আমাদের সমাজে প্রতিভাবানদের নিয়ে বেশ কিছু কথা প্রচলিত আছে। এই যেমন, “ভালো ছাত্ররা ইতিহাস পড়ে, আর খারাপ ছাত্ররা ইতিহাস গড়ে।” এছাড়াও মনে করা হয়, সংকটকালে সেই ‘ব্যাকবেঞ্চার’রা-ই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়! অন্তত ফ্রান্সের ইতিহাস সেটিই বলে। যে কারণে সে দেশের বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ হচ্ছে-
ফ্রান্স ওয়াজ সেভড্ বাই হার ব্যাকবেঞ্চার্স।
প্রতিভাবানরা দেশের বিদ্যমান সামাজিক অবকাঠামোয় প্রায় সময়ই তাদের প্রতিভা বিকাশের রাস্তা খুঁজে পায় না। তাই তাদের প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা থাকে।
আর সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি যাদের শ্রদ্ধা বা আস্থা নেই, সমাজের অধিকাংশই তাদের ভালো চোখে দেখে না। তাদেরকে ‘দুর্বৃত্ত’, ‘দুষ্কৃতকারী’ ইত্যাদি নেতিবাচক আখ্যা দেওয়া হয়।
দেশের বিপদ ঘনিয়ে আসার পরও অনেক সময় বিদ্যমান আইনের কারণে দেশকে সাহায্য করার সুযোগ পাওয়া যায় না। তখন কায়দা করে আইন ভেঙে ফেলাটাই অনেকে শ্রেয় মনে করেন। আইনেরও তো ফাঁকফোকর থাকে!
এরকম পরিস্থিতিতে আইন ভেঙে দেশকে সাহায্য করা ব্যক্তিটি অপরাধী কিনা– সে তর্কে যাওয়ার চেয়ে দেশের কথা চিন্তা করাই হয়ত বেশি জরুরি। আর ইতিহাস তো রচিতই হয়- যারা শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসে, তাদের দ্বারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করল। সরকার নির্ধারন করে দিয়েছিল, সতের বছর বয়সীরা নিশ্চিন্তে যোগ দিতে পারবে। আর ষোল বছর বয়সীরা অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে যোগ দিতে পারবে। এর চেয়ে কম বয়সী কাউকে নেওয়া আইনগতভাবে বৈধ ছিল না।
সরকারের বয়সনীতির কারণে বারো বছর বয়সী কিশোর ক্যালভিন গ্রাহামের ওপর ভর করল রাজ্যের দুশ্চিন্তা। ছোটবেলা থেকে তার প্রবল ইচ্ছা, আমেরিকান সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের হয়ে কাজ করবে। কিন্তু তার যে বয়স, তাতে তো সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার কোনো উপায়ই নেই!
মার্কিন সামরিক বাহিনী নিয়ে ক্যালভিনের ছোটবেলা থেকেই ফ্যান্টাসি ছিল। এগারো বছর বয়স থেকেই ক্যালভিন দাঁড়ি কামাত, যাতে তাকে একটু তার প্রকৃত বয়সের চাইতে আরেকটু বয়স্ক দেখায়। আর তারও আগে থেকেই, সে তার ভাইয়ের পোশাক পরে ভারিক্কি গলায় কথা বলার চর্চা শুরু করে দিয়েছিল।
ছোট থেকে লালন করে স্বপ্নটাকে এত সহজে মাটি হতে দিতে পারে না ক্যালভিন! তার মনে হলো, তার মায়ের নকল স্বাক্ষর ও একটি স্থানীয় হোটেল থেকে চুরি করা নোটারি স্ট্যাম্প কাজে দিতে পারে। কিন্তু এগুলো তার মূল দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি।
তার মূল মাথাব্যথার বিষয় ছিল একজন ডেন্টিস্ট, যিনি নিশ্চিতভাবেই লাইনে দাঁড়ানো নৌবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহীদের দাঁত দেখে তাদের প্রকৃত বয়স বের করে ফেলবেন। আর আসল বয়স ফাঁস হয়ে গেলে তার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার সমস্ত চেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
নৌবাহিনীর নিয়োগের জন্য যখন ইচ্ছুকদের লাইনে দাঁড়াতে বলা হলো, তখন সে ইচ্ছা করেই তের-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলেদের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। যাতে বুক উঁচিয়ে বলতে পারে, “এই লাইনে তের-চৌদ্দ বছর বয়সীদের ভিড়ে আমি একাই সতের বছর বয়সী তরুণ।”
ডেন্টিস্টের সামনে যখন সে আসলো, তখন তার প্রকৃত বয়স বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু ক্যালভিন নাছোড়বান্দা। সে বারবার তার বয়স সতের বলে ডেন্টিস্টের কাছে দাবি করতে লাগল। এক পর্যায়ে তার সাথে ডেন্টিস্টের তর্ক বেঁধে গেল। সে দৃঢ় গলায় বললো,
আগের বাচ্চাদের বয়স নিয়ে আপনারা কোনো ঝামেলা করলেন না, আমার সাথেই কেন করতে হবে?
