আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের সাফল্যের সিংহভাগই এসেছে মাত্র একটি কোম্পানির হাত ধরে। কাগজে-কলমে এটি একটি প্রতিষ্ঠান হলেও এর ব্যাপকতা একে বাণিজ্যের মহলে পরিচিত করেছে এক ‘সাম্রাজ্য’ হিসেবে, যা একটু একটু করে গড়ে উঠেছে গত দু’শতাব্দী ধরে, ভারতে একের পর এক শিল্পের গোড়াপত্তন করার মাধ্যমে। হ্যাঁ, বলছি টাটা গ্রুপের কথা।
অনেক পাঠকই হয়তো ভাবছেন, ‘একের পর এক শিল্প’ কোথায় পেলাম? ‘টাটা’ তো একটা গাড়ির কোম্পানি, আর মাঝে মাঝে স্যাটেলাইট টিভির সার্ভিস দেয় ‘টাটা স্কাই’ নামে। হয়তো অনেকের কানে বেজে উঠেছে সেই চিরায়ত “ইস্কো লাগা ডালা, তো লাইফ জিঙ্গালালা” বিজ্ঞাপন। সেসব পাঠকের টাটার ব্যাপকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতেই আজকের এই লেখা। কিন্তু সেটা বুঝতে হলে আমাদের দুই শতাব্দী পেছনে চলে যেতে হবে, জানতে হবে কয়েক প্রজন্ম পেছনের টাটা পরিবারের গল্প।
প্রথম প্রজন্ম: জামসেদজি টাটা
‘টাটা’র গল্প শুরু হয় সেই ব্রিটিশ শাসনের সময়। সেসময় এই ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল তুলোর অনেক বড়সড় রপ্তানিকারক। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কঠোর নজরদারির সামনে কোনো স্থানীয় উদ্যোক্তার নিজেদের ব্যবসা দাঁড় করানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই বর্বরতা একসময় ব্রিটিশদের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, বলছি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের কথা। এই বিপ্লবের সামনে পড়ে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানিকে সরিয়ে নিয়ে ভারতের শাসন সরাসরি নিজেদের হাতে নিয়ে আসে। শুরু হয় ‘ব্রিটিশ রাজ’ এর যুগ।
কোম্পানির তুলনায় ব্রিটিশ রাজের শাসনের ধরন কিছুটা আলাদা ছিল। যেখানে কোম্পানির শাসন মানেই ছিল নিপীড়ন, সেখানে ব্রিটিশ রাজের অধীনের ভারত অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ছিল। যদিও দিন শেষে ব্রিটিশরাজ ছিল নিতান্তই একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, এর বেশি কিছু নয়, তবুও তাদের শিথিলতার ফলেই স্থানীয় জনগণ কিছুটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, জন্ম নিচ্ছিলো অনেক স্থানীয় উদ্যোক্তা। আর যেহেতু ভারতের মূল ব্যবসা ছিল রপ্তানির ব্যবসা, সব উদ্যোক্তা মূলত এই ব্যবসাই শুরু করছিলেন। এই সময়ে যারা উঠে এসেছিলেন, তাদের মধ্যেই একজনের নাম জামসেদজি টাটা।
জামসেদজি টাটা ছিলেন মুম্বাইয়ের এক রপ্তানি ব্যবসায়ীর ছেলে। তিনি পড়াশোনা শেষ করেছিলেন ১৮৫৮ সালে, অর্থাৎ ব্রিটিশরাজের শাসনের একদম শুরুতে। যখন তিনি দেখলেন তার বাবার ব্যবসা এখন বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে, তিনি হংকংয়ে চলে গেলেন সেখানে তার বাবার ব্যবসাকে ছড়িয়ে দিতে। আর হংকংয়ে গিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন, টাটার এই রপ্তানি ব্যবসার বিশ্বময় চাহিদা আছে।
পরের দশকে তিনি তার বাবার ব্যবসাকে ছড়িয়ে দিতে ঘুরলেন জাপান, চীন এবং গ্রেট ব্রিটেন। এই ব্যবসায়িক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার ফলে তার ব্যবসায়িক জ্ঞান তার বাবাকে বেশ ভালোভাবেই ছাড়িয়ে গেল। ১৮৬৮ সালে তিনি নিজেই স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন তার নিজের রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, আর সেখান থেকে আসা আয় দিয়েই তিনি কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠা করলেন দুটি টেক্সটাইল মিল।
জামসেদজির ব্যবসার দর্শন ছিল একটাই, বিশ্বজুড়ে তিনি ব্যবসার মাঝে ভালো ভালো চর্চা খুঁজে বেড়াবেন এবং সেগুলো লুফে নিয়ে ভারতে প্রয়োগ করবেন। তিনি তার টেক্সটাইল মিলগুলোতে এমন এমন রীতির শুরু করেছিলেন, যা ছিল গোটা ভারতের কাছেই অজানা, যেমন পেনশন, বা অসুস্থদের জন্য আলাদা সুবিধা ইত্যাদি। তবে শুধু এগুলো করেই তিনি থেমে ছিলেন না। তিনি ইউরোপে গিয়ে দেখেছিলেন, সেখানে শিল্প বিপ্লব কীভাবে মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তিনি চাইলেন, ভারতেও তিনি একটি শিল্প বিপ্লবের জন্ম দেবেন, ব্রিটিশদের অধীনের শিল্প বিপ্লব নয়, ভারতের নিজস্ব শিল্প বিপ্লব।
