন করছিলেন। এদিকে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে কেন্দ্রীয় শাসন চূড়ান্ত রকমের দুর্বল হয়ে পড়ায় তিনি মোটামুটি স্বাধীনভাবেই গুজরাট শাসন করতে থাকেন।

১৩৯৭ সালে হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন আমির তাইমূর বেগ। তার দুর্ধর্ষ আর নির্মম আক্রমণে দিল্লি সালতানাতের কেন্দ্রীয় শাসন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। মৃতপ্রায় তুঘলক সালতানাতের কফিনের উপর গড়ে উঠে সৈয়দ সালতানাতের ভিত্তি। এই আক্রমণের ফলে দিল্লি সালতানাতের কেন্দ্রীয় শাসন থেকে অনেক অঞ্চলই স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাতে থাকে।

তৈমুরের প্রতিকৃতি; Source: Wikimedia Commons

শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহও ১৪০১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন গুজরাট রাজ্য। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র দুই বছর পরেই নিজেরই বিদ্রোহী পুত্র তাতার খানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। নিজের পিতাকেই ক্ষমতাচ্যুত করে তাতার খান গুজরাটের সিংহাসনে বসলেন। তিনি নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি নিলেন। কিন্তু সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিন পরেই শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ’র এক ভাই, অর্থাৎ তার নিজেরই এক চাচার হাতে তিনি নিহত হন। পর্দার আড়াল থেকে আবির্ভূত হয়ে এসে আবারও রাজনীতির মাঠে বিচরণ শুরু করলেন শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ। দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি ১৪১১ সাল পর্যন্ত গুজরাট শাসন করেন। তার নামানুসারেই পরবর্তীতে এই রাজ্য ‘মুজাফফরি সালতানাত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

সুলতান শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ’র তাম্র মুদ্রা; Source: Wikimedia Commons

মুজাফফর শাহের শাসনামলে মালওয়ার গুজরাটের সাতে একীভূত হয়। পরবর্তীতে অবশ্য মালওয়ার আবারও গুজরাট থেকে আলাদা হয়ে যায়।

১৪১১ সালে শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ’র মৃত্যুর পর তাতার খানের পুত্র আহমদ শাহ ‘নাসিরুদ্দিন আহমদ শাহ’ উপাধি গুজরাটের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি একজন দক্ষ আর স্বাধীনচেতা শাসক ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রায় ৩২ বছর শাসন করে ১৪৪৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি আধুনিক আহমেদাবাদ শহরটির গোড়াপত্তন করেন এবং শহরটিকে রাজধানী হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। আহমেদাবাদসহ সমগ্র গুজরাটে মসজিদ, প্রাসাদসহ তিনি বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করেন। এসবের মাঝে অনেক স্থাপনা আজও টিকে আছে।

আহমেদাবাদের Bhadra দুর্গ। ১৪১১ সালে সুলতান নাসিরুদ্দিন আহমদ শাহ আহমেদাবাদে এই দুর্গটি তৈরি করেন। ছবিটি ১৮৭২ সালে তোলা; Source: Wikimedia Commons

নাসিরুদ্দিন আহমদ শাহ তার দীর্ঘ শাসনামলে তিনি বেশ কিছু বিদ্রোহ দমন করেন। এর ভেতরে তার নিজ চাচা ফিরোজ খানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিদ্রোহ তিনি দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া মালওয়া, রাজস্থান ও আশিরগড়সহ ছোটখাট বেশ কিছু রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করা হয়েছিলো। ১৪১৪-১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে শক্তিশালী হিন্দুরাজ্য সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। সৌরাষ্ট্রের রাজা আহমদ শাহের আনুগত্য স্বীকার করে কর প্রদানে রাজি হন।

পিতা নাসিরুদ্দিন আহমদ শাহ’র শাসনামলে আহমদেদাবাদে এই মজদিদটি নির্মাণ করান মুইজ উদ-দিন মুহাম্মদ শাহ (দ্বিতীয় মুহাম্মদ শাহ)। ১৪৪৪ সালে নির্মিত এই মসজিদটি ‘কুতুব শাহ মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত। মসজিদের এই ছবিটি তোলা হয় ১৮৮০ সালে; Source: Wikimedia Commons

এছাড়া ১৪১৭ সালে খান্দেশের রাজা, ১৪১৯ সালে ঝালোয়ারের রাজা এবং বাহমনী সুলতান আহমদ শাহকে পরাজিত করেন। মেবারের বিরুদ্ধে তিনি দুবার অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। দ্বিতীয় অভিযানে তিনি মেবারের বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করেন।