বয়স্ক ডেন্টিস্ট কিশোর ক্যালভিনের সাথে সংঘাতে জড়াতে কোনোভাবেই আগ্রহী ছিলেন না। তাই শেষমেষ তাকে নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হলো।
ক্যালভিন গ্রাহামের জন্ম ১৯৩০ সালে, আমেরিকার ডালাসে। আর দশজনের মতো আনন্দময় শৈশব তার ছিল না। অল্প বয়সেই সে তার বাবাকে হারায়। তার বাবার মৃত্যুর কিছু দিন পরেই তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করে। তার সৎ পিতা সে ও তার অন্যান্য ভাই-বোনদের প্রতি সদয় ছিল না।
মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর সপরিবারে টেক্সাসে চলে আসে ক্যালভিন। ভর্তি হয় স্থানীয় একটি স্কুলে। কিন্তু স্কুল তাকে টানতো না। একদিকে তার সৎ বাবার অত্যাচারী মানসিকতা, অপরদিকে বিরক্তিকর স্কুল– গ্রাহামকে সেই ছোট বয়সেই বেশ বড় রকমের মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
ওদিকে ট্রেনিং শুরু হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছিল। একদিন সে তার মাকে বললো, হাওয়া বদলের জন্য সে আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে যাচ্ছে। বাহানা মঞ্জুর হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যালভিন।
নৌবাহিনীর মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য চলে আসে সান ডিয়েগোতে। বারো বছর চার মাস বয়সী এক কিশোর মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেয়। তৈরি হয়ে যায় ইতিহাস। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর এত কম বয়সী কেউ মার্কিন সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়নি।
ক্যালভিনের বয়স যে সরকার অনুমোদিত বয়সের চেয়ে অনেক কম, এটি তার প্রশিক্ষক ভালো করেই টের পেয়েছিলেন। শুধু সে একাই নয়, বয়স লুকিয়ে আরও বেশ কিছু কিশোর নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিতে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। প্রশিক্ষক শাস্তিস্বরূপ প্রায়ই তাদের অতিরিক্ত দৌড়াতে বাধ্য করতেন। আর মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বোঝা তাদের পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হতো শাস্তির অংশ হিসেবে।
সান ডিয়েগোতে মৌলিক প্রশিক্ষণের পর তাকে ইউএসএস সাউথ ডাকোটা জাহাজে গান লোডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঘটনার পরম্পরায় এই জাহাজটির ডাকনাম হয়ে যায় ব্যাটলশিপ এক্স। আর জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্যাপ্টেন থমাস গ্যাচ। মার্কিন জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুসজ্জিত ছিল এই জাহাজটি। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন,
ইউএসএস ডাকোটার মতো আর কোনো মার্কিন যুদ্ধজাহাজ সাগরে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এত উদগ্রীব ছিল না।
পার্ল হারবার আক্রমণকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে যু্দ্ধ শুরু হয়ে যায়। মার্কিন নৌবাহিনী সাথেও জাপানের নৌযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ক্যালভিনের আগমনের কয়েক মাস পরে ইউএসএস ডাকোটা ফিলাডেলফিয়া থেকে যুদ্ধের জন্য রওনা দেয়।
গুয়াডালক্যানালে জাপানের সাথে আমেরিকার তীব্র নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। গুয়াডালক্যানালের যুদ্ধে আটটি জাপানি ডেস্ট্রয়ার মার্কিন ইউএসএস ডাকোটাকে ঘিরে ধরে এবং ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
মোট ৪২টি শত্রুপক্ষের গুরুতর আঘাত সহ্য করতে হয় জাহাজটিকে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় জাহাজটি। এই জাহাজের পাশাপাশি আরেকটি বিখ্যাত মার্কিন জাহাজ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ গুয়াডালক্যানালের যুদ্ধে অংশ নেয়।
শত্রুদের বোমার একটি অংশ ক্যালভিনের মুখে আঘাত করে। তার চোয়াল ও মুখ দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়। কিন্তু সে হাল ছাড়ার পাত্র ছিল না। বারো বছর বয়সে যে কিশোর মার্কিন সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সাহস দেখায়, সে আবার এত সহজে হাল ছাড়ে নাকি?