১৯০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন একটি স্টিল প্রোডাকশন প্ল্যান্ট, যেটি ছিল অনেকটাই তার দেখা জার্মানির প্ল্যান্টগুলোর আদলে তৈরি। তিনি নায়াগ্রা ফলস পাওয়ার প্ল্যান্টও দেখেছিলেন, সেটার দেখাদেখি তিনি ১৯০৩ সালে একটি হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তবে সেটা সফল হওয়ার আগেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
জামসেদজি ট্যুরিজমের সত্যিকারের ক্ষমতা বুঝতে পেরেছিলেন ব্যবসা করতে গিয়ে এবং সে কারণে তার স্বপ্ন ছিল বিশ্ব জুড়ে একটি হোটেল চেইন তৈরি করা। সে স্বপ্নেরই ফল হিসেবে ভারত পেয়েছে তাজ মহল প্যালেস হোটেল, যেটি কি না এখনও ভারতের অন্যতম হোটেল।
জামসেদজি ব্যবসায়ী হলেও তার ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য সবসময়ই ছিল মানুষের উপকারে আসা। তিনি শিক্ষাকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন যে, তিনি তার সম্পদ থেকে জমি এবং দালান দান করে দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে তার অনেক পদক্ষেপই সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ হতে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। ১৯০৪ সালে একটি ব্যবসায়িক সফরে জার্মানি গিয়ে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ততদিনে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া টাটা গ্রুপ তখন যায় জামসেদজির দুই পুত্রের হাতে।
“বর্তমান প্রজন্মের কোনো ভারতীয়ই তাদের শিল্প ও বাণিজ্যের জন্য এতটা করেননি, যতটা জামসেদজি টাটা করেছেন।”
– জামসেদজি টাটার মৃত্যুর পর ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন
দ্বিতীয় প্রজন্ম: জেআরডি টাটা
জামসেদজির দুই পুত্র তাদের বাবার এতদিনের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে পড়তে দেননি, বরং আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাদের হাত ধরে ভারতের প্রথম সিমেন্ট প্ল্যান্টের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১২ সালে, আর প্রথম ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ১৯১৯ সালে।
টাটার নেতৃত্ব এরপর পরিবর্তন হয় ১৯৩৮ সালে, ততদিনে টাটা সন্স বিস্তৃত হয়ে হয়েছে ১৪টি কোম্পানির সম্মেলন। তবে এবার টাটার নেতৃত্ব জামসেদজির নাতিদের কাছে না গিয়ে গেল তাদেরই দূরসম্পর্কের ভাই জাহাঙ্গীর টাটার কাছে। জাহাঙ্গীর টাটা (যিনি জেআরডি টাটা নামেই বেশি পরিচিত) কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ১৯২৫ সাল থেকেই, এবং শুধুমাত্র ব্যবসায়ী ছাড়াও তার আরো পরিচয় ছিল।
জেআরডি টাটার জন্ম ফ্রান্সে, ১৯০৪ সালে। তার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার- সবকিছুই ছিল যেন বিশ্বব্যাপী। তিনি পড়াশোনা করেছেন লন্ডন, জাপান, ফ্রান্স এবং ভারতে। তিনি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতেও ছিলেন এক বছর। এরপর ১৯২৩ সালে জেআরডির মায়ের মৃত্যুর পর তাদের পরিবার স্থায়ীভাবে ভারতে চলে আসে। জেআরডি ১৯২৯ সালে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে ভারতে নাগরিক হন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ পাইলট, সে বছরই তিনি ভারতের প্রথম পাইলট লাইসেন্স অর্জন করেন। ভারতের ইতিহাসের প্রথম পাইলট ছিলেন এই মানুষটিই।
টাটায় যুক্ত হওয়ার পর জেআরডির প্রথম লক্ষ্যই থাকে একটি এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠা করা এবং ১৯৩২ সালে তিনি তা সম্ভব করে ছাড়েন। প্রতিষ্ঠা হয় ‘টাটা এয়ার সার্ভিস।’ জেআরডির এই প্রজেক্ট অনেক সফল হয়, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এয়ার সার্ভিস ব্রিটিশদের সাহায্য করতে সমর্থ হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়াটা ভারতের জন্য খুবই ইতিবাচক হলেও ব্যবসায়িক দিক থেকে টাটা বেশ ক্ষতিরই সম্মুখীন হয় তখন। যেমন- ভারত স্বাধীন হবার পর তৎকালীন সরকার টাটার এয়ার সার্ভিসকেই জাতীয় এয়ার সার্ভিস এয়ার ইন্ডিয়ায় পরিণত করে, ফলে ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন হয় টাটা।