১৪৪৩ সালের ১৬ আগস্ট গুজরাটের এই দক্ষ শাসক মৃত্যুবরণ করেন। কৃতিত্ব বিচারে নাসিরুদ্দিন আহমদ শাহকেই স্বাধীন গুজরাটের প্রকৃত শাসক ধরা হয়।

১৪২৪ সালে আহমদ শাহ তৈরি করেন এই অনিন্দ্যসুন্দর ‘জামে মসজিদ’টি; Source: Wikimedia Commons

আহমদ শাহ’র মৃত্যুর পর গুজরাটের সিংহাসন লাভ করেন তারই পুত্র মুহাম্মদ শাহ। তার উপাধি ছিলো মুইজ উদ-দিন। তিনিও বেশ দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তার সময়ে ইধার আর ডুঙ্গারপুরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তার সময়ে বিজয় অভিযান তুলনামূলক কম হয়েছিলো। তিনি মূলত তার শাসনামলে রাজ্যকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন।

১৪৫১ সালে মুইজ উদ-দিন মুহাম্মদ শাহের মৃত্যুর পর গুজরাটের সিংহাসনে বসেন কুতুবউদ্দিন আহমদ শাহ। শাসক হিসেবে তিনি তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেননি। ১৪৫৬ সালে এক যুদ্ধে মেবারে রানা কুম্ভের হাতে পরাজিত হন। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মালওয়ার সুলতান মাহমুদকে সাথে নিয়ে এর পরের বছরই মেবারে অভিযান পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। পরবর্তীতে মেবারের সাথে তিনি চুক্তি করতে বাধ্য হন।

কুতুবুদ্দিন আহমদ শাহ’র মৃত্যুর পর দরবারের অভিজাতরা তার চাচা দাউদ খানকে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। অবশেষে, ১৪৫৮ সালে ‘আবুল ফতেহ মাহমুদ শাহ’ উপাধি নিয়ে গুজরাটের সিংহাসনে বসেন কুতুবুদ্দিন আহমদ শাহ’র নাতি ফতেহ খান। তবে তিনি ‘মাহমুদ বেগারহা’ নামে ইতিহাসে বেশি পরিচিত। ‘বেগারহা’ শব্দটির অর্থ ‘দুই দুর্গের বিজেতা’। ধারণা করা হয়, চাম্পানী আর গিরনার- এই দুটি দুর্গ বিজয়ের পরে থেকে তিনি এই নামে ভূষিত হতে থাকেন।

মাহমদু বেগারহা নির্মিত একটি মসজিদ; Source: Wikimedia Commons

‘মাহমুদ বেগারহা’ কিংবা আবুল ফতেহ মাহমুদ শাহ প্রায় ৫৩ বছর গুজরাট শাসন করেছিলেন। আর মাহমুদ শাহকেই গুজরাটের সবচেয়ে সফল শাসক হিসেবে ধরা হয়। তার সময়ে বিভিন্ন বিজয়াভিযানের কারণে গুজরাটের সীমানা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তবে তার শাসনামলে লাগাতার যুদ্ধ হলেও গুজরাটে সবসময়ই শান্তি বজায় করছিলো।

চাম্পানীর ‘জামে মসজিদ’;  Source: Wikimedia Commons

মাহমুদ বেগারহার ঘটনাবহুল শাসনামলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ায় এসময় গুজরাটের উপকূলে পর্তুগীজ জলদস্যুরা বেশ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো। হত্যা, লুন্ঠনসহ বিভিন্ন অত্যচারে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে অতিষ্ঠ্য হয়ে মাহমুদ শাহ তার শাসনামলের শেষদিকে মিশরের সাথে একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী মিশর আর গুজরাটের নৌবাহিনী সম্মিলিতভাবে সমুদ্রে পর্তুগীজদের দমনের জন্য অভিযান শুরু করে।

প্রাথমিকভাবে বেশ সফলতা পাওয়া যাচ্ছিলো। ১৫০৮ সালে মুম্বাইয়ের নিকটবর্তী চাওল নামক স্থানে এই সম্মিলিত বাহিনী পর্তুগীজদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু পর্তুগীজ বাহিনী সাগরে বেশ দক্ষ আর অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো। ফলস্বরূপ, পরের বছরই এই সম্মিলিত বাহিনী পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে পরাজয় বরণ করে নেয়। এর ফলে উপকূল এলাকায় এই বর্বর দস্যুদের আধিপত্য একরকম স্থায়ীই হয়ে যায়। বর্বর এ পর্তুগীজরা এর পরের বছরই সুলতান মাহমুদ শাহের নিকট থেকে গোয়া সমুদ্র বন্দরটি দখল করে নেয়।