বাকি সঙ্গীদের সে টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। সে নিজেও বেশ আহত হয়েছিল, তারপরও সে সঙ্গীদের সাথে সারা রাত বসে ছিল, তাদের উজ্জীবিত করেছিল বারবার।
মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও ইউএসএস ডাকোটার গানম্যানরা গুলি ছোঁড়া অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি বোম্বাররাও তাদের অপর্যাপ্ত গোলাবারুদ দিয়ে দারুণ লড়াই করেছিলেন। নেভিইয়ার্ডে ফিরে আসার পর ইউএসএস ডাকোটার গানম্যানদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। খুব দ্রুত গুলি ছোঁড়ার জন্য সবাই তাদের প্রশংসা করেছিল।
জাপানি ডেস্ট্রয়ারগুলো ইউএসএস ডাকোটার ওপর যে পরিমাণ আক্রমণ করেছিল, তাতে তারা নিশ্চিত ছিল যে জাহাজটি ডুবে গিয়েছে। তাই তারা জাহাজটিকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ইউএসএস ডাকোটা ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাগরে সলিল সমাধি রচনার হাত থেকে বেঁচে যায়। এরপর একদম নীরবে জাহাজটি ব্রুকলিন নেভিইয়ার্ডে মেরামতের জন্য ফিরে আসে।
গুয়াডালক্যানালের যুদ্ধে ইউএসএস ডাকোটার ক্যাপ্টেন থমাস গ্যাচ বেশ গুরুতর আহত হন। বাকি নাবিকদের তৎপরতায় কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
জাপানের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অসীম বীরত্ব দেখানোর ফলে ক্যালভিন গ্রাহাম সম্মানজনক ব্রোঞ্জ স্টার মেডেল লাভ করে৷ আর শারীরিক আঘাতের পরেও অবিচল থাকার কারণে তাকে ‘পার্পল হার্ট’ দেওয়া হয়। মাত্র তের বছর বয়সী একজন কিশোরের পক্ষে এসব প্রাপ্তি ছিল বিরল সম্মানের ব্যাপার।
গুয়াডালক্যানালের যুদ্ধের পর যখন ইউএসএস ডাকোটা মেরামত করা হচ্ছিল, তখন মিডিয়ায় ক্যালভিনকে নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। তার মা একটি ডকুমেন্টারিতে তাকে দেখে চমকে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন, আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার কথা বলে ক্যালভিন আসলে নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছে!
গ্রাহামের মা নৌবাহিনীর কাছে তার বয়স ফাঁস করে দেন। তার আসল বয়স জানার পর মার্কিন নৌবাহিনী তার প্রতি চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাকে টেক্সাসের কর্পাস ক্রিস্টি নামক জায়গায় বন্দী করা হয়।
তিন মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন মার্কিন নৌবাহিনী তাকে মুক্তি দিচ্ছিল না, তখন ক্যালভিনের বোন মিডিয়ার কাছে যাওয়ার হুমকি দেন। ক্যালভিনের বোনের ভাষ্যমতে, তারা একজন মিলিটারি ‘হিরো’কে আটকে রেখেছে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই!
তার বোনের হুমকির পর তাকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ব্রোঞ্জ স্টার মেডেল ও পার্পল হার্ট-সহ তার সমস্ত খেতাব ও অর্জন কেড়ে নেওয়া হয়।
নৌবাহিনীর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গ্রাহাম আবার স্কুলে ফিরে যায়। কিন্তু সেখানকার পড়াশোনার সাথে তাল মিলাতে না পেরে হয় ‘ড্রপ-আউট’। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে সে বিয়ে করে এবং এক সন্তানের বাবা হয়। হাউসটন শিপইয়ার্ডে সে ঢালাইকারীর কাজ পায়। কিন্তু বিয়ে কিংবা শিপইয়ার্ডের চাকরি– কোনোটাই আর শেষ পর্যন্ত টিকেনি। সতের বছর বয়সে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
বিবাহবিচ্ছেদের পর সে আবার নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় কোমর ভাঙবার পর নৌবাহিনীর চাকরিটাও আর টেকেনি। সব ছেড়ে দিয়ে শেষমেশ ম্যাগাজিন বিক্রির পেশায় নিয়োজিত হয় ক্যালভিন।
১৯৭৬ সালে সাবেক মার্কিন নৌ-ব্যক্ত্বিত্ব জিমি কার্টার যখন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসলেন, ক্যালভিন তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাওয়া সম্মানী ও খেতাবগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানায়। খুব বেশি আশাহত তাকে এবেলা হতে হয়নি। পার্পল হার্ট বাদে তার ব্রোঞ্জ স্টার মেডেল ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও তার চিকিৎসা-খরচের জন্য অর্থের আবেদনও মঞ্জুর করা হয়।
১৯৯২ সালে ক্যালভিন গ্রাহাম হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর দুই বছর পর তার অর্জিত ‘পার্পল হার্ট’ তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে তার জীবনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয় ‘Too young the hero’ নামের একটি চলচ্চিত্র।
নিয়ম ভাঙা দস্যি ছেলেরাই বারেবার ইতিহাসের অংশ হয়েছে। হয়েছেন ক্যালভিনও। তার জীবন, অন্তত তার প্রথম অধ্যায় আমাদের অস্ফুটস্বরে এটাই বারবার বলে অনুপ্রাণিত করে যায় যে, বয়স-বাস্তবতা ইত্যাদি প্রতিকূলতা আসলে কিছুই না, মানুষ আসলে তার স্বপ্নের সমান বড়, তার কল্জের সমান বড়!