জেআরডি ‘টাটা মোটর’ এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৪৫ সালে, যে কোম্পানির জন্যই আমরা এখন টাটাকে সবচেয়ে বেশি চিনি। তিনি টাটার নেতৃত্বে ছিলেন ৫২ বছর। এই পুরোটা সময়ে তিনির টাটার অধীনের কোম্পানির সংখ্যা ১৪ থেকে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ৯৫-এ। কিন্তু ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন সমাজতন্ত্র ঘেঁষা আইনের সামনে এরকম একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের লাভের সাথে টিকে থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। জেআরডি খেয়াল করেন, তার এতগুলো কোম্পানির মধ্যে অনেক কোম্পানিই ভেঙে পড়ার পথে। তখন এমন ভগ্নপ্রায় একটি কোম্পানিকে ঠিক করার দায়িত্ব বর্তায় টাটা গ্রুপের নতুন সংযোজন রতন টাটার হাতে। এই তরুণের প্রপিতামহ আবার জামসেদজি টাটা স্বয়ং।
তৃতীয় প্রজন্ম: রতন টাটা
টাটার একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ছিল নেলকো, যা কি না ছিল পঞ্চাশের দশকে ভারতের সবচেয়ে বড় রেডিও তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারই বিশ বছর পর সেই কোম্পানি প্রায় মৃত্যুর মুখে পতিত হতে নিলো, মার্কেট শেয়ার নেমে গেল মাত্র ৩ পার্সেন্টে। এ অবস্থায় রতন টাটাকে বলা হলো এ প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে তুলতে। রতন তখন একটু গণ্ডির বাইরে চিন্তা করলেন। তিনি সবসময় ভাবতেন ভবিষ্যতকে কেন্দ্র করে। তিনি জানতেন রেডিও দিন দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে। তখন নেলকোতে তিনি রেডিওর পাশাপাশি অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর পণ্যও তৈরি করতে শুরু করলেন। নেলকো ঘুরে দাঁড়ালো, এই সাফল্যই ১৯৯১ সালে রতন টাটাকে এনে দিল টাটা গ্রুপের নেতৃত্ব।
রতন টাটা এমন একটি সময়ে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হলেন, যেসময় সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ছে পৃথিবীতে, চারদিকে পুঁজিবাদের জয়জয়কার। কিন্তু দেখা গেল, জেআরডি সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সামনে টাটাকে টিকিয়ে রাখতে টাটাকে অনেক বিকেন্দ্রীভূত করে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপর মূল টাটা গ্রুপের কর্তৃত্ব কম ছিল। রতন টাটা এসে মূল প্রতিষ্ঠানের ২০ পার্সেন্ট শেয়ার বিক্রি করে সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে ফেললেন বেশি করে, বেশি করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেন সবকিছু। তবুও তিনি দেখলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের সামনে তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন তিনি প্রতিযোগীদেরকেই কিনে টাটার অংশ বানিয়ে ফেলতে শুরু করলেন। যেমন- ২০০০ সালে ‘টাটা টি’ কিনে নিলো ব্রিটেনের টেটলি কোম্পানিকে। ইউরোপের স্টিল কোম্পানি কোরাস চলে এলো টাটা স্টিলের অধীনে ২০০৭ সালে, পরের বছর জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার হয়ে গেল টাটা মোটর্সের। এই ক্রয়গুলো করতে গিয়ে টাটা গ্রুপের প্রথমে একটু অর্থ খরচ করতে হয় ঠিকই, কিন্তু ক্রয়ের পর যে বিরাট মার্কেট শেয়ার তারা পায়, তাতে অচিরেই এ অর্থ পুষে যায়।
এভাবে এখন টাটা ভারতীয় কোম্পানি হলেও তাদের আয় হয় সারা বিশ্ব থেকে। পুরো টয়োটা, কোকাকোলা, ফেসবুক, মাইক্রোসফট এবং গুগলের কর্মচারীর সংখ্যা যোগ করলেও তাদের কর্মচারীর সংখ্যার সমান হবে না। যোগাযোগ, পরিবহন, খাদ্য, বিনোদন, শিক্ষা- সবক্ষেত্রেই রয়েছে তাদের সমান পদচারণা। এবং এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল কিছু মানুষ হাল না ছেড়ে সাহসী এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলেই। তাই টাটার ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্ত নেবার এবং হাল না ছেড়ে আরো শক্ত করে ধরার। এই শিক্ষা ক্যারিয়ার কিংবা ব্যক্তিজীবন, উভয়ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।