মাহমুদ শাহ ১৫১১ সালে মারা যান। তার দীর্ঘ গৌরবময় শাসনামলের একমাত্র ব্যর্থতা ছিলো এই বর্বর পর্তুগীজদের দমন করতে না পারা। ফলস্বরূপ, এ বর্বর পর্তুগীজরা পরবর্তীতে গুজরাটসহ হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের দূষিত নাক গলানোর মতো সুযোগ পেয়েছিলো।

গুজরাটের সুলতান মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর একই বছর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র শামস উদ্দিন মুজাফফর শাহ। তিনি দ্বিতীয় মুজাফফর শাহ হিসেবেই ইতিহাসে বেশি পরিচিত।

সিংহাসনে বসেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে রাজপুতদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদিকে মুহাম্মদ খিলজিকে মালওয়ারের সিংহাসনে বসানোর প্রেক্ষাপটে মেবারের সাথে তার শত্রুতার সূত্রপাত হয়। প্রথমে ইধারের ভীম সিংহকে পরাজিত করে এরপর তিনি মেবারের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অভিযানগুলোতে তিনি বেশ কিছুটা সফলতা লাভ করেন।

১৫২৬ সালের ৭ এপ্রিল। এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহ। ঘটনাটি পানিপথের যুদ্ধের মাত্র ১১ দিন আগের। আর এর ১১ দিন পরে পানিপথের প্রান্তরে দিল্লির লোদি বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর।

১৫২৫ সালের হিন্দুস্তান। মুঘলরা তখনো হিন্দুস্তানে নিজেদের স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারেন নি; Source: Wikimedia Commons

মুজাফফর শাহের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই তার উত্তরাধিকারী নিয়ে সভাসদদের মাঝে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। দরবারের অধিকাংশ সভাসদের সমর্থন নিয়ে মুজাফফর শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র সিকান্দার শাহ গুজরাটের সিংহাসনে আরোহণ করেন। গুজরাটের সিংহাসন প্রত্যাশী ছিলেন মুজাফফর শাহের অপর তিন ছেলে বাহাদুর শাহ, লতিফ খান আর নাসির খান। কিন্তু পিতার মৃত্যুর সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকায় সিকান্দার শাহ সভাসদদের তাৎক্ষণিক সমর্থনলাভের মাধ্যমে সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হন।

এদিকে পিতা মুজাফফর শাহের জীবদ্দশাতেই বোঝা যাচ্ছিলো যে সিকান্দার শাহ সিংহাসনে বসতে যাচ্ছেন। এসময় পিতা এবং ভাইয়ের সাথে বাহাদুর শাহের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে জীবননাশের আশঙ্কা থেকে তিনি দিল্লি পালিয়ে যান। দিল্লিতে তিনি লোদি বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদির অনুগ্রহ লাভ করেন। দিল্লিতে তিনি যে কতদিন অবস্থান করছিলেন, তাতে দেখা যায় আফগানদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা বেশ প্রবল। তার জনপ্রিয়তা প্রকাশ পেলে ইব্রাহিম লোদি অসন্তুষ্ট হন। নিজের এই অবস্থায় বাহাদুর শাহ তার আশ্রয়দাতাকে অসন্তুষ্ট করার মতো দুঃসাহস দেখাতে চাননি।

১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল পানিপথের প্রান্তরে ইব্রাহিম লোদির মৃত্যু হলে এই বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তিনি  জৈনপুরে চলে যান।

এদিকে সিংহাসনে বসেই সিকান্দার শাহ প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করতে থাকেন। এতে তার সভাসদরা ভয় পেয়ে যান। এমনকি সিকান্দার শাহের প্রধান সমর্থক ইমাদ উল মুলক খোশ কদম, খোদাবান্দ খানসহ অনেক ঘনিষ্ঠ সভাসদও নিজেদের জীবননাশের আশঙ্কা করতে থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে ইমাদ উল মুলক খোশ কদমের পরিকল্পনায় সিংহাসনে বসার মাত্র ৫ দিন পরেই নিহত হন সিকান্দার শাহ।

সিকান্দার শাহ-এর সমাধি; Source: Wikimedia Commons

সিকান্দার শাহ নিহত হলে আবারও সেই পুরনো প্রশ্ন জেগে ওঠে সবার মনে। এবার সিংহাসনে বসবে কে?

দরবারের একাংশ পুনরায় বাহাদুর শাহের পক্ষে সমর্থন দিলো। আরেকপক্ষ চাচ্ছিলো লতিফ খানকে গুজরাটের সিংহাসনে বসাতে। কিন্তু ইমাদ উল মুলক খোশ কদম আর খোদাবান্দ খানের ইচ্ছা ছিলো নাসির খানকে গুজরাটের শাসনক্ষমতা অর্পণ করার। কিন্তু দরবারের অন্যান্য সভাসদরা তাদের এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি।

কোনো উপায় না পেয়ে তারা একইসাথে মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ আর বাবরের নিকট গুজরাটের শাসনভার বুঝে নিতে পত্র পাঠায়। তাদের এই উদ্দ্যোগ স্পষ্টতই রাষ্ট্রবিরোধী আর গুজরাটের স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ফলে দরবারের অন্যান্য সভাসদরা ঘাবড়ে যায়। এদিকে তাজ খান নামক একজন সভাসদ গোপনে বাহাদুর শাহকে গুজরাটের বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়ে তাকে গুজরাটের সিংহাসনে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান।

কুতুব উদ-দিন বাহাদুর শাহ তখন গুজরাট থেকে অনেক দূরে, জৈনপুরে অবস্থান করছিলেন। এই পত্র পেয়ে সাথে সাথেই গুজরাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। চাম্পানীর কাছাকাছি তিনি ইমাদ উল মুলক খোশ কদমের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। ছোটখাট কিছু সংঘর্ষের পর ইমাদ উল মুলক বন্দী হন। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। শেষপর্যন্ত তিনি গুজরাটের সিংহাসনে বসতে সক্ষম হন।

গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ-এর রৌপ্যমুদ্রা; Source: coinindia.com

কুতুব উদ-দিন বাহাদুর শাহ বেশ উদার মনের মানুষ ছিলেন। এর ফলে হিন্দুস্তানের আনাচে কানাচে থেকে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী মানুষ তার দরবারে ভিড় জমাতে লাগলো। এদিকে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দিল্লি আর আগ্রাকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই বিপুল সংখ্যক আফগান কর্মহীন হয়ে পড়ে। এদের বেশিরভাগই যোদ্ধা ছিলেন। তারা দলে দলে বাহাদুর শাহের দরবারে ভীড় করতে লাগলেন।

বাহাদুর শাহ এমনিতেই আফগানদের প্রতি কিছুটা বেশিই উদার ছিলেন। এর ফলে আফগান আমির থেকে শুরু করে সাধারণ আফগানদের একটি ব্যাপক প্রবাহ গুজরাটের দিকে বইতে শুরু করে। বাহাদুর শাহ সবাইকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তবে এই পলাতক আফগানরাই পরবর্তীতে বাহাদুর শাহকে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিয়েছিলো।

গুজরাটের মুজাফফরি সালতানাতের পতাকা; Source: Wikimedia Commons

বাহাদুর শাহ অনেক আফগানকেই তার দরবারে জায়গা দিয়েছিলেন, যারা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য সবসময়ই হুমকি ছিলো। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে অনেক বিদ্রোহী কিংবা পলাতক বাহাদুর শাহ’র দরবারে আশ্রয় চাইতো, বাহাদুর শাহও তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাতেন। ফলে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাহাদুর শাহ’র প্রতি বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন। তবে বিনয়ী এই শাসক কোনোরকম হুমকি-ধামকি দিয়ে গুজরাটে দূত বা পত্র প্রেরণ করেননি। তবে গুজরাটে ধীরে ধীরে মুঘল বিদ্রোহীদের অবস্থান বেড়ে গেলে ব্যপারাটি মুঘল সালতানাতের জন্য হুমকিই হয়ে দাঁড়ায়। আর এর ফলেই সূত্রপাত ঘটে মুঘল সালতানাত বনাম মুজাফফরি সালতানাতের মধ্যকার দ্বন্দ্বের।

মুঘল পতাকা; Source: videoblocks.com

বাহাদুর শাহ এমনিতে মুঘলদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন না, কিংবা মুঘলদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করার কোনো ইচ্ছাও তার ছিলো না। পানিপথের যুদ্ধ তিনি গভীরভাগে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন মুঘলরা একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তাদের সমকক্ষ কোনো শক্তি হিন্দুস্তানের নেই, এই ব্যপারটি বাহাদুর শাহ নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে বাহাদুর শাহের ঠিকই দ্বন্দ্ব বেধে যায়। শেষপর্যন্ত যুদ্ধের মাঠ ছাড়া এই দ্বন্দ্বের অবসান করার আর কোনো উপায়ই অবশিষ্ট থাকে না।

তথ্যসূত্র

১। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩

২। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

৩। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: সুলতানি পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৪), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল

 

ফিচার ইমেজ: shadowsgalore.com

Related Articles

Exit mobile version